শরীফা বুলবুল

২২ মার্চ, ২০১৮ ০১:৩৩

একাত্তরের কাকন বিবি

একাত্তরের কোনো একদিনের কথা। তিনি ভিক্ষে করতে করতে চতুর্থবারের মতো পাকিস্তানিদের টেংরা ক্যাম্পের দিকে যাচ্ছিলেন। ঠিক জুম্মার আজানের সময়, রাস্তায় তাকে আটকে ফেলল কয়েকজন পাকিস্তানি সৈন্য। একাধিকবার ক্যাম্পে আসায় সৈন্যরা তার সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর যে যোগাযোগ আছে সেটা স্বীকার করানোর চেষ্টা করে। কিন্তু তার এক কথা, ‘আমি আমার স্বামী আবদুল মজিদ খানের খোঁজে ক্যাম্পে যাই’।

এর পরই শুরু হয় তার ওপর প্রচণ্ড শারীরিক নির্যাতন। গাছের সঙ্গে বেঁধে ফেলে নিষ্ঠুরভাবে পিটাতে শুরু করল তাকে। শরীর দিয়ে দরদর করে রক্ত পড়ছে। এভাবে দীর্ঘক্ষণ প্রচণ্ড অত্যাচারের মুখে তার শরীর একেবারে ভেঙে পড়ে। জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন তিনি। একপর্যায়ে পাকহানাদাররা মোটা লোহার শিক গরম করে তার উরু দিয়ে ঢুকিয়ে দেয়। এ হেন নির্যাতনের পরও তার মুখ থেকে কোনো কথা বের করতে পারেনি পাকিস্তানি সৈন্যরা।

পাকিস্তানিদের নিষ্ঠুর অত্যাচার সহ্য করা এই নারীটি হচ্ছেন কাকন বিবি। ইতিহাস যাকে চেনে বীরাঙ্গনা কাকন বিবি নামে। তিনি ছিলেন, মুক্তিবাহিনীর ‘ইনফরমার’। তিনি কখনোই স্বীকার করেননি ভিক্ষুকের বেশে পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে গিয়ে মুক্তিবাহিনীর জন্য খবর বয়ে আনেন। তিনি জানেন এই সত্য কথাটি হায়েনার দল জেনে গেলে তা দেশের জন্য, দেশের মুক্তিবাহিনীর জন্য চরম অমঙ্গল হবে। তাই তো পাকবাহিনীর নির্মম অত্যাচারের মুখেও তিনি চুপ করে ছিলেন। তার বয়স এখন আশি বছরের ওপরে। জন্মেছিলেন ব্রিটিশ ভারতের মিজোরাম প্রদেশে।

কাঁঠালবাগান গ্রামটি ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের খুব কাছে। গ্রাম থেকে একটু দূরেই ছিল পাকিস্তান সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর ক্যাম্প। সেই ক্যাম্পে সৈনিক হিসেবে কাজ করত পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের আবদুল মজিদ খান। আবদুল মজিদ খানের সঙ্গে কাকন বিবির বিয়ে হয় ১৯৫৮/৫৯ সালে।

বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে কর্মস্থল বোগলা ক্যাম্পে ওঠেন তিনি। আবদুল মজিদ খান বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্থানে বদলি হতেন। কাকন বিবিকেও তিনি সঙ্গে নিয়ে যেতেন। আবদুল মজিদ খান সিলেট আকালিয়া ক্যাম্পে থাকা অবস্থায় কাকন বিবিকে পরিত্যাগ করেন। তারপর হঠাৎ করেই আবদুল মজিদ খান উধাও হয়ে যান। কাকন বিবি একা হয়ে পড়েন। স্বামীর খোঁজে তিনি ক্যাম্পের অন্যান্য সৈনিকদের কাছে অভিযোগ করেন, অফিসে গিয়েও নালিশ করেন। কিন্তু সবাই তাকে অসহযোগিতা করে। শেষ পর্যন্ত স্বামীর কোনো খোঁজখবর করতে না পেরে কাকন বিবি তার ভগ্নিপতি ও বোনের সংসারে চলে আসেন। পরে প্রতিবেশী শাহেদ আলীর সঙ্গে কাকন বিবির পুনরায় বিয়ে হয়। কাকন বিবির গর্ভে জন্ম নেয় এক কন্যা সন্তান। নাম সখিনা বিবি। সখিনা যখন সাত মাসের শিশু তখনই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।

সুনামগঞ্জ-সিলেট অঞ্চলটি ছিল পাঁচ নম্বর সেক্টরের অধীন। এই সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন লে. কর্নেল মীর শওকত আলী। কাকন বিবি যে গ্রামে থাকতেন তার পাশেই মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। আবার এই ক্যাম্প থেকে খানিকটা দূরেই ছিল পাকিস্তানিদের ক্যাম্প। যা স্থানীয়ভাবে টেংরা ক্যাম্প নামে পরিচিত। মুক্তিবাহিনীর যে ক্যাম্প ছিল তার কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন শহিদ মিয়া। মীর শওকত আলী একদিন এই ক্যাম্প পরিদর্শনে আসেন। তিনিই মূলত কাকন বিবিকে পাকিস্তানিদের ক্যাম্প থেকে খবর সংগ্রহের কাজে উৎসাহিত করেন। কাকন বিবির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তিনি তাকে কাজের গুরুত্বও বুঝিয়ে দেন।

কাকন বিবি মুক্তিযুদ্ধে সম্পৃক্ত হন একজন ‘ইনফরমার’ হিসেবে। যার কাজ ছিল পাকিস্তানি ক্যাম্পে ঢুকে তাদের হাতিয়ারের ধরন, সংখ্যা ও সৈনিকদের অবস্থান সম্পর্কে খবর সংগ্রহ করা। স্বামী শাহেদ আলী তার এই কাজে বাধা দিলেও তিনি তা উপেক্ষা করেন। সেই কঠিন দায়িত্ব পালন করার জন্য তিনি কয়েকদিন সময় নেন। চিন্তা করেন। পরে নিজেই বুদ্ধি খাটিয়ে একটি ময়লা ও ছেঁড়া কাপড় পরে একদিন ভিক্ষা করতে করতে রওনা দেন টেংরা ক্যাম্পের দিকে। কৌশলে ঢুকে পড়েন টেংরা ক্যাম্পের ভেতর। তিারা কিছু ময়দা ও আটা ভিক্ষা দেয়। ভিক্ষা করার পাশাপাশি মিলিটারিদের কাছে তার প্রথম স্বামী আবদুল মজিদ খানের খোঁজও করেন। নানা কায়দায় কিছুক্ষণ ক্যাম্পের ভেতর অবস্থান করে সবকিছু দেখার চেষ্টা করেন এবং প্রথম দিন তিনি খুব ভালোভাবেই তার দায়িত্ব পালন করেন। টেংরা ক্যাম্পে তিনি যা দেখেছেন তা সবই এসে জানান কোম্পানি কমান্ডার শহিদ মিয়াকে। মুক্তিবাহিনী তখন সেই মোতাবেক তাদের অপারেশন চালায় এবং এতে তারা সফলও হয়।

দ্বিতীয় দিনও কাকন বিবি একই কায়দায় টেংরা ক্যাম্পে প্রবেশ করেন। মিলিটারির কাছে তার স্বামীর খবর জানতে চাইলে তাকে আটক করা হয়। কয়েকজন পাক হানাদার বাহিনীর সদস্য মিলে চালায় শারীরিক নির্যাতন। কিন্তু তখনো পর্যন্ত কাকন বিবি একজন ‘ইনফরমার’ এটা তারা ভাবতে পারেনি। নির্যাতন শেষে তারা কাকন বিবিকে ছেড়ে দেয়।

ওই ঘটনার পর কাকন বিবি বেশ কিছুদিন আর টেংরা ক্যাম্পে যাননি। টেংরা ক্যাম্পে ‘ইনফরমার’ হিসেবে কাজ করেছেন কাকন বিবি, এই খবর জানামাত্রই দ্বিতীয় স্বামী শাহেদ আলী রেগে আগুন হয়ে যান। তিনি কাকনকে প্রচণ্ড মারধর করেন। একপর্যায়ে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন ‘নষ্টা মেয়ে’ বলে। একমাত্র মেয়ে সখিনা বিবিকে শাহেদ আলী নিজের কাছেই রেখে দিলেন। শাহেদ আলী আবার বিয়ে করলেন।

এই দুঃসময়েও কাকন বিবি ‘ইনফরমার’ হিসেবে কাজ করার জন্য যান সুনামগঞ্জে অবস্থিত পাকহানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে। সেখান থেকে যান সিলেট ক্যাম্পে। পরে যান গোবিন্দগঞ্জ, জাউয়া বাজার ক্যাম্পে। সব জায়গাতেই তার একই কাজ। ক্যাম্পের অবস্থান, সৈন্য সংখ্যা, হাতিয়ার ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা নিয়ে আসা। যেতেন সেই ভিক্ষুকের বেশেই। পাকিস্তানি সৈন্যদের কাছে খোঁজ করতেন নিজের প্রথম স্বামীর।

বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে কাজ শেষ করে কাকন বিবি আবার নিজের গ্রাম কাঁঠালবাড়িতেই ফিরে আসেন। দীর্ঘদিন পর কোম্পানি কমান্ডার শহিদ মিয়ার নির্দেশে তৃতীয়বারের মতো তিনি আবার যান টেংরা ক্যাম্পে। তৃতীয়বারও নানা নির্যাতনের মুখে পড়েন।

কাকন বিবি ক্যাম্প থেকে খবর সংগ্রহ করে মুক্তিবাহিনীর কাছে প্রেরণ করছেন তা স্থানীয় কয়েকজন রাজাকার সন্দেহ করে। ওইসব রাজাকাররা পাকিস্তানি ক্যাম্পে গিয়ে অফিসারদের কাছে তাদের সেই সন্দেহের কথা জানায়। পাকিস্তানি সৈন্যরা তাকে ধরে নিয়ে অকথ্য নির্যাতন চালায়। যে নির্যাতনের বর্ণনা শুরুতেই বলা হয়েছে। কাকন বিবিকে নির্যাতনের একপর্যায়ে পাকবাহিনীর বড় অফিসার এসে দেখেন কাকন বিবি অজ্ঞান। অফিসার ডাক্তার ডাকালেন। ডাক্তার এসে ইনজেকশন দিয়ে কাকন বিবির জ্ঞান ফেরাল। তারপর তাকে কিছু খাবারও দেয়া হলো। কিন্তু কাকন বিবির খাওয়ার মতো সামর্থ্যও ছিল না। উরুতে যে গরম লোহার শিক ঢোকানো হয়েছে তার যন্ত্রণায় তিনি সবকিছু অন্ধকার দেখতে থাকেন। এর মধ্যেই অফিসার তাকে জিজ্ঞেস করে, তুমি কেন ক্যাম্পে যাও? কাকন বিবি অস্ফুট স্বরে উত্তর দিলেন, স্বামীর খোঁজে। অফিসার আবার জিজ্ঞেস করল, কে তোমার স্বামী? কাকন বিবি বললেন, আবদুল মজিদ খান। অফিসার তখন ক্যাম্পে ফিরে গিয়ে সিলেটে ওয়্যারলেস করে। সেখানে সত্যিকার অর্থেই আবদুল মজিদ খান নামে কোনো সৈনিক আছে কি না তা জানার জন্য। আবদুল মজিদ খান তখন সিলেটেই ছিলেন। কিন্তু তিনি ক্যাম্পের বাইরে ছিলেন। মজিদ খান ক্যাম্পে ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গেই অফিসার তার সঙ্গে কথা বলে। অফিসার মজিদ খানের কাছে জানতে চায়, কাঁঠালবাড়িতে তার কোনো স্ত্রী আছে কি না? মজিদ খান স্বীকার করে, কাকন বিবি নামে তার স্ত্রী কাঁঠালবাড়িতে থাকেন। অফিসার মজিদ খানের কাছ থেকে এই তথ্য পাওয়ার পর কাকন বিবিকে পাকহানাদাররা তাকে ছেড়ে দেয়।
 
দৈনিক ভোরের কাগজ-এর সৌজন্যে

আপনার মন্তব্য

আলোচিত