সিলেটটুডে ওয়েব ডেস্ক

২৬ মে, ২০১৫ ০৮:৫৫

‘আবার যদি দেখা হয় তোমার আমার’: প্রেমিকার প্রতীক্ষায় রেলস্টেশনে ২০ বছর!

"জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার-
তখন আবার যদি দেখা হয় তোমার আমার!"


জীবনানন্দ দাশ যদি বেঁচে থাকতেন আর জানতেন বাস্তবেই বছর কুড়ি ধরে প্রণয়িনীর প্রতীক্ষায় কাটিয়ে দেয়া এই যুবকের কথা। হয়ত তাইওয়ানের অহ জিকে নিয়ে লিখতেন  অমর কোন কাব্য।
কাব্য লেখার মতই কাজ করে চলেছেন ৪৭ বছর বয়সী তাইওয়ানের এই বাসিন্দা। ৪৭ বছর বয়স হলেও এখনও যেন ঠিক সাতাশ বছরেই দাঁড়িয়ে আছেন তিনি প্রিয় মানুষটির জন্য একই রকম আবেগ আর ভালোবাসা নিয়ে।

বয়স যখন ছিলো ২৭ তখন একটি রেলস্টেশন থেকে প্রেমিকা বিদায় নেয়ার সময় বলেছিলেন- 'আমার জন্য অপেক্ষায় থেকো'।  তিনিও কথা দিয়েছিলেন- 'সারাজীবন তোমার জন্য অপেক্ষায় থাকব'।

বোকা প্রেমিক অহ জি সেই থেকেই একই জায়গায় আছেন দাঁড়িয়ে। অপেক্ষায় আছেন প্রিয়জনের ফিরবার। ভোগবাদী , দেনা পাওনার হিসেব নিকেশের পৃথিবীতে অহ জি যেন সত্যিকার এক ভিন্ন আলোড়ন।

প্রিয় মানুষের জন্য প্রতীক্ষা কখনো মধুর হয়, কখনও হয় অস্থিরতার। ২০ বছর ধরেই যদি কেউ স্থিরভাবে একজনের জন্য অস্থির হয়ে বসে থাকে তাঁর ভালোবাসার মূল্য দেয়ার খুব বেশি লোক কি এই পৃথিবীতে থাকার কথা?নাহ ফেরেন নি অহ জির প্রেমিকা। তিনি হয়ত অন্য কারো সাথে দিব্যি কাটিয়ে দিচ্ছেন জীবন।  

থাইল্যান্ডের অনলাইন অডিটিসেন্ট্রালডটকমের এক সংবাদদাতা ছয় মাস অপেক্ষা করে অহ জির কাছ থেকে জানতে পেরেছেন, এই রেলস্টেশনেই ২০ বছর আগের একদিন প্রেমিকা তাঁকে ছেড়ে গিয়েছিল। ছেড়ে যাওয়ার সময় বলেছিল, ‘অপেক্ষায় থেকো আমার জন্য।’ আর অহ জি কথা দিয়েছিলেন, ‘সারা জীবন থাকব তোমার অপেক্ষায়।’ ওই কথাটিকেই আঁকড়ে ধরে দুই দশক ধরে প্রেমিকার অপেক্ষায় আছেন জি।  এই এক বিচিত্র ঘটনা আলোড়ন তুলেছে তাইওয়ান ও সিংগাপুরের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে।


তবে এই প্রেমিক কিন্তু জানেন না, সে মেয়েটি কোথায় থাকে, এখন কী অবস্থায় আছে কিংবা সে অন্য কারো সাথে প্রেমে আবদ্ধ হয়ে গেছে কি না? এসব প্রশ্ন জিজ্ঞেস করাতে তিনি ওই সাংবাদিকের ওপর ক্ষেপে যান এবং সরাসরি মুখের ওপর বলে দেন তিনি এ  ব্যাপারে কোনো কথা বলবেন না।

২০ বছর ধরে যাঁরা তাইনান স্টেশনে নিয়মিত আসা-যাওয়া করছেন, তাঁদেরই একজন ৬১ বছর বয়সী শো জে পি। তিনি বলেন, ‘২০ বছরে ধরে আমি যত দিন স্টেশনে এসেছি, প্রতিদিনই তাঁকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। প্রথম কয়েক বছর তিনি অপেক্ষা করতেন রেলস্টেশনে ঢোকার মুখের একটি সিঁড়ির পাশে। আর গত চার-পাঁচ বছর ধরে তিনি স্টেশন থেকে বের হওয়ার পথের পাশে দাঁড়িয়ে থাকেন। সেখানে দাঁড়িয়েই স্টেশন থেকে বেরিয়ে আসা মানুষগুলোকে দেখেন তিনি। মানুষের মুখে কাকে যেন খোঁজেন।ঝড়-বৃষ্টি-তুষারপাত কোনোকিছুতেই তাঁর এই রুটিনের নড়চড় হয়নি। শুনেছি এই স্টেশনেই থাকেন তিনি।

এত বছরে তাই স্টেশনের যাত্রীদের সবারই পরিচিত মুখ হয়ে গেছেন প্রেমিক অহ জি। এখন স্টেশন থেকে বের হওয়ার পথে অনেকেই তাঁর কুশল জিজ্ঞেস করেন। অনেকে তাঁকে খাবার দিয়ে যান।

তাইনান শহরের লোকজন জিকে ‘হিউম্যান হাচিকো’ নামে ডাকে। হাচিকো হচ্ছে জাপানের বিখ্যাত লেখক আকিতা ইনুর ম্যান বুকার এবং ডাবলিন সাহিত্য পুরস্কারজয়ী বই ‘জো জাসির’ একটি কুকুর চরিত্র। যে একটি রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে যুদ্ধে নিহত তাঁর মালিকের জন্য দীর্ঘ এক যুগ অপেক্ষা করেছিল।

অহ জির পরিবারের লোকজন থাকেন তাইনান শহরেই। তাঁর ছোট ভাই ওন জি জানান, প্রথম প্রথম পরিবারের লোকজন এসে তাঁকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতেন। ঘরে নিয়ে আটকেও রাখা হয়েছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। ঠিক চলে এসেছেন আগের জায়গায়। কয়েক বছর আগে সমাজকর্মীরা তাঁকে ভর্তি করিয়েছিলেন এক পুনর্বাসন কেন্দ্রে। কয়েকদিন পর সেখান থেকে আগের ঠিকানায় পালিয়ে ফিরে এসেছেন তিনি।

অবশ্য কিছুদিন থেকে শহরের বিখ্যাত প্রেমিক জিকে নিয়ে দেশ-বিদেশের সংবাদপত্র ও জনগণের তুমুল আগ্রহের পর তাইনান শহরের সমাজকল্যাণ কর্তৃপক্ষ ব্যাপারটিতে হস্তক্ষেপ করেছে। শহরের মেয়র একদিন নিজে এসে তাঁকে নিয়ে গেছেন স্থানীয় একটি চার্চের প্রার্থনা ও তাঁর সম্মানে আয়োজিত ভোজসভায়। চুল কাটিয়ে, শহরের মেয়রের উপহার দেওয়া নতুন পোশাক পরে স্টেশনের কিছু বন্ধুকে নিয়ে ওই ভোজসভায় যান তিনি। এ সময় তাঁকে বেশ উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল। কিন্তু যেই তাঁকে স্টেশন ছাড়তে বলা হলো, অমনি বেঁকে বসলেন তিনি। জানালেন তিনি কোথাও যাবেন না, বরং অপেক্ষা করবেন স্টেশনেই।

এরপর স্থানীয় একটি ট্যুরিজম ক্লাব তাঁদের অর্থায়নে জিকে পরিবারের একজনসহ ঘুরতে পাঠিয়েছেন। শহরের বিভিন্ন সরকারি এবং বেসরকারি আয়োজনেও তাঁকে নিয়মিত দাওয়াত দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু জীবনের এত আয়োজনে কিছুতেই মন লাগে না তাঁর। ঠিক ফিরে যান অপেক্ষার রেলস্টেশনেই। তাঁর মনে পড়ে যায়, কেউ তাঁকে বলেছিল- ‘অপেক্ষায় থেকো আমার জন্য।’ আর কাউকে তিনি কথা দিয়েছিলেন, ‘সারা জীবন থাকব তোমার অপেক্ষায়।’

আপনার মন্তব্য

আলোচিত