হাসান মোরশেদ

২৯ মে, ২০১৫ ১৪:১১

দাসপার্টির খোঁজে: খসড়া পর্ব-৫

সর্বোচ্চ সম্মানের ঘোষণা দিয়ে ও রাষ্ট্র তাঁকে ভূষিত করেছে তৃতীয় খেতাবে, অথচ সহযোদ্ধাদের কাছে আজও তিনি শ্রেষ্ঠ বীর। বিশাল ভাটি অঞ্চলের বীরশ্রেষ্ঠ। হত্যা আর মরদেহ প্রদর্শনের ধরণে তাকে একাত্তরের যীশুও বলেন অনেকে। চুয়াল্লিশ বছর পর লেখক হাসান মোরশেদ বেরিয়েছেন শহীদ জগৎজ্যোতি দাস আর তাঁর দাসপার্টির খোঁজে। তাঁর সেই অনুসন্ধান ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে সিলেটটুডে২৪ ডট কম-এ। আজ প্রকাশিত হল পঞ্চম পর্ব

(চতুর্থ পর্বের পর)

 

সেদিন ৫ জুলাই ১৯৭১।
আগের সন্ধ্যাবেলা তারা এসে আশ্রয় নিয়েছেন শাল্লা থেকে দু মেইল আগে হাওরের পাড়ে আঙ্গাউড়া নামে এক গ্রামে। সালেহ চৌধুরী, চাঁন মিয়া, ইয়াসিন, আব্দুল, তালেব এবং রাজ্জাকের নেতৃত্বে বালাট থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের দল। কুদ্দুস থেকে দিরাই, পুলিশের উপর নজর রাখবেন বলে। দুই নৌকায় তার পনেরোজন সশস্ত্র। এই গ্রামে ছিলেন কমিউনিষ্ট পার্টির কর্মী শ্রীকান্ত দাস। প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টির রাতে হাওরের ঢেউয়ের মাঝে পরিকল্পনার ছক কাটা হলো পরের দিনের থানা আক্রমনের।

ভোর ছয়টায় থানা কম্পাউন্ডে ঢুকে গেলো মুক্তিযোদ্ধা দল। ঝড়বৃষ্টির ভোরে পুলিশ বাহিনী ঘুমে। ঘুমন্ত অবস্থাতেই সবাইকে বন্দী করা হলো, অস্ত্র ও গুলাবারুদ নেয়া হলো দখলে। এসময় থানার ওসি কেঁদে আর্জি জানালো কিছু গুলাগুলি করার জন্য, বিনা প্রতিরোধে আত্নসমর্পণের কথা জানলে পাক আর্মি তাদের খুন করে ফেলবে। ওসি অনুরোধে কয়েক রাউন্ড গুলী করা হলো আর আতংকে গ্রামের মানুষ শুরু করলো দৌড়াদৌড়ি।

সালেহ চৌধুরী ওয়ারলেস লাইন কেটে দিয়ে পুলিশদের ছেড়ে দিলেন। তার পর অস্ত্র ও  গুলী নৌকায় বুঝাই করে রওয়ানা দিলেন এবার দিরাই’র দিকে।
এদিকে সেই ওসি ওয়ারলেস লাইন ঠিক করে দিরাই থানায় জানিয়ে দিলো সব ঘটনা আর নিজে তার পুলিশ বাহিনী নিয়ে পিছিয়ে আজমিরীগঞ্জে গিয়ে যোগ দিলো রাজাকারদের সাথে।
তিনটার দিকে দিরাই থানায় আক্রমন হলো। সালেহ চৌধুরী নৌকায় থেকে গিয়েছিলেন দখল করা অস্ত্রের কাছে, ভেবেছিলেন শাল্লার মতোই নির্ঝঞ্জাট হবে দিরাই দখল। কিন্তু একটু পরেই শুনলেইন গুলীর শব্দ। গুলীর শব্দ শুনে দৌড়ে গেলেন থানা কম্পাউন্ডে, একটা রক্তাক্ত লাশ পড়ে আছে।

শাল্লা থেকে ওয়ারল্যাসে থানা লুটের সংবাদ শুনে পুলিশ ইন্সপেক্টর শরাফত উল্লাহ করনীয় নির্ধারনে ডেকে  এনেছিলো অন্য থানায় কর্মরত দিরাইর স্থানীয় আরেক পুলিশ কর্মকর্তা আব্দু রাজ্জাককে। মুক্তিযোদ্ধাদের উপর নির্দেশ ছিলো বাধা দিলে শরাফত উল্লাহকে খতম করে দিতে হবে। মুক্তিযোদ্ধারা কম্পাউন্ডে প্রবেশ করা মাত্রই আব্দুর রাজ্জাক লাফিয়ে বের হওয়ার চেষ্টা করে, তার হাতে ছিলো লাইটার। মুক্তিযোদ্ধারা ভেবেছিলেন সে রিভলবার বের করেছে। এ ছাড়া এখানে গুলীতে নিহত হয়  আগের রাতে ওসি হিসাবে যোগ দেয়া আরেকজন।
এই থানা থেকে ও সব রাইফেল ও গোলাবারুদ নৌকায় তোলা হয়।  সালেহ চৌধুরী তার স্থানীয় সহযোদ্ধাদের নিয়ে থেকে যান দিরাই আর দুই থানার অস্ত্র বোঝাই নৌকা নিয়ে বালাট ফিরে যায় মুক্তিযোদ্ধাদের দল। ছাত্রনেতা তালেব ও চলে যান বালাট, আর ফিরে আসেননি।

জনগনকে আস্বস্ত করা ও শান্তি শৃংখলা বজায় রাখার জন্য সালেহ চৌধুরী ও আব্দুল কুদ্দুস দিরাই শাল্লার সর্বত্র।

এরপর সুরঞ্জিত সেনের কাছ থেকে খবর আসে যে টেকেরঘাট সাব-সেক্টর গঠিত হয়েছে, এই এলাকা টেকেরঘাটের সাথেই থাকবে। এখন থেকে নিয়মিত মুক্তিযোদ্ধাদের দল আসতে থাকবে। তখন পর্যন্ত কোন সেনা কর্মকর্তা না পাওয়ায় সুরঞ্জিত নিজেই সাব-সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। ভারতীয় পক্ষ থেকে উপদেষ্টা ছিলেন মেজর বাথ ও ক্যাপ্টেন বার্মা। সালেহ চৌধুরী ও গেলেন টেকেরঘাট। এসময়ই জেনারেল গিল এর সাথে নদীপথ দখল নিয়ে তার কথা হয়।

তাদের পক্ষ থেকে এবার দায়িত্ব দেয়া হলো জগন্নাথপুর থানা দখল ও জয়কলস রাজাকার ঘাঁটি উৎখাত।
জয়কলসে সাত্তারের নেতৃত্বে শক্তিশালী একটা রাজাকার বাহিনী গড়ে উঠেছে, এরা সিলেট সুনামগঞ্জ মহাসড়ক  ফেরি ও ব্রীজ পাহারা দেয়, মন্দির লুট এবং হিন্দুদের উৎপীড়ন করে এ ছাড়া শরনার্থী নৌকা আটকে লুটতরাজ করে।

 জয়কলস আক্রমনের জন্য কাছাকাছি গ্রাম ডুমুরিয়া রেকি করে আসলে ও টেকেরঘাট থেকে জানিয়ে দেয়া হয় জয়কলস বালাট সাব-সেক্টর এর আওতায় পড়েছে। বালাট থেকেই এখানে আক্রমন হবে।
জগন্নাথপুর থানা আক্রমনের তারিখ নির্ধারিত হয় ২০ জুলাই। ভাটিপাড়ার মানিক চৌধুরীর নেতৃত্বে  একদল প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধা তখন এসেছেন সালেহ চৌধুরীর নেতৃত্বে। কুদ্দুস মিয়া চলে যান জগন্নাথপুর এলাকা রেকি করে আসার জন্য।

জগ্ননাথপুর থানা ও আক্রমন করা হয় ভোরেবেলা। এখানে ও বিনা রক্তপাতে অস্ত্র ও গোলাবারুদ দখল করা হয়। বাকী পুলিশদের ছেড়ে দিলে ও থানার ওসিকে বন্দী করা হয় আর বন্দী করা ব্যাংক ম্যানেজারকে। স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ এই ব্যাংক ম্যানেজার মানুষজনকে বাধ্য করছিলো পাকিস্তানের পতাকা উড়াতে। পরিকল্পনা করা হয়েছিলো হাওরে গিয়ে খতম করে ফেলা কিন্তু তার কান্না আর কাকুতি মিনতিতে ছেড়ে দেয়া। ছেড়ে দেয়ার পর এই লোক ব্যাংকের ভল্ট থেকে সব টাকা নিয়ে গিয়ে সিলেট হেড অফিসে জমা দিয়ে সরকারী পদক পেয়েছিলো যুদ্ধ চলাকালীন সময়েই। আর থানার ওসিকে টেকেরঘাট সাব-সেক্টরে দাপ্তরিক কাজে লাগানো হয়েছিলো।

জগন্নাথপুর থানা থেকে দখলকৃত অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তারা চলে যান টেকেরঘাট সাব-সেক্টরে। তখন পর্যন্ত সালেহ চৌধুরী হাতে ছড়ি আর কোমরে ছুরি রাখতেন। কিন্তু সেবার টেকেরঘাটে গেলে মেজর বাথ তাকে স্টেনগান দেন। যুদ্ধ শেষে অস্ত্র সমর্পণ পর্যন্ত এই স্টেনগানটি তার সঙ্গী ছিলো।



এবার টেকেরঘাট থেকে ফিরে এসে বড় অপারেশন আজমিরীগঞ্জ। আজিমিরীগঞ্জ ভাটি অঞ্চলের প্রধান বন্দর ও ব্যবসা কেন্দ্র। সিরাজ মিয়ার নেতৃত্বে দুই শতাধিক রাজাকারের বিশাল বাহিনী। এরা রীতিমত পোষ্ট বসিয়ে প্রতিটি নৌকা চেক করে, পর্যবেক্ষন টাওয়ার বানিয়ে সেখান থেকে হাওর ও নদীপথে চোখ রাখে আর ভৈরব থেকে প্রতি সন্ধ্যাবেলা স্টিমার ভর্তি হয়ে পাক আর্মি আসে এদিকে টহলে, রাতে অবস্থান করে ভোরবেলা চলে যায়। আজমিরীগঞ্জ দখলে রাখার মতো তখনো অবস্থা তৈরী হয়নি মুক্তিযোদ্ধাদের। সিদ্ধান্ত হয় হাটবারে তড়িৎ আক্রমন করে রাজাকারদের ভড়কে দিতে হবে এবং পাকিস্তান আর্মির স্টিমার এসে পৌঁছার আগেই নিরাপদে ফিরে আসতে হবে। এ জন্য বানিয়াচঙ্গের নজরুল, ভাটিপাড়ার নজরুল ও আওয়ামী লীগ নেতা রমেশ পান্ডের নেতৃত্বে ত্রিশজনের তিনটা দল এসে উপস্থিত হয় দিরাই।
ভাটি অঞ্চলে বাজারে বাজারে পণ্য বিক্রী করার জন্য একও ধরনের বড় নৌকা থাকে। এরকম একটা নৌকা জোগাড় করা হয় এবং মুক্ত এলাকায় শাল্লায় আক্রমনের রিহার্সাল ও দেয়া হয়। সিদ্ধান্ত হয় এলএমজি হাতে একদল যাবে থানায়, একদল বাজারে রাজাকারদের ডিউটি এরিয়ায় আরেকদল রাজাকার সিরাজের বাড়িতে আর সালেহ চৌধুরী থাকবেন নৌকায়। আক্রমনের সমোয় বিকাল ঠিক চারটা।

৮ আগষ্ট শাল্লা থেকে রওয়ানা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের দল আজমিরীগঞ্জ বাজারে গিয়ে পৌঁছে  ঠিক চারটায় কোন বিপত্তি ছাড়াই। যদিও  তার কথা ছিলো নৌকায় থাকায় কিন্তু অপারেশনের উত্তেজনায় স্টেনগান হাতে সালেহ চৌধুরীই লাফিয়ে নামেন সবার আগে। তিনটি গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধারা ও লাফিয়ে নেমে তিনদিকে দৌড় দেন। পর্যবেক্ষন টাওয়ার থেকে রাজাকাররা দেখতে পেয়ে গুলী ছুড়লে ও মুক্তিযোদ্ধাদের এলএমজির আওয়াজ শুনে থানার পুলিশ ও রাজাকাররা পালাতে থাকে হাতের অস্ত্র নদীতে ফেলে। স্থানীয় মানুষদের সহযোগীতায় সব অস্ত্র নদী থেকে তোলা হয়, থানা থেকে গুলী। সার্কেল অফিসারকে বন্দী করা হয় আর স্থানীয় মানুষদের সহযোগীতায় বাড়ি বাড়ি তল্লাশী দিয়ে বন্দী করা হয় চার রাজাকারকে। সার্কেল অফিসারকে পড়ে ছেড়ে দিলে ও রাজাকারদের খতম করে ভাসিয়ে দেয়া হয় হাওরে।
দ্রুত অপারেশন শেষ করে যখন তারা নদীপথ পেরিয়ে হাওরে চলে যাচ্ছেন তখন পেছনে দেখা যাচ্ছে ভৈরব থেকে আসা পাক আর্মি ভর্তি স্টিমার। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের দল নিরাপদেই ফিরে আসেন  তাদের আস্তানায়।
 ৫ নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মীর শওকত আলী তার গ্রন্থ ‘The Witness’ এ ছোট্ট করে আজমিরীগঞ্জ অপারেশনের কথা উল্লেখ  করছেন।



সালেহ চৌধুরীর কাছ থেকে একাত্তুরের গল্প শুনতে শুনতে পেরিয়ে গেছে ঘন্টা চারেক যদিও মাত্র আগষ্ট মাসের শুরু- বাকী রয়ে গেছে আরো অনেক কিছু, দাস পার্টির পুরোটাই। কিন্তু প্রৌঢ় যোদ্ধা ক্লান্ত একটানা বলতে বলতে যদি ও তাঁর স্মৃতিশক্তি অসামান্য।
আবার আসবো, আবার আমাদেরকে সময় দিতে হবে- কথা আদায় করে যখন বের হয়ে আসি, দুপুর গড়িয়ে গেছে তখন।

আগের সব পর্বের লিংকঃ

[প্রথম পর্ব]    [দ্বিতীয় পর্ব] 

[তৃতীয় পর্ব]    [চতুর্থ পর্ব]

আপনার মন্তব্য

আলোচিত