নিজস্ব প্রতিবেদক

২৬ মার্চ, ২০১৫ ০২:২৮

দেশের জন্য জীবন দিয়েও 'শত্রু' আখ্যা পেলেন জিসি দেব

ড. জিসি দেব; পুরো নাম গোবিন্দ চন্দ্র দেব। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা লগ্নে যে ক’জন বীর বাঙালি প্রাণ দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। শহীদ বুদ্ধিজীবি। অথচ এই শহীদের বাড়িটিই ‘অর্পিত সম্পত্তি’ আখ্যা দিয়ে দখল করে রাখা হয়েছে অদ্যাবধি। জাতির শ্রেষ্ট সন্তানকে কী নিকৃষ্ট প্রতিদান!

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হায়েনারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর। ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামে চালায় বাঙালি নিধনযজ্ঞ। সে রাতেই পাকিস্তানি হায়েনারা হত্যা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক, মানবতাবাদী দার্শনিক গোবিন্দ চন্দ্র দেব (ড. জি সি দেব) কে। স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনা পর্বেই স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করেন এই জশস্বী।

জিসি দেবকে হত্যার পরই স্থানীয় রাজাকার আর আলবদররা তাঁর পৈতৃক ঘর ও অসংখ্য দুর্লভ বই সহ সকল স্মৃতিচিহ্ন‎ পুড়িয়ে দেয়। বাড়িটি দখল করে নেয় রাজাকারেরা। স্বাধীনতার পর রাজাকাদের মতোই ভূমিকা নেয় সরকার। জিসি দেবের বাড়িটি শত্র“ সম্পত্তি (পরবর্তীর্তে অর্পিত সম্পত্তি) আখ্যা দিয়ে দখল করে রেখেছে সরকার।

জাতির শ্রেষ্ট সন্তানের সাথে কী ভয়ংকর পরিহাস! যাঁর প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হলো স্বাধীনতার লাল সূর্য তার কপালেই জুটলো ‘শত্রু’ আখ্যা। সরকার যায়, সরকার আসে। স্বাধীনতার স্বপক্ষের বিপক্ষের লোকরা ক্ষমতায় আসে। তবু জিসি দেবের বাড়িটি উদ্ধারে নেওয়া হয় না কোন উদ্যোগ। ‘শত্রু’ কলংক তিলকই লেগে থাকে জাতির এই সূর্য সন্তানের কপালে। ফলে শহীদ হওয়া বুদ্ধিজীবী ড. জি সি দেবের পৈতৃক বাড়িটি গত ৪৪ বছর ধরে রয়েছে দখলদার চক্রের হাতে।

ড. জিসি দেবের বাড়ি সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার লাউতা ইউনিয়নের নন্দিরফল গ্রামে। বাড়িটির সর্বমোট ভূমির পরিমান ২দশমিক ৪৭ একর। ব্যাক্তিগত জীবনে জিসি দেব ছিলেন অকৃতদার। তাঁর অপর ভাই যুদ্ধপূর্বকালীন সময়েই ভারতে চলে যান। তিনি সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়েই জিসি দেবের বাড়িটি অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে অধিগ্রহণ করে সরকার।

অভিযোগ রয়েছে স্থানীয় প্রশাসন উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে অবৈধভাবে শত্রু সম্পত্তি তালিকাভূক্ত। এরপর এ বাড়িটি একের পর এক  বিভিন্ন ব্যাক্তিকে লিজ প্রদান করে। সেই সময়েই স্থানীয় সচেতন এলাকাবাসী বাড়িটি অর্পিত সম্পত্তির তালিকা থেকে বাদ দিয়ে জিসি দেব যাদুঘর কিংবা পাঠাঘার করার দাবী জানান। বলাবাহুল্য, সে দাবী সরকারের কর্ণকুহরে পৌছায় নি কিংবা সরকার তাতে কর্ণপাত করেন নি।

এরপর বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামের ফলে ১৯৯২ সালে তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজিম উদ্দিন এই বাড়িটি ড. জি সি দেবের নামে রেকর্ডভুক্ত করেন। বিগত সেটেলমেন্ট জরিপেও একই নামে বাড়িটি রেকর্ডভুক্ত হয়। জিসি দেবের নামে রেকর্ডভূক্ত করার সাথে সাথে স্বভাবতই বাড়িটির লিজ গ্রহীতারা অবৈধ দখলদার হয়ে যায়। তবে রহস্যজনক কারনে অধ্যাবদি অবৈধ দখলদারদেরকে বাড়িটি থেকে উচ্ছেদ করা হয় নি।

এদিকে স্থানীয় প্রভাবশালী একটি মহল বাড়িটি তাদের দখলে নেয়ার জন্য নানা পায়তারা শুরু করে। সরকারের স্থানীয় সংশ্লিষ্টদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে দখলদাররা এ বাড়িতে অবস্থান পাকাপোক্ত করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এখনও দখলদাররা অবৈধভাবে বসতঘর বানিয়ে জিসি দেবের বাড়িতে বসবাস করছে। স্থানীয় প্রশাসনও বাড়িটি উদ্ধারের কোন কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। বর্তমানে বাড়িটি নিয়ে প্রশাসন, অবৈধ দখলদার ও স্থানীয় সচেতন মহলের মধ্যে চলছে ত্রিমুখী লড়াই।

ছ'বছর আগে ড. জি সি দেব স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করা হয়। তবে তাঁর পৈতৃক বাড়িটি উদ্ধারে জন্য সরকারীভাবে কোন রকম ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। স্থানীয় সাংসদ শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বরাবরেও এ ব্যাপারে দাবী জানিয়েছেন এলাকাবাসীরা।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত