নূরুল মোহাইমীন মিল্টন, কমলগঞ্জ

০৯ মে, ২০১৫ ২৩:৫৬

প্রভারাণী মালাকার: তিনি বীরাঙ্গনা, তাই একঘরে!

লোকে তাঁকে ব্যঙ্গ করে ডাকে পাঞ্জাবীর বউ, তাঁর ছেলের জন্ম পরিচয় নিয়ে খোঁচা দেয় এলাকাবাসী। দেশের জন্য সম্ভ্রম দিয়ে আজ স্বাধীন দেশেই প্রতিদিন সম্ভ্রমহানি ঘটছে প্রভারাণীর

নিজের জীর্ণ কুটিরের সামনে স্বপরিবারে প্রভারাণী। লোকে যাকে ব্যঙ্গ করে পাঞ্জাবীর বউ ডাকে

আপনাদের সাথে কথা বলে কি লাভ হবে? পত্রিকায় লিখলে সমাজে আমার দুর্ভাগ্যের কথা জেনে সবাই উপহাস করবে। এলাকার অনেক লোক আমাকে ব্যঙ্গ করে ডাকে পাঞ্জাবীর বউ বলে। কেউ কোন দিন খোঁজ করেনি কেমন আছি। ভাঙ্গা কুঁড়ে ঘরে থেকে দু'বেলা দু’মুঠো ভাতের জন্য গ্রামে গ্রামে ফেরী করে সংসার চালাই।

কথাগুলো বলছিলেন কমলগঞ্জের বীরাঙ্গনা মা প্রভারাণী মালাকার। প্রভারাণীর বর্তমানে ৬০ বছর বয়সেও গ্রামে গ্রামে বিস্কুট, চানাচুর, চকোলেট ফেরি করে পরিবার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। একমাত্র ছেলে কাজলকে এলাকার মানুষ খোঁচা দেয় পিতৃপরিচয় নিয়ে। মানুষ তাকে কাজ দেয় না। উপায়ান্তর না দেখে বাধ্য হয়ে রিক্সা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন কাজল। গ্রামে একঘরে হয়ে আছেন। রিং টয়লেটের জন্য আবেদন করে ইউনিয়ন পরিষদের আশ্বাস পেলে এখনো রিং টয়লেটটিও পাননি।

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তাকে মায়ের সামনে থেকে ধরে নিয়ে স্থানীয় রাজাকাররা তুলে দেয় পাকিস্তানী আর্মির হাতে। সে সময়ের ১৬ বছরের প্রভারাণী দুই বার রাজাকার ও পাঞ্জাবির হাতে গণধর্ষনের শিকার হন। তাঁর বাড়ি কমলগঞ্জ উপজেলার মুন্সীবাজার ইউনিয়নের মির্জানগর গ্রামে। স্বাধীনতা লাভের ৪৪ বছর পার হলেও সেই 'হতভাগ্য' মহিলার ভাগ্যে এখনও জুটেনি বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি, পাননি কোন সরকারী সাহায্য সহযোগীতা। স্থানীয় ভূমিখেকোদের কারণে দখল হয়ে যাচ্ছে স্বামীর রেখে যাওয়া শেষ ভিটেমাটিও।

কমলগঞ্জের মির্জানগর গ্রামে গিয়ে প্রভারাণী মালাকারের সাথে দেখা হলে তিনি কান্নাজড়িত কন্ঠে ৪৪ বছর আগের ভয়ঙ্কর স্মৃতিতে ফিরে যান- সঠিক দিন তারিখ তাঁর মনে নেই। বৈশাখ মাসে বিয়ে হয় আর শ্রাবণ মাসে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। তখন স্বামী কামিনী রাম মালাকার চলে যান ভারতে। তিনি (প্রভারাণী) চলে যান বাবার বাড়ী পাশ্ববর্তী গ্রাম বিক্রমকলসে। পনের দিন পর বিক্রম কলস গ্রামের দু’জন রাজাকার এক গোধুলী লগ্নে প্রভারাণীকে তাঁর মায়ের সামনে থেকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে যায় পাশ্ববর্তী বাদল মাষ্টারের বাড়ি। সে রাতে বাদল মাষ্টারের বাড়িতে অবস্থান নেয়া সেনা সদস্যদের লালসার শিকার হন প্রভারাণী।

পরদিন সকালে আর্মিরা তাঁকে ছেড়ে দিলে তিনি আশ্রয় নেন বোনের বাড়ী জাঙ্গাল হাটি গ্রামে। এরপর ২০/২৫ দিন পর রাজাকাররা আবার পেয়ে যায় তাঁর সন্ধান। শত চেষ্টা করেও তিনি তাদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারেননি। যে দিন রাজাকাররা জাঙ্গাল হাটি প্রভারানীর বোনের বাড়ী হানা দেয় তখন নিজেকে রক্ষার জন্য ধানের জমির আইলের নীচে আশ্রয় নেন, কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। রাজাকাররা আবার তাঁকে জোর করে ধরে নিয়ে আসে। তখন প্রভারাণীর বোন ও স্থানীয় নারায়ণক্ষেত গ্রামের গফুর মিয়া তাঁকে বাঁচাতে এগিয়ে আসলে রাজাকারদের হাতে তাদেরকেও নির্যাতনের শিকার হতে হয়।

এক সময় প্রভারাণীকে নিয়ে আসা হয় শমশেরনগর ডাক বাংলোয়। যেখানে ছিল পাকিস্তানী আর্মিদের ক্যাম্প। সারা রাত পাকিস্তানী আর্মিরা তাঁকে পর্যায়ক্রমে ধর্ষণ করে। নিজেকে বাঁচানোর সকল চেষ্টা করেও তিনি রক্ষা পাননি। অনেক কাকুতি-মিনতি করেছিলেন আর্মিদের নিকট কিন্তু কোন লাভ হয়নি। এক সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। সারা রাত নির্যাতনের পর সবাই চলে গেলে তিনি এক সময় কোন রকম হেঁটে হেঁটে আবার নিজের বোনের বাড়ি চলে যান।

প্রভারাণী জানান, দেশ স্বাধীন হবার এক বছর পর তাঁর ছেলের জন্ম হয়। কিন্তু সেই ছেলেকে নরপশুরা পাঞ্জাবির ছেলে হিসেবে ডাকে। আক্ষেপ করে প্রভারাণী বলেন, এলাকার মানুষের নিকট মুখ দেখানো যায় না। সুদীর্ঘ ৪৪ বছরেও বীরাঙ্গনার সেই স্বীকৃতি তিনি আজও আদায় করে নিতে পারেননি।

উপরন্তু নানা হয়রানি, মামলা ও কটূক্তি সহ্য করে চলেছেন। সে সময় তাঁর ইজ্জত লুণ্ঠনকারী দলের নজির, ইন্তাজ, ইদ্রিছ, রইছ পরবর্তীতে জেল খাটে। জেল থেকে বের হয়ে কমলগঞ্জ উপজেলার শমশেরনগরের ইদ্রিছ মিয়া প্রভারাণীর স্বামীর উপর মিথ্যা মামলা দেয়। যে কারনে তাঁর স্বামীকে জেল কাটতে হয়। কয়েক বছর পর প্রভারাণীর স্বামী মারা যান।

স্বামী মারা যাওয়ার পর দু’বেলা দু’মুঠো ভাত খাওয়ার জন্য প্রভারাণী বেছে নেন ফেরী করার কাজ। এক সময় তাঁর ছেলে কাজল মালাকার বিয়ে করে। বর্তমানে তার ৬ মেয়েসহ ৯ সদস্য বিশিষ্ট পরিবারে একবার খেলে আরেক বার না খেয়ে থাকতে হয়।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কমলগঞ্জ ইউএনও জাহিদুল ইসলাম মিঞা জানান, প্রভারাণীর ব্যাপারে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে কথা বলছেন। এছাড়াও জয়িতায় প্রভারাণীর নাম পাঠিয়েছেন।

কমলগঞ্জ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার ও মুন্সীবাজার ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল মোতালিব তরপদার জানান, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের মাধ্যমে প্রভারাণীর সকল তথ্যাদি সংশ্লিষ্ট দপ্তরে প্রেরণ করা হয়েছে। বর্তমান মহাজোট সরকার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষা ও স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরঙ্গনা ও শহীদ পরিবারের যে সকল তথ্য অন্তর্ভুক্ত হয়নি, সেসব তথ্যের জন্য কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। আশা করি রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রভারাণী অচিরেই বীরঙ্গনার স্বীকৃতি পাবেন।

ইতিমধ্যে প্রভারাণী মালাকারকে বিধবা ভাতার জন্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বলে উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা সরজিত কুমার পাল জানিয়েছেন।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত