নিজস্ব প্রতিবেদক

০৭ এপ্রিল, ২০১৯ ০১:২৬

সিলেটে এলো ‘বাতিঘর’

মা-বাবার সাথে বই কিনতে এসেছে ছোট ইয়ানা। মা বাবা তাকে নিয়ে গেলেন শিশু কর্নারে। ইয়ানা নিজে একটা একটা করে বই খুলে দেখছে। হঠাৎ ছোট একটা বই খুলেই ইয়ানা চেঁচিয়ে ওঠে ‘মাম্মি মাম্মি, এটা ডিম।’ বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছে আর বলছে, ‘এটা ইঁদুর, এটা বল, একটা কমলা।’ বইয়ের প্রতিটি পাতার উল্টানোর সাথে সাথে ইয়ানার চোখে মুখে খুশির ছটা।

শনিবার সন্ধ্যায় সিলেট নগরে নতুন চালু হওয়া বইয়ের দোকান বাতিঘর-এ গিয়ে দেখা মিলে এ দৃশ্যের।

সিলেটে নতুন হলেও বইপ্রেমীদের কাছে বাতিঘর পরিচিত নাম। ঢাকা ও চট্টগ্রামের পর এবার সিলেটেও যাত্রা শুরু করেছে সৃজনশীল বইয়ের এ প্রতিষ্ঠানটি। সিলেট নগরের পূর্ব জিন্দাবাজার এলাকার গোল্ডেন সিটি কমপ্লেক্সের দ্বিতীয় তলায় বিশাল জায়গাজুড়ে নিজেদের সিলেট শাখা চালু করেছে বাতিঘর। শুক্রবার (৫ এপ্রিল) থেকে পাঠকদের জন্য বাতিঘর উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় জানান বাতিঘর'র কর্মকর্তা লিংকন দাশ।

প্রথমদিন থেকেই পাঠকরা ভিড় করছে এই লাইব্রেরিতে। সৃজনশীল বইয়ের সংগ্রহশালার পাশাপাশি বাতিঘরের সাজসজ্জাও নজর কাড়ছে সিলেটের পাঠক দর্শনার্থীদের। সিলেটের দুটি ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার আদলে সাজানো হয়েছে বাতিঘরের সিলেট শাখা। সিলেট বাতিঘরে প্রবেশ করলেই দেখা যাবে সুরমা নদীর ওপর ব্রিটিশ আমলে নির্মিত ঐতিহ্যবাহী কিনব্রিজ আর নদীপাড়ে স্থাপিত আলী আমজদের ঘড়ি। শুধু তাই নয়, চায়ের দেশ সিলেটের বাতিঘরের দেয়ালে করা হয়েছে চা-বাগানের আদলে।

প্রতিষ্ঠানটির অভ্যন্তরীণ সজ্জা করেছেন শিল্পী শাহীনুর রহমান। আলোকসজ্জা করেছেন নাসিরুল হক খোকন ও জুনায়েদ ইউসুফ।

শুক্রবার অনানুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পর থেকেই বই কিনতে সিলেটের বইপ্রেমীরা ভিড় করছেন বাতিঘরে। শুধু ক্রেতা নয় এই প্রতিষ্ঠানের নান্দনিক সৌন্দর্য একনজর দেখতে ছবি তুলতেও আসছেন দর্শনার্থীরা।

ইয়ানার মা সিলেট ওমেন্স মেডিকেল কলেজের লেকচারার আমিরা বিনতে হোসেন শামা বলেন, ‘বাতিঘর শুধু বড়দের নয় বাচ্চাদেরও বই কেনার সুযোগ করে দিয়েছে। এ ধরনের একটি প্রতিষ্ঠান সিলেটে খুব দরকার ছিল। এই প্রতিষ্ঠানের অনেক সুনাম শুনেছি। আজ দেখার সুযোগ হলো। বাতিঘর সিলেটে শাখা করায় আমরা পাঠকরা খুব খুশি হয়েছি।’

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী রাফি আদনান তার বন্ধুদের নিয়ে বাতিঘরে এসেছেন বই কিনতে। তিনি বলেন, ‘বাতিঘরের কালেকশন অনেক ভাল। বই কিনতে এসে এখান থেকে কেউ খালি হাতে ফিরবেন না। আমি পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকেই আজ এসেছি। এর আগে চট্টগ্রামের বাতিঘর থেকেও বই কিনেছিলাম।’

তিনি বলেন, ‘বাতিঘরের আরেকটি বিশেষত্ব হলো তাদের প্রতিষ্ঠানের সাজসজ্জা। যে এলাকায় প্রতিষ্ঠান সেই এলাকার ঐতিহ্যকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠানের সাজানোর আইডিয়া অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। এই কনসেপ্টটা অনেক সুন্দর ও স্থানীয় ক্রেতাদের আকৃষ্ট করার জন্য সবচেয়ে ভালো মাধ্যম।’

নগরের শামিমাবাদ এলাকার বাসিন্দা সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার রিজু বলেন, সিলেটে সুন্দর পরিবেশে বড় পরিসরে বই কেনার মত প্রতিষ্ঠান নেই বললেই চলে। আমরা সাধারণত বইয়ের দোকানে গিয়ে বিক্রেতাকে বইয়ের নাম বলে বই কিনি। এভাবে পড়ে বই কেনার সুযোগ সিলেটের খুবই কম। এক্ষেত্রে বাতিঘরকে অনেক আকর্ষণীয় মনে হয়েছে আমার কাছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ক্রেতাদের জন্য খোলা থাকবে বাতিঘর। দেশি-বিদেশি লক্ষাধিক বইয়ের সংগ্রহ রয়েছে এখানে। বিভিন্ন বিষয়ে প্রায় ১০ হাজার লেখকের নানা ধরনের বই পাওয়া যাবে এই প্রতিষ্ঠানে। ইতিহাস, আত্মজীবনী, জীবনী, প্রবন্ধ, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা, শিল্পকলা, নাট্যতত্ত্ব, চলচ্চিত্র, ধর্ম, দর্শন, কথাসাহিত্য, অনুবাদ, কবিতা, শিশুসাহিত্য, বিজ্ঞান, রাজনীতি, গবেষণাসহ নানা ধরনের বিষয়ের বইয়ের সমাহার রয়েছে বাতিঘরে। সিলেটি ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি কর্নার, ক্যাফে কর্নারসহ বেশ কিছু কর্নার রয়েছে।

নির্বাচিত লেখক, শিশু–কিশোর কর্নার, প্রকাশনা সংস্থার কর্নারের পাশাপাশি এখানে সিলেটে ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি বিষয়ের উপর একটি কর্নার আছে। রয়েছে একটি ক্যাফে কর্নারও। শিগগিরই বাতিঘরের নামফলক বাংলার পাশাপাশি সিলেটের নাগরী লিপি দিয়েও লিখা হবে জানান এ প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টরা।

সিলেট বাতিঘরের দায়িত্বরত লিংকন দাশ বলেন, ‘যথেষ্ট উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে আসছেন সবাই। বই কিনছেন ছবি তুলছেন সমানতালে। বাতিঘরে এসে ক্রেতা, দর্শনার্থী সবারই উৎসাহ উদ্দীপনা লক্ষ করেছি এই দুইদিনে। আশা করছি বাতিঘরের সিলেটের যাত্রা ভাল হবে।’

বাতিঘরের স্বত্বাধিকারী দীপঙ্কর দাশ সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘পাঠকদের চাহিদা অনুযায়ী আমরা বাতিঘরের শাখা করি। সিলেটে বই পড়ার অনেক মানুষ আছেন। সিলেটের বেশ কয়েকজন মানুষ এখানে শাখা করার জন্য বলেন। এছাড়া আমি মনে করি দেশের প্রতিটি বিভাগীয় শহরে একটি মানসম্মত বইয়ের দোকান থাকা প্রয়োজন। তাই সিলেটে যাত্রা শুরু করেছে বাতিঘর।

তিনি বলেন, ‘বইয়ের দোকানের গৎবাঁধা নিয়মের বাইরে আমরা চিন্তা করি। আমরা চাই পাঠক বই পড়ে তার পছন্দমত বই কিনবেন। চা কফি খাবেন। বিভিন্ন বিষয়ের উপর আমাদের অনেক সংগ্রহ থাকে। নতুন বইয়ের পাশাপাশি পুরোনো ও দুষ্প্রাপ্য বই পাওয়া যাবে এখানে। নামীদামী লেখকের পাশাপাশি নতুন লেখদেরও বই থাকে। একজন পাঠকের বই কেনার আগে বই দেখে পড়ে নিজের চাহিদামত কেনার সুযোগ থাকে। শুধু তাই নয় পাঠকের চাহিদা অনুযায়ী আমরা বিদেশ থেকেও বই এনে দেই। বই বিপণনে নতুনত্ব এনে দেশজুড়ে পাঠকসমাজ গড়ে তোলাই আমাদের লক্ষ্য।’

আপনার মন্তব্য

আলোচিত