রণদীপম বসু : আলোর পথের যাত্রী

 প্রকাশিত: ২০১৫-১১-০৯ ১৮:০৫:৩৪

 আপডেট: ২০১৫-১১-০৯ ১৮:০৯:৫৫

হাসান আওরঙ্গজেব:

বাংলাদেশের সৃজনশীল ব্লগ-চর্চা আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ রণদীপম বসু গত ৩১ অক্টোবর প্রকাশনা সংস্থা শুদ্ধস্বরের কার্যালয়ে প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুল ও কবি তারেক রহিমের সাথে নৃশংস জঙ্গি হামলার শিকার হন।

ঘাতকেরা চেয়েছিল তিনজনের মৃত্যু একসাথে নিশ্চিত করতে। কিন্তু পরম করুণাময়ের অশেষ কৃপা, মানুষের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও ভালবাসায় সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে তিনজনই ফিরে আসেন। নতুন করে জীবন পান। অথচ এই তিনজনই মুক্তচিন্তা ও মত প্রকাশের জন্য জীবন দেয়া শহীদদের কাতারে খুব সহজেই শামিল হয়ে যেতেন। নিয়তি তাদেরকে নিতান্তই করুণা করেছে। আরেকবার হেমন্তের শিশির আর পাকাধানের ঘ্রাণ নিতে তাদেরকে বাঁচিয়ে রেখেছে পুনর্বার মরনাঘাত না আসা পর্যন্ত।

“বেঁচে আছি তাই ভাবছি” মৃত্যুর থাবা থেকে ফিরে এসে প্রথমবারের মত রণদীপম বসু তার টাইমলাইনে লিখছেন, সবার তীব্র সহায়তা পেয়ে এবারের মতো বেঁচেই গেলাম মনে হয়! তাই ভাবছি নতুন জন্মের তারিখটা হোক ৩১শে অক্টোবর!

পুরনোটা হয়তো ইতিহাস, তবু তা নিজের কাছে বড্ড সেকেলে, ম্লান ও তাৎপর্যহীন এখন!!”

হ্যাঁ, পুরোনো জন্মদিনটার মত তিনিও এতদিনে ইতিহাস হয়ে যেতে পারতেন, স্মৃতি হয়ে যেতে পারতেন, দীপনের মত কিংবা অভিজিতের মত কিংবা অনন্তের মত কিংবা নীলাদ্রির মত কিংবা বাবুর মত কিংবা রাজিবের মত। তারপর একদিন আমরা ভুলে যেতাম সবকিছু। বিরামহীন খুনের সংস্কৃতিতে আমরা ভুলে যেতাম কে-কোথায়-কখন খুন হয়েছিলো। কিংবা আদৌ কি কেউ খুন হয়েছিল? আমাদের একথা স্মৃতিচারণ করতে কিংবা স্মরণ করতে কষ্ট হতো যে রণদীপম বসু নামে টুটুল নামে তারেক নামে কেউ একসময় বেঁচেছিল আমাদের সময়ে।

যারা রণদীপম বসুর বই ও ব্লগের নিয়মিত পাঠক কিংবা ব্যক্তিগত পর্যায়ে তাঁকে চেনেন, তাঁরা জানেন তার চিন্তা-চেতনা ও বিশ্বাস সম্পর্কে, তার পরমতসহিষ্ণুতা ও শ্রদ্ধাবোধ সম্পর্কে। তার বিনয় ও মানুষের প্রতি তার মমত্ববোধ সম্পর্কে। ভার্চুয়াল জগতে একজন চিন্তাশীল ও বিরামহীন সৃজনশীল চেতনার চর্চাকারী হিসেবে তিনি পরিচিত।

বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে সাথে যারা এই মাধ্যমে ব্যক্তিগত পর্যায়ে শিল্প সাহিত্য দর্শন বিজ্ঞান ও মুক্তচিন্তার চর্চা করেছেন, বাংলা ভাষায় এই মাধ্যমকে সমৃদ্ধ করেছেন, তিনি তাদের অন্যতম। তার লেখনী কোনো ধর্ম বা গোষ্ঠীকে আঘাত হেনেছে, কারো অনুভূতি ও মর্যাদাবোধকে হেয় করেছে এমন নজির কেউ উপস্থাপন করতে পারবেন না। অথচ তিনি ধর্মান্ধদের চাপাতির কোপে ক্ষত বিক্ষত হলেন। তার জীবন বিপন্ন হল।

রণদীপম বসু তার “দর্শন চর্চা ও কিছু ঔচিত্যবোধ প্রসঙ্গে” প্রবন্ধে বলেন-

“......ইদানিং বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে যখন কাউকে কাউকে সদম্ভে নিজেকে নাস্তিক হিসেবে পরিচয় দিতে দেখি কিংবা কেউ কেউ যুক্তিনিষ্ট আস্তিক হিসেবে নিজেকে পরিচিত করান তখন আমার কেবলই বিভ্রম হয়! কেননা এই আমি যে সত্যিই মূর্খ এ বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। আমার মূর্খতার বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ।...”

হ্যা, রণদীপম বসু এমনই একজন বিনয়ী ও সংবেদনশীল মানুষ, যিনি গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে না গিয়েও মূলধারার সাহিত্য ও দর্শন চর্চায় নিজেকে একনিষ্ঠ রেখেছেন। তিনি বিশ্বাস করেন- চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোনো মাহাত্ম্য নেই। তা প্রকাশ করতে যদি লজ্জাবোধ হয়, তবে সে ধরনের চিন্তা না করাই বোধ হয় ভাল।

রসায়ন শাস্ত্রের ছাত্র হয়েও দর্শন শাস্ত্রে তার যে অগাধ ব্যুৎপত্তি ও পান্ডিত্য, তা আমাদের বিস্মিত করে। ভারতীয় দর্শন ও সংস্কৃত সাহিত্যের উৎপত্তি ও বিকাশ, সাংখ্য-দর্শন, যোগ-দর্শন, মীমাংসা-দর্শন, বৌদ্ধ-দর্শন, বৈশেষিক-দর্শন, বেদান্ত-দর্শন, ন্যায়-দর্শন, জৈন-দর্শন এসব জটিল দার্শনিক টার্মস সমূহকে আধুনিক পাঠকের জন্য সহজবোধ্য, প্রাঞ্জল ও পাঠযোগ্য ভাষায় পরিশ্রম সাধ্য অজস্র লেখনীর মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেছেন।

প্রাচীন ভারতীয় আস্তিক-দর্শন, যা আসলে ধর্মের নিগূড় তত্ব ও নৈতিকতার মাপকাঠি ছিল, পুরাণ ও শাস্ত্রের কিছু পূজনীয় গ্রন্থাদির অলৌকিক মাহাত্ম্য দিয়ে যা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল- তার ভিত্তিভূমিকে চ্যালেঞ্জ করেছে যে চার্বাক দর্শন, তিনি নতুন আঙ্গিকে তাঁকে জীবন্ত করেছেন।

এই প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন-

“...প্রাচীন লোকায়তিক চার্বাকেরা যাবতীয় শাস্ত্রীয় অলৌকিকতাকে এমনই নির্মম বিদ্রূপ বাণে বিদ্ধ করেছেন যে যুক্তিহীন অলৌকিকতার শাস্ত্রীয় সৌধটা কল্পনায় চোখের সামনেই ধূলিস্মাৎ-ই হতে দেখি শুধু, কিন্তু নিজেকে এমন কোন বিকল্প আরেকটি সুরম্য সৌধে অধিষ্ঠিত হতেও দেখি না! বরং এক ধু-ধু বিরান প্রান্তরে দেখি দাঁড়িয়ে আছি আমি একা, সহায়হীন নিঃসম্বল, চার্বাকদের মতোই! নিজেকে একাকী আবিষ্কার ভীতিকরও বটে। বেদ বা শ্রুতিশাস্ত্রেই উক্ত আছে যে, সৃষ্টির শুরুতে প্রজাপতি ব্রহ্মা নিজেকে একাকী দেখে ভীত হয়েছিলেন! তাই মানুষও একাকীত্বকে ভয় পায়। এজন্যেই কি তিনি সৃষ্টিকার্যে ব্রতী হয়েছিলেন! কে জানে! শাস্ত্রে এর বিভিন্ন ব্যাখ্যাও আছে অবশ্য। তবে একাকী মানুষ যে তার একাকিত্ব কাটাতে সচেষ্ট হয় সঙ্গির খোঁজে তাতে সন্দেহ কী! আমিও সচেষ্ট হয়েছি সেই একাকী চার্বাকের খোঁজে। এভাবেই আমারও মার্গপথ নির্দিষ্ট হয়ে গেছে...”।

দুই
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন শাস্ত্রে স্নাতকোত্তর এই লেখক একাধারে একজন কবি, প্রাবন্ধিক, দর্শন-চর্চাকারী ও গবেষক, শিশু-কিশোর সাহিত্যিক এবং একজন বিশিষ্ট ইয়োগা-বিশারদ। কবিতা লেখার মাধ্যমে সাহিত্যিক জীবনের শুরু হলেও লিখেছেন ব্যাপক বিষয়ের ওপর।

গদ্য, প্রবন্ধ, শিশু-কিশোর সাহিত্য সবদিকেই ছিলেন সাবলীল। মুক্তিযুদ্ধ ছিল তার চিন্তা-চেতনার প্রেরণা। প্রাত্যহিক জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে পরিব্রাজকের চোখে লিখেছেন চতুর্মুখী সব গদ্য। সেসব লেখার মাধ্যমে তিনি জীবনের সত্যকে অন্বেষণ করতে চেয়েছেন, যেখানে তার ব্যক্তিগত জীবনবোধ ও দর্শন প্রতিফলিত হয়েছে।

ব্যক্তিগতভাবে অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী এই সৃজনশীল মানুষটির কাছে আমার ঋণ কোনোদিন শোধ হওয়ার নয়। তার সঙ্গে পরিচয় না হলে হয়তো জীবনকে দেখার অনেকগুলো জানালা আমার চিরকালের মত বন্ধ থেকে যেত। হ্যাঁ, সেইসব জানালাগুলো, যা একজন মানুষের সুপ্ত চেতনাকে জাগিয়ে দেয়ার জন্য বয়ে নিয়ে আসে রাশি রাশি আলোর ধারা। সেই আলোতে স্নাত হতে-হতে আমি জীবনকে ভালবাসতে শিখেছিলাম। তার স্নেহ, ভালবাসা, জীবনবোধ আমাকে প্রাণিত করেছে।

তার সঙ্গে পরিচয়টাই ছিল একটা অসাধারণ ঘটনা।
দু’হাজার পাঁচ কি ছয় সালের কথা। আমি তখন সুনামগঞ্জে আমার নানার বাড়িতে থেকে উদ্দেশ্যহীন জীবনযাপন করছি। কাজ বলতে তেমন কিছুই ছিল না। বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানো আর বই পড়াই ছিল আমার একমাত্র কাজ। একদিন সকাল বেলা আমাদের পাশের বাড়ির হিন্দু প্রতিবেশী এক সুশ্রী ভদ্র মহিলা আমাকে বাড়ির সামনে পেয়ে জানতে চাইলেন, আমিই কি সেই লোক যে কিনা গতকাল গভীর রাত পর্যন্ত জেগে-জেগে সজোরে কবিতা পাঠ করেছে। আমার মনে পড়ল গতরাতে আমি কবি আবুল হাসানের ‘রাজা যায় রাজা আসে’ বইটি অনেক রাত পর্যন্ত পড়েছিলাম। তাছাড়া আবৃত্তির ঢঙে সজোরে কবিতা পাঠ করতে আমি ভালবাসতাম।

আমি বললাম, “হ্যাঁ, আপনি ঠিকই বলেছেন”। তিনি বললেন, “আমার বড় একজন ভাই আছেন, তিনি ঢাকা থাকেন, কবিতা লেখেন, এখন তিনি বাড়িতে আছেন। গতকাল তিনি আপনাদের বাসার বাহিরে দাঁড়িয়ে আপনার কবিতা পড়া শুনেছেন”। অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে তিনি আরও বললেন, “দাদা আপনাকে আমাদের বাসায় চা খাওয়ার নিমন্ত্রণ করেছেন। আপনি আসবেন, অবশ্যই”।

ভদ্র মহিলার আন্তরিকতায় আমি মুগ্ধ হলাম। সেদিন সারাদিন ভীষণ উত্তেজনায় ছিলাম কখন বিকেল হবে। আমি ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করার জন্য ভীষণ উদগ্রীব হয়ে আছি। সারাদিন ভাবলাম, তিনি কবিতা লিখেন। নিশ্চয়ই একজন কবি! রাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার কবিতা পাঠ শুনেছেন! কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন কে জানে! অবশেষে বিকেল হলে আমার লেখা কতগুলো আগর-বাগর টাইপের কবিত দুই পকেটে ঠেশে ঢুকিয়ে চা’পানের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গেলাম।

দাদার সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাতটি ছিল খুবই সৌহার্দ্যপূর্ণ ও আন্তরিক। এতদিন পর পেছনে ফিরে তাকালে মনে হয় সেদিন আমার উত্তেজনাপূর্ণ ছেলেমানুষি আবেগটিকে দাদা ঠিকই ধরতে পেরেছিলেন। আমাকে স্নেহের বন্ধনে বেঁধে ছিলেন। জীবনবোধ জাগ্রত হয় এমনসব বই পাঠের পরামর্শ দিয়েছিলেন। তারপর থেকে দাদার পরিবারের সঙ্গে ধীরে-ধীরে আমার এক আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়ে ওঠে। দাদার ব্যক্তিগত সংগ্রহে থাকা পুরোনো সব বই আমি একটার পর একটা পড়ে শেষ করতে থাকি। রবীন্দ্রনাথ, আন্তন চেখভ, নিকোলাই গোগল, টলস্টয়, ইভান বুনিন, কার্ল মার্ক্স, লেনিন ও ফ্রেড্রিখ এঙ্গেলস এর অনেক রচনা একটার পর একটা আমি পড়তে থাকি আর পালটে যেতে থাকি।

বাংলাদেশ নামের এই দুঃখিনী ব-উপদ্বীপ তার মহৎ চিন্তাশীল সন্তানদের কখনোই রক্ষা করতে পারেনি। প্রতিক্রিয়াশীলতার অতিকায় দানবের হিংস্র থাবা তাদের রক্তে লাল হয়েছে। গুটিকয় যারা বেঁচে আছেন, তাঁরা নিতান্তই ভাগ্যের জোরে।

হয়তো এমন একদিন আসবে যেদিন এই রক্তের ঋণ শোধের মুহূর্ত সমাগত হবে। সেদিনও আজকের ভোরের মতই সোনালি সূর্যের রেণু এসে খেলা করবে হেমন্তের ধানক্ষেত ভালবেসে জড়িয়ে থাকা শিশিরের সাথে।

সেদিন পর্যন্ত রণদীপম বসু, টুটুল আর তারেক রহীমদের বেঁচে থাকা খুব প্রয়োজন।

রণদীপম বসু
জন্ম : ৩১ জানুয়ারি ১৯৬৪ ইং 
শিক্ষা : স্নাতকোত্তর (রসায়নবিদ্যা) চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
নিজ জেলা : সুনামগঞ্জ
.
প্রকাশিত বই :
১) অদৃশ্য বাতিঘর (কবিতা, ২০০৬)
২) খোকার জানালা (কিশোর কবিতা, ২০০৮)
৩) তিন দশে তেরো (শিশুতোষ ছড়া, ২০০৮)
৪) ইয়োগা, সুস্থতায় যোগচর্চা (স্বাস্থ্য, ২০১০)
৫) অবমুক্ত গদ্যরেখা (প্রবন্ধ-গবেষণা, ২০১১)
৬) উৎবচন (মুক্তচিন্তা, ২০১২)
৭) টিপলু (কিশোর গল্প, ২০১৩)
৮) চতুষ্পদী কষ্টগুলি (কবিতা, ২০১৪)
৯) চার্বাকের খোঁজে ভারতীয় দর্শন (দর্শন ও সমাজ, ২০১৫)

আপনার মন্তব্য