ধারাবাহিক উপন্যাস: বসনা- ৭

রেজা ঘটক

 প্রকাশিত: ২০১৫-১০-২৭ ১৫:৫৮:৫৪

 আপডেট: ২০১৫-১০-২৭ ১৬:০৪:৪৬

বসনা উপন্যাস মূলত ইতিহাস প্রধান। বসনিয়া যুদ্ধ ও জীবন এই উপন্যাসের উপজীব্য বিষয়। লেখার পরতে পরতে ফুটে:

পূর্ব প্রকাশিতের পর...

মাথা নষ্ট হলেই বউ পিটাই।

দ্রিনা নদীর দক্ষিণ পারে বসনিয়ার পাহাড়ি ভ্যালি জোয়ার্নিক আর উত্তর পারে সার্বিয়ার মালি জোয়ার্নিক। দ্রিনা নদী এই দুই জোয়ার্নিককে ভৌগলিক ভাবে আলাদা করেছে। প্রায় ৩৪৬ কিলোমিটার দীর্ঘ দ্রিনা নদী আসলে বসনিয়া-হারজেগোভিনাকে সার্বিয়া থেকে আলাদা করেছে। দ্রিনা হলো বসনিয়া-হারজেগোভিনা ও সার্বিয়ার সীমানা নির্ধারনী নদী। বসনিয়ার গোটা উত্তর-পূর্ব সীমানা ঘিরে এই দ্রিনা নদী। বসনিয়ার একেবারে পূর্বদিক জুড়ে পুরোটা সার্বিয়া, উত্তর, পশ্চিম আর দক্ষিণ-পশ্চিমটা জুড়ে ক্রোয়েশিয়া, দক্ষিণ-পূর্বের কিছুটা সীমান্ত জুড়ে মন্টিনিগ্রো আর একেবারে বসনিয়ার দক্ষিণের দভ্রোনিকের বিশাল অংশ জুড়ে আদ্রিয়াটিক সাগর।  

সার্বিয়ার রাজধানী বেলগ্রেট থেকে বসনিয়া-হারজেগোভিনার রাজধানী সারায়েভো পর্যন্ত প্রধান যে মহাসড়ক, সেটি দ্রিনা নদীর কাছে জোয়ার্নিক পয়েন্ট দিয়ে গেছে। ১৪১০ সাল পর্যন্ত জোয়ার্নিক ‘বেল টাওয়ার’ নামে পরিচিত ছিল। তখন পর্যন্ত বসনিয়া ও উত্তরের সকল জনপদে ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য প্রধান ঘাঁটি ছিল জোয়ার্নিক। অটোমান তুর্কি সাম্রাজ্যের সময় জোয়ার্নিক ছিল সানিয়াক অঞ্চলের রাজধানী শহর।

অটোমান সাম্রাজ্যে যে ছয়জন সানিয়াক রাজা ছিলেন, মূলত তাদের সময়ে জোয়ার্নিক অঞ্চলে জনবসতি গড়ে উঠতে শুরু করে। সানিয়াক রাজাদের সরাসরি তত্ত্বাবধানে তখন জোয়ার্নিক অঞ্চলে যেসব জনবসতি গড়ে উঠেছিল, সেগুলোর মধ্যে জোয়ার্নিক, ভিদিন, নিকোপলিস, পোজেগা, স্মেদারেভো ও মোহাক ভ্যালি ছিল অন্যতম। ১৮০৬ সালে বসনিয়ার বিখ্যাত মুসলিম বসনিয়াক ক্যাপ্টেন মেহমেদ বেগ কুলেনোভিক জোয়ার্নিকে বসবাস শুরু করেন। মূলত তখন থেকেই জোয়ার্নিক ভ্যালিতে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগতে শুরু করেছিল। ক্যাপ্টেন মেহমেদ বেগের মত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে এই জোয়ার্নিকে এসেই আমি বাড়ি করে বসবাস শুরু করলাম। আর আমার বাপ-দাদাদের চৌদ্দগোষ্ঠীর বসবাস ছিল দ্রিনা নদীর পাশেই নিকোপলিস ভ্যালিতে।

বসনিয়া যুদ্ধের আগে ১৯৯১ সালে জোয়ার্নিকের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৮২ হাজার। যার মধ্যে প্রায় শতকরা ৬০ ভাগ ছিল বসনিয়াক মুসলিম, শতকরা ৩৭ ভাগ ছিল অর্থোডক্স সার্ব, শতকরা ২ ভাগ ছিল যুগোশ্লাভ ও অন্যান্য, আর শতকরা ১ ভাগের মত ছিল ক্যাথলিক ক্রোয়্যাট।

জোয়ার্নিকের ঠিক যে পয়েন্টে আমার বাড়ি, তার ঠিক পেছনেই দ্রিনা নদী। বসনিয়ার অন্যান্য অঞ্চলের মত জোয়ার্নিকে শীতের সময় খুব শীত পড়ে। প্রায় প্রতি বছর তুষারও পড়ে। আবার গরমের সময় প্রচণ্ড গরম পড়ে। পাহাড়ি এই জোয়ার্নিক ভ্যালির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অন্যান্য বলকান দেশগুলোর চেয়েও চমৎকার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মান থেকে ফিরে আমি এই জোয়ার্নিকে এসে বাড়ি করি। বাড়ি করার এক বছরের মাথায় হাইরিয়াকে বিয়ে করি।

আমাদের বিয়ের তিন বছরের মাথায় আমার বড় মেয়ে সাদিয়ার জন্ম হয়। সাদিয়ার কথা মনে পড়লে এখনো আমার বুকটা একেবারে নিরেট পাথর হয়ে যায়। আমার বড় মেয়ে সাদিয়াকে আমরা বাঁচাতে পারিনি। সাদিয়া তখন এক বছরের একটু বড়। হাঁটি হাঁটি পা পা করে একটু একটু হাঁটে। পুরো বাড়িতে সাদিয়া সাধ্যমত হাঁটার চেষ্টা করে। বাইরের চুলায় ভুট্টা সিদ্ধ দিয়ে আমার বউ হাইরিয়া কি কাজে যেন ঘরে ঢুকেছিল। সেই ফাঁকে কোত্থেকে দৌঁড়ে এসে হঠাৎ সেই জ্বলন্ত চুলার মধ্যে পড়ে যায় আমার অতি আদরের ছোট্ট সাদিয়া।

আমি তখন কাছেই আমার আলু ক্ষেতে কাজ করছিলাম। হঠাৎ হাইরিয়ার চিৎকারে আমি বাড়িতে ছুটে আসি। এসে দেখি আমার ছোট্ট সাদিয়া যেন একখণ্ড জ্বলন্ত আগুনের টুকরার কয়লা হয়ে গেছে। সাদিয়ার পুরো পেট-বুক পুড়ে একেবারে আঙ্গার হয়ে গেছে। ওইটুকু ছোট্ট শরীরের হাত-পা-মাথা কোথাও পুড়তে কিচ্ছু আর বাকি নাই। মাত্র আধা ঘণ্টায় সব শেষ। আমার আদরের সাদিয়া চোখের সামনে ছটফট করতে করতেই মরে গেল। সেই কষ্ট আমি জীবনে আর কখনোই ভুলতে পারিনি।  

জোয়ার্নিকের নতুন বাড়িতে দ্রিনা নদীর তীর ঘেঁষে ছোট্ট সাদিয়াকে কবর দিলাম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, সেই রাত থেকে আমার লাগাতার মদ খাওয়ার আবার শুরু। আমি যেন তখন থেকে পাগল হয়ে গেলাম। কিচ্ছু ভালো লাগত না। দিনে রাতে যখন খুশি মদ গিলতাম। কাজে মন বসাতে পারতাম না। যখন মন মেজাজ দুটোই খারাপ হতো তখন হাইরিয়াকে পাগলের মত মারতাম। আবার কয়েক ঘণ্টা পর মনে হতো হাইরিয়াকে মারাটা খুব অন্যায় হয়েছে। আবার কাছে ডেকে হাইরিয়াকে আদর করতাম। কিন্তু যখনই সাদিয়ার কথা মনে পড়ত, তখনই আমার মাথার ভেতর ভারি গোলমাল পাকাত। কিচ্ছু না পেয়ে তখন আবার হাইরিয়ার উপর চড়াও হতাম।

এমনিতে আমার গায়ে তখন সিংহের মত শক্তি। হিটলারের সেনাবাহিনীতে ছিলাম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমি ছিলাম হিটলারের সেনাবাহিনীর একজন দক্ষ টেইলার। স্বয়ং হিটলারের অনেক জামা, কোর্তা, স্যুট-প্যান্ট আমি নিজ হাতে বানিয়েছি। সেটা নিয়ে আমার ভেতর এক ধরনের অহঙ্কারও ছিল। জোয়ার্নিকে এই বুড়ো সোলায়মানের কাছে এখনো অনেক নামকরা লোক স্যুট বানাতে আসেন। আমার বানানো স্যুট দেখে যে কেউ বুঝতে পারত এটা ওই বুড়ো সোলয়মানের কাজ।   

রাশিয়ার সৈন্যদের কাছে হিটলার বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর আমার মত যারা ভাগ্যবান সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যায়, তাদেরকে যার যার দেশে যাবার সুযোগ দেওয়া হলো। আমি দেশে ফিরে দেখলাম, নিকোপলিস ভ্যালিতে পরিবারের আর কেউ বেঁচে নেই। আমার বাবা বেঁচে নেই। আমার মা বেঁচে নেই। আমার একমাত্র ছোট বোন তানিয়া বেঁচে নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আমার পরিবারের সবাইকে মেরে ফেলেছে। একমাত্র আমি সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলাম।

জার্মান থেকে আমার সঙ্গে যুগোশ্লাভিয়া ফিরেছিল আমার বন্ধু রুস্তুম। আমার পরিবারের কেউ জীবিত নেই শোনার পর, রুস্তুম আমাকে এদিকে বসবাসের জন্য উৎসাহ দিল। রুস্তুমদের বাড়ি এখান থেকে দুই-আড়াই মাইল ভেতরে গ্রামে। আর রুস্তুমের সঙ্গে ওদের বাড়িতে যাওয়া আসা তখন এতই ঘনিষ্টতায় গড়াল যে, এক সময়ে রুস্তুম ওর একমাত্র ছোট বোন হাইরিয়াকে বিয়ে করার জন্য আমাকে প্রস্তাব করল। আমাদের বিয়ের তিন মাস আগে রুস্তুমও বিয়ে করেছিল।

সেই থেকে জোয়ার্নিকের সঙ্গে দ্রিনা নদীর সঙ্গে আমার জীবন মিশে আছে। জোয়ার্নিক আর দ্রিনা যেন আমার জীবনের অংশ হয়ে গেছে। আমার আদরের সাদিয়ার কবর এই দ্রিনার কোল ঘেঁষে। সাদিয়ার কথা আমি আমার বাকি জীবনেও ভুলতে পারব না। তারপর একে একে হাইরিয়ার গর্ভে আসল সামিয়া, রাফিয়া আর মার্সিয়া। আমার বাড়ির সামনে একটা দোকান দিলাম। সেখানে আবার টেইলারিং শুরু করলাম। জোয়ার্নিকের সবাই আবার আমাকে মাস্টার সোলায়মান ডাকা শুরু করল। সকালে বাড়ির সামনের ক্ষেতে কাজ করতাম। আর বিকালে দোকানে জামাকাপড় সেলাই করতাম।

কখনো কখনো অনেক রাত করে বাড়িতে ফিরতাম। সাদিয়ার কথা মনে পড়লেই মদের বোতল নিয়ে বসতাম। তারপর মেয়েরা বড় হতে শুরু করল। আমার কাজের চাপ খুব বেড়ে গেল। দোকানে আমি তখন সারাদিন কাজ করতাম। হাইরিয়া সকালে ঘরে কাজ করত। আবার বিকালে কখনো কখনো আমার বদলে ক্ষেতে কাজ করত। কখনো দুজনে মিলে ক্ষেতে কাজ করতাম।

আলু আর ভুট্টা আমাদের একমাত্র খাবার তখন। আর আমরা দুজনেই এটার চাষবাষ জানতাম। আমি যেমন জামাকাপড় সেলাইতে মাস্টার, আমার বউ হাইরিয়া তেমন ক্ষেত থেকে আলু তোলায় মাস্টার। আলু আর ভুট্টার যে কতরকম রান্না জানে হাইরিয়া। আর হাইরিয়ার রান্নার হাতও খুব ভালো। একে একে মেয়েরা বড় হলো। একটা সময় পর ওদের বিয়ে হলো। আর ধীরে ধীরে মদ খেয়ে হাইরিয়াকে পেটানোর আমার বদাভ্যাসটাও চলে গেল। এখনো যৌবনকালের সেসব পাগলামির কথা মনে পড়লে নিজেরই খুব হাসি পায়।

সামিয়া বিয়ের আগেই ভালো চাকরি পেল। আইন বিষয়ে পড়াশুনা করার পর সামিয়া আমাদের কোর্টে সরকারি হাকিম হিসাবে চাকরি পেল। কিন্তু বেলগ্রেডে নার্সিং পড়তে থাকা রাফিয়া তখন অনেকটাই আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। লোকমুখে রাফিয়ার নামে আমার কাছে তখন নানান কিসিমের নালিশ আসত। কেউ বলত রাফিয়া নাকি একটা বিদেশি ছেলের সঙ্গে ডেটিং করে। কেউ বলত রাফিয়া হাসপাতালের ডাক্তারদের মাথা নষ্ট করে দেয়। কেউ বলত সে কোনদিন না কোন রোগীর সঙ্গে বিয়ে করে ভেগে যায়। এই নিয়ে তখন হাইরিয়ার মহাটেনশন। আমি বউকে বলতাম, আমার মেয়েকে তো আমি চিনি। তুমি এত উতলা হইও না।  

ছোটমেয়ে মার্সিয়াও তখন বড় হচ্ছে। কলেজের ফাইনাল পরীক্ষা শেষে। কেউ কেউ পরামর্শ দিল, রাফিয়ার মত মার্সিয়াকে যদি এখন বেলগ্রেডে পড়তে পাঠাও, এই মেয়েও বেয়ারা হয়ে যাবে। হাইরিয়া কিছুতেই মার্সিয়াকে বেলগ্রেড পাঠাতে রাজি নয়। আমিও তখন কিছুটা দ্বিধান্বিত। পরে মার্সিয়াকে দোকানে আমার সাথে জামা সেলাইয়ের কাজ শেখাতে শুরু করলাম। মার্সিয়া ধীরে ধীরে আমার কাছ থেকে প্যান্ট-শার্ট, স্যুট, কোট কাটা শিখতে শুরু করল। মার্সিয়ার কলেজের রেজাল্ট হলেই ওর বিষয়ে যে কোনো একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমাকে। ততদিন ও দোকানে বেশ মনোযোগী ছাত্রীর মত কাপড় কাটার কাজ শিখতে লাগল। ঠিক এই সময়ে এক বিকালে রাফিয়া তার সেই বিদেশি বন্ধুকে নিয়ে আমার দোকানে এসে হাজির হলো। ছেলেটি রাফিয়ার চেয়ে অন্তত প্রায় দুই ফুট খাটো। ছেলেটি নিজেকে ডাক্তার লোহানী বলে পরিচয় দিল। মার্সিয়ার সঙ্গে ওদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে আমি আর কোনো কাজ করতে পারলাম না। ভেতর থেকে দোকান বন্ধ করে আমি মদের বোতল নিয়ে বসলাম।

আগের পর্বের লিংকসমূহ

বসনা- ১

বসনা- ২

বসনা-৩



বসনা- ৪


বসনা- ৫


বসনা- ৬

আপনার মন্তব্য