সিলেটটুডে ডেস্ক

০৯ নভেম্বর, ২০১৯ ১০:২১

তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে বাবরি মসজিদের রায় হওয়া উচিত : আরশাদ মাদানি

ছবি: সংগৃহীত

কেবল ধর্মীয় বিশ্বাস নয়, তথ্য-প্রমাণের ওপর ভিত্তি করেই বাবরি মসজিদ-রাম মন্দির মামলার রায় হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছেন জমিয়তে উলেমা-এ-হিন্দের প্রধান আরশাদ মাদানি।

বুধবার তিনি বলেছেন, বিপক্ষে গেলেও রায়কে সম্মান জানাবে তার সংগঠন।

ভারতের ইতিহাসের সবচেয়ে স্পর্শকাতর রাজনৈতিক ও সামাজিক মামলার নিষ্পত্তি হতে চলেছে শনিবার সকালে। বাবরি মসজিদ-রাম মন্দির নিয়ে অযোধ্যা মামলার চূড়ান্ত রায় দেবেন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ।

আরশাদ মাদানিকে উদ্ধৃত করে পিটিআই বলেছে, ‘প্রত্যেক বিচার-প্রেমী মানুষই চান- কঠোর তথ্য ও প্রমাণের ওপর ভিত্তি করেই মামলার রায় দেওয়া হোক, কোনো ধর্মীয় বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে নয়।’

তিনি বলেন, ‘আদালতের যুক্তি-তর্ক শেষ হয়েছে। এখন আমরা রায়ের অপেক্ষা করছি। আমাদের আইনজীবী রাজীব ধাওয়ান তথ্যের ওপর ভিত্তি করে খুবই জোর যুক্তি-তর্ক তুলে ধরেছেন। আমাদের বিশ্বাস, রায় আমাদের পক্ষেই যাবে।’

জমিয়ত প্রধান বলেন, ‘দেশ আমাদের, আইন আমাদের এবং সুপ্রিম কোর্ট আমাদের। আমরা প্রমাণ দিয়েছি। রায় যাই হোক না কেন, আমরা তাকে সম্মান জানাব।’

একদিন আগে দিল্লিতে মুসলিম ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ-আরএসএস প্রতিনিধিরা। এতে রায় ঘিরে পরিস্থিতি শান্ত রাখার ওপর জোর দেওয়া হয়।

কিছু হিন্দুত্ববাদীর দাবি, এই মসজিদের জায়গায় রামের জন্মস্থান বলে পরিচিত একটি প্রাচীন মন্দির ছিল। সেই মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের ওপরই নির্মিত হয়েছিল মসজিদটি।

অযোধ্যায় শতাব্দী প্রাচীন বাবরি মসজিদটি ১৯৯২ সালে ভেঙে দেওয়া হয়। এনিয়ে ভারতে রীতিমতো দাঙ্গা শুরু হয়। এতে মারা যায় প্রায় দুই হাজার মানুষ।

১৫২৭ সালে মুঘল সম্রাট বাবরের নির্দেশে তার নামে উত্তর প্রদেশের অযোধ্যায় নির্মিত হয় বাবরি মসজিদ। তবে হিন্দুদের দাবি, এটিই রাম জন্মভূমি এবং এখানে ভগবান রামের মন্দিরও ছিল।

সিপাহি বিদ্রোহের চার বছর আগে ১৮৫৩ সালে প্রথম ধর্মীয় বিবাদের সূত্রপাত হয় এই মসজিদকে কেন্দ্র করে।

সেই বিবাদ আয়ত্তের বাইরে চলে যাওয়ায় ছয় বছর পর ব্রিটিশ সরকার বিতর্কিত কাঠামোর চারপাশ ঘিরে দেয়। ভেতরের অংশে মুসলিম ও বাইরের অংশে হিন্দুদের প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়।

১৮৮৫ সালে ওই স্থানে মন্দির নির্মাণের দাবি জানিয়ে ফৈজাবাদ জেলা আদালতে প্রথম মামলা দায়ের করেন মোহন্ত রঘুবর দাস।

ভারতের স্বাধীনতার তিন বছর পর ১৯৪৯ সালে স্থাপত্যের ভেতরে রামের মূর্তি উদ্ধার হয়। মুসলমানদের অভিযোগ, মন্দিরের ভেতরে হিন্দুরা মূর্তি রেখে এসেছে। এ ঘটনায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু দুঃখপ্রকাশ করেন। তখন দুই সম্প্রদায়ই আইনি মামলার পথে যায়। স্থাপত্যটিকে বিতর্কিত আখ্যা দিয়ে চিরতরের জন্য বন্ধ করে দেয় কেন্দ্রীয় সরকার।

১৯৮৪ সালে নতুন রাজনৈতিক শক্তি ভারতীয় জনতা পার্টির উত্থান হয়। গোটা ভারতে মাথাচাড়া দেয় হিন্দুত্ববাদ। রামের জন্মভূমিকে অশুভ শক্তি থেকে ‘মুক্ত’ করার ডাক দিয়ে উগ্রবাদী সংগঠন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতৃত্বে গঠিত হয় রাম মন্দির কমিটি। তার পুরোধা ছিলেন বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আদভানি।

১৯৮৬ সালে জেলা আদালতের বিচারকের আচমকা নির্দেশের ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বাবরি মসজিদের গেট খুলে দেওয়া হয়। ক্ষুব্ধ মুসলমানরা বাবরি মসজিদ অ্যাকশন কমিটি গঠন করে ফেলেন।

১৯৮৯ সালে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ মসজিদ লাগোয়া জমিতে রাম মন্দির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে।

পরের বছর বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সদস্য-সমর্থকেরা রাম মন্দির নির্মাণ করতে যাওয়ায় মসজিদের গম্বুজের আংশিক ক্ষতি হয়। উত্তর প্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মুলায়ম সিং যাদব করসেবকদের ওপর গুলি চালনার নির্দেশ দেন। রাম মন্দির নির্মাণের সমর্থনে আদভানি দেশ জুড়ে রথযাত্রা বের করেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রশেখর মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করলেও তা বিফলে যায়।

১৯৯১ সালে উত্তর প্রদেশে ক্ষমতায় আসে বিজেপি।

১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর ভিএইচপি, বিজেপি ও শিবসেনার সমর্থকেরা গুঁড়িয়ে দেয় বাবরি মসজিদ। রক্তক্ষয়ী দাঙ্গায় দুই হাজারের বেশি মানুষের প্রাণ হারায়।

১৯৯৮ সালে কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসে বিজেপির জোট সরকার। এর চার বছর পর প্রধানমন্ত্রী হন অটল বিহারি বাজপেয়ি নিজের অফিসে অযোধ্যা সেল গঠন করেন।

ওই বছরই মার্চ মাসের মধ্যে মন্দির নির্মাণ সম্পূর্ণ করার চ্যালেঞ্জ নেয় ভিএইচপি। ২৭ ফেব্রুয়ারি অযোধ্যা থেকে ফেরার সময় গুজরাটের গোধরার কাছে সাবরমতী এক্সপ্রেসে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যু হয় ৫৮ জন করসেবকের। তিন দিনের মধ্যে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দাঙ্গা বাধে। বহু মানুষের মৃত্যু হয়।

এপ্রিল মাসে ওই স্থানের অধিকার কোন সম্প্রদায়ের- সেই মর্মে এলাহাবাদ হাইকোর্টে মামলার শুনানি শুরু হয়।

সেখানে আদৌ রাম মন্দির ছিল কি না তা জানার জন্য পরের বছর জানুয়ারিতে আদালত আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়াকে দায়িত্ব দেয়। ২০০৩ সালের আগস্টে তারা জানায়, মসজিদের নিচে রাম মন্দির থাকার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এই রিপোর্টকে চ্যালেঞ্জ করে মুসলিম ল’ বোর্ড।

নির্মীয়মাণ রাম মন্দিরের সাইটে জিপ বোঝাই বিস্ফোরকসহ হামলা চালানো হয়। হামলাকারীরা সেনাদের হাতে নিহত হয়।

২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে এলাহাবাদ হাইকোর্ট বিতর্কিত কাঠামোকে তিন ভাগে বিভক্ত করে দেওয়ার নির্দেশ দেয়, যা পায়- উত্তর প্রদেশের সুন্নি সেন্ট্রাল ওয়াক্‌ফ বোর্ড, নির্মোহী আখড়া ও রাম লালা কমিটি। এভাবে কাঠামোর কর্তৃত্ব যায় হিন্দুদের দখলে। মুসলমানদের হয়ে এক আইনজীবী রায়কে চ্যালেঞ্জ জানান। ডিসেম্বরে অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভা ও সুন্নি ওয়াক্‌ফ বোর্ড এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে যায়।

পরের বছর মে মাসে এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়কে খারিজ করে সুপ্রিম কোর্ট। সেই থেকে বিতর্কিত কাঠামো বন্ধই পড়ে আছে।

আদালতের বাইরে মীমাংসা করে নিতে ২০১৭ সালের ২১ মার্চ সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি জে এস খেহের নির্দেশ দেন।

একই বছরের ৫ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্র, বিচারপতি অশোক ভূষণ ও এন আবদুল নাজিরের বেঞ্চে নতুন করে শুরু হয় মামলা।

চলতি বছরের ৮ মার্চ বিচারপতি এফ এম কলিফুল্লা, আধ্যাত্মিক গুরু শ্রী শ্রী রবি শংকর ও আইনজীবী শ্রীরাম পঞ্চুকে নিয়ে তিন সদস্যের মধ্যস্থতাকারী প্যানেল তৈরি করে দেয় সুপ্রিম কোর্ট। ২ আগস্ট মধ্যস্থতার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। প্রধান বিচারপতি তখন জানান, ৬ আগস্ট থেকে প্রতিদিন শুনানি হবে।

টানা ৪০ দিন ম্যারাথন শুনানির পর মামলার রায়দান স্থগিত রাখা হয়। ঘোষণা করা হয় ১৭ নভেম্বরের মধ্যে রায় হবে। ৮ নভেম্বর হঠাৎই ঘোষণা করা হয় শনিবার অর্থাৎ আজ মামলার চূড়ান্ত রায় হবে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত