সিলেটটুডে ডেস্ক

২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ২২:৪২

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিচার দাবি

মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালি জাতির ওপর নৃশংস গণহত্যা ও নির্যাতনের ঘটনায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিচারের দাবি জানিয়েছেন দেশি-বিদেশি বিশিষ্টজনরা।

শুক্রবার (২৮ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর বাংলা একাডেমি মিলনায়তনে '১৯৭১ :মুক্তিযুদ্ধ, গণহত্যা ও বিশ্ব' শীর্ষক আন্তর্জাতিক সেমিনারের উদ্বোধনী দিনে বিশিষ্টজনরা এ দাবি জানান।

এসময় তারা বলেন, গণহত্যা ও নির্যাতনের ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগী জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতা, আলবদর-আলশামস ও রাজাকারদের বিচার হলেও তাদের নেতৃত্বদানকারী অপরাধীদের বিচার এখনও হয়নি। সরকারের ব্যর্থতায় একাত্তরের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও মেলেনি এখনও। অন্যদিকে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টা চালাচ্ছে, শহীদ ও নির্যাতিতদের সংখ্যা নিয়েও অপপ্রচার চলছে। তরুণ প্রজন্মকে সঙ্গে নিয়ে এ ব্যাপারে বিশ্বব্যাপী জনমত গড়ে তুলতে হবে।

সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্পের আওতায় দ্বিতীয়বারের মতো দেশে দু'দিনব্যাপী 'গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র' এ সেমিনার করে। সেমিনারে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, মিসর ও বাংলাদেশের ২৩ জন মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যাবিষয়ক গবেষক অংশ নেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর বাংলা একাডেমির পৃথক মিলনায়তনে চারটি অধিবেশন হয়। শনিবার একই মিলনায়তনে সেমিনারের সমাপনী অধিবেশন হবে।

অধিবেশনে অংশগ্রহণকারী আলোচকরা মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল সেসব দিনের স্মৃতিচারণ করে বলেন, পাকিস্তানি বাহিনীর আদলে বিশ্বের অনেক দেশেই এখনও নৃশংস গণহত্যা-নির্যাতন চলছে। শক্তিশালী দেশগুলোর স্বার্থেই এসব ঘটনা ঘটছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্যোগে প্রতিটি গণহত্যার বিচার সম্পন্ন হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য পৃথিবী রেখে যাওয়া সম্ভব হবে।

একাত্তরের রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা লে. কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির বীরপ্রতীকের সঞ্চালনায় সেমিনারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। স্বাগত বক্তব্য দেন আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক বাংলা একাডেমির ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি চিত্রশিল্পী হাশেম খান। সেমিনারে 'বিশ্ব পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ' শীর্ষক আলোচনা পর্বে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন শিক্ষাবিদ ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন। শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন ভারতের জাতীয় গবেষণা অধ্যাপক ড. জয়ন্ত কুমার রায়। উদ্বোধনী পর্বে সভাপতিত্ব করেন গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘরের ট্রাস্টি অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন।

সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেন, মুক্তিযুদ্ধ ও তার পটভূমিতে যেসব ঘটনা ঘটেছে, সেসবের মধ্যে অন্যতম গণহত্যা। এ বিষয়ে আরও গবেষণা হওয়া জরুরি।

গণহত্যাকারীদের বিচার দাবি করে মন্ত্রী বলেন, এ দাবি শুধু দেশের ভেতরে নয়, আন্তর্জাতিকভাবেও জোরালো হওয়া উচিত। বিচারের দাবি জোরালো না হওয়ায় স্বাধীনতাবিরোধীরা আরও শক্তিশালী হয়েছে। পঁচাত্তরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে।

অধ্যাপক ড. জয়ন্ত কুমার রায় বলেন, গণহত্যার বিচারে এখনও অনেক কাজ অসমাপ্ত রয়েছে। এ কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

শিল্পী হাশেম খান বলেন, যতদিন যাচ্ছে পাকিস্তানিদের গণহত্যার ভয়াবহতা দৃশ্যমান হচ্ছে। এ নিয়ে যত বেশি আলোচনা হবে, তরুণ প্রজন্ম তত বেশি গণহত্যা রুখে দেওয়ার শক্তি সঞ্চয় করবে।

সভাপতির বক্তৃতায় মুনতাসীর মামুন বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার বিষয়টি চাপা দিতে চেয়েছিল। কারণ এই গণহত্যা যদি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়, তা হলে এর দায় আমেরিকা ও চীনকেও নিতে হবে। এখন এই কথাগুলো বলার সময় এসেছে। তিনি আন্তর্জাতিকভাবে গণহত্যার স্বীকৃতি আদায়ে সরকারকে আরও জোরালো ভূমিকা নেওয়ার আহ্বান জানান।

উদ্বোধনী দিনে চারটি অধিবেশনে ২৩ জন চিন্তাবিদ, গবেষক-লেখক তাদের প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবিরের সঞ্চালনায় প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বেলজিয়ামের পাওলো কাসাকা, ভারতের কৌশিক বন্দ্যোপাধ্যায়, নেদারল্যান্ডসের থিজস বাউনেট, কম্বোডিয়ার কিও ডং, বাংলাদেশের জসীম উদ্দীন প্রমুখ।

পাওলো কাসাকা বলেন, বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন হয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ বিচার নিয়ে সরব নয়। এখানে নৃশংস গণহত্যা হয়েছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এই গণহত্যার বিচারের বিষয়ে জোরালো উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

কৌশিক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যত লেখা প্রকাশিত হয়েছে, তার বেশিরভাগেই রাজনৈতিক ও সামরিক প্রেক্ষিত আলোচনা হয়েছে। পাকিস্তানি বাহিনী ও তার সহযোগীদের দ্বারা বাঙালি গণহত্যা ও নির্যাতন গবেষণায় অনেকটা উপেক্ষিত। এখন সময় এসেছে মুক্তিযুদ্ধের পুরো প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণের। এটি হলে বিচারের পথ উন্মুক্ত হবে।

থিজস বাউনেট বলেন, গণহত্যায় লাখ লাখ মানুষ নিহত হয়েছে- যার বেশিরভাগই সাধারণ নিরস্ত্র মানুষ। এখনও সারাবিশ্বে গণহত্যা সংঘটিত হচ্ছে। এর আলোকেই বাংলাদেশের গণহত্যার সহিংসতার ক্ষেত্রটি বুঝতে হবে। এর বিচারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন।

এ ছাড়াও পৃথক অধিবেশনে যুক্তরাজ্যের ড. লাখুমল লুহানা, স্যামুয়েল জ্যাফি, ভারতের দিলীপ চক্রবর্তী, ড. শুভরঞ্জন দাশগুপ্ত, অনিন্দিতা ঘোষাল, তৈমুর রাজা চৌধুরী, ‌ইমাদউদ্দিন বুলবুল, আশীষ কুমার দাস, বাংলাদেশের অধ্যাপক মেসবাহ কামাল, চৌধুরী শহীদ কাদের, সাবিনা নার্গিস লিপি প্রমুখ তাদের প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। এরপর বিকেলে শাহরিয়ার কবির নির্মিত ৬৫ মিনিটের প্রামাণ্যচিত্র 'বিবেকের কণ্ঠস্বর' প্রদর্শিত হয়।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত