শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার, কলকাতা

২৩ আগস্ট, ২০১৫ ২০:৪৩

গণসঙ্গীতের গৌরাঙ্গ সাহা আর নেই

রবীন্দ্রনাথের একটা গানের লাইন ছিল, এল যখন সাড়াটি নাই/ গেল চলে জানালো তাই/ এমন করে আমারে হায় কে বা কাঁদায় সেজন ভিন্ন। কিছু কিছু মানুষ আছেন, তাঁরা যখন থাকেন তখন তাঁদের উপস্থিতি আমরা অনুভব করি না। চলে গেলে বুকের ভেতর বেজেই চলে শূন্যতার বিষাদসঙ্গীত।

তেমনই মানুষ ডা. গৌরাঙ্গ সাহা। কী তাঁর পরিচয়। ভারতের বামপন্থী সাংস্কৃতিক সংগঠন ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ শিলচর শাখার সভাপতি, বিশিষ্ট গণসঙ্গীত শিল্পী, শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রাক্তন পৌর প্রতিনিধি এবং একজন সহৃদয় সামাজিক মানুষ।

সঙ্গীতশিল্পী কথাটা লিখেই বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠল। আচ্ছা, শিল্পী মানে তো তিনি যিনি অনুষ্ঠানে অনুষ্ঠানে গান গেয়ে বেড়ান। এইমাত্র যে মানুষটার নামের শুরুতে শিল্পী কথাটা লিখেছি, তাঁকে তো কখনো কোনো অনুষ্ঠানে গান গাইতে শুনি নি। কেউ কি কখনো তাঁকে দেখেছে কোনো অনুষ্ঠানে গান গাইতে? না। খুব বেশি হলে কোরাস দলের শেষ সারিতে তাঁকে দেখা গেছে মাথা নেড়ে গান গাইছেন।

এতটাই পেছনে দাঁড়াতেন যে মাইকে তাঁর কন্ঠস্বর কোনো শ্রাব্য হয়েছে বলে মনে হয় না। অথচ তিনি এত এত গান জানতেন, এতটাই মিষ্টত্বে ভরপুর ছিল তাঁর কন্ঠস্বর যে তাঁকে শিল্পী না বললে যে আর কাউকেই শিল্পী বলা যাবে না। এটা কি তাঁর অপরাধ যে তাঁকে কেউ কখনো অনুষ্ঠানে গান গাইতে শোনে নি? একজন শিল্পীর যা জরুরি, অর্থাৎ গান জানা এবং একটি ভালো কন্ঠস্বর, এই দুইই তো তাঁর ছিল। তবে কেন তাঁকে কখনো অনুষ্ঠানে গাইতে শোনা যায় নি, তাঁর দায় তাঁর নিজের যতটা, তার চেয়ে বেশি কি তাঁর সমসময়ের বা পরবর্তী সময়ের তাঁর ঘনিষ্ঠ সুহৃদদের নয়?

ডা. গৌরাঙ্গ সাহা জন্মেছিলেন ১৯২৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর। চলে গেলেন আজ দুপুরে। দীর্ঘ সময় ধরে তাঁর কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে আছে নানা ক্ষেত্রে। শহর শিলচরের তিনি যেমন একজন প্রাজ্ঞ হোমিওপ্যাথ, ঠিক তেমনি বামপন্থী রাজনীতির এক একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে নাগরিক রাজনীতির অঙ্গনেও তাঁর স্পষ্ট স্বাক্ষর রেখে গেছেন।

মূলত চিকিৎসক হিসেবে তাঁর সুপরিচিতি তাঁকে এই শিলচর শহরের মত বামপন্থীদের দুর্বল সাংগঠনিক পরিসরেও পুরসভায় জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। কিন্তু এগুলো ছাড়িয়ে তাঁর আসল পরিচয় ছিল তিনি ছিলেন গানের মানুষ। সব ধরনের গানের সমঝদার হলেও তাঁর গানের ক্ষেত্র ছিল গণসঙ্গীত।

চল্লিশের দশকের শেষে কলকাতায় হোমিওপ্যাথি নিয়ে পড়তে গিয়ে সেখানকার কমিউনিস্টপন্থী গণসঙ্গীতের দলের সাথে তাঁর যুক্ত হওয়া। সেখান থেকেই তাঁর গানের বিপুল জন্ম। গরমের ছুটি কিংবা পুজোর ছুটিতে শিলচরে বাড়িতে এলেই গণনাট্য কর্মীদের সামনে উজাড় করে দিতেন তাাঁর গানের ঝাঁপি। এ হেন গানের যাঁর ভান্ডার তিনি কখনোই নিজে সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে গান গাইতেন না। কিন্তু অসম্ভব সুরেলা ও মিষ্টত্বে ভরপুর ছিল তাঁর কন্ঠ।

গত শতকের আটের দশকে ছাত্র রাজনীতির মধ্য দিয়ে আমার বাম রাজনীতির সংস্পর্শে আসা। গান গাইতাম ছোটো বেলা থেকেই। যখন ছাত্র রাজনীতি করছি সেই সময়ে রেডিওতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের শিল্পী হিসেবে আমার নথিভুক্তি হয়ে গেছে। ফলেই ছাত্র সংগঠনের নানা সভায় বলা হত গান গাইতে। সে সময়ে শিলচরে গণসঙ্গীত চর্চার ক্ষেত্রে একটা ভাঁটা চলছিল। গণনাট্য ভেঙে গেছে। আর কোনো গণসঙ্গীতের দলও নেই।

মে দিবসের জনসভায় দেখতাম গৌরাঙ্গদা কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে উদ্বোধনী সঙ্গীত গাইছেন। বলা বাহুল্য, তিনি নিজে সবসময়ই পেছনের সারিতে। কিছুদিন পর ‘দিশারী’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের জন্ম হল। সেই সংগঠনের মূল সংগঠক হিসেবে অনন্ত দেব, অনুরূপা বিশ্বাস, গৌরাঙ্গ সাহা, পলু বিশ্বাস ইত্যাদি পুরোনো সময়ের গণনাট্য কর্মীরা।

নতুন সময়ের শিল্পীদের নিয়ে তৈরি হল গানের স্কোয়াড। কিছু নতুন গান তৈরি হল পুরোনো সময়ের গানের আদলে। আর কিছু পুরোনো গানকে তোলা হল কন্ঠে। এই গান তুলে দেওয়ার দায়িত্ব কাঁধে নিলেন গৌরাঙ্গদা। সেই থেকেই তাঁর সাথে আমার অন্তরঙ্গ সম্পর্ক।

গৌরাঙ্গদা যেহেতু সকাল সন্ধ্যা চেম্বারে ব্যস্ত থাকতেন, তাই দুপুরবেলা বাড়িতে ভাত খেতে যখন আসতেন, সে সময়েই তাঁর কাছে গান তুলতে যেতাম আমি। এভাবেই চল্লিশের কালজয়ী গান সব গলায় তুলেছি তাঁর কাছ থেকে। সলিল চৌধুরীর ‘ও মোদের দেশবাসীরে’ ‘ও আয়রে ও রামরহিমের বাছা’ ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা’ পরেশ ধরের ‘ও ভাইরে বন্ধু বলতে কী পারো’ সাধন দাশগুপ্তের ‘চাষী দে তোর লাল সেলাম’ বিজন ভট্টাচার্যের ‘ও হুসেন ভাই দামুকদিয়ার চাচা’ হিন্দি উর্দু গণসঙ্গীত ‘অব মচল উঠা হ্যায় দরিয়া’ ‘ইসবার লড়াই লানেওয়ালে’ ‘হো সাবধান আয়া তুফান’ ইত্যাদি অসংখ্য গান শিখেছি তাঁর কাছে। পরবর্তী সময়ে শিলচরে আবার পুনর্গঠন করা হল গণনাট্যের। সমস্ত পুরোনো গণনাট্যের শিল্পী কর্মীদের সাথে যুক্ত হলাম আমরা। দুই প্রজন্মের গণশিল্পীদের অংশগ্রহণে হৈ হৈ করে চলল গণনাট্যের কার্যক্রম।

একবার ঠিক হল ‘গণনাট্য- একাল ও সেকাল’ শীর্ষক একটি অনুষ্ঠান হবে। পুরোনো সব শিল্পীদের ডাকা হল। মহড়া চলছে বিরাট উৎসাহে। বয়সের ভারে বৃদ্ধ শিল্পীরাও গানে নাচে অংশ নেবেন। আমাকেও যেতেই হবে মহড়ায়। হারমোনিয়াম ধরার জন্যে। ঘরে প্রবীণদের ভিড়। মুকুন্দকাকু, গৌরাঙ্গদা, বিজুদা, পল্টুদা, জিসুদা, মিলনদা, নীলুদা, পলুদা, ফণীদা। পল্টুদার কাঠের দোতলায় আসর সরগরম।

বন্ধুরা ভুলেই যাচ্ছেন, পাশে তাঁদের সন্তানসম একজন বসে আছেন। হাসি ঠাট্টা রসিকতায় যেন ফিরে গেছেন তাঁদের যৌবনে। দেখা গেল মুকুন্দকাকুর সব গানের বাণী মুখস্থ। গৌরাঙ্গদার সুর স্মৃতিতে জীবন্ত। ‘রাজমিস্ত্রির গান’ তাঁদের পুরনো প্রযোজনা। ফণীদা নাচবেন। সঙ্গে গান গাইবেন পল্টুদা ও গৌরাঙ্গদা। আমি হারমোনিয়ামে, তবলায় কালিকাপ্রসাদ। রিহার্সেলে পল্টুদা গৌরাঙ্গদা দুজনে গলা মিলিয়ে গান গাইলেও স্টেজে উঠে গৌরাঙ্গদা শুধু মাথা নেড়েই গেলেন। সামনে মাইক রয়ে গেল অব্যবহৃত। পল্টুদা একাই গেয়ে গেলেন।

অনুষ্ঠানের পর আমি গৌরাঙ্গদাকে বললাম, এ কী করলেন। আপনি গলা ছাড়লেনই না কেন? এত সুন্দর করে দুজনকে দুটো মাইক দিলাম। উনি আমাকে উল্টে বুঝিয়ে দিলেন, আরে পল্টুকে দিয়ে গানটা গাইয়ে নিলাম। এটাই তো অ্যাচিভমেন্ট। আমি হতবাক! এমন মানুষই ছিলেন। নিজের ব্যক্তিগত অংশগ্রহণটা কখনোই তাঁর কাছে বড়ো বিষয় ছিল না। সবসময়েই দেখতেন সামগ্রিকভাবে।

আজ দুপুর একটায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন গৌরাঙ্গ সাহা। শিলচর থেকে খবর এসেছে শেষ যাত্রায় লোকের ঢল নেমেছে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি কাছাড় জেলা কার্যালয়, শিলচর পৌরসভা হয়ে তাঁর মরদেহ রক্তপতাকায় আচ্ছাদিত হয়ে শ্মশানঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। গণনাট্যের কর্মীরা আন্তর্জাতিক সঙ্গীতের পাশাপাশি রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে গেয়ে তাঁকে অন্তিম যাত্রায় নিয়ে গেছেন। সারা শহরে নেমে এসেছে শোকের ছায়া।

বিজ্ঞান বলে কোনো শূন্যতাই স্থায়ী হয় না। কিন্তু গৌরাঙ্গদার মৃত্যু আমার ভেতরে যে শূন্যতার সৃষ্টি করেছে, কোনো বিজ্ঞান দিয়েই তা পূরণের কোনো সম্ভাবনা আমি দেখছি না।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত