ইমেল নাঈম-এর চার কবিতা

 প্রকাশিত: ২০১৫-১০-২১ ২৩:৪৭:১৬

ব্যথা ছড়িয়ে পড়ছে এই শহরের পথে প্রান্তরে, অনেক দিন হাঁটি নি যাযাবর পথে, স্থির দৃষ্টি ভুলে গেছে শব্দ স:

অনেক দিন
 
কতকাল দৌড়ে আসা ভ্রান্ত সময়ের পরে
তিক্ততার মাঝে লুকায়িত যে’টুকু প্রবঞ্চনা,
তাতে আঘাতের পর আঘাতে জর্জরিত হয়
যে শরীর তার প্রেসকিপশনে ওষুধ নেই।
 
রোগের লক্ষণ নিরূপণে আঁকড়ে ধরা অনুভব
ভাষা থমকে যায় ভুল অবয়বে, ক্ষতবিক্ষত
শরীরে উঠে দাঁড়ায়, অতঃপর তাকিয়ে থাকে
অনির্দিষ্ট গন্তব্যে। গন্তব্যে এঁকে দেয় সব পথ
 
কোথাও শিউলি ফুটছে। পথের ধারে দৌড়ে
চলা মানুষের ভিড়, এক অসহায় আত্মকথা
এ’ পথে হাঁটে নি অনেক দিন। অনেক দিন
কবিতা লেখার ছলনায় ভুল করে নি আর
 
ব্যথা ছড়িয়ে পড়ছে এই শহরের পথে প্রান্তরে,
অনেক দিন হাঁটি নি যাযাবর পথে, স্থির দৃষ্টি
ভুলে গেছে শব্দ সুরের মূর্ছনা বধিরের
অভিনয়ে  অন্ধ সাজা। প্রাপ্যগুলো বেহিসাবি—
হয়ে পড়ে থাকে অবহেলায় অনেক দিন...
 
 
 
অকৃত্রিম আবাসন
 
একদিন থেমে যাবে আমাদের সকল যাত্রাপথ
থেমে যাবে প্রাণের স্পন্দন, পত্রিকার পাতায়
প্রতিদিনের হারিয়ে যাওয়া খবরের মতো ভেসে
যাবো আমরা। এরচেয়ে ভালো শিশুটিকে দেখি।
 
কঠোর নিরাপত্তার ভিড়ে খেলছে আপন মনে
সামনে সারিবদ্ধ কঠিন এক মানব প্রাচীর
এর দেয়াল ভাঙতে গেলেই ছড়িয়ে দেয়া হয়
মরিচের গুড়ো নাকে মুখে। এই বিশ্বে কেউ
দেয় নি তাকে বেষ্টনির ও'প্রান্ত দেখার অধিকার।
 
এই দেব শিশুতে খুঁজি আগামী দিনের পৃথিবী,
তার মাঝেই নবজাগরণের অস্ফুট আলোড়ন,
রুদ্ধ করে দাও তার ক্ষমতা। ক্ষুধা, দরিদ্রতার
বন্ধনে আটকে দাও। সংকুচিত করো তার চোখ।
 
সে স্বপ্ন দেখতে ভুলে যাক চিরতরে, পৃথিবীকে
গড়ে তোল কঠিন রুক্ষতায়। পাঠ্যবই নয়।
পরিবার নয়। বন্ধু বান্ধবও নয়। তাকে শেখাও
এই পৃথিবীতে সে একা, নিরুপায়,  অসহায়।
 
চোখ বুজে সবাই মেনে নাও তার এই পরিণতি
একমাত্র পরিচয় হোক আশ্রিত, অন্ধকার হোক
চলার সাথী। সবাই জেনে শুনে চুপ করে থাকো—
ভুলে যাও শান্তির মন্ত্র, নীরব হও বৃক্ষের মতো
 
আঘাত সহ্য করো, মৃত্যুকে বরণ করে নাও
তবুও বলো না — যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই,
সবার জন্য পৃথিবী হোক অকৃত্রিম আবাসন।
মানবতা ব্যবসায়ীরা বেঁচে থাকুক যুদ্ধ সংঘাতে।
 
 
সাতকাহন
 
তিক্ত শব্দগুলো অবচেতনেই ঘোরাফেরা করে
অনেক হলো রসায়ন, আজ হোক ভিন্ন গল্প
কথার পিঠে কোন কথা জমবে না আর
জন্মের পরেই শুকিয়ে যাওয়া এক নাইট কুইন।
 
বৃক্ষের মূলে জমে থাকা শিশির কণাগুলো
শিকড়ের সান্নিধ্যে শীত নিদ্রায় লুটিয়ে যায়
এভাবে ক্লান্তি ঝাড়ছে আমার স্বপ্নগুলো।
তবুও ক্লান্তিতে বশ্যতা স্বীকার করে উঠি
 
অনুরণন থাকে নদীরও, সেও শিখেছে অংক
জোয়ার ভাটার নিয়মকানুনে ভাসে, ভাসায়
প্লাবনে আটকে দেয় আমাদের যত আয়োজন
হিসেব করে ওঠে অকারণেই, অচ্ছুত কল্পনায়
আঁকড়ে ধরি। স্পর্শ নয় আর কোনো।
 
স্পর্শগুলো আজ একেকটি সাতকাহনের বিলাপ
এখানে আনন্দের রূপান্তর ঘটে প্রতিটি মুহূর্ত
বিষাদ ছুঁয়ে যায় , চিবুক চুইয়ে পড়ে দুঃখ
বিচ্ছেদের অংকেই থেকে যায় সকল সুখ ধর্ম।
 
 

 
মৃত্যুর আয়োজন

 
এমন মিথ আর ভ্রান্ত বিশ্বাসে আর কত রাত পোড়াবে। ধোঁয়ার মায়াজালে বিতৃষ্ণ জীবন, রেখে যাওয়া আদি পথ। এখানে হরিত বর্ণ শুকিয়ে ম্লান হয়। বখে যাওয়া জীবন জানে, ঝরে পড়া ম্লান রঙের প্রতি ফোঁটায় গোপন ব্যথাতুর আসক্তি। ছুঁয়ে যাওয়া দুঃখরা জানে, নিকোটিনের চেয়ে বেশি কেউ চেনে না তাকে। বাদবাকি সব কিছু একটা মোহ।  
 
বেশি কথা জমা নেই আমাদের এই বিভ্রান্ত পথে। কাশফুলের মেলায় থোকায়থোকায় জমাট বদ্ধ শুভ্রতাটুকু চুরি করে নেয় সবুজ, হলুদ আর তামাটে মাটি। এখানে কিশোরী দৌড়ে, দামাল বালক উদোম গায়ে উড়ায় ঘুড়ি। প্রেমিকের দল এপথে আসে না কোনো। তাদের সময় কাটে আলো আঁধারে, শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কোনো কক্ষে। যেখানে ভালবাসা কক্ষপথ ভুলে হারিয়ে যায়।   
 
হারিয়ে গেছে আরো অনেক কিছু। রাখালের দল, গরুর পাল। গ্রাম্য বধূর ঘোমটা তোলা পথ। পালকিবাহক, তার সামনে পিছে দৌড়ে চলা বিয়ের অতিথি। পাল তোলা নৌকো, মাঝিমাল্লার কণ্ঠের গান, বাউল দলের একতারার টুংটাং। আধুনিকতার স্রোত এসে হানা দিয়ে গেছে তাদের। হারিয়ে গেছে, বিনিময়ে পেলাম দুঃখের সান্নিধ্য।  
 
তোমাদের ঘরজুড়ে আজ মোমবাতির আলো জ্বলুক, লেড বাতির বদলে। পুড়তে থাকুক দেশলাইকাঠি। পুড়ুক বুকের বাম প্রকোষ্ঠ, অবচেতন পচন ঠেকাতে ব্যর্থ হোক ভিন্ন সুন্দরী প্রেমিকার দল। অতীত ছিঁড়ে খায় ভেতরটা, বাইরে দিয়ে চাকচিক্যময় সুরম্য দেয়াল। নেশা আসুক, পানীয়জলে, আমার মৃত্যু লেখা হোক এমন আয়োজনে।

আপনার মন্তব্য