হাসান মোরশেদ

০১ মে, ২০১৫ ১৫:১৯

দাসপার্টির খোঁজে:খসড়া পর্ব-১

সর্ব্বোচ্চ সম্মানের ঘোষণা দিয়ে ও রাষ্ট্র তাকে ভূষিত করেছে তৃতীয় খেতাবে , অথচ সহযোদ্ধাদের কাছে আজও তিনি শ্রেষ্ঠ বীর। বিশাল ভাটি অঞ্চলের বীরশ্রেষ্ঠ। হত্যা আর মরদেহ প্রদর্শনের ধরণে তাকে একাত্তরের যীশুও বলেন অনেকে। চুয়াল্লিশ বছর পর লেখক হাসান মোরশেদ বেরিয়েছেন শহীদ জগৎজ্যোতি দাস আর তাঁর দাস পার্টির খোঁজে।। তাঁর সেই অনুসন্ধান ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে সিলেটটুড২৪ডটকম-এ। আজ প্রকাশিত হলো প্রথম ক

১৭ এপ্রিল ২০১৫।
বাসা থেকে বের হয়েছি সকাল সাড়ে সাতটায়। বৈশাখের আজ চতুর্থ দিন। গত চারদিন প্রচন্ড গরম, কড়া রোদ নেই অথচ চড়া তাপমাত্রা, বাতাস নেই- হাসফাস লাগে আমার। অথচ আজ এই সকালবেলা, বৈশাখের চতুর্থদিনের সকালবেলা হেমন্তের সকালের মতোই স্নিগ্ধ ও মায়াময়- হালকা কুয়াশার মতো চারদিক, ঘাসের ডগায় একটু শিশির।
ছুটছি সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক ধরে। ছোট বড় বেশ কটি নদী , খাল এবং তার উপরে সেতু। বেশীর ভাগ সেতুই সরু ছিলো, জাইকার অর্থায়নে সেতু সম্প্রসারনের কাজ চলছে – তাই মাঝেমধ্যেই গাড়ির গতি কমে যাচ্ছে।

ঘন্টা দেড়েক চলার পর জাউয়াবাজার পেরিয়ে তারপর পাগলা বাজার।  সুনামগঞ্জ শহর এখান থেকে সম্ভবতঃ  বিশ কিলোমিটারের মতো দূরত্ব। আমার আজকের প্রথম টার্গেট পাগলা ও জয়কলসের মাঝামাঝি সদরপুর বলে একটা জায়গা। চোখ রাখি রাস্তায়।

একটা ব্রীজ পেরোই। ব্রীজের নীচ দিয়ে একটা মোটামুটি প্রশস্থ নদী কিংবা খাল উত্তর থেকে দক্ষিনে  প্রবাহমান। এখনো বর্ষা আসেনি, তেমন বৃষ্টিও হয়নি। তবু নদী কিংবা খালটি শীর্ণ নয়, ভরা বর্ষায় বেশ  প্রসস্থ হবে ধারনা করি।  এটিই সদরপুর। ব্রীজ পেরিয়েই গাড়ি থেকে নামি। হাতের ডানে একটা চায়ের দোকান। দুতিন জন বসা কিন্তু সকলেই তরুন। আমি একজন মধ্যবয়স্ক কিংবা বৃদ্ধের খোঁজে। অপেক্ষা করতে হয় না। ব্রীজ পেরিয়ে একজন এগিয়ে আসেন। আমিও এগিয়ে যাই। আগ বাড়িয়ে সালাম দেই।


ছবি: আব্দুল মন্নান

ইনি আব্দুল মন্নান,  পেছনের গ্রাম কামরুপদলং এর বাসিন্দা। আমি যেইসময়টাকে খুঁজছি, সেই সময়ে তার বয়স ছিলো পনেরো বছর। আমি এখানে দাঁড়িয়ে ১৯৭১ কে খুঁজছি।  ১৯৭১ এর যে ঘটনাকে খুঁজছি এখানে দাঁড়িয়ে কামরুপদলং এর আব্দুল মন্নান সেই ঘটনার স্বাক্ষ্য দেন।

১৯৭১ এর জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ। আব্দুল মন্নানের অবশ্য জুলাই মনে নেই ‘ বাইরা’ মনে আছে। ‘বাইরা’ মানে বর্ষা কাল। সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কে পাকিস্তান আর্মির নিয়মিত যাতায়াতের জন্য এই ব্রীজটি ছিলো গুরুত্বপুর্ণ,  ব্রীজে সার্বক্ষনিক পাহারায় থাকতো রাজাকারদের একটা দল।
 
সেক্টর-সাবসেক্টর গঠনের কাজ তখন প্রাথমিক পর্যায়ে। ৫ নং সেক্টরের বালাট সাব সেক্টরের অধীনে এই জায়গাটি। কিন্তু গুরুত্ব বিবেচনায় সেই তাহিরপুরের টেকেরঘাট সাব-সেক্টরের একদল গেরিলাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ব্রীজটি উড়িয়ে দেয়ার। টেকেরঘাট থেকে অনেকগুলো হাওর, নদী পার হয়ে বিশজনের দল কাছাকাছি এক গ্রামে এসে অবস্থান নিয়েছে।  দলটির নেতৃত্বে একুশ বছরের এক তরুন- জগতজ্যোতি দাস। বাড়ি আরো ভাটিতে হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জে হলেও সুনামগঞ্জ কলেজের ছাত্র। এইসব এলাকা তার চেনা আর একমাসের প্রশিক্ষনে  দুর্দান্ত পারফর্মেন্স তাকে আলাদা করে দিয়েছে অন্যদের থেকে। জগতজ্যোতি ও তার দলকে বিশেষভাবে তৈরী করা হয়েছে সিলেট ও সুনামগঞ্জ অঞ্চলের পাকিস্তান আর্মির একটা লাইফ লাইনকে অকার্যকর করে দিতে। নদীপথে ঢাকা থেকে ভৈরব হয়ে হাওর পাড়ি দিয়ে আজমিরীগঞ্জ ও শেরপুর হয়ে সিলেট আসা যায় আবার আজমিরীগঞ্জ থেকে দিরাই জামালগঞ্জ হয়ে মহকুমা সদর সুনামগঞ্জ পর্যন্ত নদীপথ চালু আছে। এই পথে সিলেট- সুনামগঞ্জে পাকিস্তান আর্মির রসদ ও অস্ত্র সরবরাহ চলছে।জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত জগতজ্যোতির দাস পার্টি যুদ্ধ করে টেকেরঘাট সাব-সেক্টরের বিশাল এলাকাজুড়ে।


সদরপুর থেকে সামনে এগোতে থাকি কিছুক্ষন পর জয়কলস বাজার। জয়কলস থেকে রাস্তা সোজা চলে গেছে আহসানমারা ব্রীজ পেরিয়ে সুনামগঞ্জের দিকে। এই অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে জয়কলসের প্রসংগ উঠে এসেছে বারবার।  জয়কলসের সাত্তার রাজাকার কমান্ডার। যুদ্ধ শুরুর পর জেল পালানো  দাগী ডাকাতদের নিয়ে সে বিরাট রাজাকার বাহিনী গড়ে তুলেছিলো। সদরপুর ব্রীজ থেকে শুরু করে জয়কলস ব্রীজ, আহসানমারা ফেরী পাহারা দিতো তার লোকজন। দিলা নামে এক কুখ্যাত ডাকাতকে সাথে নিয়ে সাত্তার মন্দির লুট, শরনার্থীদের উপর হামলা, আওয়ামী লীগের লোকজনের বাড়ীঘরে আগুন দেয়ার কাজ করছিলো।  আগস্টের মাঝামাঝি নিজামউদ্দীন লস্কর ময়নার নেতৃত্বে বালাট থেকে একদল মুক্তিযোদ্ধা এসে সাত্তারের বাড়ী আক্রমন করেছিলেন- দিলা ডাকাত নিহত হলে ও সাত্তার পালিয়ে গিয়েছিলো। একই সময় এরা আহসানমারা ফেরি উড়িয়ে দিয়েছিলেন এবং জয়কলস এ থাকা পাকিস্তান আর্মির সাথে তাদের যুদ্ধ হয়েছিলো। এখানে শহীদ হয়েছিলেন মহররম আলী নামে একজন যোদ্ধা, কমান্ডার ময়না নিজে গুলীবিদ্ধ হয়েছিলেন। মহররম আলীর শহিদ হবার জায়গাটা আমি খুঁজে পাইনা কিন্তু নিজাম উদ্দীন লস্কর ময়নার দেয়া বর্ণনা মতে ধারনা করি জয়কলস ব্রীজ পার হয়ে আহসানমারার দিকে যেতে হাতের ডানে রাস্তার ঢালে হবে হয়তো।  

তার আগে আমি জয়কলস বাজার থেকে  বামের সরু রাস্তায় ঢুকে এগুতে থাকি। অনেক বছর আগে আমার ছোটবেলায় সিলেট থেকে নানাবাড়ি দিরাই যাওয়া আসার জন্য লঞ্চঘাটের রাস্তা ছিলো এটি। এই রাস্তার শেষ মাথায় ছিলো লঞ্চঘাট, সেই সময় ভীষন কর্মব্যস্ত জায়গা। লঞ্চে উঠার আগে আমরা নদী থেকে সদ্য ধরা মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেতাম। সেই ঘাট নেই এখন আর। সিলেট থেকে দিরাই সরাসরি সড়ক যোগাযোগ চলছে প্রায় দুইযুগ।

এইখানে এক চায়ের স্টলে ঢুকে সালাম দিয়ে পরিচয় করে নেই দুজন বয়স্ক মানুষের সাথে। একজন উজানী গাঁওয়ের আলমাছ আলি, আরেকজন জয়কলসের আব্দুল করিম। জিজ্ঞেস করি- এখানে মুক্তিযোদ্ধা তালেবের কবর কোথায়?
প্রথা অনুযায়ি নামধাম জিজ্ঞেস করেন। জানতে চান- আমি সাংবাদিক কিনা? উত্তরে না বলি। এবার আরেকটু কৌতুহলী হয়ে প্রশ্ন করেন- আমি তালেবের কেউ হই নাকি? বলি- হ্যাঁ, তালেব আমার ভাই।

দুজনই আমাকে পথ দেখান। একটা প্রাথমিক বিদ্যালয় আর মসজিদ এর মাঝখানে এক চিলতে জায়গা। এটি একটি পারিবারিক কবরস্থান। স্থানীয় একটি পরিবারের। এখানেই দাফন করা হয়েছিলো তালেব ও তার দুজন সহযোদ্ধাকে। ছোট্ট একটা ফলকের মতো আছে কিন্তু সেখানে কোন নামধাম কিচ্ছু নেই।  

জগতজ্যোতির মত তালেব ও ছিলেন সুনামগঞ্জ কলেজের ছাত্র। বাড়ি দিরাই থানায়। বয়স বিশ-একুশের মতোই কিন্তু রাজনৈতিক চেতনা ও সাংগঠনিক দক্ষতার জোরে সুনামগঞ্জ মহকুমা ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। জুলাই এর প্রথম সপ্তাহে সাংবাদিক সালেহ চৌধুরীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের যে দলটি দিরাই থানা দখল করে, তালেব সেই দলে ছিলেন। পরে বালাট সাব-সেক্টরে সংযুক্ত হয়ে যুদ্ধ করতে থাকেন।  ২৭ নভেম্বর সীমান্তবর্তী মংগলকাটা গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটিতে পাকিস্তান আর্মি আক্রমন করলে তালেব সহ একটি দল চলতি নদীর বালুচরে গিয়ে ডিফেন্স নেন। এখানেই পাকিস্তান আর্মির হাতে ধরা পড়েন তালেব ও তার সহযোগী একজন চা বাগান শ্রমিক। সুনামগঞ্জ শহরে নিয়ে এসে তাকে প্রচণ্ড নির্যাতন করা হয় সুনামগঞ্জ স্কুলের সামনে জনসভা করে তাকে দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়।

৬ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মিলিত আক্রমনে সুনামগঞ্জ শহর থেকে পাকিস্তান আর্মি পালিয়ে যাবার সময় তালেব, তার সহযোগী চাবাগান শ্রমিক এবং আরেকজন মুক্তিযোদ্ধা কৃপেন্দ্রকে আহসানমারা ফেরীর কাছে গুলী করে হত্যা করে। পরে তাদের লাশ উদ্ধার করে একই কবরে দাফন করা হয়।

আলমাছ আলী ও আব্দুল করিম সেইদিনের স্মৃতিচারন করেন। পাকিস্তান আর্মি চলে যাবার পর তিনজনের লাশ উত্তোলন হলো, জানাজা হলো, একই কবরে তাদেরকে শুয়ে দেয়া হলো চিরদিনের জন্য- একজন আবু তালেব, একজন কৃপেন্দ্র দাস, আরেকজনের নাম অজ্ঞাত। এই প্রায় বৃদ্ধ দুজন মানুষের এসব মনে আছে কিন্তু কবরস্থানের পাশ ফুটবল খেলছিলো, গেটে দাঁড়িয়ে বিড়ি ফুঁকছিলো যে কিশোরেরা  তারা এই মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মদানের কাহিনী কি জেনেছে? আমি নিশ্চিত হতে পারিনা।



ছবিঃ আবু তালেব, একজন কৃপেন্দ্র দাস ও অজ্ঞাত এক মুক্তিযোদ্ধার সমাধি

আহসানমারা ব্রীজ পেরিয়ে সোজা রাস্তা সুনামগঞ্জের দিকে। আমি বামের রাস্তা ধরি। এই রাস্তা চলে গেছে দিরাই। একটু এগিয়ে হাতের ডানে রাস্তা বাঁক নেয়- এখান থেকেই আরো ঘন্টা দেড়েক দূরত্বে আমার আজকের গন্তব্য- জামালগঞ্জ।  




ছবি: আহসানমারা ব্রীজ, সুনামগঞ্জ

আমি মুলতঃ দাসপার্টিকে খুঁজছি। দাসপার্টির জীবিত গেরিলাদের সাথে কথা বলা, যুদ্ধক্ষেত্রগুলো যথাসম্ভব দেখে নেয়াই আমার উদ্দেশ্য।  দাসপার্টির সদস্য ছিলেন ছয়ত্রিশের জনের মতো। এদের মধ্যে কয়েকজন  এসেছিলেন কিশোরগঞ্জ থেকে। জামালগঞ্জ-সাচনার যুদ্ধে কিশোরগঞ্জের সিরাজ শহিদ হলে এরা কিশোরগঞ্জের যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে যান। বাকিদের মধ্যে কয়েকজন তাহিরপুর-ধর্মপাশার, কয়েকজন দিরাই-শাল্লা-জগন্নাথপুরের  এবং বাকীরা আজমিরীগঞ্জের। জামালগঞ্জ থেকে ছিলেন একজন আয়ূব আলী। আয়ূব আলীর কথা আমাকে জানিয়েছিলেন সাংবাদিক সালেহ চৌধুরী, যিনি দিরাই শাল্লা অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সমন্বয়ক ছিলেন। ।
 
জামালগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাধারন সম্পাদক, সাবেক ছাত্রনেতা আকবর আমার ব্যক্তিগত বন্ধু। আকবর নিজে তার এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংগ্রহ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের পুর্নবাসনের কাজ করেন। দাসপার্টির গেরিলা যোদ্ধা আয়ূব আলীর খোঁজে তাই আকবরের সাথে যোগাযোগ করি। আকবর জানান- আয়ূব আলী মারা গেছেন গতবছর চরম দরিদ্র অবস্থায়। আহ! বড় দেরী হয়ে যায় সবকিছুতে।

দাসপার্টির আর কোন সদস্য জামালগঞ্জে না থাকলে ও জামালগঞ্জ-সাচনার যুদ্ধ ছিলো তাদের অন্যতম অপারেশন। ঐ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের আরো দুইটা গ্রুপ ছিলেন তাদের সাথে। সিদ্ধান্ত নেই- জামালগঞ্জ যাবো। জামালগঞ্জ গিয়ে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় সাড়ে এগারোটা। রোদ চড়া না কিন্তু অনেক গরম , সকালের স্নিগ্ধতা ফুরিয়েছে।


সুনামগঞ্জ থেকে সুরমা নদীর ভাটিতে জামালগঞ্জ। নদীর এপাড়ে উপজেলা সদর, ঐ পাড়ে বিখ্যাত সাচনা বাজার। সুনামগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা বজলুল মজিদ খসরুর  ‘রক্তাক্ত ৭১ সুনামগঞ্জ’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়ঃ- জুলাই মাসের প্রথম দিকে জামালগঞ্জ ও সাচনাবাজার এলাকায় পাকসেনারা ঢুকে বিরাট বিরাট পাকা বাংকার তৈরী করে শক্ত অবস্থান গড়ে এবং তান্ডব শুরু করে। হিন্দু প্রধান গ্রামগুলো ভস্মীভুত করে। আওয়ামী লীগ ও হিন্দু  নিধনে পাক আর্মিকে সহযোগীতা করে তখনকার সবচেয়ে ধনাঢ্য ব্যক্তি পিডিপির লাল মিয়া। জয়কলসের সাত্তার রাজাকারের মতোই সে ও খুনী ডাকাতদের নিয়ে বাহিনী গড়ে তোলে, পাকবাহিনীর যাতায়াতের জন্য তার দুটো লঞ্চ দান করে। এই লাল মিয়া তার বাহিনী নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের একটা দলকে ঘেরাও করে সাতজন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে মাছ শিকারে বর্শা দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে।  মুক্তিযোদ্ধারা তার বাড়ি আক্রমন করে ধ্বংস করে দিলে ও সে প্রানে বেঁচে যায়। ’৭৫ এর পর এই লালমিয়া বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতা হিসেবে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়। সে মারা গেছে বছর কয়েক আগে কিন্তু তার এক ছেলে বর্তমানে জামালগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান, আরেক ছেলে জামালগঞ্জ সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। তার সম্মানে ‘লাল সাহেব’ নামে একটা যাত্রীবাহি লঞ্চ চলে সুনামগঞ্জ-জামালগঞ্জ নৌপথে।  


জুলাই মাসে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের নেতৃত্বে টেকেরঘাট সাব-সেক্টর গঠিত হলে সুরঞ্জিত সেন সহ অন্যান্য সংগঠক- এডভোকেট আলী ইউনুস, নজির হোসেন, হোসেন বখত ও ভারতীয় মেজর বাট সাব-সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা কমাণ্ডারদের নিয়ে জামালগঞ্জ থানা ও সাচনাবাজার আক্রমনের পরিকল্পনা গ্রহন করেন।

গুরুত্ব বিবেচনায় তিনটি দল নির্বাচিত হয়।  প্রথম দলে কমাণ্ডার ইপিআরের আব্দুল হাই, সেকেন্ড ইন কমান্ড সিরাজুল ইসলাম- এই দলের দায়িত্ব পড়ে সাচনাবাজারের বাংকারগুলো আক্রমন করা। জগতজ্যোতি ও তার সেকেন্ড ইন কমান্ড আলী আমজদের দায়িত্ব নেন অপর পাড়ে জামালগঞ্জ থানা সদরের বাংকারের দখল নেয়া। মোজাহিদ মিয়া ও ইব্রাহিম খলিলের নেতৃত্বে আরেকটি দল ব্যাক আপ পার্টি হিসেবে।

৭ আগষ্ট ছয়টি বড় নৌকা নিয়ে টেকেরঘাট থেকে  এসে তিনটি দল আক্রমন শুরু করে।  জগতজ্যোতির দল থানা আক্রমন করার সাথে পাকসেনারা দক্ষিন দিকে পালাতে থাকলে মোজাহিদ মিয়ার দলটির প্রতিরোধে এগোতে না পেরে দুর্লভপুর গ্রামের দিকে পালাতে থাকে।

একই সময় নদীর অপর পাড় সাচনা বাজারে আব্দুল হাই ও সিরাজের দল একের পর এক গ্রেনেড চার্জ  করতে করতে এগোতে থাকে। বাংকারের ভেতরে কিছু পাক আর্মি ও রাজাকার মারা যায়, অনেকগুলো পালাতে থাকে। পালাতে পালাতে বাজারের ভেতরের একটা বাংকারে সবগুলো জড়ো হয়। সিরাজ ক্রলিং করে এগিয়ে গিয়ে সেই বাংকারে গ্রেনেড চার্জ করেন কিন্তু ঐদিক থেকে ছুঁড়া একটা গুলি তার চোখ  ভেদ করে চলে যায়। পাকসেনা ও রাজাকারেরা পালিয়ে যায় আর অতিরিক্ত রক্তক্ষরনে ঐখানেই শহীদ হন সিরাজুল ইসলাম। এই যুদ্ধে পাকিস্তান আর্মি মারা যায় পয়ত্রিশ জন।  

সিরাজের লাশ সহযোদ্ধারা টেকেরঘাট সাব-সেক্টরের ফিরিয়ে নিয়ে দাফন করেন। টেকেরঘাটে এখনো সেই কবরটি আছে। সাচনা বাজারের নামকরন করা হয় ‘সিরাজ নগর’ যদি ও পরবর্তীতে তা আর টিকে থাকেনি। এই বিজয়কে ধরে রাখার জন্য সাব-সেক্টর থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল স্থায়ীভাবে এসে ঘাঁটি করে সাচনায়। আগষ্টের শেষের দিকে  পাকিস্তান আর্মির বিশাল একটা দল অনেক প্রস্তুতি  নিয়ে জামালগঞ্জ দখলের জন্য রওয়ানা দেয়। সেই সময়ের এই এলাকার অতি বিখ্যাত হুজুরে মাওলানা আমিনউদ্দীন ( শেয়খে কাতিয়া নামে পরিচিত) জোহরের নামাজের পর পাক আর্মির দলকে দোয়া দরুদ করে লঞ্চঘাট পর্যন্ত এগিয়ে দিলেও জামালগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধাদের হাত থেকে আর ছিনিয়ে নিতে পারেনি।

সিরাজ শহীদ হবার এক সপ্তাহ আগে তার বাবাকে চিঠি লিখেছিলেন। সেই চিঠি সহযোদ্ধাদের মারফত পৌঁছায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। সেখান থেকে নিয়মিত এই চিঠি পাঠ হতো মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করতে।

চিঠিটি ছিলো এরকমঃ
‘টেকেরঘাট হইতে’
তারিখঃ ৩০.০৭.৭১
প্রিয় আব্বাজান,
আমার ছালাম নিবেন। আশা করি খোদার কৃপায় ভালোই আছেন। বাড়ির সকলের কাছে আমার শ্রেনীমত ছালাম ও স্নেহ রহিলো। বর্তমানে যুদ্ধে আছি। আলী রাজা, রওশন, সাত্তার, রেণু, ইব্রাহিম, ফুলমিয়া সকলেই একত্রে আছি। দেশের জন্য আমরা সকলেই জান কোরবান করিয়াছি। আমাদের জন্য ও দেশ স্বাধীন হওয়ার জন্য দোয়া করিবেন। আমি জীবনকে তুচ্ছ মনে করি। কারন দেশ স্বাধীন না হলে জীবনের কোন মূল্য থাকিবেনা। তাই যুদ্ধকেই জীবনের পাথেয় হিসেবে নিলাম।  আমার অনুপস্থিতিতে মাকে কষ্ট দিলে আমি আপনাদেরকে ক্ষমা করিব না। পাগলের সব জ্বালা সহ্য করিতে হইবে, চাচা-মামাদের ও বড়ভাইদের নিকট আমার ছালাম। বড়ভাইকে চাকরিতে যোগ দিতে নিষেধ করিবেন। জীবনের চেয়ে চাকরী বড় নয়। দাদুকে দোয়া করিতে বলিবেন। মৃত্যুর মুখে আছি। যে কোন সমোয় মৃত্যু হইতে পারে এবং মৃত্যুর জন্য সর্বদা প্রস্তুত। দোয়া করিবেন মৃত্যু হইলে ও যেন দেশ স্বাধীন হয়। তখন দেখবেন লাখ লাখ ছেলে বাংলার বুকে পুত্রহারাকে বাবা বলে ডাকবে। এই ডাকের অপেক্ষায় থাকুন।
আর আমার জন্য চিন্তার কোন কারন নাই। আপনার দুই মেয়েকে পুরুষের মতো শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলবেন। তবেই আপনার সাধ মিটে যাবে। দেশবাসী স্বাধীন বাংলা কায়েমের জন্য জন্য দোয়া কর, মীরজাফরি করিওনা। কারন মুক্তিফৌজ তোমাদের ক্ষমা করিবেনা এবং বাংলায় তোমাদের জায়গা দিবেনা।
ছালাম, দেশবাসী ছালাম।
ইতি মো। সিরাজুল ইসলাম।


(চলবে...)

আপনার মন্তব্য

আলোচিত