সিলেটটুডে ডেস্ক

১৫ জুন, ২০১৫ ০৩:২৬

রাজাকার ফোরকান মল্লিকের যুদ্ধাপরাধের রায় যেকোনো দিন

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জের ফোরকান মল্লিকের মামলার রায় ঘোষণা হবে যেকোনো দিন। মামলার বিচারিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ায় রায় ঘোষণা অপেক্ষমাণ রেখেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২।

রবিবার (১৪ জুন) আসামিপক্ষে যুক্তিতর্ক (আর্গুমেন্ট) উপস্থাপন শেষ করেন তার আইনজীবী আব্দুস সালাম খান। গত ২ জুন শুরু করে তিন কার্যদিবসে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করলেন তিনি। এর আগে গত ২৮ মে থেকে ১ জুন পর্যন্ত তিন কার্যদিবসে ফোরকানের বিরুদ্ধে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটর মোখলেসুর রহমান বাদল।

উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ হলে আইন অনুসারে রায় অপেক্ষমান (কোর্ট এওয়েটিং ভারডিক্ট- সিএভি) রেখেছেন চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল।

গত ১৯ জানুয়ারি, ২০১৫ থেকে ১৯ এপ্রিল পর্যন্ত ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা সত্য রঞ্জন রায়সহ রাষ্ট্রপক্ষের ১৪ জন সাক্ষী। অন্যদিকে গত ২৬ এপ্রিল থেকে ১৭ মে পর্যন্ত ফোরকান মল্লিকের পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছেন চারজন সাফাই সাক্ষী।

গত ১৯ জানুয়ারি ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে সূচনা বক্তব্য (ওপেনিং স্টেটমেন্ট) উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটর মোখলেছুর রহমান বাদল। গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে হত্যা-গণহত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, ধর্মান্তরকরণ ও দেশান্তরকরণের ৫টি মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযোগ (চার্জ) গঠন করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে ৮ জনকে হত্যা ও গণহত্যা, ৪ জনকে ধর্ষণ, ৩ জনকে ধর্মান্তরকরণ, ১৩টি পরিবারকে দেশান্তরকরণ, ৬৪টি বসতঘর ও দোকানপাটে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ।

এর আগে ৯ ডিসেম্বর, ২০১৪ ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের পক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর মোখলেসুর রহমান বাদল। বিপক্ষে শুনানি করেন ফোরকান মল্লিকের আইনজীবী আব্দুস সালাম খান।

২ ডিসেম্বর, ২০১৪ ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের দাখিল করা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। ১৭ নভেম্বর এ আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেন প্রসিকিউটর মোখলেসুর রহমান বাদল। পরে তিনি অভিযোগ আমলে নেওয়ার পক্ষে শুনানি করেন।

২৭ অক্টোবর, ২০১৪ ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেন তদন্ত সংস্থা। ২৮ অক্টোবর এ প্রতিবেদন প্রসিকিউশনের কাছে জমা দেওয়া হয়। ২৬ জুন, ২০১৪ শুরু করে ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত মামলাটির তদন্ত করেন তদন্ত কর্মকর্তা সত্যরঞ্জন রায়।

ফোরকানের বাড়ি পটুয়াখালী জেলার মির্জাগঞ্জ উপজেলার ছইলাবুনিয়া গ্রামে। দীর্ঘদিন পলাতক থাকার পর গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ২৫ জুন, ২০১৪ সকালে পটুয়াখালী গোয়েন্দা শাখার একটি দল বরিশালের রূপাতলী বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে ফোরকান মল্লিককে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের দায়ে ২০০৯ সালের ২১ জুলাই ফোরকানের বিরুদ্ধে মির্জাগঞ্জ থানায় আবদুল হামিদ নামে এক ব্যক্তি মামলা দায়ের করেন।

২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে পটুয়াখালীর আদালতে বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ সময় তিনি উচ্চ আদালত থেকে ছয় মাসের জামিন নেন। ৩০ মার্চ, ২০১৪ বিচারিক কার্যক্রম চলাকালে আদালতে হাজির না হওয়ায় তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়।

ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে বিচারিক প্রক্রিয়া চলাকালে তার বিরুদ্ধে হত্যা, লুণ্ঠন, খুন, ধর্ষণসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রমাণ পান পটুয়াখালীর আদালত। তখন মামলাটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার একেএম নাসির উদ্দিন মাহমুদ মামলাটি গত বছরের ২৫ জুন তদন্ত সংস্থার কাছে পাঠান। তদন্ত সংস্থা মামলাটি গ্রহণ করে ২৬ জুন থেকে তদন্ত শুরু করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা সত্যরঞ্জন রায়।

৩০ জুন, ২০১৪ ফোরকান মল্লিককে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় গ্রেফতার দেখানো (শ্যোন অ্যারেস্ট) ও তদন্তের স্বার্থে ট্রাইব্যুনালে হাজির করানোর আবেদন জানান প্রসিকিউটর প্রসিকিউটর মোখলেসুর রহমান বাদল।

শুনানি শেষে ফোরকান মল্লিককে ৩ জুলাই ট্রাইব্যুনালে হাজির করানোর জন্য কারা মহাপরিদর্শককে আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-২। ৩ জুলাই ফোরকান মল্লিককে হাজির করা হয়ে গ্রেফতার দেখিয়ে (শ্যোন অ্যারেস্ট) কারাগারে পাঠান ট্রাইব্যুনাল।

ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে পাঁচ অভিযোগ : অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭০-৭১ সালে ফোরকান মল্লিক মুসলিম লীগের একজন সমর্থক ও কর্মী হিসেবে একই গ্রামের শান্তি কমিটির সভাপতি আজহার উদ্দিন খান, খবির বিশ্বাস, সুবিদখালীর শাহজাহান সিকদার, আ. ওয়াজেদ সিকদার, কাকড়াবুনিয়া গ্রামের আলী আকবর গাজী, ইউসুফ আলীসহ অন্যান্যদের সঙ্গে মুসলিম লীগের পক্ষে প্রচারণা চালান।

পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তারা রাজাকার বাহিনী গঠন করেন। পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ থানার সুবিদখালী পুরাতন হাসপাতাল ভবনটিতে ছিল রাজাকারদের প্রধান ক্যাম্প। মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক সুবিদখালী বাজারের ডা. দেবেন্দ্রনাথ সরকার ও তার স্ত্রীকে হত্যার পর ওই বাসাটি থানা শান্তি কমিটির প্রধান কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করেন তারা।

এসব ক্যাম্প-কার্যালয় থেকে মির্জাগঞ্জ থানার বিভিন্ন এলাকায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নানা মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেন ফোরকান মল্লিক ও তার বাহিনী।

প্রথম অভিযোগ: ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আষাঢ় মাসের মাঝামাঝি সময় (ইংরেজি ২৭ জুন থেকে ৩ জুলাই) সকাল ছয়টার দিকে ফোরকান মল্লিক ও তার সঙ্গী অন্যান্য সশস্ত্র রাজাকাররা গানবোটে করে পাকিস্তানি সেনাদের মির্জাগঞ্জ থানার কাকড়াবুনিয়া গ্রামে নিয়ে আসেন। পাকিস্তানি সেনাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে আসার পর ওই গ্রামের হাওলাদার বাড়ির মো. কাঞ্চন আলী হাওলাদার ও হাজী আবুল হাশেম হাওলাদারসহ মোট সাত জনকে আটকের পর আটককৃতদের ওপর নির্যাতন চালান, বাড়ি-ঘর লুটপাট এবং জোর করে অর্থ আদায় করেন। আটককৃতদের এক মাস আটক রাখার পর ছেড়ে দেওয়া হয়।

দ্বিতীয় অভিযোগ: মুক্তিযুদ্ধের সময় আষাঢ় মাসের শেষের দিকে (ইংরেজি ২ জুলাই থেকে ১৭ জুলাই) সকাল সাড়ে নয়টার দিকে ফোরকান মল্লিক ও তার সঙ্গী অন্যান্য সশস্ত্র রাজাকাররা গানবোটে করে পাকিস্তানি সেনাদের মির্জাগঞ্জ থানার দেউলি গ্রামে নিয়ে আসেন। পাকিস্তানি সেনাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে আসার পর ওই গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আলতাফ হায়দারসহ মোট ছয়জনের ঘর-বাড়িতে লুটপাটের পর অগ্নিসংযোগ করেন।

তৃতীয় অভিযোগ: ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ১২ আগস্ট থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ফোরকান মল্লিক ও তার সঙ্গী অন্যান্য সশস্ত্র রাজাকাররা গানবোটে করে পাকিস্তানি সেনাদের মির্জাগঞ্জ থানার সুবিদখালীতে নিয়ে আসেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সংবাদবাহক কাকড়াবুনিয়া গ্রামের হাফিজ উদ্দিন খলিফা, মির্জাগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. আব্দুল কাদের জমাদ্দার, সুবিদখালী বাজারের ডা. দেবেন্দ্রনাথ ও তার স্ত্রী বিভা রানীকে আটকের পর নির্যাতন চালিয়ে তাদের হত্যা করেন। এ অভিযোগে ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে গণহত্যা, লুটপাট, ধর্ষণ, ধর্মান্তরকরণ এবং বিতারণের অভিযোগ আনা হয়েছে।

চতুর্থ অভিযোগ: ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ৫ থেকে ৮ ভাদ্র (ইংরেজি ২২ আগস্ট থেকে ২৫ আগস্ট) সময়ের মধ্যে ফোরকান মল্লিক ও তার সঙ্গী অন্যান্য সশস্ত্র রাজাকাররা গানবোটে করে পাকিস্তানি সেনাদের মির্জাগঞ্জ থানার কাকড়াবুনিয়া বাজারে আসেন। এখানে তারা চারজনকে হত্যা করেন। এছাড়াও ফোরকান মল্লিক ও তার সহযোগী রাজাকার এবং পাকিস্তান সেনারা হত্যা, গণহত্যা, জখম, আটক, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের মতো অপরাধ সংঘটিত করেন।

পঞ্চম অভিযোগ: ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ৫-৮ ভাদ্র (ইংরেজি ২২ আগস্ট থেকে ২৫ আগস্ট ১৯৭১) সময়ের মধ্যে ফোরকান মল্লিক ও তার সঙ্গী অন্যান্য সশস্ত্র রাজাকাররা মির্জাগঞ্জ থানার দক্ষিণ কলাগাছিয়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মো. আবুল হোসেন মৃধাকে আটকের পর নির্যাতন এবং বাড়ি-ঘর লুটপাট করেন।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত