শামস শামীম

২৫ জুন, ২০১৭ ২০:৪৪

একাত্তরের অশ্রুত আখ্যান: প্রেক্ষিত ‘চোরাপল্লী’ কামারগাঁও

‘মুক্তিযুদ্ধ আমরা খরছি। আমরার বউরা মুক্তিরে রাইন্দ্যা খাবাইছে। ঘর বাড়ি জ্বালাইছে আমরার। বাল-বাচ্চারে গুলি কইরা মারছে আলী রেজা রাজাকার। আমরার বউ-ঝিরে ধইরা লইয়া গ্যাছে। এখন আমরারে কেউ চিনেনা। মুক্তির স্বীকৃতি দেয়না। রাজাকার অইযায় মুক্তিযোদ্ধা। আমরার কেউ নাই। হকলে আমরারে ঘৃণা করে। আমরার মুক্তিযুদ্ধের কথা কয়না।’

গত ১৭ জুন নিজের বস্তিরূপী একচালা টিনের খুপরি ঘরে বসে শাল্লা উপজেলার চোরাপল্লী খ্যাত কামারগাঁওয়ের কালু মিয়া (৬৫) ক্ষোভ ও যন্ত্রণায় ফুসতে ফুসতে একা একাই বলছিলেন এসব কথা। আমি তখন এই গ্রামে অন্য বিষয় নিয়ে কাজ করছিলাম। চোখ কান খোলা রেখে সাংবাদিকদের সতর্ক থাকতে হয়; তাই একদিকে চোখ আরেক দিকে কান পেতে কাজ করছিলাম। ঠিক এমন সময়ই তার হৃদয় রেখাপাত করা কথাগুলো কানে বাজে। দ্রুত নির্ধারিত কাজ ফেলে তার কাছে ছুটে আসি। শুনি একাত্তরের মর্মন্তুদ অশ্রুত আখ্যান। নিজের প্রতি করুণা হয়, আরও একাধিকবার গ্রামটিতে গেলেও বাংলাদেশের জন্মযুদ্ধের এই বিষয়টির খোঁজ নেইনি। নাকি আমিও এই সমাজের বাসিন্দা বলে তাদের অসামান্য অবদানকে অস্বীকার করতে চাই!

কালু মিয়ার অবয়ব জুড়ে অভাবের ছাপ। ক্ষুধা, সামাজিক বঞ্চনা ও স্বীকৃতিহীনতার কারণে সারাদিন নিজের খুপরি ঘরে বসে আবোলতাবোল বকেন। এই বকাবকির বেশিরভাগই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ সংশ্লিষ্ট। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রস্তুতি থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ শেষ পর্যন্ত ওতপ্রোতভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে ছিলেন কামারগাঁও গ্রামের অকুতোভয় ৩০-৪০ জন তরুণ। গ্রাম পুড়েছে। নারীরা সম্ভ্রম হারিয়েছে। রাজাকারদের হাতে শহিদ হয়েছে ৫ জন। এতকিছুর পরও একাত্তরের অসামান্য অবদান চাপা পড়ে আছে ৪৭ বছর ধরে। কালু মিয়ার মতো কয়েকজন এ নিয়ে কথা বললেও ভদ্রজন এটাকে ‘আবোলতাবোল’ বলে পাশ কাটিয়ে যান।

দূর থেকে তার কথা শুনে কাজ ফেলে ছুটে আসি খুপরি ঘরে। ১০ ফুট বাই ১০ ফুট ঘর। বাঁশের খুঁটি দিয়ে চৌকি বানিয়েছেন। চৌকির উপরে তিনি আর তার স্ত্রী থাকেন। নিচে স্ত্রী সন্তান নিয়ে থাকে তার ছেলে হাবিবুর। এভাবেই গ্রামের ৩২টি ঘরে গাদাগাদি করে থাকেন সবাই। খুপরি ঘরের চৌকিতে শুয়ে শুয়ে বকছেন তিনি। আমাকে বসানোর জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলেন। বসতে দেওয়ার কোন উপকরণ ঘরে নাই বুঝতে পেরে আমি সালাম দিয়ে দাড়িয়েই কথা বলতে শুরু করি। তাঁর মুখেই শুনি গ্রামবাসীর মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের কথা। নারী নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, হত্যা-ধর্ষণের কথা। শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসে। চোখ ভিজে জল আসে আমার। যে কাজের জন্য গিয়েছিলাম সেটি বাদ দিয়ে সিদ্ধান্ত নেই এই গ্রাম নিয়েই 'একাত্তরের অশ্রুত আখ্যান' লেখব। প্রায় ঘণ্টা দুয়েক আলাপে মোটামুটি গ্রামবাসীর মুক্তিযুদ্ধের অজানা কাহিনী জানতে পারি।

১৯৯৬ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে ভোটার তালিকায় পেশা ‘চুরি’ উল্লেখ করে জাতীয়-আন্তর্জাতিক আলোচনায় আসে সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার কামারগাঁওসহ কয়েকটি কথিত চোরাপল্লীর বাসিন্দারা। ‘চোরের গাও’ খ্যাত অন্যান্য পল্লী নানাভাবে সরকারি-বেসরকারি সহায়তায় জীবন-মানের উন্নয়ন ঘটালেও অবহেলা, বঞ্চনা আর সামাজিক ঘৃণা নিয়েই দিনাতিপাত করছে এই গ্রামের বাসিন্দারা। গ্রামে ৩২টি খুপরি ঘরে বাস করে অন্তত ৯২ পরিবার। আরও চারটি পরিবার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি কক্ষে গাদাগাদি করে বসবাস করে।

অন্য গ্রামের মতো এই গ্রামবাসী সরকারি সুযোগ সুবিধা পায়না। গ্রামের চারটি নলকূপের তিনটিই নষ্ট। একটিও স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা নেই। ১৯৩৭ সালে প্রতিষ্ঠিত প্রাথমিক বিদ্যালয়টিও অবহেলায়। টিনসেডের মসজিদটিও জীর্ণদশায়। বিনোদনের জন্য গ্রামে একটিও টিভি নেই। এলাকার লোকজন রসিয়ে রসিয়ে অবহেলিত গ্রামবাসীর চুরির গল্প করলেও কখনো স্বাধীনতাযুদ্ধে তাদের অসামান্য অবদান স্বীকার করেনা।

এবার মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইকালে গ্রামের নির্যাতিত নারী-পুরুষসহ যারা মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রেখেছিলেন জীবিত এমন চারজন স্বীকৃতির জন্য আবেদন করেছিলেন। কিন্তু সামাজিক সেই ঘৃণার কারণেই বাদ পড়েছে তারা তালিকা থেকে। কেউ তাকায়নি তাদের দিকে।

আমি যখন তার কাছে এই বিষয়টি নিয়ে শোনতে চাই তখন তিনি বেকে বসেন। শুনে কি হবে, আমি কি তাদের জন্য কিছু করার ক্ষমতা রাখি-এমন প্রশ্ন ছুড়েন। তার দীর্ঘদিনের বঞ্চনা, অপমানের ক্ষোভ লক্ষ্য করি। ধিরে ধিরে শান্ত হন তিনি। খুলতে থাকেন কথার ঝাঁপি। একাত্তরের চাপাপড়া ইতিহাস ক্রমেই বেরিয়ে আসে তার মুখ থেকে। একটু পরপরই থুথু ফেলেন ঘর থেকে। এর বাতাস আমার উপরেও এসে লাগে। তার এই থুথু বুঝি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ব্যবসাকারী বা সামাজিকভাবে তাদের ঘৃণার পাত্র করে যারা রেখেছে তাদের প্রতি! এই সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে তার থুথুর ছিটা গায়ে নিয়েই আমি আমার দেশের জন্মযুদ্ধের কথা শোনতে থাকি। আহ! কি মর্মন্তুদ, হৃদয় বিদারক!

ভূগোলে গ্রামটি সুনামগঞ্জ জেলার অন্তর্ভুক্ত হলেও পাশেই হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলার মানচিত্র। শুধু মামলা সংক্রান্ত কাজ ছাড়া বাদবাকি জীবন পরিচালনার সব কাজ গ্রামবাসীকে এই তিন জেলার নিকটবর্তী উপজেলা সদরে গিয়েই সম্পন্ন করতে হয়। একাত্তরে হাওরাঞ্চলের সংখ্যালঘু অধ্যুষিত গ্রামে রাজাকাররা লুটপাট করলেও এই কথিত চোরের গ্রামের লোকজন তখন পাহারা দিয়েছেন বিভিন্ন গ্রাম। এই সময়ের জন্য, মানুষের বিপদের সময়ে তারা উত্তরাধিকারী সূত্রে পাওয়া এই চৌর্যবৃত্তি কেবল ছেড়েই দেননি মুক্তিযোদ্ধাদের সপরিবারে সহায়তা করেছেন।

এবার স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর গ্রামের কালু মিয়া, গিয়াস উদ্দিন, জুনাব আলী ও শহিদ মিয়া স্বীকৃতির জন্য আবেদন করেও পরাজিত হয়েছেন।

মুক্তিযোদ্ধার নৌকার বাইছাল:
১৯৭১। তখন বর্ষা মাস। উত্তাল হাওর। ক্ষণে ক্ষণে আফাল উঠে। তুমুল যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ছে হাওরে। দাস পার্টির কমান্ডার জগৎজ্যোতি, আঞ্চলিক কমান্ডার (হাওরাঞ্চল) সালেহ চৌধুরী, দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা সুকুমার দাস দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন হাওর এলাকা। কখনো সফল, কখনো বিফল হচ্ছেন তারা। ঠিক এমন সময়েই সালেহ চৌধুরী, হাফিজ উদ্দিন, মন্নান চৌধুরী, সুকুমার দাসসহ মুক্তিযোদ্ধারা কামারগাঁও গ্রামে আসেন। গ্রামবাসীকে জড়ো করে আসার উদ্দেশ্য বর্ণনা করেন।

যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরুর পর থেকেই কামারগাঁওবাসীর অবস্থান দেশের পক্ষে থাকায় আগত মুক্তিযোদ্ধারা তাদের সহজেই বুঝাতে সক্ষম হন। একটি নিষিদ্ধ পেশার প্রতি তাদের আকর্ষণ বলেই মুক্তিযোদ্ধা সন্তর্পণে নৌকা বাওয়ার জন্য তাদের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। কারণ হাওরের মানচিত্র এই গ্রামের পুরুষদের নখদর্পণে। নৌকা এমনভাবে বাইতে পারেন যে কাকপক্ষীটিও টের পায়না। এ কারণেই সফল অপারেশন পরিচালনার জন্য মূলত নৌকার ‘বাইছাল’ (কাণ্ডারি) সংগ্রহের জন্য এসেছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা।

গ্রামবাসী সাদরে মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রহণ করেন। শপথ করেন দেশের পক্ষেই থাকবেন। গ্রামের মোড়লরা বিভিন্ন স্থান থেকে নিয়ে আসা ৫টি নৌকা তাৎক্ষণিক দান করেন মুক্তিযোদ্ধাদের। এতে মুক্তিযোদ্ধারা খুশি হন। সাহসী ও সচেতন ৩০-৪০ জন তরুণদের হাওরাঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের নৌকা বাওয়ার জন্য তালিকাভুক্ত করেন। পাশাপাশি দুর্গম ও চার জেলার মোহনার গ্রাম হিসেবে অনেকটা নিরাপদ বলে সময়ে-অসময়ে মুক্তিযোদ্ধারা এখানে আশ্রয় ও বিশ্রাম নিবেন বলে সিদ্ধান্ত হয়। পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধাদের ‘ঘাঁটি’ হিসেবে পরিচিতি পায় গ্রামটি। গ্রামের লেছু মিয়া সরদার, লেবু মিয়া, তাজু মিয়া, আল মাছ মিয়াসহ ৫ জন মুক্তিযোদ্ধাদের বহন ও যাতায়াতের জন্য ৫টি নৌকা দান করেন। এবং তারা নিজেরাও বাইছাল হিসেবে থাকার সিদ্ধান্ত নেন, যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত তারা মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ছিলেন। এছাড়াও বাইছাল হিসেবে কালু মিয়া, মজর উদ্দিন, গিয়াস উদ্দিন, আজমান আলী, জয়নাল মিয়া, মুসলিম উদ্দিন, জুনাব আলী, শহিদ মিয়া, কেরামত আলী, জলা মিয়া, জালাল মিয়া, নূর মিয়া, আফাই মিয়া, এলমদর মিয়াসহ গ্রামের অন্তত ৩০-৪০জন যুবক নিয়মিত কাজ করেছেন।

গ্রামের তরুণরা মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দুর্গম এলাকা পাড়ি দিয়েছেন। রাজাকারদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের মুখোমুখি সংঘর্ষের সময়েও কাণ্ডারি হিসেবে সাহসের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন অনেকে। নৌকার বাইছালরা এসময় মুক্তিযোদ্ধাদের মুখে হাওরাঞ্চলের দুর্ধর্ষ ও অসম সাহসী মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি দাশের গল্প শোনেছেন। জীবিতরা এখনো তার নাম মনে রেখেছেন শ্রদ্ধায়। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের বন্দুক, গুলিও বহন করেছেন। এখনো মুক্তিযোদ্ধাদের সহকারি গিয়াস উদ্দিন মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতির সঙ্গে ঘুঙ্গিয়ার গাঁওয়ের স্মৃতিচারণ করেন। গোবিন্দপুরের মুক্তিযোদ্ধা সুকুমার বাবু, সাউদেরশ্রী গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা প্রিয়লাল, দেবেন্দ্র, আপন, দুলালের নাম তার মনে রয়েছে। তাদের সঙ্গে বিভিন্ন সম্মুখযুদ্ধে নৌকা নিয়ে তিনি ছিলেন অতন্দ্র।

নারীরা রেঁধে খাইয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের:
শুধু যে গ্রামের যুবকেরা নাও বাওয়ার কাজ করেছে তাই নয়। তাদের বধূরাও মুক্তিযোদ্ধাদের রান্নাবান্না করে খাইয়েছেন। এখনো রান্নার চিহ্ন ৭-৮টি চুলার আলামত দেখতে পাওয়া যায় মজর আলীর খুপরি ঘরের সামনে। মাটি পুড়ে যাওয়া গোলাকার ক্ষত হিসেবে সেই চিহ্ন বহন করছে চুলাগুলো।

মুক্তিযোদ্ধাদের রান্না করে খাওয়ানোর জন্য নারীদের যে টিম গঠন করা হয়েছিল তাতে নেতৃত্ব দিনে মজর আলীর স্ত্রী ললিতা বেগম। এছাড়াও আফজল বিবি, মাস্টরের মা, মন বিবিসহ অনেক নারী এই রান্নাবান্নার কাজ করতেন। প্রায় প্রতিদিনই তাদের রান্না করে খাওয়াতে হতো মুক্তিযোদ্ধাদের। একাজে কখনো ক্লান্তিবোধ করেননি তারা। প্রায় আড়াই থেকে তিন মাস বর্ষাকালীন সময়টা গ্রামের নারীরা মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করেন। এই নারীদের মধ্যে অনেকেই মারা গেছেন। জীবিত আছেন দুই তিনজন। অন্যরা গ্রাম ছেড়ে চলে গেছেন।

ললিতা বেগম সারি সারি চুলা দেখিয়ে বলেন, ‘কিতা কইয়াম বাজান। আমরার গেরাম আছিল মুক্তির ঘাটি। তারারে রাইন্দা খাবাইতাম। নাও বুঝাও দিয়া মুক্তির দল আইয়া খাইতো। রাতদিন খাবাইতাম। আমরার কষ্ট অইতো। কিন্তু বুঝতাম দিতামনা। ছোডো ছোডো ছেলে-পুলের মুখ দেইখ্যা মায়া লাগতো’।

তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসার আগে তিনি জানালেন তার স্বামী মজর আলী স্বীকৃতির জন্য এবার চেষ্টা করেছিলেন। দায়িত্বপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের অসহযোগিতা ও অনৈতিক আবদারের কারণে আবেদনই করেননি তিনি। এই নারী আমার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে জানতে চান-‘বাজান আমি মুক্তির লাগি পোয়া ( ছেলে) কোয়াইলাম। আমার কুন্তা অইবনি। ভাঙ্গা ছাপড়া ঘর আর বাইরের সরকারি খাস জমিয়ে দেখিয়ে বলেন, ‘আমরারে ইতা দিবনি’।

চতুর নাগরিক জীবন রপ্ত করা আমি তাঁর এই প্রশ্নের উত্তরে কৌশলে সান্ত্বনা দিয়ে পালিয়ে আসি। এমন পরিস্থিতিতে আমি বরাবরই পলায়নপর! আমারতো সাধ সাধ্য কোনটাই নাই; বলা হয়না সে কথা এই মুক্তি নারীকে।

শহিদ হয়েছেন যারা:
হবিগঞ্জ জেলার রাজাকার আলী রেজা তার সোর্সের মাধ্যমে খবর পেয়েছিল কামারগাঁওয়ে মুক্তিযোদ্ধারা অবাধে যাতায়াত করে বিভিন্ন স্থানে অপারেশন পরিচালনা করছে। তাই মনে মনে সে স্থানীয় রাজাকারদের খবর দিয়ে তাদের অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে কামারগাঁও গ্রামে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়। গ্রামবাসী দিন তারিখ ঠিক মনে করতে না পারলেও জানান বিজয়ের ২/৩দিন আগে এক সকালে গ্রামের তিনদিক থেকে অতর্কিত আক্রমণ চালায় রাজাকাররা। গ্রামের পশ্চিম উত্তরের দিক বাদে তিনদিকেই তুমুল আক্রমণ করে।

এইদিন মুক্তিবাহিনীও গ্রামটিতে ছিলোনা। ফলে প্রতিরোধ করার কোন সুযোগই ছিলনা গ্রামবাসীর। গ্রামের সাহসি পুরুষেরাও ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের বহনকারী নৌকার সঙ্গে। হাওরে তিনদিকে নৌকা রেখে রাজাকার বাহিনী গুলিবৃষ্টি শুরু করে। কোন প্রতিরোধ না আসায় ধিরে ধিরে গ্রামে নৌকা লাগায়। নৌকা থেকে নেমেই গ্রামে আগুন দিতে শুরু করে। আগুনের তাপে ঘর থেকে বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে বের হতে থাকেন নারীরা। দিগ্বিদিক ছুটাছুটি করেন।

ওই সময় রাজাকারের গুলিতে মজর আলীর কিশোর ছেলে আলী হোসেন মারা যান। অন্যদের মধ্যে ইন্তাজ আলী, মিয়াফর আলী, মধু মিয়া ও মোজাফফরের মা শহিদ হন। শহিদ স্বজনদের রেখে ছোট খাল ধরে শ্রিহাইলের দিকে পালিয়ে যান অনেক নারী পুরুষ। লুট করে নিয়ে যায় তাদের সহায় সম্বল। পালিয়ে যাওয়াদের অনেকেই রাজাকারের গুলিতে আহন হন। রাজাকারদের সঙ্গে স্থানীয় স্বাধীনতা বিরোধী গোষ্ঠীও এই সুযোগে ‘চোর’র শায়েস্তা করতে সহযোগিতা করে। শুধু কামারগাঁওই নয় পার্শ্ববর্তী গোবিন্দপুর, রৌয়া গ্রামেও অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে আলী রেজার রাজাকার বাহিনী।

ধরে নিয়ে যায় ২০ নারীকে:
গ্রামে অতর্কিত আক্রমণ ও আগুনে জ্বালিয়ে দিয়েই রাজাকার বাহিনী ক্ষান্ত হয়নি। আদিম উন্মত্ততায় মেতে ওঠতে বাছাই করে করে অন্তত ২০জন নারীকে খোঁজে বের করে। প্রকাশ্যে তাদের অনেককে নির্যাতন করে। পরে নৌকায় তুলে পার্শ্ববর্তী ধামপুর গ্রামে নিয়ে যায়। সেখানে ৩-৪ দিন রেখে অমানুষিক নির্যাতন শেষে ছেড়ে দেয় তাদের। অন্যান্য এলাকায় একাত্তরের নির্যাতিত নারীরা যখন সম্ভ্রম খুইয়ে আত্মীয়-স্বজনদের মুখ দেখানোর ভয়ে আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন তখন বিজয়ের পর কামারগাঁওয়ের নির্যাতিত নারীদের পাশে দাঁড়ান স্বজনরা। তারা সম্ভ্রমহারা মা বোনের পাশে দাঁড়ান। নিজের বধূটিকেও কাছে তুলে নেন স্বামী। দুঃসময়ে ছেড়ে দেননি তাদের।  

ওইদিন রাজাকাররা গ্রামের নূরজান বিবি, ফরজান বিবি, সজিবা বেগম, মন বিবি, কুলসুম বিবি, আফজল বিবি, শহীদের মাসহ অন্তত ২০জন নারীকে ধরে নিয়ে যায়। ধামপুর গ্রামে পালাক্রমে তাদের উপর নির্যাতন করে রাজাকারের দল। বিজয়ের পর গ্রাম থেকে বিবস্ত্র, রক্তাক্ত দেহের এসব নারীদের উদ্ধার করেন মুক্তিযোদ্ধারা। নির্যাতিতদের মধ্যে অধিকাংশই মারা গেছেন। ২-৩ জন বেঁচে আছেন। তারা এখন কামারগাঁও গ্রামে থাকেননা। অন্যত্র পরিবার নিয়ে বসবাস করেন।

প্রত্যক্ষদর্শী ও বাইছালদের কথা:
গিয়াস উদ্দিন (৬৫) যৌবনে ছিলেন দুরন্ত সাহসি। মুক্তিযোদ্ধাদের নৌকা বহনে টানা ৩ মাসের মতো কাজ করেন বিশ্বস্ততার সাথে। যোদ্ধাদের নিয়ে অনেক স্মৃতি রয়েছে তার। বহন করেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের মেশিনগান ও ম্যাগাজিন। কয়েকটি সম্মুখযুদ্ধেও মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগি ছিলেন তিনি। ঘনিষ্ঠতা ছিল শহিদ জগৎজ্যোতি দাসের সাথে। ঘুঙ্গিয়ারগাঁও থানা আক্রমণের সময় জগৎজ্যোতির সাহস দেখছেন তিনি।

গিয়াস উদ্দিন বলেন, আমাদের গ্রামের চারজন এ বছর মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় যাচাই-বাছাইয়ের জন্য আবেদন করেছিলাম। মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি আমাদের ভূমিকার কথা সবাই জানলেও স্বীকার করতে চায়না। অথচ আমরা স্বজন হারিয়েছি। আমাদের নারীদের ধরে নিয়ে গিয়ে সম্ভ্রম কেড়ে নেওয়া হয়েছে। আমাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখনো চোর বলে আমাদের ঘৃণা করা হয়। আমাদের লোকদের লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করে মামলা-হামলায় জড়ানো হয়।

কালু মিয়া বলেন, ‘মুক্তির ঘাঁটি আমরার কামার গাঁও। আমরার ঝিরে-বউরে ধইরা নিয়া গেছে। নির্যাতন করছে। মুক্তিরে লগে গিয়া অকুল হাওরে বিপদে পড়ছি। 'উফ' শব্দটি করিনি। যদি রেজাকাররা ঠার পাইলায়। মুক্তির লাগি আমরা সবতা কোয়াইলাম, কুন্তা পাইলামনা।’

মুক্তিযোদ্ধাদের নৌকা বহনকারী তৎকালীন কিশোর শহিদুল মিয়া। তার মা আফজল বিবি মুক্তিযোদ্ধাদের রেঁধে-বেড়ে খাইয়েছেন। পরে রাজাকাররা তার মাকে তুলে নিয়ে যায়। এখনো সেই দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছেন তিনি।

শহিদুল মিয়া বলেন, আমার পরিবারের অনেক অবদান রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে। কোন অবদানের স্বীকৃতি পাইনি। এবার সেই স্বীকৃতির জন্য আবেদন করেও ব্যর্থ হয়েছি। কেউ সহযোগিতা করেনি। আমাদের কথা কানে তুলেনি। সবাই এখনো আমাদের অন্য চোখে দেখে। কোন ধরনের সহায়তা করতে চায়না।

পথহারানোর কথকতা:
১৭ জুন। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি মাথায় নিয়েই হাওরের উত্তাল ঢেউয়ের মধ্যে গুঙ্গিয়ারগাঁও উপজেলা সদর থেকে আমরা রওয়ানা দিয়েছিলাম কামারগাঁও গ্রামে। বেলা ১১টায় পৌঁছে যাই। গিয়েই বর্ষণের মুখোমুখি হই। গাছপালাহীন বিরান গ্রামটি বর্ষায় সতেজ হওয়ার চেষ্টা করছে। চারদিকে হাওর। থৈ থৈ জল, ঢেউ আছড়ে পড়ছে গ্রামে। খুপরি ঘরগুলোতে ঠাসাঠাসি বসে আছে গ্রামের বিভিন্ন বয়সের নারী পুরুষ। আমাদের দেখেই হল্লা করে ছোটো ছোটো ছেলে মেয়ে বেরিয়ে পড়ে। অভুক্ত, মলিন, হাড্ডিসার চেহারা একেক জনের। বঞ্চনা আর অপমানের দ্রোহে বেড়ে ওঠছে তারা। মাঝি ছুরত আলী সাবধান করে দিলো জিনিষপত্র খোয়ানোর শতভাগ আশঙ্কা আছে। আমাদের সঙ্গে শাল্লা উপজেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি ও স্থানীয় যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক পিসি দাস ছিলেন। এই গ্রামের অনেকেই তার পরিচিত। আরও দু’একবার যাওয়ায় আমারও কয়েকজন পরিচিত ছিল। তাই তাদের ঘরেই গিয়ে বসলাম। গল্প জুড়ালাম। এর ফাঁকে ফাঁকে কাজ করতে গিয়েই মুক্তিযুদ্ধের চাপাপড়া ইতিহাসের সন্ধান পাই।

সাধারণত বিকেল সাড়ে ৫টার পরই কামারগাঁও গ্রামে ঘুঙ্গিয়ারগাঁও থেকে যাত্রীবাহী নৌকা আসা বন্ধ হয়ে যায়। সাহস করে আমরা রাত ৮টায় রওয়ানা দেই রাতের অন্ধকার ও দুর্গম হাওরের বুক চিরে। বিকেলে চলে আসব জেনে মাঝি ছুরত আলী টর্চলাইট নেয়নি। গন্তব্যে আসতে পথ হারাতে পারি এই আশঙ্কা করে গ্রামের আব্দুল আলী তার টর্চ লাইটটি পিসি দাকে দেন। ব্যাটারি চালিত লাইটের আলোয় আমরা গন্তব্যের দিকে ছুটলাম। কিছুক্ষণ আসার পরই মাঝি ছুরত আলী বিশাল হাওরে পথ হারিয়ে ফেলেন। আমি পথ হারানোর অনুমান করে পিসি দাকে ডাক দিই। তিনি নৌকার ভিতর থেকে ছুটে এসে মাঝিকে ধমক দিয়ে নিজেই কাণ্ডারি ধরেন। এবার নৌকা চলছে ঠিক গন্তব্যে; চোরের গাঁওয়ের মানুষের লাইটের আলোয় খুঁজছি পথ...।

গ্রামের পশ্চিমে খলচরিবন্দ হাওর, পূর্বে কান্দা ও দাড়াইবিল। উত্তরে রৌয়ার বন্দ, দক্ষিণে আবদারবন্দ হাওর। এই বর্ষায় এখন এই হাওর-কান্দার কোন চিহ্নই নেই। সবদিক অবিকল এক। বিস্তৃত জলের কান্তার।

উত্তাল হাওর। ঢেউ উঠছে ক্ষণে ক্ষণে, দোলছে নাও। এলোমেলো বাতাস শিষ কাটছে কানে। সহযাত্রীদের মধ্যে মৌ আপা ও রাজন ভাই নৌকার আগায় বসে আছেন। রাতের অন্ধকারে দূরের দ্বীপগ্রাম থেকে আলো দেখা যাচ্ছে। মাঝে-মধ্যে টহল দিচ্ছে জলমহালের ইজারাদারের প্রহরী। খবরদার-হুশিয়ার করছে।

আমার মন তখনো কামার গাঁওয়ে। কানে বাজছেই কালু মিয়ার যন্ত্রণার কথা; ‘আমরা মুক্তিরে খাওয়াইলাম, নৌকা দিলাম, বউ-ঝির ইজ্জত হারাইলাম। আমরা কুন্তা পাইনা। রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধা অয়, তারার সন্তানরা সবতা পায়। একটা মুক্তির নাম আমরার গ্রামে দেয় নাই। হ্যারা আমরারে চোর ডাকাইত ডাকে’।

হঠাৎ মাথার উপরের আকাশটা আরও মেঘঘন হয়। সম্পূর্ণ দৃষ্টির চত্বর থেকে দূরে চলে যায় কামারগাঁও। বজ্রবিদ্যুতে চোখরাঙানিতে নয়নে ভাসে কালু মিয়ার পাণ্ডুর মুখ।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত