মারূফ অমিত

২৮ ডিসেম্বর, ২০১৪ ২০:১৬

রক্তঝরা ৬ দফা

 
৭ জুন ১৯৬৬। বাংলাদেশের ইতিহাসের খাতার একটি পাতা। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের এক অগ্নিঝরা দিন এই ৭ জুন। আত্মত্যাগে ভাস্বর এই দিন বাংলাদেশের প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।   
 
সাতচল্লিশের শুরু থেকেই বাংলাদেশের কোটি জনতা শোষণের শিকার হতে শুরু করে বর্বর পশ্চিমা শোষক দ্বারা। বিরামহীন বঞ্চনার শিকারে পরিণত কোটি বাঙ্গালী বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, ৫৪ র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে ঘুরে দাঁড়াতে চাইলেও  পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর রাজনৈতিক দাবার বোর্ডের কিস্তির কূটচাল থেকে বাঁচতে পারেনি পূর্ব বাংলার জনগণ। জনগণের রায়কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সামরিক শাসক আইয়ুব খান রাজনীতির নতুন রূপরেখা তৈরি করে। অত্যাচারের লৌহ চাকা চালিয়ে যেতে থাকে আইয়ুব শাসনের বিরুদ্ধে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠে। ১৯৬৬ সালে এমনি এক উদ্ভুত পরিস্থিতির উপর দাঁড়িয়ে বাঙালি জাতির ত্রাণকর্তা রূপে আবির্ভূত হন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ঘোষণা করেন ৬ দফা। দফা গুলো এমন ছিলঃ

প্রথম দফা – পাকিস্তানের সরকার হবে যুক্তরাষ্ট্রীয় এবং সংসদীয়। কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইনসভা প্রত্যক্ষ ও সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচিত হবে। জনসংখ্যার ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় আইনসভার প্রতিনিধি নির্বাচিত হবে।
দ্বিতীয় দফা
– যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের হাতে থাকবে কেবলমাত্র দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্র সংক্রান্ত বিষয়াদি।

তৃতীয় দফা – দেশের দুটি অঞ্চলের জন্য দুটি পৃথক অথচ সহজেই বিনিময়যোগ্য মুদ্রা থাকবে। এক্ষেত্রে দুই অঞ্চলে একক মুদ্রাও থাকতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে ফেডারেল ব্যাংককে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধন পাচার রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

চতুর্থ দফা – রাজস্ব সংক্রান্ত নীতি-নির্ধারণের দায়িত্ব এবং কর ধার্যের ক্ষমতা প্রাদেশিক সরকারগুলোর থাকবে। দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয় পরিচালনার জন্য আদায় করা রাজস্বের অংশবিশেষ কেন্দ্রীয় সরকারকে দেওয়া হবে।

পঞ্চম দফা – বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দুই অঞ্চলের জন্য পৃথক হিসাব রাখতে হবে। প্রাদেশিক সরকারগুলো বিদেশের সঙ্গে বৈদেশিক নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাণিজ্যিক চুক্তি করতে পারবে।

ষষ্ঠ দফা – কার্যকরভাবে জাতীয় নিরাপত্তায় অংশগ্রহণের জন্য প্রদেশগুলোকে প্যারামিলিশিয়া বা আধা-সামরিক বাহিনী গঠনের ক্ষমতা দেওয়া হবে।

বাঙ্গালির প্রানের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর তাসখন্দ চুক্তিকে কেন্দ্র করে ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অসম্মেলনের আলোচ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার অনুরোধ জানান। কিন্তু এই সম্মেলন তাসখন্দ চুক্তিকে কেন্দ্র করে হওয়াতে এবং ভারত – পাকিস্তান এর রাজনীতির ক্ষেত্রে এই চুক্তি পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীকে এক হুমকির সম্মুখে ফেলার চিন্তা ভাবনার জায়গা থেকে এই বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর এ দাবি আয়োজক পক্ষ প্রত্যাখ্যান করে। প্রত্যখানের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ বৈঠক থেকে ওয়াক আউট করে, সম্মেলনের সঙ্গে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে বেরিয়ে আসে। ৬ দফা উত্থাপনের পর লাহোর সম্মেলনের বিরোধীরা শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে অপপ্রচার শুরু করে। ৬ দফা উত্থাপনের পর শেখ মুজিবকে “বিছিন্নতাবাদী” বলেও আখ্যায়িত করা হয়। ৭ ফেব্রুয়ারি করাচীর ইংরেজী পত্রিকা ‘ডন’ উর্দু পত্রিকা ‘জং’সহ পশ্চিম পাকিস্তানের সকল পত্রিকা এবং ঢাকার পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনেম খানের ‘পয়গাম’সহ অন্যান্য সরকারী পত্রিকায় প্রথম পৃষ্ঠার ব্যানার হেডলাইনে বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা আখ্য্যিত করে প্রধান শিরোনাম ও করা হয়। বঙ্গবন্ধু সর্বদলীয় কনফারেন্সের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে করাচীতে সোহরাওয়ার্দীর লাখাম হাউসে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তখন      সোহরাওয়ার্দীর কন্যা আখতার সোলায়মানও ৬ দফা প্রশ্নে শেখ মুজিবের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। অবশেষে ১১ ফেব্রুয়ারি ’৬৬ (শুক্রবার) ঢাকায় ফিরে এসে বঙ্গবন্ধু বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের কাছে ৬ দফার ব্যাখ্যা করেন।

৬ দফা প্রশ্নে কিছু লোকের বিরোধিতা থাকার পর’ও  ৬ দফা প্রশ্নে শেখ মুজিবের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে সর্বপ্রথম ১৩ ফেব্রুয়ারি পত্রিকায় বিবৃতি দেন চট্টগ্রামের জেলা আওয়ামী লীগ সম্পাদক এমএ আজিজ। ১৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ২১ বিশিষ্ট আইনজীবী পত্রিকায় এক বিবৃতিতে ৬ দফাকে সময়োচিত কর্মসূচী বলে সমর্থন করেন। ২১ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগ কার্যকরী সংসদের এক বিশেষ সভায় বঙ্গবন্ধু ৬-দফা দাবি প্রস্তাবাকারে পেশ করেন এবং তা সর্বসম্মতিক্রমে বাঙালীর মুক্তির সনদ হিসেবে গৃহীত হয়। ৬-দফার প্রচারে শেখ মুজিব প্রথম জনসভা করেন চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে ২৫ ফেব্রুয়ারি ’৬৬ শুক্রবার জহুর আহমদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত লাখো জনতার বিশাল সমাবেশে বঙ্গবন্ধুর প্রস্তাব ৬-দফাকে সমর্থন জানানো হয়। এই ছয় দফার পক্ষে জনমত সংগ্রহ করতে বংবন্ধুকে অনেকবার গ্রেফতার হতে হয়েছে। ৬-দফার পক্ষে জনমত সংগঠিত করার লক্ষে সারা বাংলায় গণসংযোগ শুরু করেন।  এ সময় তাঁকে সিলেট, ময়মনসিংহ ও ঢাকায় বারবার গ্রেফতার করা হয়। ১৯৬৬-এর প্রথম তিন মাসে তিনি ৮বার গ্রেফতার হন। ৮ মে নারায়ণগঞ্জ পাটকল শ্রমিকদের জনসভায় বক্তৃতা করার পর তাঁকে আবার গ্রেফতার করা হয়। মুজিবের আটকের প্রতিবাদে এবং ছয় দফার সপক্ষে প্রথম প্রদেশব্যাপী হরতাল পালিত হয় ১৯৬৬ সালের ৭ জুন। দিনটি যাতে পালন করতে না পারে সেজন্য মোনেম খান সবিশেষ তৎপর ছিলেন। পূর্বদিন রাতে বেতার ভাষণে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।   এমনকি সাম্প্রদায়িকতা, বাঙালী-অবাঙালীর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির উস্কানি দিয়ে মোনেম খান তাঁর চিরাচরিত ভাষণ দেন। ৬ জুন ছিল প্রাদেশিক পরিষদের বাজেট অধিবেশন।    গবর্নর মোনেম খান প্রাদেশিক পরিষদে ভাষণ দিতে গেলে বিরোধী দলের সদস্যরা পরিষদ বর্জন করে হরতালের প্রতি পূর্ণ সমর্থন করেন। ৭ জুন সকাল বেলা লখো শ্রমিকের সমাবেশে তেজগাঁওয়ে যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মনি এক জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেন। সভাশেষে এক বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। হঠাৎ পুলিশ মিছিলের ওপর আক্রমণ চালায়। প্রথমে লাঠিপেটা শুরু করলে পুলিশের সঙ্গে জনতার সংঘর্ষ বাঁধে পুলিশ গুলি চালায়, যার ফলে ৩ জন গুলিবিদ্ধ হয়। এর মধ্যে সিলেটের অধিবাসী বেঙ্গল বেভারেজ কোম্পানির শ্রমিক মনু মিয়া ঘটনাস্থলে নিহত হন। তাঁর লাশ নিয়ে নুরে আলম সিদ্দিকীসহ অন্যরা মিছিল বের করেন। উক্ত ঘটনায় তেজগাঁও শিল্প এলাকায় শ্রমিকরা আরও বিক্ষুব্ধ হয় এবং তেজগাঁও রেল ক্রসিংয়ে দিয়ে উত্তর দিক থেকে আগত ট্রেনটি পথিমধ্যে থামিয়ে দেয়। ট্রেনটি পুনরায় চালাবার চেষ্টা করলে লাইনচ্যুত হয়। এই সময় পুলিশ ও ইপিআর বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য ফাঁকা গুলি ছোড়ে। এর মধ্যে একটি গুলি আজাদ এনামেল ও এলুমিনিয়াম ফ্যাক্টরির ছাঁটাইকৃত শ্রমিক নোয়াখালীর আবুল হোসেনের পায়ে বিদ্ধ হয়  আবুল হোসেন উত্তেজিত হয়ে পুলিশকে তার বুকে গুলি চালানোর আহ্বান জানালে পুলিশ তার বক্ষভেদ করে গুলি ছোড়ে এবং আবুল হোসেন শাহাদাতবরণ করেন। এখানে পুলিশের গুলিতে আরও ৫ জন আহত হয়। দুপুর নাগাদ তেজগাঁও থেকে পল্টনমুখী এক জঙ্গী মিছিল পাক মোটরস, হোটেল শাহবাগ, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন হয়ে সেগুনবাগিচার মোড়ে এলে সশস্ত্র পুলিশ বেষ্টনীর সম্মুখীন হয়। ছাত্রনেতৃবৃন্দ কার্জন হল প্রাঙ্গণে সমবেত হওয়ার জন্য মিছিলটিকে আহ্বান জানায়। তখন এক জঙ্গী মিছিল বের হয়।
 ৭ জুন নারায়ণগঞ্জের শিল্প এলাকার জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। কলকারখানা বন্ধ রাখে, জনতা ও রেলওয়ের শ্রমিকদের ওপর হামলা চালালে পুলিশের গুলিতে ৬ জন ঘটনাস্থলে মারা যান। তা সত্ত্বেও শ্রমিক নেতা সাদুর নেতৃত্বে লক্ষাধিক শ্রমিক-জনতা পোস্তগোলা, ডেমরা নারায়ণগঞ্জ থেকে মিছিল নিয়ে যাত্রাবাড়ী পৌঁছলে পুলিশ ও ইপিআর বাহিনীর প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। পল্টনে জনসভা হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু পুলিশ ও ইপিআর বাহিনী এলাকাটি সকাল থেকেই ঘিরে রাখে, যার জন্য জনসভা করা সম্ভব হয়নি। ছয় দফা দাবি প্রতিষ্ঠার প্রথম পর্যায়ের সংগ্রামে সাফল্য ও গৌরবের ইতিহাস রচনা করে তেজগাঁও, পোস্তগোলা, নারায়ণগঞ্জ, ডেমরা, আদমজীনগর শিল্পাঞ্চলের সংগ্রামী শ্রমিকরা।

এভাবেই মুক্তির সনদ ৬ দফা বাস্তবায়নে ঝরে হাজারো প্রানের তাজা রক্ত। ৬ দফা সমর্থনের প্রতিফলন হয় ৭০ এর নির্বাচনে। জয়ধ্বনি হয় শেখ মুজিবুরের নৌকার। মানুষ স্বপ্ন দেখে স্বাধীনতার-লাল সবুজের বাংলার ।। 

আপনার মন্তব্য

আলোচিত