উজ্জ্বল দাশ

০৫ জানুয়ারি, ২০১৮ ০১:১২

শহীদ শ্রীকান্তের জন্মভিটার খোঁজে...

স্কেচ: সত্যজিৎ চক্রবর্তী

প্রকৃতির আঁচলঘেরা বিদ্যাপীঠ সিলেটের মুরারিচাঁদ (এম.সি) কলেজ। প্রাচীন এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির ছাত্রাবাসগুলোর একটি ’শহীদ শ্রীকান্ত ছাত্রাবাস’। বীর মুক্তিযোদ্ধা শ্রীকান্ত দাস মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন। কলেজের সম্ভাবনাময় তরুণ এই শিক্ষার্থীর আত্মদানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ছাত্রবাসটির নামকরণ। যাঁর নামে ছাত্রাবাসটির নামকরণ সেই শহীদের ছবি কিংবা তাঁর বীরত্বগাথা সম্পর্কে ছাত্রাবাসে কিছু তথ্য সংরক্ষিত থাকবে সেটিই তো স্বাভাবিক।

না; সম্প্রতি ছাত্রাবাসে খোঁজ করে তাঁর সম্পর্কিত কোন স্মৃতিচিহ্ন কিংবা তথ্য মেলেনি। খোদ মুরারীচাঁদ কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকেও আসেনি যুৎসই উত্তর। তাঁর নামে প্রতিষ্ঠিত সুনামগঞ্জ শহীদ শ্রীকান্ত ভোকেশনাল ইনস্টিটিশনেও একই অবস্থা! আর এই অপ্রাপ্তি থেকেই শহীদ শ্রীকান্তের জন্মভিটের খোঁজে কুশিয়ারার পাড় ঘেঁষা পাহাড়পুর গ্রামে ।

পাহাড়পুর বাজারে নেমেই এক দোকানির কাছে জানতে চাই শহীদ শ্রীকান্ত দাস নামে কাউকে চেনেন কিনা? ভদ্রলোক নিরাশ করেন নি। নিয়ে গেলেন ৫০ গজ দূরে গ্রামের মানুষের শ্রদ্ধা আর ভালবাসায় স্থাপিত শহীদ শ্রীকান্ত সাংস্কৃতিক, নাট্য ও সমাজ কল্যাণ সংস্থায়। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক অজিত কুমার দাস সংশ্লিষ্ট কজনকে ডেকে পাঠালেন। খবর পেয়ে এসেছেন শহীদ শ্রীকান্তের ছোটভাই উমাকান্ত দাস। কাছে পাই গ্রামের কজন মুক্তিযোদ্ধাদের। আলাপচারিতায় বয়োজ্যেষ্ঠজনদের আক্ষেপ শ্রীকান্ত বেঁচে থাকলে পরিবারটির এমন হাল হতনা। জানা গেল, ১৯৯৯ সালে গ্রামের বীর সন্তান শ্রীকান্তের স্মৃতিকে ধরে রাখতেই তাদের এই প্রচেষ্ঠার শুরু। গেল বছর নিজস্ব জায়গায় ছোট্ট এই ভবনটি নির্মাণ করেছেন তারা। দেশজ সংস্কৃতির বিকাশে রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির নানাবিধ কার্যক্রম। সাদা কাগজে কম্পোজ করে দেয়ালে সেঁটে রেখেছেন শহীদ শ্রীকান্তের জীবন বৃত্তান্ত!

ভাই উমাকান্তকে সাথে নিয়ে আমরা চলি শহীদের জন্মভিটায়। পাশাপাশি জীর্ণ দু’টি টিনের ঘর। উঠানে জড়ো হয়েছেন প্রতিবেশিরা। তাদের অনেকেই শ্রীকান্তকে দেখেছেন। শুরু হয় স্মৃতি রোমন্থন।  

শহীদ শ্রীকান্ত দাস হবিগঞ্জ জেলার আজমীরীগঞ্জ উপজেলাধীন ২নং বদলপুর ইউনিয়নের পাহাড়পুর গ্রামের সন্তান। ১৯৫২ সালে তাঁর জন্ম।  বাবা নীলকান্ত ও মা চন্দ্রময়ী দাসের চার সন্তানের দ্বিতীয় শ্রীকান্ত। বেঁচে আছেন ভাই উমাকান্ত ও তাদের একমাত্র ছোট বোন ময়তারা।

স্থানীয় পাহাড়পুর স্কুলে থেকে প্রাথমিক; ১৯৬৯ সালে বিরাট এএবিসি হাই স্কুল থেকে বিজ্ঞান বিভাগে প্রথম শ্রেণীতে মেট্রিকুলেশন পাস  করেন শ্রীকান্ত। নানা সীমাবদ্ধতা মাড়িয়ে সে বছরই ভর্তি হলেন সিলেটে মুরারিচাঁদ কলেজে। থাকার জায়গা পেলেন কলেজ ছাত্রাবাসে। টানাপোড়নের সংসারে দিন বদলের আভাস ছিলেন শ্রীকান্ত!

যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। ১৭ মে ১৯৭১। শ্রীকান্ত, গোপাল চক্রবর্ত্তী, হরিপসন্ন চক্রবর্ত্তী, সুশান্ত দাস  তারা চার জন পাহাড়পুর থেকে রওয়ানা হন ভারতের পথে। শ্রীকান্ত শহীদ হওয়ার সেই অপারেশনের রাতেও তারা একসাথেই লড়েছেন।  

বালাট থেকে সুনামগঞ্জের গণি হাওলাদারের পাস নিয়ে ভারতের এ,কিউ, ওয়ান মেঘালয় এর মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ শিবিরে ২৮ দিন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। শ্রীকান্তের ব্যাচ নং ০৬। প্রশিক্ষণ শেষে ৫নং সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মীর শওকত আলী, সাব সেক্টর কমান্ডার মেজর এম.এ মোতালিব এর অধীনে কোম্পানি কমান্ডার সিলেটের এনামুল হক চৌধুরীর নেতৃত্বে স্বাধীনতা যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। তাদের কম্পানীর সেকেন্ড কমান্ড ছিলেন সিলেটের মোঃ সিরাজ মিয়া।

পাহাড়পুর স্কুলে বসে শহীদ শ্রীকান্তের সহযোদ্ধা গোপাল চক্রবর্তী শোনালেন যুদ্ধদিনের সেইসব কথা। গোপাল চক্রবর্ত্তী স্মৃতি রোমন্থন করে বলেন, ’ মে মাসের শুরুর দিক। কুশিয়ারায় পাড়ে আমরা ফুটবল খেলছিলাম। নদীতে গানবোট যাচ্ছে আর এলাপাথাড়ি গুলি চালায় দ’ুপাড়েই। খেলা বন্ধ হয়ে গেল। রাতের বেলা শ্রীকান্ত আর হরিপ্রসন্ন আসল আমাদের বাড়িতে। শ্রীকান্ত মন খারাপ করে বলেছিল, দাদা এভাবে টেকা যাবে না। চলেন আমরা যুদ্ধে যাই। বলে কয়ে পরিবারের অনুমতি মিলবেনা বিধায় পালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিই আমরা। আমাদের সাথে শরিক হন  সুশান্ত দাস। তিন চারদিন পর এক ভোর রাতে রওয়ানা দিই সীমান্তের পথে।’  

গোপাল আরও বলেন, শারীরিক গঠনে শ্রীকান্ত খুব বলিষ্ট ছিলনা কিন্তু তাঁর মনের জোর ছিল প্রবল। শেষ পর্যন্ত লড়ে গেছে। ওর লাশটা পরেছিল; একটা ছবি তোলে রাখতে চাইছিলাম, অনুমতি মেলেনি। তাঁর আগ্রহেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম আমরা চারজন, পাশাপাশি ছিলাম সবসময়। বিজয়ের মাত্র দুই সপ্তাহ আগে আমরা সাথীহারা হই।

২৭ নভেম্বর সুনামগঞ্জের বৈশেরপাড়া ষোলগড়ের মাঝামাঝি ডলুরায় সম্মুখযুদ্ধে পাকসেনাদের হাতে শহীদ হন শ্রীকান্ত। রাস্তায় পরেছিল তাঁর লাশ। বেয়নেট দিয়ে খুচিয়ে শ্রীকান্তের দেহ থেকে হৃৎপিন্ড ও চোখ খুলে নিয়ে যায় পাকবাহিনী। জয়বাংলা বাজার সংলগ্ন ডলুরা গণকবরে তাঁকে সমাহিত করা হয়। ডলুরা গণকবরে ৪৪ নং স্মৃতি স্মারকটি শহীদ শ্রীকান্ত দাসের।

১৯৭০ সালে হোস্টেলের ছাত্রাধিনায়ক ছিলেন লেখক রসময় মোহন্ত। একই সময়ে ছাত্রাবাসে ছিলেন রসায়নে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী বর্তমানে হবিগঞ্জে কর্মরত এডভোকেট তমাল কুমার বিশ্বাস। শহীদ শ্রীকান্তের সাথে তাঁর শেষ দেখার স্মৃতি নিয়ে বললেন, ’ মার্চ থেকেই উত্তাল চারদিক। ছাত্রাবাসে থাকা শিক্ষার্থীরা বাড়ি যেতে শুরু করেছে; কখন কি হয়। ৭ মার্চের পর শ্রীকান্ত, আমি ও মনোরঞ্জন দাস বাড়ির পথে রওয়ানা হই। বইপত্র, ব্যবহার্য সবকিছু হোস্টেল সুপার স্যারের বাসায় রেখেছিলাম।  দেশ স্বাধীন হয় আমরা সকলেই ফিরে আসি। ফেরেনি শুধু শ্রীকান্ত। ৭২ সালের শেষদিকে আমরা হোস্টেলে অবস্থানরত শিক্ষার্থীরা ’’ শহীদ শ্রীকান্ত ছাত্রাবাস’’ নামকরণ করে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিই। শুরুতে প্রশাসন নামকরণকে ভাল ভাবে নেননি; পরবর্তীতে সেটিই তারা বহাল রেখেছেন।’     

শহীদ শ্রীকান্ত ছিলেনই তার পরিবারের ঘুরে দাঁড়ানোর ভরসা। সিলেটে তাঁকে পড়তে পাঠানো ছিল পরিবারের বড় কঠিন সিদ্ধান্ত। দেশ স্বাধীন হয়, কালো মেঘে ঢাকা পরে পরিবারের স্বপ্ন।

ফেরার সময় হয়। শহীদের ছোটভাই উমাকান্ত গভীর শূন্যতা নিয়ে বললেন; ’আমরা শহীদ পরিবার, অনেক গর্ব লাগে। দাদাকে হারানোর পর আমরা গতিপথ হারাই। তাঁকে মানুষ স্মরণ করছে এটাই বড় পাওনা।’
 
লেখক : প্রজেক্ট লন্ডন ১৯৭১-এর উদ্যোক্তা ও সমন্বয়ক

আপনার মন্তব্য

আলোচিত