মারূফ অমিত

১১ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:২৭

ফেঞ্চুগঞ্জ মুক্ত দিবস আজ: কাইয়ার গুদামকে গণকবরের স্বীকৃতি দাবি

১১ ডিসেম্বর আজ। ১৯৭১ সালের এইদিনে পাকহানাদার মুক্ত হয়েছিলো ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা।  

১৯৭১ সালের ৪ মে পাক সেনারা ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলায় প্রবেশ করেই প্রথমে তৎকালীন আওয়ামীলীগ নেতা উপজেলার ইসলামপুর গ্রামের মরহুম আছকর আলীর বাড়িতে হানা দিয়ে তার পুত্র শহীদ আসাদুজ্জামান বাচ্চুকে ধরে নিয়ে হত্যা করে। এ সময় বাড়ির অন্য সদস্যদের খুঁজতে থাকে। তারা পূর্ব থেকেই বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। তথ্যমতে ফেঞ্চুগঞ্জের পাক সেনাদের হাতে প্রথম শহীদ আসাদুজ্জামান বাচ্চু।

পাক সেনা ফেঞ্চুগঞ্জে প্রবেশের পর প্রথমেই ফেঞ্চুগঞ্জ বাজারে ‘‘কাইয়ার গুদামে’’ ক্যাম্প স্থাপন করে এবং এই ক্যাম্প ছিল পাক সেনাদের নির্যাতন এবং নিরীহ বাঙ্গালিদের হত্যাকান্ডের কেন্দ্রবিন্দু। অনেক জানা অজানা নিরীহ বাঙ্গালিকে ধরে নিয়ে এই ক্যাম্পে নির্যাতন করা হতো। অনেককে হত্যা করে ভাসিয়ে দেয়া হতো কুশিয়ারা নদীতে। তাই কাইয়ার গুদামটি কালের সাক্ষী হয়ে এখনও দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে আছে কাইয়ার গুদামের পাশের বিশাল শিমূল গাছটি। এই গাছের উপরে পাক সেনাদের পাহারা বসানো হতো।

যুদ্ধ চলাকালে উপজেলার মাইজগাঁও এলাকার নজরুল ইসলাম পংকীকে ধরে নিয়ে হত্যা করে। যুদ্ধ শুরুর পূর্ব এবং পরবর্তী সময়ে গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার কঠিন কাজে যারা নিয়োজিত ছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন তৎকালীন আওয়ামীলীগ নেতা মরহুম আব্দুল লতিফ, আওয়ামীলীগ নেতা মরহুম আরকান আলী, প্রয়াত ডাঃ রথীন্দ্র কুমার নাথ, তৎকালীন ছাত্রনেতা হবিবুল ইসলাম শাহ, ডাঃ আবুল হোসেন, শ্রমিক নেতা মরহুম ইসকন্দর আলী, মরহুম হাজী করম উল্লাহ, এম এইচ খান হুরু মিয়া, ডাঃ দেওয়ান নুরুল ইসলাম চঞ্চল, মরহুম মজাহিদ আলী জড়া মাষ্টার, মরহুম আলাউদ্দিন পীর, মরহুম আব্দুল গনি স্যার সহ অনেকেই।

মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এপ্রিল মাসের শেষের দিকে হানাদার বাহিনী ফেঞ্চুগঞ্জ থানা সদরে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। ৭১ সালের ৪ মে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার ইসলামপুর গ্রামের প্রবীণ রাজনীতিবিদ মরহুম হাজী মো. আছকর আলীর বাড়িতে হামলা চালায় পাকসেনারা।

আছকর আলীর বড় ছেলে তৎকালীন ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ও মদন মোহন কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র আসাদুজ্জামান বাচ্চুকে ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়। এ উপজেলায় ঘাতকদের নির্মম হত্যাযজ্ঞের প্রথম শহীদ হন আসাদুজ্জামান বাচ্চু।

ফেঞ্চুগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে জানান, পাক সেনারা সারকারখানা ও মনিপুর চা বাগানে তৈরি করে টর্চারসেল। এছাড়া যুবতী মেয়েদের উঠিয়ে নিয়ে সেখানে পাশবিক নির্যাতনের পর হত্যা করতো তারা।  

ফেঞ্চুগঞ্জ পশ্চিমবাজারে অবস্থিত কাইয়ার গুদাম ছিল হায়েনাদের বন্দিশালা ও কসাই খানা। উপজেলার বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজনকে ধরে এনে বন্দিশালায় নির্মম নির্যাতনের পর হত্যা করে মরদেহ ফেলে দেওয়া হতো কুশিয়ারা নদীতে।

একইভাবে মুক্তিযোদ্ধা নেওয়ার আলীকে এই বন্দিশালায় রেখে নির্যাতন করে নদী তীরে নামিয়ে ২৮টি গুলি ছুড়া হয় তার দেহে। গুলিতে ক্ষত-বিক্ষত মরদেহ ভাসিয়ে দেওয়া হয় নদীতে। এমন তথ্য জানিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা শফিকুল ইসলাম।

১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর ফেঞ্চুগঞ্জ মুক্ত হলে ঐতিহাসিক কাইয়ার গুদামে শত শত জনতার ভীড় জমে। গুদামের আশাপাশে ছিল স্বজনহারাদের আর্তনাদ। কালের সাক্ষী এই কাইয়ার গুদামের ভেতরে ঢুকতে এখনো কেউ সাহস পান না।

মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর আক্রমণে ফেঞ্চুগঞ্জ থেকে পালিয়ে যাবার পূর্বে পাকসেনারা উপজেলা সদর ও পাশ্ববর্তী রাজনপুর গ্রামে তাদের বিরাট গাড়ীবহর পুড়িয়ে দেয় এবং অন্য যুদ্ধ সামগ্রী নষ্ট করে ফেলে। পাক হানাদাররা কুশিয়ারা নদীর উত্তর পাড়ে অবস্থান নেয়। আর দক্ষিণ পাড়ে অবস্থান নেয় মুক্তিবাহিনী।

১০ ডিসেম্বরই হয় ভয়ঙ্কর সম্মুখ যুদ্ধ। এ সময় মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর কিছু অংশ কুশিয়ারা নদীর ওপর রেলওয়ে সেতু দিয়ে উত্তরপাড়ে অগ্রসর হলে পাকসেনারা তাদের লক্ষ্য করে অতর্কিত গুলি চালায়। এতে সেতুর উপর থেকে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সারিবদ্ধ সদস্যরা মুহুর্তের মধ্যে কুশিয়ারা নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর অসংখ্য সদস্যরা শহীদ হয়েছিলেন তা আজও জানা যায়নি।

কৌশল পরিবর্তন করে পরদিন ১১ ডিসেম্বর উপজেলার কাসিম আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে থেকে কুশিয়ারা নদীর উত্তর পাড়ে পাকসেনাদের লক্ষ্য করে মর্টার সেল নিক্ষেপ করে তাদের ঘায়েল করতে সক্ষম হয় মুক্তিবাহিনী। এক পর্যায়ে মুক্তিযো্দ্ধা ও মিত্রদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে ঠিকতে না পেরে পাকসেনারা স্থানীয় মল্লিকপুর রাস্তা দিয়ে ইলাশপুর হয়ে ফেঞ্চুগঞ্জের ছেড়ে সিলেটের দিকে পালিয়ে যায়।

এদিকে মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ ৪৬ বছর পরও পাকিস্তানী জল্লাদখানা খ্যাত এই গুদাম গণকবরের স্বীকৃতি পায়নি, হয়নি কোন স্মৃতিস্তম্ব নির্মাণ।

স্থানীয়রা জানান, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ফেঞ্চুগঞ্জ, ভাটেরা এবং এর আশেপাশের এলাকা থেকে বাঙ্গালীদের ধরে এনে এখানে নির্মম নির্যাতন করা হত। অসংখ্য বাঙ্গালী নারীকে এই গুদামে এনে পাশবিক নির্যাতন করা হত। বিভিন্ন এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে এনে এই গুদামের পাশে গুলি করে হত্যা করে পাশেই বয়ে চলা কুশিয়ারা নদীতে লাশ ফেলে দেওয়া হতো।

স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তিরা জানান,উপজেলার পশ্চিম বাজারের ছত্রিশ মৌজায় ২২ শতক জমির ওপর পাকিস্তান আমলে খোকা চান ভাটিয়ারির ছেলে মানিক চান ভাটিয়ারি মালিকানাধীন ছিল এই গুদাম। যা কাইয়ার গুদাম নামে পরিচিত ছিল। কাইয়া নামের এক মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীর নামানুসারে এটির নাম হয় কাইয়ার গুদাম।

ফেঞ্চুগঞ্জের বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ নায়েক রশিদ আলী বীর প্রতীকের ভ্রাতুষ্পুত্র ছায়েদুল ইসলাম খালেদ এ ব্যাপারে সিলেটটুডে টুয়েন্টিফোরকে জানান, কাইয়ার গুদামকে গণকবরের স্বীকৃতি এবং গুদামের পাশে স্মৃতিস্তম্ব নির্মাণের দাবীতে আমি নিজ তত্ত্বাবধানে নির্যাতিত ও শহীদ পরিবারের পক্ষ থেকে স্বাক্ষর গ্রহণ শুরু করেছি আমরা গত বছর।  এই গুদাম নিয়ে আমরা রিসার্চ করে যাচ্ছি। কতজন এখানে শহীদ হয়েছেন, কিভাবে হয়েছেন তা নিয়ে আমরা বই পুস্তক, ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি করছি এলাকার প্রবীণ ব্যক্তিদের সাহায্যে।

তিনি জানান, আমাদের পূর্ব পুরুষদের দেশের জন্য আত্মত্যাগ এর স্বীকৃতি চাই। আমি মনে করি দ্রুত এই গুদামকে সরকারী ভাবে গণকবরের স্বীকৃতি দেয়া হোক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত