সহুল আহমদ

১৭ আগস্ট, ২০১৭ ২৩:৫৬

মুক্তিযুদ্ধের সর্ববৃহৎ ডিজিটাল সংগ্রহশালা ‘মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ’

২০০৭ সাল। শুরু হলো এক ওয়েবসাইটের, বিষয় মুক্তিযুদ্ধ। আরও বিশাল করে ভাবলে মুক্তি সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ। শুরুটা হয়েছিল তারুণ্যের হাত ধরে। শুরুটা বাংলাদেশের প্রতি ভালোবাসা আর দেশজন্মের ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে। এরপর দিন যায়, আস্তে আস্তে সমৃদ্ধ হতে থাকে ওয়েবসাইট। সাধ্যের মধ্যে সংগ্রহ।

আরও কিছু হাত আসে, মাথাও আসে; সেখান থেকে চিন্তা। পরিসর হতে থাকে বিস্তৃত, সমৃদ্ধ হতে থাকে সংগ্রহশালা। ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধ আরও কিছু লোক জড়ো হন। ব্যক্তি উদ্যোগ রূপ নেয় সামষ্টিকে। চলে আসে তারুণ্যের অগ্নি-স্ফুলিঙ্গ গণজাগরণ। ওয়েবসাইটের বিস্তৃতি বাড়ল, এক এক করে অনেকের কাছে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। চলে গেল এক দশক। এই সময়ের মধ্যে ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ওই ওয়েবসাইট মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বড় সংগ্রহশালা। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক লেখক-গবেষকদের তথ্য, উপাত্ত সংগ্রহের বড় এক আশ্রয়।

‘মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ’ নামের এ ওয়েবসাইটে এই মুহূর্তে আছে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার গুরুত্বপূর্ণ দলিল, পত্রপত্রিকা, বই, তথ্যচিত্র, ভিডিও ফুটেজ, চলচ্চিত্র, অডিও, আলোকচিত্র, মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকাসহ বহুবিধ তথ্য উপাত্ত। গবেষণার কাজে ডিজিটাল এই সংগ্রহশালা দারুণ কাজে আসছে।

প্রায় ১৫ টেরাবাইট জায়গা নিয়ে গড়া সংগ্রহশালায় বাংলার পাশাপাশি রয়েছে ইংরেজি বিভাগ। ইংরেজি ভাষায় লেখা বই-প্রবন্ধ ইত্যাদি রাখা হয়েছে এই বিভাগে। ফলে আন্তর্জাতিক দুনিয়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে পড়তে পারছে, প্রয়োজনে ডাউনলোডও করতে পারছে।

আর্কাইভে আছে ৩০ ক্যাটাগরি, যেখানে আছে চিরায়ত বাঙলা, ’৪৭-পূর্ব বাঙলা, পাকিস্তান আমল। ভাষা আন্দোলন, ৫৪’র নির্বাচন, ছয় দফা, আগরতলা মামলা ও ’৬৯-এর অভ্যুত্থান। ’৭০-এর নির্বাচন ও অসহযোগ আন্দোলন, অপারেশন সার্চলাইট, স্বাধীনতার ঘোষণা, বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১, মুক্তিযুদ্ধ-মুক্তিযোদ্ধা ও যুদ্ধের ইতিহাস এবং বিশ্লেষণ। গণহত্যা-যুদ্ধাপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধী ও তাদের বিচার, যুদ্ধশিশু এবং মুক্তিযুদ্ধে নারী ও শিশু, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড, উদ্বাস্তু। বাঙালি, বিদেশীদের ভূমিকা ও দৃষ্টিভঙ্গি। সময়ক্রম এবং স্মৃতিকথা, শিল্প-সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, ব্যক্তি বিশেষের ভূমিকা, মুক্তিযোদ্ধাদের নামীয় তালিকা, স্বাধীন বাংলা বেতার। ৭১-পরবর্তী বাংলাদেশ, মৌলবাদ ও সংখ্যালঘু নির্যাতন, রাজনীতি, বিতর্ক ও ভিন্নমত, পাকিস্তান ও দোসরদের ভাষ্য। অর্থাৎ, মুক্তিযুদ্ধ ও এর আগে পরের ইতিহাসের মোটামুটি ধারাবাহিক একটি উপস্থাপনা। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নানা বিষয় তুলে ধরা হয়েছে এ আর্কাইভে।

‘মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ’ আসলে ইন্টারনেট ভিত্তিক একটা ডিজিটাল পাবলিক লাইব্রেরি যেখানে আপনি মুক্তিযুদ্ধের বই, দলিল, পত্রিকা, মুক্তিযোদ্ধাদের গেজেট, ডকুমেন্টারি, ভিডিও ফুটেজ, চলচ্চিত্র, অডিও ও আলোকচিত্র সবই বিনামূল্যে পাবেন। এই প্রজন্মের যারাই মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে চায় কিংবা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা করতে আগ্রহী তাদের কাছে এই আর্কাইভ এক সুবিশাল জ্ঞানের উৎস। মুক্তিযুদ্ধের এই ডকুমেন্টগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে বিভিন্ন সংগ্রাহক, ব্রিটিশ লাইব্রেরি, অ্যামেরিকান লাইব্রেরী অব কংগ্রেস, সুইডেন ও অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন লাইব্রেরী সহ দেশি বিদেশি বিভিন্ন আর্কাইভ থেকে।

এই আর্কাইভ কতটা উপকারী তার একটা নমুনা দেয়া যাক। মনে করেন আপনি ‘বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র’ পড়তে চান। এখন ১৫ খণ্ডের এই বিরাটকায় পুস্তকের দাম পড়বে প্রায় ১৭,০০০ টাকা। টাকার এই অঙ্কটা দেখে অনেকেই পিছিয়ে যাবেন নিশ্চিত, কিন্তু এই বইটা পিডিএফ আকারে পুরোটাই পাবেন আর্কাইভে, একেবারে বিনামূল্যে। পাশাপাশি, এমন অনেক দলিলপত্র পাওয়া যায় যেগুলো বর্তমানে দুষ্প্রাপ্য কিংবা। তাদের সংগ্রহে  আছে প্রায় প্রায় চার হাজার বই এবং এই সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়ছে। এছাড়া, তাদের সংগ্রহে আছে মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তী সময়ের উল্লেখযোগ্য ঘটনার পেপারকাটিং, শতাধিক ডকুমেন্টারি, সহস্রাধিক ভিডিও ফুটেজ, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রায় পাঁচ হাজার ছবি সহ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ডিজিটাইজড তথ্য।

পেছন ফিরে তাকালে দেখা যায়, 'বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ পাঠাগার ও গবেষণা কেন্দ্র' প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০৭ সালে, এবং এ নামেই কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকে। পরবর্তীতে ২০১৬ সালের মার্চ মাসে প্রতিষ্ঠানটি 'মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ ট্রাস্ট' নামে নিবন্ধিত হয়।

মুক্তিযুদ্ধ ও বিশুদ্ধ ইতিহাস চর্চার লক্ষ্যে 'মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ ট্রাস্ট' পাঁচটি উদ্যোগ গ্রহণ করে যার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ, মুক্তিযুদ্ধের ছবির সংগ্রহশালা, ৭১'এর গণহত্যা ও নির্যাতন আর্কাইভ,  মুক্তিযুদ্ধ পাঠশালা এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা ও প্রকাশনা কেন্দ্র গড়ে তোলা অন্তর্ভুক্ত ছিল।

কর্মী-উপদেষ্টা মিলিয়ে বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভে ১২ জন স্বেচ্ছাশ্রমে নিবেদিত। প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি ও ট্রাস্টি হিসেবে আছেন শান্তা আনোয়ার, প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি হিসেবে আছেন সাব্বির হোসাইন। আছেন দেওয়ান মাবুদ আহমেদ (ট্রাস্টি), মশিউর রহমান (স্বেচ্ছাসেবী), সুমিত চৌধুরী (স্বেচ্ছাসেবী), মৌশিক মিশু (সহযোগী), রেজাউল কবির বাদল (উপদেষ্টা), শেখ মো. কাশেম (উপদেষ্টা), ডা. মাহফুজুর রহমান (উপদেষ্টা), এম নাঈম খান (উপদেষ্টা), আরিফ রহমান (গবেষণা সহকারী) এবং সহুল আহমদ (গবেষণা সহকারী)।

প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি ও ট্রাস্টি শান্তা আনোয়ার বলেন, আমরা চাই মুক্তিযুদ্ধের তথ্যের সহজলভ্য হোক। আর এর জন্য এইযুগে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হচ্ছে তথ্যের ডিজিটাইজেশান ও তা ইন্টারনেটের মাধ্যমে সর্বস্তরে পৌঁছে দেয়া। সেই লক্ষ্যেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।

প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক সাব্বির হোসাইন জানান, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ডিজিটাল পদ্ধতিতে সংরক্ষণ ও অনলাইনের মাধ্যমে সর্বস্তরের জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে কাজ করছে মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ। একাত্তরের পরাজিত শক্তিরা তিন দশক ধরে যে ইতিহাস বিকৃতির কাজ করেছে, তার বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভের সৃষ্টি।   

মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে সাব্বির হোসাইন বলেন, ছবির মাধ্যমে একটা মিউজিয়াম করতে চাই, যাতে করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-আগ্রহী মানুষজন ছবি দেখে মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশকে অনুভব করে।

এ আর্কাইভ আপনি ব্যবহার করবেন কিভাবে? পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে বসে আপনি, শুধু ইন্টারনেট সংযোগ থাকলেই, এই আর্কাইভ ব্যবহার করতে পারবেন একেবারেই সহজে। এখানে যেমন বাংলাভাষায় বই ও দলিলাদি পাবেন, তেমনি পাবেন ইংরেজি ভাষার দলিলাদিও। এখানে যেমন বাংলাদেশের ভেতরে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণাগুলো পাবেন, তেমনি পাবেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক আন্তর্জাতিক গবেষণাগুলোও। এই আর্কাইভ তাই এখন আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃতি পেয়েছে। যুক্তরাজ্যের পাবলিক রিসার্চ বিশ্ববিদ্যালয় 'ইউনিভার্সিটি অব ইক্সেটার'-এর হিউম্যানেটিস কলেজের 'দ্য ইক্সেটার সাউথ এশিয়া সেন্টার' তাদের একাডেমিক রিসোর্স ম্যাটেরিয়াল সেকশনে 'মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ ট্রাস্ট'-কে অন্তর্ভুক্ত করেছে।  

উল্লেখ্য, এ পর্যন্ত ১৫ লক্ষাধিক পাঠক-গবেষক মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ ব্যবহার করেছেন।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত