ডা. মুফতি মোহাম্মদ শামছ

১০ জুলাই, ২০১৭ ২০:৪৮

অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস দ্বারা সৃষ্ট রোগ

কারো ডায়াবেটিস থাকলে তাকে প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করা দরকার। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন। কারণ অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের কারণে মানুষের নানা রোগ সৃষ্টি হতে পারে।

ডায়াবেটিস ও চক্ষুরোগ :
যে সকল সুস্থ সবল স্বাভাবিক মানুষ চোখ রোগের কারণে অন্ধত্ব-বরণ করেন, তাদের প্রায় ২০-২৫ ভাগ রোগীই ডায়াবেটিস দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থাকেন। ৩০ বছর বয়সের পর রুটিন চেক-আপ করানোর প্রচলন আমাদের দেশে খুব একটা গুরুত্ব দিয়ে করা হয় না, যার ফলে অধিকাংশ রোগীই জানে না তিনি যে ডায়াবেটিস এ ভুগছেন।

ডায়াবেটিস রোগ শুরু হওয়ার সময় থেকে ১০ বছর এর মধ্যেই চোখের অসুবিধা দেখা দেয় দৃষ্টি শক্তির অনেক পরিবর্তন ঘটে। অবহেলা করে অনেকেই এর প্রতি কোন গুরুত্ব দেন না অথচ অন্ধত্বের অন্যতম প্রধান কারণ হল ডায়াবেটিস। ডায়াবেটিস হলে চোখের রেটিনা নামক অংশটি ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হতে থাকে যার ক্রমধারা গুলো হলো -

  • নন-প্রলিকারেটিভ বেকগ্রাউন্ড রেটনাপ্যাথি উথআউট মেকুলোপ্যাথি
  • ম্যাকুলাপ্যাথি
  • প্রি-প্রলিকারেটিভ রেটিনোপ্যাথি
  • প্রলি ফারোটিভ রেটিনোপ্যাথি।

সব কথার শেষ কথা রোগীর চোখ দেখার ক্ষমতা লোপ পায়। যদি সিমপল বেকগ্রাউন্ড রেটিনোপ্যাথি হয় তবে কোন চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না তবে প্রি-প্রলিফারেটিভ, প্রলিফারেটিভ এবং মেকুলোপ্যাথিক রেটিনোপ্যাথি হয় তাহলে রেটিনাল লেজার ফটোকয়াগোলেশন নামক চিকিৎসা নিতে হয়। আর যদি ভিট্রিযাস এ রক্তক্ষরণ জনিত কবলে দৃষ্টি শক্তি লোপ পায় তবে ভিট্রিকটমি নামক অপারেশন করতে হয় তা না হলে রোগী চিরদিনের মত অন্ধত্ব লাভ করে। তাই ডায়াবেটিস যাদের আছে তাদের খুব নিয়মতান্ত্রিক দৈনন্দিন জীবনাচরণে অভ্যস্ত হয়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে অন্যথায় চিরদিনের মতো অন্ধত্বের শিকার হতে হবে ।

ডায়াবেটিস ও স্নায়ুরোগ :
প্রায় ৩০ ভাগ ডায়াবেটিস রোগী খুব তাড়াতাড়ি ডায়াবেটিস স্নায়ুরোগে আক্রান্ত হন। পায়ের পাতায় অবশ ভাব, ব্যথা করা, জ্বালাপোড়া করা, ক্ষত হওয়া, পায়ের মাংসপেশি শুকিয়ে যাওয়া এরই সাথে পায়ের টেনডন রিক্সেক কমে যাওয়া, কম্পন অনুভূতি লোপ পাওয়া, হাতে কারপাল টানেল সিনড্রোম ও পায়ে ফুট ড্রম হওয়া, দাঁড়ানো বাসা শুয়ে থাকা অবস্থায় তিন রকমের রক্তচাপ পাওয়া যা পশচারাল হাইপোটেনশন নামে পরিচিত; র‌্যালেটিভ টেকিকারডিয়া বা স্বাভাবিক অবস্থায় নাড়ির গতি ১০০ বিট এর বেশী পাওয়া, খাবার গিলতে গেলে গলায় ব্যথা অনুভব করা, পেট ভরা ভরা অনুভব করা, বমি বমি ভাব অনেক ক্ষেত্রে বমি হওয়া, রাতে ঘুম ভেঙে যাওয়া, পায়খানার বেগ আসার কারণে এর সাথে পাতলা পায়খানা হওয়া অথবা অপূর্ণ পায়খানা হওয়া। প্রস্রাবের চাপ থাকা সত্ত্বেও প্রস্রাব শুরু হতে দেরী হওয়া, বার বার প্রস্রাবে বেগ পাওয়া, প্রস্রাবে ইনফেকশন হওয়া, পুরুষত্ব লোপ পাওয়া বা বন্ধ্যত্ব, খাওয়ার সময় শরীরে ঘাম হওয়া, পাইপোগ্লাইসেমিয়া হওয়া ছাড়ায় রাতে শরীরে ঘাম হওয়া, মুখ শুকনা ভাব পায়ের চামড়া ফাটা, পায়ের পাতা ঠাণ্ডা হওয়া এবং লাইট রিফ্লাক্স নষ্ট হয়ে যাওয়া বা দেরিতে হওয়া, যদি এ লক্ষণ দেখা তবে অবিলম্বে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য কঠোরভাবে আত্মনিয়োগ করা।

ডায়াবেটিস ও কিডনি রোগ :
ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত থাকলে কিডনি রোগ হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ১৭ গুণ বেশী। যে সকল রোগের কারণে কিডনি নষ্ট বা বিকল হয়ে যায় ডায়াবেটিস তাদের মাঝে অন্যতম প্রধান একটি রোগ। দীর্ঘদিন থেকে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস কিডনি বিকল করে দেয়। তিনটি ধাপে ডায়াবেটিস রোগীর কিডনি বিকল বা নষ্ট হয় প্রথমে গ্লমেরুলার ডেমেজ হয় এরপর ইসচেমিয়া হয় এবং তারপর এসেনডিং ইনফেকশন। কিভাবে বুঝবেন? -শরীর ফুলে যাওয়া প্রস্রাবে প্রোটিন পাওয়া- শরীরে পানি জমে যাওয়া, উচ্চ রক্তচাপ, প্রস্রাবের সাথে রক্ত যাওয়া। কি করবেন? - কিছুই করার নেই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতেই হবে তারপর ও যদি হয়ে যায় তখন কি করবেন বসে বসে আল্লাহর নাম ডাকবেন কারণে চিকিৎসা শাস্ত্রের অনেক উন্নতি হলেও ডায়াবেটিক নেক্রপেথি হয়ে গেলে তা কমিয়ে আনার কোন উপায় এখনও আবিষ্কার হয় নি। তবে চিকিৎসা শাস্ত্রে কিডনি বিকল হওয়ার গতিটা কিছু কমিয়ে আনতে পারে কিন্তু পুরোপুরি বন্ধ করতে পারে না। যদি উচ্চ রক্তচাপ থাকে তবে প্রোটিন জাতীয় খাবার (৪০ - ৬০ গ্রাম /দিন) কম পরিমাণে খেতে হবে এবং উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য ACE inhibitor ও লোপ ডায়াবেটিস জাতীয় ঔষধ ব্যবহার করতে হবে। আর যদি কিডনি বিকল হয়েই যায় মানে সিরাম ক্রিয়েটিনিন যদি ২০০ মিলিমোল পার লিটারের হয়ে যায় তবে সাথে সাথে কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ নেকফ্রোলজিষ্টর এর পরামর্শ নিতে হবে।

আর সিরাম ক্রিয়েটিনিন যদি ৪৫০ মিলিমোল পার লিটারের বেশী হয়ে যায় তবে ডায়াবেটিস বা কিডনি ট্রাস্নপ্লাণ্ট করার প্রস্তুতিমূলক ডায়ালাইসিস নিতে হবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এর পরামর্শ অনুযায়ী।

ডায়াবেটিস ও পায়ের ক্ষতরোগ :
যাদের ডায়াবেটিস নিউরোপ্যাথি হয়ে গেছে তারা খুব ঘন ঘন পায়ের পাতায় ক্ষত রোগে আক্রান্ত হন। কারণ হল নিউরোপ্যাথি হওয়া পায়ের অনুভূতি ক্ষমতা লোপ পায় তাই পায়ে কোন আঘাত লাগলে বা ক্ষত হলে রোগী সহজে বুঝতে পারেন না ফলে ক্ষতস্থানে ইনফেকশন হয় আর পায়ের টিস্যু পচে যায় খুব দ্রুত। তার কারণ ১। নিউরোপ্যাথি ২। ইনফেকশন আর ৩। রক্ত চলাচল কমে যাওয়া বা ইসচেমিয়া। কিভাবে বুঝবেন?

- প্রাথমিকভাবে যদি নিউরোপ্যাথি হয় তবে পায়ের পাতায় হাত দিলে কিছুটা গরম অনুভূত হবে, পায়ের রক্তনালীর বা নাড়ীর গতি কখনো পাওয়া যাবে কখনো পাওয়া যাবে না, অনুভূতি লোপ পাবে, চামড়া পিংক বা রক্তবর্ণ ধারণ করবে, পা দেখতে শুকনো শুকনো মনে হবে ,স্বাভাবিক চামড়ার যে মসৃণতা আছে তা লোপ পাবে, কেলাস তৈরি হবে চামড়ার খসে যাবে, ব্যথাবিহীন ক্ষত তৈরি হবে, ক্ষত স্থানের চামড়া আর স্বাভাবিক চামড়ার মাঝখানে একটি কালো লাইন বা দাগ কাটা থাকবে আঙুল পচা শুরু হবে (ডিজিটাল গ্যানস্রিন পায়ের ইন্টারোসিয়াস মাসুল নামক অংশ শুকাতে থাকবে এবং পা কিছুটা ফোলা থাকবে। আর প্রাথমিকভাবে যদি রক্ত চলাচল কমে যায় তবে - পায়ের পাতা হাত দিয়ে ঠাণ্ডা অনুভূত হবে পায়ের রক্তনালীর নাড়ীর গতি পাওয়া যাবে না, পায়ের অনুভূতি ঠিক থাকবে, পায়ে আলসার বা ক্ষত হয়ে তাতে ভাল ব্যথা অনুভব হবে, পায়ে পচন ধরবে (গ্যানগীন হবে)।

যদি ডায়াবেটিক ফুট হয়েই যায় কি করবেন?
- খুব যত্ন সহকারে কঠোরভাবে ডায়াবেটিক নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, পায়ের যত্ন নিতে হবে। বিশেষজ্ঞ ভাস্কুলার সার্জনের পরামর্শ মোতাবেক পায়ের এনজিওগ্রাম করে রক্ত নালীর রিকন্সট্রাকশন করার সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে। (চিরপডিষ্ট বা পা রোগ বিশেষজ্ঞ এখনো আমাদের দেশে তৈরি হয়নি। উন্নতবিশ্বে থেকে আমরা স্বাস্থ্য খাতের দিকে অনেক পিছিয়ে)

সতর্ক সাবধান নিয়মিত নিয়মতান্ত্রিক গোছানো জীবনযাপনে অভ্যস্ত হতে পারলে ডায়াবেটিস থাকা সত্ত্বেও - এ সকল অসুবিধা থেকে দুরে থাকা সম্ভব।

  • ডা. মুফতি মোহাম্মদ শামছ: এমবিবিএস, সিসিডি, এফএমডি, এফসিজিপি।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত