সিলেটটুডে ওয়েব ডেস্ক

২২ মে, ২০১৫ ১৪:২৭

আইএস’র হামলায় ধ্বংসের মুখে ঐতিহাসিক নগর পালমেইরা

বুধবার ইরাকি সেনাবাহিনীকে হটিয়ে সিরিয়ার ঐতিহাসিক শহর পালমাইরা'র দখল নিয়ে নেয় উগ্র ধর্মীয় সংগঠন ইসলামিক স্টেট(আইএস) । শহরের এক তৃতীয়াংশই এখন তাদের দখলে।
ইউনেস্কোর ‘হেরিটেজ সাইট’, দু’হাজার বছরের পুরনো এই ঐতিহাসিক শহরে  দিনভর সংঘর্ষ শেষে কার্যত পালিয়ে বেঁচেছে সেনাবাহিনী। সিরিয়ার তরফে গোটা বিশ্বের কাছে আকুল আবেদন জানানো হয়েছে, এই ঐতিহ্যশালী শহরকে রক্ষা করতে সকলে যেন এগিয়ে আসেন।

ইরাকের মসুল, নিমরুদ, হাতরা— আইএস জঙ্গি তাণ্ডবে গুঁড়িয়ে যাওয়া প্রাচীন শহরের সংখ্যাটা নেহাত কম নয়। চলতি মাসেই অ্যাসিরীয় সভ্যতার বিখ্যাত রাজধানী শহর, ২৭০০ বছরের পুরনো খোরসাবাদ তছনছ হয়ে গিয়েছে। প্রত্নতত্ত্ববিদদের আশঙ্কা, এ বার সেই তালিকায় জুড়তে চলল সিরিয়ার পালমাইরার নামও।

অনেক দিন থেকেই জঙ্গিদের নিশানায় ছিল পালমাইরা শহর। গত শনিবারও এখানে ঢুকে পড়েছিল আইএস বাহিনী। তবে সে যাত্রায় ২৪ ঘণ্টার বেশি শহরটা নিজেদের হাতে রাখতে পারেনি তারা। প্রতিশোধ নিতে বুধবার আবার শহরের উত্তর দিক দিয়ে হামলা চালায় তারা। একটি মানবাধিকার সংগঠনের কর্তা জানিয়েছেন, বুধবারের হামলার পর আশপাশের এলাকায় আর দেখাই মিলছে না সেনাদের। আর তাতেই আরও ঘন হচ্ছে আশঙ্কার কালো মেঘটা। কারণ জেহাদি ঐতিহ্যের বাইরে সব কিছুই তারা নিশ্চিহ্ন করবে— এটাই আইএসের ঘোষিত নীতি। তাই তাদের নিশানায় কখনও জাদুঘরের প্রত্ন-সামগ্রী। কখনও প্রাচীন অ্যাসিরীয় স্থাপত্য। কোনও কোনও সূত্র এমনও দাবি করে, পৃথিবী জুড়েই প্রাচীন ইতিহাসের বহু দিকচিহ্ন উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করছে তারা। এমনকি মিশরের পিরামিডের দিকেও তাদের নজর আছে।

শুধু স্থাপত্য নয়, বইয়ের পাতায় ধরা ইতিহাস-ই বা বাদ থাকে কেন? ক’দিন আগে মসুলের গ্রন্থাগারে ঢুকে একসঙ্গে দশ হাজার বইয়ে আগুন ধরিয়ে নথির নিশানও মুছতে চেয়েছিল আইএস জঙ্গিরা। প্রত্নতত্ত্ববিদদের আশঙ্কা, একই রকম তাণ্ডব এ বার নেমে আসতে পারে পালমাইরার উপরে। হাজার হাজার বছরের পুরনো ইতিহাসের গর্ব ধুলোয় মেশা এখন হয়তো শুধু সময়ের অপেক্ষা। মার্চ মাস থেকেই পালমাইরায় আনাগোনা চালাচ্ছে আইএস। শহরের বহু সৌধের গায়ে তারা গেঁথে দিয়েছে গুলির দাগ। কিন্তু পুরোপুরি কব্জা করতে পারেনি শহরটা। এ বার সেই লক্ষ্যে সফল হয়েছে তারা। একটা বড় অংশ কার্যত এখন তাদের দখলে।

পালমাইরার যে রাস্তা এখন সেনা-জঙ্গি যুদ্ধক্ষেত্র, এক কালে সেই পথেই নামত ব্যবসায়ীদের ঢল। ভূমধ্যসাগরের অ্যান্টিয়োক থেকে ইউফ্রেটিসের পথে উটের পিঠে মাল বোঝাই করে নিয়ে যেতেন সওদাগররা। পথের ধারে তাঁদের জিরিয়ে নেওয়ার জায়গা ছিল এই শহর। এ শহরের স্থাপত্যে মিশে ছিল গ্রেকো-রোমান আর পার্সি শৈলী। পালমাইরীয় সাম্রাজ্যের প্রতিপত্তি বাড়ে খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকে রানি জেনোবিয়ার আমলে। আশপাশের এলাকা জয় করে ধীরে ধীরে নিজের রাজ্যের পরিধি বাড়ান ক্লিওপেট্রার এই বংশধর। তবে সৌভাগ্য স্থায়ী হয়নি খুব বেশি দিন। ২৭১ সালে রোম সম্রাট অরেলিয়ানের কাছে পরাজিত হন জেনোবিয়া। সম্রাটের সঙ্গেই বন্দিনী জেনোবিয়াকে নিয়ে আসা হয় রোমে।

পালমাইরার পথে-ঘাটে, সৌধের দেওয়ালে কান পাতলে এখনও শোনা যায় ইতিহাসের সেই ফিসফিসানি। সিরিয়ার প্রত্ন বিভাগের প্রধান মামুন আব্দুলকরিমের আক্ষেপ, জঙ্গিদের ধ্বংসলীলায় এ বার হয়তো গুঁড়িয়ে যাবে দু’হাজার বছরের স্মৃতিভাণ্ডার! শুধুই ধ্বংস নয়, প্রশাসনের আশঙ্কা, পাল্লা দিয়ে চলবে লুঠতরাজও। প্রত্ন সামগ্রী বেচে যে আয় ভালই হয়, এত দিনে তা জেনে গিয়েছে আইএস। নিজেদের লাভের রাস্তা খোলার জন্য ঐতিহাসিক নিদর্শন বিকোতে তারা দু’বারও ভাববে না বলেই দাবি সরকারি কর্তাদের। চার বছর ধরে যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ায় ইতিহাসের যত নিদর্শন গুঁড়িয়ে গিয়েছে, উধাও হয়ে যাওয়া নিদর্শনের সংখ্যা তার চেয়ে কম নয়।

আন্তর্জাতিক বাজারে গত কিছু দিন ধরে প্রাচীন জিনিসপত্রের জোগান যে ভাবে বেড়ে গিয়েছে, তার সিংহভাগই আসছে পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। সংবাদমাধ্যমে তা নিয়ে লেখালেখি কম হয়নি। নানা সূত্র থেকেই খবর এসেছে যে, চোরাপথে ইতিহাসের সামগ্রী চড়া দামে বেচে নিজের রসদ সংগ্রহ করে থাকে আইএস। আবার দারিদ্র আর অরাজকতার আবহে কখনও অভাবের টানে সাধারণ মানুষ আবার কখনও সুযোগসন্ধানী গুপ্ত ব্যবসায়ীরাও লুঠতরাজে নেমে পড়ছে। ইতিহাস নিহত হচ্ছে হয় গোলার আঘাতে, নয় ডাকাতের হাতে।

ইতিহাস-নিধনের এই ধারা অবশ্য নতুন নয়। আফগানিস্তানে ১৭০০ বছরের পুরনো বেলেপাথরের বামিয়ান বুদ্ধমূর্তি উপড়ে ফেলতে না পেরে ডায়নামাইট বোঝাই লরি এনে গোটা কাঠামোটা উড়িয়ে দিয়েছিল তালিবান। আবার ২০০৩ সালে ইরাকে সাদ্দাম বিরোধী অভিযানের সময় ব্যাবিলনকে যে ভাবে ফোঁপরা করে দিয়েছিল মার্কিন মিত্রসেনা, সেই স্মৃতিও ফিকে হয়নি আজও।

ইতিহাসবিদদের আক্ষেপ, জমি দখলের লড়াইয়ে বরাবরই প্রথম বলি ইতিহাস। আক্রমণকারী যে পক্ষেরই হোক না কেন! আপাতত পালমাইরা বাঁচবে কি না, পরিষ্কার হয়ে যাবে ক’দিনের
মধ্যেই।

 

 

সূত্র: এপিবি আনন্দ

আপনার মন্তব্য

আলোচিত