নিজস্ব প্রতিবেদক

১৪ নভেম্বর, ২০১৯ ২৩:৪৪

চা বাগানে ঊষা’র আলো

সিলেটের লাক্কাতুরা চা বাগানের ভেতরের একটি ভাঙাচোরা স্কুল। এই স্কুলের ভেতরে এক কক্ষে শিশু-কিশোরদের সংগীতের প্রশিক্ষণ চলছে। আরেক কক্ষে চারুকলার। যারা প্রশিক্ষণ নিচ্ছে তারা সকলেই চা বাগানের শিশু। বাবা-মা বাগানে কাজ করেন। যাদের দৈনিক মজুরি মাত্র ৮৫ টাকা। বাবা-মা’র এই আয়ে দু’বেলা খাবারই জুটে না পরিবারের। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই তাই বিলাসিতা এই শিশুদের কাছে। আর সংগীত-চিত্রকলার শিক্ষা?- সে তো মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওই ‘ভদ্রপল্লি’র বিষয়-আশয়। ‘এইখানে তাহাকে খুঁজিয়া পাওয়া’ দুস্কর।

তবু ‘এইখানে’ই সংগীত আর চিত্রকলার প্রশিক্ষণ নিচ্ছে চা বাগানের শিশুরা। সুবিধাবঞ্চিত এসব শিশুদের জন্য এই ব্যবস্থা করে দিয়েছে ‘ঊষা’ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন।

কেবল সংগীত আর চারুকলা নয়, চা বাগানের শিশুদের আবৃত্তি, নৃত্যসহ নানা সৃজনশীল বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে ঊষা। তাও একেবারে বিনামূল্যে। দেওয়া হয় শরীর চর্চার প্রশিক্ষণও। এছাড়া কিশোরীদের বয়ঃসন্ধীকালীন নানা পরামর্শও দিয়ে থাকে ঊষা। আর নিয়মিত বিরতিতে এই শিশু-কিশোরদের জন্য ঊষা আয়োজন করে মেডিকেল ক্যাম্পের। বই পড়ায় উৎসাহী করে তুলতে বাগানের শিশুদের পাঠ্যবইয়ের বাইরের বিভিন্ন সৃজনশীল ও মননশীল বইও বিনামূল্যে প্রদান করে ঊষা। প্রশিক্ষণ ক্লাস শেষে প্রশিক্ষণার্থী শিশুদের বিনামূল্যে খাবারও দেওয়া হয়। মাঝেমাঝে দেখানো হয় দেশ-বিদেশের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র।

বাংলাদেশে ১৬২টি চা বাগান রয়েছে। এরমধ্যে সিলেট বিভাগেই রয়েছে ১৩৮টি। আর চা জনগোষ্ঠী রয়েছে প্রায় ৭ লাখ। যৎসামান্য মজুরির কারণে দেশের সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর শীর্ষেই রয়েছে চা শ্রমিকেরা। জীবনমানের সকল সূচকেই পিছিয়ে রয়েছেন বাগানের বাসিন্দারা।

ফলে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এখানকার শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশ। এই সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সুস্থ ও সৃজনশীল হিসেবে গড়ে তোলা এবং প্রতিভা বিকাশ কাজ করছে ঊষা। ব্যতিক্রমী এই উদ্যোগের কারণে ইতোমধ্যে প্রশংসা কুড়িয়েছে স্বেচ্ছাসেবী এই সংগঠনটি।

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন সিলেট ভ্যালির সভাপতি রাজু গোয়ালা ঊষা’র কার্যক্রমের প্রশংসা করে বলেন, বাগানের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য নতুন আলো নিয়ে এসেছে এই সংগঠনটি। আমাদের শিশুদেরও স্বপ্ন দেখাতে শেখাচ্ছে তারা।

‘বঞ্চিত শিশুদের প্লাটফর্ম’ এই স্লোগানে ২০১৭ সালে যাত্রা শুরু করে ঊষা। চা বাগান ছাড়াও সিলেট নগরীর সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়েও কাজ করে ঊষা। প্রায় দুইশ’ সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের বিভিন্ন ধরণের প্রশিক্ষণ প্রদান করছে সংগঠনটি। এরমধ্যে বড় অংশই চা বাগানের শিশু। এই মুহূর্তে সিলেট নগরীর পার্শ্ববর্তী মালনীছড়া ও লাক্কাতুরা চা বাগানের শিশুদের নিয়ে কাজ করছে ঊষা। পর্যায়ক্রমে কার্যক্রমের পরিধি আরও বৃদ্ধির কথা জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

ঊষার প্রধান উদ্যোক্তা নিগার সাদিয়া নামের এক তরুণী। একটি বেসরকারি সংস্থার কাজ করতেন তিনি। চাকরী ছেড়ে এখন সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়েই আছেন।

নিগার সাদিয়া বলেন, ঊষা হচ্ছে বঞ্চিত শিশুদের একটা প্ল্যাটফর্ম। তাদের মধ্যেও অনেক প্রতিভা রয়েছে। কিন্তু এগুলো বিকাশের সুযোগ পায় না। আমরা সেই সুযোগটুকু করে দিতে চাই। এখানকার শিশুদের সৃজনশীল হিসেবে গড়ে তুলতে চাই।

প্রথমে ফেসবুকে ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে টাকা সংগ্রহ শুরু হয়েছিলো ঊষার কার্যক্রম। তাদের কাজ দেখে অনেকে স্ব-উদ্যোগেই জড়িত হয়েছেন এতে। ঊষাকে আর্থিক সহায়তা করে থকেন তারা। বই দিয়ে সহায়তা করে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। আরও কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও ঊষার বিভিন্ন আয়োজনে সহযোগী হয়।

শারীরিক আর মানসিক সুস্থতার পাশাপাশি সুবিধাবঞ্চিত এসব শিশুদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার দিকেও নজর রাখে ঊষা। নিগার সাদিয়া বলেন, শিশুদের লেখাপড়া যাতে বন্ধ না হয়ে যায় সেদিকেও আমরা খেয়াল রাখি। বিভিন্ন সময় শিক্ষা উপকরণও দিয়ে থাকি।

তিনি বলেন, আমরা এখন থেকে প্রতি মাসে একটি দিনকে ‘হাইজিন ডে’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। হাইজেন ডে’তে ঊষার শিক্ষার্থী শিশুরা-কিশোররা তাদের শরীর ও বাসাবাড়ি পরিচ্ছন্ন করবে। কিশোরীরা তাদের শরীরের যত্ন নেবে।

ঊষা এই কার্যক্রমকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার স্বপ্ন নিগারের, যাতে আরও অধিক সংখ্যক শিশুর কাছে এই সেবা পৌঁছে দেওয়া যায়।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত