গোলটেবিলে হুমায়ূন ও তাঁর তোতাকাহিনী

 প্রকাশিত: ২০১৫-১১-১৩ ১৭:৩৫:১০

 আপডেট: ২০১৫-১১-১৩ ১৭:৪৬:২৭

মাসকাওয়াথ আহসান:

হেভেনে দেবুদা একটি তৃতীয় শক্তি গড়ার জন্য মরিয়া। সাম্যবাদী বনাম কাম্যবাদী দুই রাজনৈতিক বলয়ের বাইরে একটা রাজনৈতিক দল তার চাই-ই চায়। রাজনীতির নেশা চন্দ্রমুখীর প্রতি ভাললাগার মতই দেবুদাকে আকর্ষণ করে। তাই এমন কাউকে দরকার যে জনপ্রিয়; যার মধ্যে মানুষকে বশ করার ক্ষমতা আছে; তবেই না তৃতীয় চুমুকের প্রয়োজনীয়তা সহজে বুঝবে বেহেশতবাসী।

দেবুদা হুমায়ূনের বাসায় পৌঁছে যান ভোর বেলা। হুমায়ূন ফেসবুকে চেক করছিলেন লোকজন তাকে মনে রেখেছে নাকি এ কেবলি পন্ডশ্রম হলো। মেনিমুখো আঁতেলের সংখ্যা দুনিয়ায় কম। বেশীর ভাগ মানুষই সুস্থ; সহজ চিন্তা করে; তারা কৃতজ্ঞ। মনে রেখেছে তারা। কিছু বেশী বোঝা পারমাণবিক বোমা টাইপের চুলকানিউদ্দি আছে; তারা জ্যোতিষীর মত আঙ্গুল উঁচিয়ে বলছে; হুমায়ূনের সাহিত্য টিকবে না।

দেবুদা চা খাবেন?

--আপনি মশাই এভাবে অপমান করলেন? দেবু কী চা খায়!

না এতো সকালে ভাবলাম, চা খাওয়াটাই ভালো।

--যাকগে ভাই আজ একটু প্রেসক্লাবে যেতে হবে আপনাকে।

আমি রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে চাই; এসব নোংরা ব্যাপার।

--আপনি কী চান আমরা ডিপলিটিসাইজড হই!

তাই বলে কোন সলিউশান না দিয়ে অঙ্গীকারের জাবর কাটার মানে হয়না।

--আমরা সলিউশানের জন্য তৃতীয় চুমুক দিতে চাই রাজনীতিতে।

আজ কী নিয়ে গোলটেবিল!

--প্যালেস্টাইনে গণহত্যা; মালয়েশিয়ান বিমানে হামলা করে বর্বর হত্যাকান্ড এই দুটো বিষয় নিয়ে।

চলুন দেখি কী বলতে চান।

হুমায়ূন একটি খাঁচায় তোতা পাখী নিয়ে নেন। দেবুদা সন্দেহের চোখে তাকায়। হুমায়ূন মুচকি হাসেন।

প্রেসক্লাবে শ্যারন নামের দেবুদার ইহুদী বান্ধবী অপেক্ষা করছিল। জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ এসেছেন দেখে ভি আইপি লাউঞ্জের দর্শকরা দাঁড়িয়ে সম্মান জানায়। হুমায়ূন বেশ অবাক; একদল দর্শক হিমুর মতো হলুদ পোশাক পরে দাঁড়িয়ে।

দোজখ থেকে প্যারোলে আনা হয়েছে হিটলারকে। আজকের ফিলিস্তিনী হত্যাযজ্ঞের মূল কারণ সেই। হলোকস্ট ঘরানাটাই হিটলারের তৈরী; ইজরায়েলের ঘাতক নেতানিয়াহু তো হিটলারেরই ধারাবাহিকতা। হিটলারকে একটি কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। কিছু পান খেকো বানর প্রকৃতির লোক হিটলার জিন্দাবাদ বলে শ্লোগান দিয়ে ওঠে।

দেবুদা ক্ষিপ্ত হয়ে মাইক্রোফোন নিয়ে বলেন, তোমাদের লজ্জা করেনা। ‘জর্দা দিয়া পান খাইতাছি’ প্রকল্পে বেহেশতে আসছো ভালো কথা; কিন্তু ব্যাক্কল হেভেনে গেলেও ব্যাক্কলই থাকে। আরে বুদ্ধির ঢেঁকিরা খুনীর পক্ষে শ্লোগান দেও লজ্জা করেনা!

হুমায়ূন আহমেদের তোতা পাখিটি চিৎকার করে ওঠে, তুই হিটলার! তুই হিটলার।

সমস্ত অডিটোরিয়াম করতালিতে মুখরিত হয়। হিটলার ঘামতে থাকে।

হিটলার মিনমিন করে বলে, আপনারা রথশ্চাইল্ড ব্যাটারে আনেননি কেন।এই ব্যাংকিং ও শেয়ার ব্যবসার দরবেশ পরিবারইতো এই ফ্রিমেসেন যুদ্ধ ব্যবসা শুরু করেছে। আমিতো হিটম্যান। টাকা দিয়েছে; ৬ মিলিয়ন ইহুদী খেয়ে নিয়েছি।

পান খেকোরা উল্লসিত হয়।

প্যানেলিস্ট চেয়ারে বসে থাকা গ্যোয়েটে বলেন, শাইসে; তুমি কী ফিডার বেবী ছিলা! তোমাকে টাকা দিল আর তুমি মানুষ মারলে!

হিটলার কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বলে, চিত্রকর হতে চেয়েছিলাম পারিনি; তাই ভীষণ হতাশ ছিলাম আমি!

গ্যোয়েটে ধমক দেন, এসব চালিয়াতি কথা বলে লাভ নেই; বড় আমার চিত্রকর এসেছে!

হুমায়ূন আহমেদের তোতা পাখীটি আবার চিৎকার করে বলে, তুই হিটলার; তুই হিটলার!

দর্শকের হাততালিতে আবার উল্লসিত হয় গোলটেবিল গৃহ। গ্যোয়েটে হুমায়ূনের দিকে চোখ টিপ মেরে বলেন, এরকম একটি তোতা থাকলে বেশী কথা বলা লাগে না। ভারী কথাও বলা লাগে না।

শ্যারণ সঙ্গে করে একজন ইহুদী রাবাইকে নিয়ে এসেছে। ধর্মযাজক বললেন, প্রিয় পান খেকো হিটলার প্রেমীর দল, ইহুদীদের প্রতি ঘৃণার জন্যই হিটলারের প্রতি ভালোবাসা তাইতো।

মওলানা ফজলু আমিনী পান বহুল মুখে ফত ফত শব্দ করে বলে, জরুর, আবেশ্যই, উনি মুসলিম জাহানের বন্ধু।

হুমায়ূনের তোতা পাখীটি এবার বলে ওঠে, তুই রাজাকার, তুই রাজাকার

আবার করতালি। কে একজন একটি পাদুকা ছুঁড়ে মারে আমিনীর দিকে। হুমায়ূন চিন্তা করেন, কে জুতা মারলো; সে আরেক পাটিও মারুক। একপা খালি আমার অন্য পায়ে জুতার চেয়ে; দুই পা খালি ভালো দেখায়।

রাবাই বলেন, ওল্ড টেস্টামেন্ট বা তোরা পড়ছেন আমিনী সাহেব।

সে নিরুত্তর; এরা তো কিছু পড়ে না; মুখে শুনে বাকীটা চাপা মেরে দেয়া আর নারী দেহ নিয়ে নীল বাকওয়াজ।

রাবাই বলেন, এই তোরা বা তাওরাত গ্রন্থের জীবন বিধান আর কুরান গ্রন্থের দিক নির্দেশনায় অমিল খুব কম খুঁজে পাবেন। আপনার মাথায়ও টুপি; আমার মাথায়ও একটু ছোট টুপি। গোঁফ আপনারও নাই আমারো নাই; দাড়ি দুজনেরই আছে। ইহুদীদের নির্দেশনা দেয়া আছে; কোথাও সিনাগগ না পেলে মসজিদে নামাজ পড়ো; খোদার ঘর; সেখানেও সমস্যা নেই। মুসাফির ইহুদীদের বলা হয়েছে, ইহুদীদের বাড়ী না পেলে মুসলমান গৃহে খেতে পারো; কারণ খাদ্যাচার একি রকম। তাহলে আপনি কী নিয়ে ইহুদীদের প্রতি নাখোশ।

আমিনী জোশ পেয়ে গিয়ে বলে, ফিলিস্তিনী মুসলিম ব্রাদারান হত্যার জন্য দায়ী ইহুদীরা।

রাবাই জিজ্ঞেস করেন, নেতানিয়াহু কবে থেকে ইহুদী ধর্মের রাবাই হলো; ও তো এই হিটলারের মতো খুনী। খুনীদের আবার ধর্ম কী!

গ্যোয়েটে সমর্থন করেন, এই যে দেখুন মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্স ইউক্রেনে গুলি করে ফেলে শ’তিনেক মানুষ মারা হলো;বএরা তো বেশীর ভাগই খৃষ্টান। এদেরকে বোঝাই যাচ্ছে জায়নিস্টরা মেরেছে রাশিয়ার পুতিনকে ফাঁসাতে।পুতিন যেহেতু ফিলিস্তিনীদের পাশে দাঁড়িয়েছে; ওকে কোণঠাসা করতে এখন আমাদের কানা ছেলে ওবামা লোচন বলছে, ওদিকে ফিলিস্তিনীদের ইজরায়েলের আক্রমণ করা খুবই জরুরী আবার ইউক্রেনেও কিছু একটা করতে হবে। জায়নিস্টদের তোতা ওবামার চেয়ে হুমায়ূনের তোতার কমসেন্স অনেক বেশী। এতো মানবাধিকারটা বোঝে। ওবামা তোতা তো তাও বুঝছেনা।

এর মাঝে আমিনীর প্যারোলের সময় শেষ; দোজখের পুলিশ তাকে কোলে করে নিয়ে যায়।

দেবুদা হুমায়ূন আহমেদকে কিছু বলার অনুরোধ করেন।

হুমায়ূন বলেন, ভাই আমি বৃটিশ শাসন, পাকিস্তানী শোষণ আর বাংলাদেশের ভাষণ শুনে ক্লান্ত হয়ে বেহেশতে আসছি; এইখানে আমাকে রেহাই দেন, যা বলার তোতাই বলেছে। সৃষ্টিকর্তা সবাইকে মানুষের অবয়বে পৃথিবীতে পাঠান, সেখানে গোয়েটের মত মানুষেরা সাধনা করে মানুষ হয়ে ওঠেন আর হিটলারদের বিবর্তন ঘটে উলটোরথে। আমি আসি। যাই দেখি ফেসবুক পুরুতরা আমাকে কী কী ভাবে খাটো করছে। এইগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হিটলার; নিজেরা কিছু লিখতে পারেনা তাই লেখকদের গণহত্যা করে কীবোর্ড চুলকিয়ে।

গ্যোয়েটে বলেন, ওসব নাটকুদের সাহিত্য সমালোচনায় কিছু এসে যায়না। পাঠকের মন জয় করা বিরাট ব্যাপার।

দেবুদা বলে, আমার কথাই ধরেন, শরতচন্দ্র টিকবেনা বলে যারা কফি হাউজ কাঁপিয়ে দিতো তাদের থোতা মুখ ভোঁতা করে দিয়ে উনি ক্লাসিক হয়ে গেছেন; তাই আমিও ক্লাসিক।

শ্যারন বলে, এরকম অকাল কুষ্মান্ড ক্রিটিক আমি বার্লিন-প্যারিসে দেখেছি; এরা ফ্লপ রাইটার্স গিল্ড। খ্যাতিমান লেখকদের কুতসা করে লাইম লাইটে আসার চেষ্টা করতো এই হিংসুটিদের দল। দেখেন না, একজন ফ্লপ চিত্রকরের মধ্যেই তো হিটলার বসবাস করে।

হিটলারের প্যারোল শেষ; তাকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে যায় দোজখের পুলিশ। হিমুরা চিৎকার করে, হিটলারের চামড়া; তুলে নেবো আমরা।

গোয়েটে হুমায়ূনকে জিজ্ঞেস করে, জায়নিস্ট কারা তুমি চেনো তাদের!

হুমায়ূন বলেন, আমি পাবনা শহরের একটি গল্প বলি। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন শিক্ষক জয়ন্ত রায়। এরপর তার বাড়ীটি দখল হয়ে যায়। সেখানে জামাত-বিএনপি-আওয়ামী লীগ সবাই মিলে পলিটিক্যাল বাটারফ্লাই অফিস খুলেছে। তো ফিলিস্তিনীদের উপর এই আগ্রাসনে তেমনি ইজরায়েল-সৌদী আরব-এমেরিকা সবার ইন্টারেস্ট আছে। কাজেই ঐ অসাম্প্রদায়িক চেতনার শ্লোগানই বলুন আর জিহাদী চেতনার শ্লোগানই বলুন শেষ হয় দখলদারিতার বিকৃতিতে। এটাই আজকের জায়নিজম। ফাঁপা বুলি আর সম্পদ লুন্ঠন।

--আর এই হামাস যারা রকেট ছুঁড়ে ইজরায়েলে আর ফিলিস্তিনীদের মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে, ইজরায়েল হামলা চালালে; এদের পেছনে কে!

ইয়াসির আরাফাতের মৃত্যুর পর এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তৈরী হয়; এদের টাকাটুকা তেল আভিভ থেকেই আসে। ইজরায়েলের জন্য যুদ্ধের বিছানা গরম করাই যেহেতু হামাসের কাজ। হামাস তাওয়া গরম করে; ইসরায়েল পারাটা ভাজে।

শ্যারন জিজ্ঞেস করে, এই যে রয়টার্স, সিএন এন এরাতো জায়নিস্টদের মিডিয়া; যুদ্ধের উস্কানি দেয়াই এদের কাজ।

হুমায়ূন বলেন, পৃথিবীর মানুষ খুব গুজব প্রিয় ও নাচুনী বুড়ী; সিএন এন হচ্ছে ঢাকের বাড়ি।

দেবুদা বলে, আপনি আসাতে আজ সত্যিই অনেক কাজের হয়েছে গোলটেবিল, তো ঢাকায় এরকম গোলটেবিল কী নাই; আপনাকে তো কোনদিন কোথাও দেখা যায়নি এরকম প্রাণ খুলে কথা বলতে।

--ওরে বাবা; ওখানে কথা বলা বিপদ; বামন চিন্তার গজ ফিতা নিয়ে বসে থাকে ছাগবান্দরথাল প্রজাতির কিছু উপ-মানুষ। ওদের মাথায় যে দু’ছটাক ঘিলু আছে ওটার সঙ্গে মিলিয়ে ওদের মন মতো কথা না বললেই গালি দিয়ে যায় তারা।এরা সব ছোট খাটো জিনিসের হিটলার।

আপনার মন্তব্য