এস আলম সুমন

০৬ ডিসেম্বর, ২০১৬ ১২:৪৭

৬ ডিসেম্বর কুলাউড়া শত্রুমুক্ত দিবস

আজ ৬ ডিসেম্বর কুলাউড়া মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে মৌলভীবাজার জেলার এই উপজেলা পাকিস্তানী হানাদার মুক্ত হয়।

৯ মাস মহান মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সমগ্র দেশ শত্রু মুক্ত হয়। তার পূর্বে দেশের বিভিন্ন জেলা উপজেলা ক্রমান্বয়ে শত্রুমুক্ত হয়। দীর্ঘ নয় মাস পাকিস্তানী ও তাদের দোসরদের অমানবিক হত্যা, জুলুম, রাহাজানি, নির্যাতন সহ্য করে বাঙালিরা মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা ফিরে পায়। পাকিস্তানী শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালি বিদ্রোহীদের দীপ্ত শিখায় সেদিন জ্বলে উঠেছিল।

সারাদেশের মত সাংবাদিক, শিক্ষক, ছাত্র-যুবক, শ্রমিকসহ সবাই সাহসী ভূমিকায় মুক্ত হয়েছিল কুলাউড়া। ৭ মার্চ ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের পর পূর্ব পাকিস্তানের চেহারা পাল্টে যায়। সারা দেশ জুড়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি লক্ষ্য করা যায়। ঠিক ঐ সময়ে পাকিস্তানী শাসকদের শোষণ থেকে মুক্তির সংগ্রামে কুলাউড়ার দেশপ্রেমিক মুক্তিকামী সন্তানরা হাতে তুলে নিয়েছিল অস্ত্র।

সারা বাংলায় পাকিস্তানী সামরিক জান্তারা অত্যাচার নিপীড়ন শুরু করলেও কুলাউড়া থানায় তাদের প্রথম আসে ৭ মে ১৯৭১ সালে। মৌলভীবাজার থেকে কুলাউড়া প্রবেশ পথে কাপুয়া ব্রিজের কাছে গতিরোধ করতে অকুতোভয় বীর সৈনিক জয়চন্ডী ইউনিয়নের মো. আকরাম ওরফে আছকির মিয়া ও হাবীব উদ্দিন। পাকিস্তানী সেনা ও দু’দলের মধ্যে গুলি বিনিময় চলতে থাকে, এক পর্যায়ে তারা দু’জন গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। এই দুই জনই বীর সন্তান হলেন কুলাউড়া থানা এলাকার স্বাধীনতা মুক্তিসংগ্রামের প্রথম শহীদ। পাকিস্তানী সেনা ও তাদের দোসরদের সহায়তায় নিধনযজ্ঞ অব্যাহত রাখে। ৫ এপ্রিল থানার জয়চন্ডী ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম থেকে রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকিস্তানী সেনারা ২২ জন গ্রামবাসীকে ধরে এনে ও ২৪ মে, ১৪ জুন মীরবক্সপুর গ্রামে গিয়ে বেশ কয়েকজন গ্রামবাসীকে হত্যা করে একই গ্রামে গিয়ে নিধন যজ্ঞ চালায়।

উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধারা যেসব স্থানে অপারেশন চালায় এর মধ্যে উপজেলার দত্তগাঁও, চাতলাপুর চা বাগান, চাতলাপুর আলীনগর ফাঁড়ি, পাইকপাড়া, মনু রেল স্টেশন, পৃথিমপাশা বরমচাল, মনু রেলস্টেশন লাইন কর্মধা এলাকা উল্লেখযোগ্য। নভেম্বর শেষপ্রান্তে এবং ডিসেম্বর প্রথম দিকে ভারত ও বাংলাদেশ চুক্তি হওয়াতে যৌথ মিত্র বাহিনী মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লে যুদ্ধের গতি তীব্রভাবে বেড়ে যায়। থানার সবচেয়ে বড় ও সর্বশেষ অপারেশন হয় গাজীপুর চা বাগানে। উক্ত চা বাগানে যুদ্ধের সময় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর একটি শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল। নেতৃত্বে ছিলেন মেজর আব্দুল ওয়াহিদ মোগল। প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য বাগানে অবস্থান করছিল। অপরদিকে গাজীপুরের বিপরীতে চোঙ্গা বাড়ি। সেখানে মুক্তি বাহিনী ক্যাম্প ছিল।

নভেম্বর শেষ দিকে গাজীপুর মুক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এতে নেতৃত্ব দেন জুড়ী উপজেলার প্রয়াত চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা এম এ মোমিত আসুক। সাগরনাল চা বাগানে প্রথম এসে অবস্থান নেয় তারা। উক্ত স্থানে মিলিত হন ধর্মনগর থেকে আগত কর্নেল হর দয়াল সিংহের নেতৃত্বে ভারতীয় সেনাবাহিনী ৬৭ রাজপুর রেজিমেন্টের বিরাট একটি দল। তারাও বাগানে অবস্থান নেয়।

৩০ নভেম্বর কাকুরা চা বাগান অবস্থানকারী ৭৫ জন রাজাকার ও ৫ জন পাকিস্তানী সৈন্য ধরা পড়ে। ১ ডিসেম্বর কাকুরা চা বাগান থেকে গাজীপুর চা বাগান এলাকার দিকে মিত্র বাহিনীরা অগ্রসর হলে পাক সেনাদের সাথে পাল্টা গুলি বর্ষণ চলতে থাকে। ২ ডিসেম্বর রাতে যুদ্ধ হয়। ৩ ডিসেম্বর ৪-৫ গোর্খা রেজিমেন্ট কর্নেল হারকিলের নেতৃত্বে একটি দল সাহায্যে এগিয়ে আসে। পেছনে ৯৯ মাইল্টেল ব্রিগেডের আর্টিলারি সহায়তায় রাতেও প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। তবুও গাজীপুর চা বাগান এলাকা দখল মুক্ত সম্ভব না হওয়াতে ৪ ডিসেম্বর যুদ্ধের পরিকল্পনা বদলে ফেলা হয়। পিছন দিক থেকে আক্রমণ করার পরিকল্পনা নেন হারকিল। সে অনুযায়ী এম এ মোমিত আসুক ও মোহনলাল সোম পিছনে আসার দায়িত্ব গ্রহণ করে রাত ১২টায় সম্মিলিত বাহিনী পাকিস্তানী বাহিনীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।

শেষ দিকে লস্করপুর গ্রামে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনী এ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। উক্ত যুদ্ধে প্রায় ২৫০ জন পাকিস্তানী সৈন্য প্রাণ হারায়। জীবিতরা সবাই পালিয়ে যায়। ৫ ডিসেম্বর গাজীপুর চা বাগান এলাকা মুক্ত হয়। ঐ দিনই সন্ধ্যার দিকে সম্মিলিত বাহিনী কুলাউড়ায় পৌঁছে, এ রাতেই সব পাকিস্তানী সৈন্য ব্রাহ্মণবাজারের দিকে সড়ক পথে কুলাউড়া ত্যাগ করে। অবশেষে এভাবেই ৬ ডিসেম্বর কুলাউড়া শত্রুমুক্ত হয়।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত