নিজস্ব প্রতিবেদক

০১ ডিসেম্বর, ২০১৯ ২৩:৫৪

বইয়ের বোঝা বইতে হয় না যে স্কুলের শিক্ষার্থীদের

ব্যাগ ভর্তি বইয়ের বোঝা বয়ে নিয়ে চলছে শিশু- এমন দৃশ্য দেখা যায় প্রায় সকল বিদ্যালয়ের সামনেই। চিরচেনা এই দৃশ্যের বিপরীত চিত্র দেখা গেলো সিলেট নগরীর ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয় স্টিমেইজ-এ। বইখাতা ছাড়াই এ স্কুলে প্রবেশ করছে শিক্ষার্থীরা। বই থাকে স্কুলের মধ্যেই। পড়া শেষে তা আর বাড়িতে বয়ে নিয়ে যেতে হয় না শিক্ষার্থীদের। ব্যতিক্রমী এমন নানা উদ্যোগের কারণে ইতোমধ্যে নজর কেড়েছে নতুন প্রতিষ্ঠিত এই বিদ্যাপীঠটি।

স্টিমেইজ-এর আরেকটি ব্যতিক্রমী উদ্যোগের কথা শুরুতেই উল্লেখ করা যেতে পারে। এই বিদ্যালয়ে তিনবেলা খাবার দেওয়া হয় শিক্ষার্থীদের। সকালে পাঠদান শুরুর আগেই দেওয়া হয় প্রাতঃকালীন নাস্তা। কয়েকটি ক্লাস হয়ে যাওয়ার পর দেওয়া হয় ‘লেট মর্নিং স্ন্যাকস’। আর দুপুরে সব শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণ করা হয় দুপুরের খাবার।

নগরীর হাউজিং এস্টেট এলাকায় ২০১৮ সালের জুলাইয়ে এই বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন মাহবুব সুন্নাহ নামের এক প্রবাসী।

ব্যাংকে টাকা ফেলে রাখেন আর অট্টালিকাসম বাড়ি তৈরির মতো অনুৎপাদনশীল খাতে টাকা ব্যয় করেন- এমন দুর্নাম আছে সিলেটের প্রবাসীদের। তবে আমেরিকা প্রবাসী সফটওয়্যার প্রকৌশলী মাহবুব সুন্নাহ তার ব্যতিক্রম। বিদেশে তিনি শিক্ষকতার সাথে জড়িত ছিলেন কিছুদিন। ভেতর থেকে দেখেছেন সেখানকার শিক্ষা কার্যক্রম। প্রবাসে অর্জিত নিজের অর্থ আর জ্ঞানের সমন্বয় ঘটিয়ে তিনি নিজেদের পৈতৃক ভিটায় গড়ে তুলেছেন একটি আধুনিক বিদ্যাপীঠ।

প্রাক কিন্ডারগার্টেন (প্রি-কে) শ্রেণি থেকে এ লেভেল পর্যন্ত শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয় এই স্কুলে। বর্তমানে বিভিন্ন শ্রেণিতে ৬৫ জন শিক্ষার্থী আছেন এখানে। আর শিক্ষক আছেন ১৮ জন। জানুয়ারি আর জুলাই এই সেমিস্টারে ভর্তি করা হয় শিক্ষার্থীদের।

এই স্কুলে দুই সন্তান পড়ে সিলেটের সমাজকর্মী আব্দুল করিম কিমের। তিনি বলেন, আমার মেয়েটা ছোট। সে আগে স্কুলে যেতে চাইতো না। এখানে ভর্তি হওয়ার পর স্কুলের প্রতি তার আগ্রহ বেড়েছে।  বই আনা-নেওয়ার ঝামেলা না থাকা, বন্ধুবান্ধবদের সাথে একসাথে খাওয়াদাওয়ার সুবিধাসহ এখানকার বিভিন্ন কার্যক্রম স্কুলের প্রতি তাকে আকৃষ্ট করেছে।

স্টিমেইজ স্কুলে গিয়ে দেখা যায়, স্কুলের শ্রেণিকক্ষগুলো সাজানো হয়েছে নান্দনিক সাজে। শ্রেণিকক্ষ ভর্তি বই আর খেলাধুলার সরঞ্জাম। পড়তে পড়তে শিশুরা ক্লান্ত হয়ে পড়লে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য ক্লাস রুমেই আছে বিছানা। আছে বিজ্ঞানাগার আর প্রযুক্তি ল্যাব। যাতে খেলাচ্ছলে নানা যন্ত্রপাতি ভাঙছে আর তৈরি করছে শিশুরা। ইংরেজি মাধ্যম হলেও গুরুত্ব সহকারে বাংলাও পড়ানো হয় এখানে। সাথে-সাথে শিক্ষার্থীদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া বাংলার ইতিহাস ঐতিহ্য আর ঐতিহাসিক চরিত্রদের সাথে। বিশেষ দিবসে শিক্ষার্থীদের নিয়ে যাওয়া হয় বিশেষ বিশেষ স্থানে।

গত ১৪ ডিসেম্বর যেমন সব শিক্ষার্থীদের শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. শামসুদ্দিন চৌধুরীর বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন স্টিমেইজ’র শিক্ষকরা। এই শহীদ বুদ্ধিজীবীর বাড়িতে নিয়েই শিক্ষার্থীদের শোনানো হয় দেশের জন্য প্রাণ দেওয়া বুদ্ধিজীবীদের গল্প।

স্কুলে গিয়ে দেখা যায়, করিডরে সারিবদ্ধভাবে রাখা মাটিভর্তি ছোট ছোট টব। শিক্ষকরা জানালেন, এই সপ্তাহেই প্রতিটি টবে একটি করে গাছ রোপণ করবে সকল শিক্ষার্থী। তার আগে গাছ লাগানোর উপকারিতা, গাছের পরিচর্যা সম্পর্কে তাদের বলবেন একজন বিশেষজ্ঞ। এরপর নিজেদের লাগানো গাছগুলো টবসহ শিক্ষার্থীদের দিয়ে দেওয়া হবে। তিন মাস পর পর গাছগুলোর সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে স্কুল কর্তৃপক্ষকে অবহিত করতে হবে।

স্টিমেইজ-এ প্রতি শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ভর্তি ফি হিসেবে নেওয়া হয় ২৭ হাজার টাকা। আর প্রি-কে থেকে থ্রি পর্যন্ত মাসিক বেতন ৩ হাজার টাকা এবং ফোর থেকে টুয়েলভ পর্যন্ত বেতন রাখা হয় ৫ হাজার টাকা।

স্কুলটির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মাহবুব সুন্নাহ বর্তমানে আমেরিকায় রয়েছেন। সেখান থেকে স্কুল প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দেশে থাকাকালীন আমি একটি আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখতাম। এখানকার স্কুলগুলোর শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে আমার কিছু অসন্তুষ্টি ছিলো। ২০০৫ সালে ইংল্যান্ডে গিয়ে আমি শিক্ষকতায় যোগ দেই। তখন দেশে একটি আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাব আরও বেশি করে উপলব্ধি করি। মূলত ২০০৭ সালে আমি দেশে স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেই। কিন্তু সেবছরই আমি আমেরিকা চলে যাওয়ায় এই উদ্যোগ কিছুটা পিছিয়ে যায়।

মাহবুব সুন্নাহ বলেন, আমেরিকা-ইংল্যান্ডে গিয়ে বুঝতে পারি, আমাদের স্কুল-কলেজের শিক্ষাপ্রদান প্রক্রিয়া অনেক পশ্চাৎপদ। বর্তমান সময়ে বিশ্বের সাথে প্রতিযোগিতা করার মতো মোটেই মানানসই নয়। ফলে আবার দেশে স্কুল প্রতিষ্ঠার কাজে মনোযোগী হই। ২০১২ সালে নিজেদের পৈতৃক ভিটায় স্কুলের নির্মাণ কাজ শুরু করি।

তিনি বলেন, স্কুলের কার্যক্রম শুরুর পর থেকেই আমি বছরের বেশিরভাগ সময়ই দেশে থাকি। তবে আমার পক্ষে একা কখনোই এই প্রতিষ্ঠান চালানো সম্ভব নয়। তাই আমরা একটি টিম গড়ে তোলার চেষ্টা করছি। শিক্ষকদের প্রতিনিয়ত প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। আর শারীরিকভাবে আমি না থাকলেও সার্বক্ষণিক স্কুলের দায়িত্বশীলদের সাথে আমার যোগাযোগ হয়। আমেরিকায় বসেও আমি স্কুলের প্রতিদিনকার কার্যক্রম তদারকি করি।

স্টিমেইজ’র উপাধ্যক্ষ এম. এ. আই. সাদি বলেন, আমোদের স্কুলের শিক্ষার্থীদের প্রতিদিন বইয়ের বোঝা বইতে হয় না। বই স্কুলেই থাকে। এখানে যা পড়ানো হয় ও যা বাড়ির কাজ দেওয়া হয় তা একটি শিটে করে শিক্ষার্থীদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়। ওই শিটেই বাড়ির কাজ করে পরদিন স্কুলে নিয়ে আসে শিক্ষার্থীরা। বাড়িতে তাদের বই নিয়ে যেতে হয়, বই কিনতেও হয় না।

তিনি বলেন, আমরা স্বল্প ব্যয়ে শিক্ষার্থীদের আধুনিক শিক্ষা দিতে চাই। শিশুরা যাতে আনন্দের সাথে শিক্ষালাভ করতে পারে সেদিকে আমরা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেই।

তিনি বলেন, শিশুদের কিছুক্ষণ পরপর ক্ষুধা লাগে। তাই আবার স্কুলে তিনবার খাবারের  ব্যবস্থা রেখেছি। এখানে সবার সঙ্গে একসাথে খেতে হয় বলে তারা শেয়ারিং আর সকলের সাথে খাওয়ার নিয়মকানুনও শিখে নেয়। খাবার আইটেমে আমরা প্রতিদিন শাকসবজিও রাখি। প্রথমদিকে কেউ কেউ শাকসবজি খেতে চাইতো না, এখন তারা এসবে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত