ধারাবাহিক উপন্যাস: বসনা- ৯

রেজা ঘটক

 প্রকাশিত: ২০১৫-১১-২৭ ২০:৫৬:৫৪

 আপডেট: ২০১৫-১১-২৮ ১৯:২১:৫৫

বসনা উপন্যাস মূলত ইতিহাস প্রধান। বসনিয়া যুদ্ধ ও জীবন এই উপন্যাসের উপজীব্য বিষয়। লেখার পরতে পরতে ফুটে:

পূর্ব প্রকাশিতের পর...


সেই মিলনের রাত!

রাত সাড়ে নয়টায় তুজলার সেন্ট্রাল বাস স্টোপিসে আমাদের বাস এসে থামলো। তখনও আমাদের বিশ্বাস হচ্ছিল না কী হতে যাচ্ছে। আমাদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? কেন নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? বাস স্টোপিসে প্রত্যেকটা বাস থেকে একজন একজন করে বাস থেকে সবাইকে নামানো হচ্ছে। নামানোর পর সবার দেহ তল্লাসি করা হচ্ছে। কারো কাছে মূল্যবান কিছু পাওয়া গেলে, যেমন সোনার গহনা, টাকা পয়সা ইত্যাদি, যা-ই পাওয়া যাচ্ছে তা সেনা সদস্যরা চিলের মত ছো মেড়ে কেড়ে নিচ্ছেন। এই নিয়ে বয়স্ক কারো কারো সঙ্গে সেনাদের সঙ্গে কিছুটা তর্ক-বিতর্কও হচ্ছে। অল্প বয়স্করা অবশ্য তর্ক করতে খুব ভয় পাচ্ছে। পাছে তাদের আবার আলাদা লাইনে না নেয়।

ছোটখালা মার্সিয়ার কাছে তখনো কিছু টাকা ছিল। টাকাগুলো ছোটখালা কী করবে ঠিক বুঝতে পারছিল না। আমার মাথায় তখন হঠাৎ একটা বুদ্ধি আসলো। টাকাগুলো ছোট্ট আহমেদের শার্টের কলারের ভেতর গুজে দিলাম। ছোটখালা চোখ বড় বড় করে আমাকে কেবল একটা শাসানি দিল। কিন্তু মুখে কিছুই বললেন না। একসময় আমাদের বাসের পালা আসলো। একে একে সবাই বাস থেকে নামলো। সবাইকে অন্যদের মত তল্লাসি করে মূল্যবান যা কিছু পেল, সবকিছু সেনারা মুহূর্তে হাতিয়ে নিল। ছোট্ট আহমেদকে একবারের জন্যও সেনারা কেউ চেক করলো না। আমাদের একপাশে দাঁড় করিয়ে আমাদের পেছনের যাত্রীদেরও একইভাবে তল্লাসি করলো সেনারা।

যে মহিলা ছোটখালার সঙ্গে ঝগড়া করে সেই সোনার আংটিটা কেড়ে নিয়েছিল, সেই আংটিটা এবার তাকে তল্লাসি করে সেনারা নিয়ে নিল। তাই নিয়ে ওই মহিলা সেনাদের সঙ্গে কিছুক্ষণ তর্ক করলো। কিন্তু সেই তর্কে সেনারা একদম পাত্তা দিল না। মহিলাকে এক ধাক্কা দিয়ে আমাদের দিকে ছুড়ে দিল। মহিলা তখন প্রচণ্ড রাগে ফুসছিল আর আমার দিকে আগুন চোখে তাকাচ্ছিল। কিন্তু মুখে কিছু বলার মত সাহস পাচ্ছিল না। সবগুলো বাসের যাত্রীদের এভাবে নামিয়ে তল্লাসি শেষে সেনারা নিজেদের গাড়িতে ওঠার আগে, সবার উদ্দেশ্য একটা বক্তৃতা দিল ওদের কমান্ডার গোছের একজন।

যার সারমর্ম হলো, তোমরা এখন যেখানে খুশি যেতে পারো। তোমরা এখন মুক্ত! কিন্তু ভুলেও কেউ তুজলার বাইরে যাবার চেষ্টা করবে না। কেউ যদি সেই চেষ্টা করো তাহলে তাদের গুলি করা হবে। সেনা কমান্ডারের বক্তৃতা শেষ হলে তাদের গাড়িগুলো একে একে বাস স্টোপিস থেকে বের হতে লাগলো। ছোটখালা আমাকে আর আহমেদকে তখন সেই লাইনে দাঁড়িয়ে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন।
তাহলে কী আমরা সত্যি সত্যি সেনাদের কবল থেকে মুক্ত হলাম? নাকি সামনে আমাদের জন্য আরো বড় কোনো অঘটন অপেক্ষা করছে? আমরা কেউ জানি না, এভাবে আমাদের তুজলা বাস স্টোপিসে এতো রাতে নামিয়ে দেয়ার মানে কী? নাকি ওরা ঘুরে এসে সবাইকে ব্রাশ ফায়ার করে মেরে ফেলবে? ওদের আসল উদ্দেশ্য কী আমরা তখনও কেউ জানি না। আমরা কেবল ওদের হুকুম পালনে সেখানে সবাই নিরবে দাঁড়িয়ে রইলাম।

সেনাদের গাড়িগুলো যখন ধীরে ধীরে চোখের আড়াল হলো, তখন বাস স্টোপিস থেকে ছোট ছোট জটলা আকারে সবাই স্টোপিস ছাড়তে শুরু করলো। আহমেদ আর আমাকে নিয়ে ছোটখালাও সেই জটলা অনুসরণ করতে লাগলেন। বাস স্টোপিস থেকে আধা কিলোমিটার যাবার পর জটলাগুলো বিভিন্ন দিকে ভাগ হচ্ছিল। আমরা কোন দিকে যাবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। এত রাতে আমরা কোথায় ঠাই নেব, তাও আমাদের তখন জানা নেই। আমরা কী খোলা রাস্তায় কোথাও বসে পড়ব নাকি কোথাও পালিয়ে যাব? কোথায় পালিয়ে যাব আমরা? পালিয়ে কী আমরা সেনাদের কবল থেকে মুক্ত হতে পারব? আমরা আসলে তখন কিচ্ছু জানি না, কেবল অন্যরা যা করছিল, আমরাও তাই অনুসরণ করছিলাম।

ততক্ষণে ছোট্ট আহমেদ ক্ষুধায় জ্বালায় ছোটখালার কোলেই ঘুমিয়ে পড়েছে। আহমেদকে একবার আমি কোলে নিচ্ছিলাম, কিছুদূর গেলে আবার ছোটখালা নিচ্ছিল। এভাবে পালা করে আমরা সামনে আগাচ্ছিলাম। অন্যদের চেয়ে যাদের দলে তখন ছোট্ট বাচ্চা ছিল, কেবল তাদের গতি তখন কিছুটা ধীরগতির ছিল। রাস্তার পাশে একটা দোকান খোলা পেয়ে সবাই সেখানে হঠাৎ ভিড় করছিল। ছোটখালা আমাকে বললেন, যদি কোনো খাবার পাওয়া যায়, আমি যেন একটা উকি দেই।

অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি ঘটনা হলো যে, সেই দোকানো কিছু জিনিসপত্র তখনো বিক্রি হচ্ছিল। কিন্তু মানুষের যে স্রোত, তা হয়তো সামাল দেবার মত জিনিসপত্র বা খাবার সেই দোকানে তখন ছিল না। দোকানদার বারবার দোকান বন্ধ করার চেষ্টা করছিল। আর মানুষের হুড়োহুড়িতে তখন সেখানে আরেকটা যুদ্ধের মত পরিস্থিতি শুরু হয়েছিল। তবু দোকানদার অনেক ধৈর্য দেখালেন। দোকানের ছোট্ট একটা ঝাপ খোলা রেখে সবাইকে সামাল দেবার চেষ্টা করলেন। ছোটখালা আহমেদের শার্টের কলার থেকে টাকা বের করে আমার হাতে কিছু টাকা দিলেন। সেই টাকা নিয়ে সেই বিশাল জটলার ভেতর থেকে আমি তিন প‌্যাকেট বিস্কুট, একটা জুস আর একটা ভুট্টোর বক্স কিনতে সক্ষম হলাম। শকনো ভুট্টো এমনভাবে সেই বক্সে রাখা যে বক্স খুললেই তা তখন খাওয়া যাবে। জটলা থেকে একটু দূরে গিয়ে আহমেদকে ঘুম থেকে জাগিয়ে আমরা তিনজন একটু একটু তাই খেলাম। কাছাকাছি কোথাও পানি পাওয়া যায় কিনা বা কোথাও পানির কল আছে কিনা তা দেখার জন্য অন্য জটলার সবাই তখন আবার ব্যস্ত হয়ে গেল। খাবার শেষ করে আমরাও তখন পানির জন্য আশে পাশে অন্যদের মত উকি দিচ্ছিলাম। ঠিক তখনই ডেভিড আর একটা ছেলে আমাদের দেখে হঠাৎ 'মায়া-মায়া' বলে চিৎকার করে উঠলো।

আমার এখনো বিশ্বাস হয় না এখানে ডেভিড কীভাবে আসলো? আর ডেভিডের সঙ্গের ছেলেটা-ই বা কে? নাকি চোখে আমরা সত্যি সত্যি শর্সেফুল দেখছি? দৌঁড়ে এসে ছোটখালা আর আমাকে শক্ত করে জাপটে ধরলো ডেভিড। আমার প্রাণের ভাই ডেভিড। ওহ গড, তাহলে ডেভিড এখনো জীবিত আছে! আমার তখনো কিছুই বিশ্বাস হচ্ছিল না। কতক্ষণ যে ডেভিড আমাদের সেখানে ওভাবে জাপটে ধরে ছিল, তা এখন আর বলতে পারব না। মনে হচ্ছিল, হাজার বছর পর, পথ হারিয়ে আমরা যখন অচেনা এক নিরুদ্দেশ যাত্রায় হাবুডুবু খাচ্ছিলাম, তখন হঠাৎ সেখানে এক সাক্ষাৎ ফেরেশতার মত ডেভিড হাজির হয়েছিল।

কয়েক মুহূর্ত আমরা সবাই একেবারে স্রেফ চুপচাপ ছিলাম। তারপর সবাই একটানা কিছুক্ষণ ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদলাম। কিন্তু কেউ কাউকে একদম ছাড়ছিলাম না। সেই কান্নার ভাষা পৃথিবীতে কেউ কোনো দিন তর্জমা করতে পারবে না। এ যেন মৃত্যুর আগে পৃথিবীর রূপ দেখার শেষ সৌভাগ্যের মত এক একটুকরা সোনাঝড়ানো মিলনমেলা। তখন ঘড়ির কাঁটায় পৃথিবীতে ঠিক কয়টা বাজে আমরা কেউ বলতে পারব না। আমরা সবাই যেন তখন স্বর্গের কোনো দরজায় দাঁড়িয়ে এক নতুন স্বপ্নের মোহে একেবারে বিভোর হয়ে গেছিলাম। কান্না ছাড়া তখন আমাদের যেনো অন্য কোনো ভাষায় কথা বলার কোনো শক্তি ছিল না। সেই কান্নারও তখন যেনো কোনো শব্দ ছিল না। কেবল একটু একটু বুদবুদের মত ফুপিয়ে ফুপিয়ে বুকের ভেতরে জমানো হাজার বছরের বিষবাষ্প অপসারণের এক অকল্পনীয় মুহূর্ত যেনো ছিল সেটা। পৃথিবীর কোনো কিছুর সঙ্গেই সেই মুহূর্তের আর কোনো যেনো তুলনা করা যায় না।

এক সময় ডেভিড ছোটখালার কোল থেকে আহমেদকে ছাড়িয়ে নিয়ে নিজের ঘাড়ে তুলে নিল। আর এতোক্ষণ আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ডেভিডের সঙ্গের ছেলেটিকে দেখিয়ে বললো, মামা, নানা, নানী, সবাই ওদের বাড়িতে আছে। ও হচ্ছে মোহাম্মেদ। যেন হাজার বছর পর, পরিচিত কারোর মুখের ভাষা শুনে আমরা তখন কিছুটা খেই ফিরে পেলাম। তারপর ডেভিডের ডান হাত আমি শক্ত করে ধরলাম। আর ছোটখালা আমার অন্য হাত ধরেছেন। আমাদের সামনে সামনে তখন মোহাম্মেদ হাঁটছিল। আমরা কেবল মোহাম্মেদকে তখন অনুসরণ করছিলাম।

আমরা কী তখন হাঁটছিলাম নাকি দৌঁড়াচ্ছিলাম, এখন আর তার কিছুই মনে নেই। মনে হচ্ছিল, যুদ্ধের ভেতর থেকে হঠাৎ আমরা জীবন ফেরত পেয়েছিলাম। এতোক্ষণ যে আমরা ক্ষুধার্ত ছিলাম, একটু বিস্কুট আর ভুট্টো মুখে দিয়ে পানির সন্ধান করছিলাম, সেই অভুক্ত শরীরে এত শক্তি যে তখন কোথা থেকে এসেছিল, কেউ বলতে পারে না। আমাদের তখন হাঁটার বা দৌঁড়ানোর গতি কেবল ক্রমশ বাড়ছিল। এভাবে আমরা যে কত হাজার মাইল হেঁটেছিলাম, এখন তার কিচ্ছু মনে নেই। কেবল মনে হচ্ছিল, আমরা রকেটের চেয়েও দ্রুতগতি নিয়ে দূরে কোথাও পালানোর জন্য কেবল নিজেদের গতি তখন বাড়াচ্ছিলাম। কারণ আমরা কেউ জানি না, সেনারা কোন রাস্তায় কোথায় কীভাবে আমাদের জন্য ওৎ পেতে আছে। আমরা যেন মুক্তির স্বাদ পেতে তখন আরো শক্তি সঞ্চয় করেছিলাম কোনো অজানা অশ্বশক্তি থেকে। নাকি স্বয়ং ঈশ্বর তখন আমাদের অঢেল শক্তি দিয়েছিলেন সেই অনিশ্চিত পথটুকু পাড়ি দিতে!  

আমরা যখন শহরের রাস্তা ছেড়ে গ্রামের রাস্তায় নামলাম, তখন যেন কিছুটা জীবনের ঘ্রাণ টের পেতে শুরু করলাম। খেয়াল করলাম, আমার খালি পায়ে তখন মাটির আচর লাগছিল। দ্রুত গতিতে হাঁটতে গিয়ে কখন যে আমার স্যান্ডেল ছিড়ে গেছে, আর তা পা থেকে স্বেচ্ছায় ফেলে দিয়েছিলাম, তা নিজেরও তখন স্মরণে নেই। ছোটখালারও তখন আমার মত একই দশা। তবু আমরা প্রাণপন মোহাম্মেদের পিছু পিছু গায়ের শেষ শক্তিটুকু দিয়ে তখন হাঁটছিলাম। কখনো আমার শরীরের পুরো ভর ডেভিডের গায়ে ঝেড়ে দিচ্ছিলাম। গ্রামের রাস্তায় অনেকটা ভেতরে যাবার পর ডেভিড বললো, এখন আর কোনো ভয় নেই। এদিকে সেনারা একদম আসে না।

তবু ছোটখালা বললো, কোথাও আর বসার দরকার নেই। রেস্ট যা নেবার সবাইকে একবার ভালো করে দেখার পর তারপর নেব। ডেভিড চোখেমুখে একটা খুশির ভাব এনে বললো, তোমরা যে এই বাসে আসতে পারো, সেই খবর আমরা গ্রামের অন্যদের কাছ থেকে জেনে সেই দুপুর থেকে এখানে পালিয়ে ছিলাম। মোহাম্মেদ আর আমি দুপুর থেকেই এই রাস্তায় ওই জঙ্গলের ভেতরর পালিয়ে ছিলাম। তখন সেদিকে তাকিয়ে দেখলাম সেখানে গভীর ঘন এক জঙ্গল।

সকাল থেকেই গ্রামের সবাই কীভাবে যেনো খবর পেয়েছে, ব্রাটুনাচে সেনারা যাদের আটক করেছে, তাদের তুজলার দিকে নিয়ে আসবে। অন্যদের মত আমরাও ধারণা করেছিলাম, যদি তোমরা বেঁচে থাকো, এই দলে তোমরাও হয়তো থাকবে। থ্যাকংস গড, যে শেষ পর্যন্ত তোমাদের খুঁজে পেয়েছি। আমরা গত সপ্তাহ থেকে মোহাম্মেদদের গ্রামের বাড়িতে সবাই আশ্রয় নিয়েছি। আমরা কেউ স্বপ্নেও ভাবিনি যে, তোমাদের সাথে আবার আমাদের দেখা হবে। সবাই তোমাদের টেনশনে ঠিকমত খাওয়া-দাওয়া পর্যন্ত ভুলে গেছে। সবচেয়ে বেশি দুঃশ্চিন্তা ছিল মায়াকে নিয়ে। আমরা সবাই ধরে নিয়েছি হয়তো সেনারা ওকে ক্যাম্পে রেখে দেবে। কারণ আমরা শুনেছি, মায়ার বয়সি সকল মেয়েকে সেনারা ক্যাম্পে আটকে রাখেছে। ভাগ্যিস তোমরা এখনো বেঁচে আছো আর তোমাদের আমরা খুঁজে পেয়েছি। এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না, সত্যি সত্যি তোমাদের খুঁজে পেয়েছি।

ডেভিডের কথা আর ফুরায় না। এক ফাঁকে ছোটখালা জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কীভাবে এদিকে আসতে পারলা? জবাবে ডেভিড বললো, আমরা পাহাড় ডিঙ্গিয়ে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে এদিকটায় এসেছি। পথে নানা একবার খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু তিনিই সবাইকে এই পাহাড়ি জঙ্গল পাড়ি দিতে খুব উৎসাহ দিয়েছেন। যুদ্ধের সময় কী কী করতে হয়, তা তিনি আমাদের চেয়ে অনেক ভালো বোঝেন, এটা আমি এখন বিশ্বাস করি। তিনি যে হিটলারের সেনাবাহিনীতে চাকরি করেছেন, এটা এতোদিন আমি একদম বিশ্বাস করিনি। এবার পাহাড়ি জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পালানোর সময় বুড়োর সকল কথাই আমার বিশ্বাস হয়েছে। নইলে আমরা কেউ হয়তো আর বাঁচতাম না।

রাত সাড়ে বারোটায় আমরা মোহাম্মেদদের গ্রামের বাড়িতে পৌঁছালাম। তখন সেখানে এক নতুন দৃশ্যের অবতারণা ঘটলো। তুজলার রাস্তায় ডেভিডকে পেয়ে আমাদের যে অনুভূতি হয়েছিল, সেই দৃশ্যের যেনো আবার পুনঃ মঞ্চায়ন সেখানে। এবার পরিবারের অন্য সকল সদস্যদের সঙ্গে মামা, সোলায়মান নানা, হাইরিয়া নানী, সবাইকে জড়িয়ে ধরে কতক্ষণ যে আমরা কেবল দীর্ঘ-শ্বাস নেবার চেষ্টা করেছিলাম, এখনো বিশ্বাস করতে পারি না। বারবার শুধু মনে হয়েছে, কেবল স্বয়ং ঈশ্বরই তাঁর একান্ত ইচ্ছায় আমাদের সবাইকে আবার মিলিয়ে দিয়েছেন। সেটা যেনো এক নতুন পৃথিবীতে নতুন করে বাঁচার জন্য প্রাণ ভরে শ্বাস নেবার মুহূর্ত। আমরা পরস্পর পরস্পরকে তখন কেবল জড়িয়ে ধরে ওভাবে যে কতক্ষণ সেই মিলনের রাতে কাটিয়েছিলাম, এখনো মনে পড়লে শিউরে উঠি। সে এক মহামিলনের রাত্রি যেন। পৃথিবীতে সেদিনের মত সুখের মুহূর্ত হয়তো বাকি জীবনে আর কখনো আসবে না। আমরা তখন প্রাণ ভরে কেবল শ্বাস নিয়েছি। ইচ্ছামত কেঁদেছি। আর চোখ বড় বড় করে পরিবারের সবাইকে অবিশ্বাসের মত বারবার কেবল হৃদয় জুড়িয়ে দেখেছি। মনে হয়েছে কতকাল, কত সহস্র বছর পর, কত দুর্ঘটনা, বিপদ, শঙ্কা কাটিয়ে, পুরো একটা যুদ্ধের ভেতরে আবার আমরা সবাই একত্রিত হয়েছি। তখন বুঝিবা আমাদের পরস্পর পরস্পরকে কেবল ভালো করে একনজর দেখার, জড়িয়ে ধরার, আর কান্না করার সময়। আমাদের কারো মুখে তখন কান্না ছাড়া আর কোনো শব্দ কাজ করেনি। যেন কান্নাই ছিল তখন আমাদের ভাববিনিময়ের একমাত্র উপায়। আমরা সবাই যেন তখন বোবা হয়ে গিয়েছিলাম। পৃথিবীতে সেই বোবা কান্নার রাতের সেই অনন্ত সুখের ক্ষণটি যেন ছোট্ট জীবনের সবচেয়ে সুখের মুহূর্ত। আহা, যুদ্ধের ভেতরে এভাবে যে আমরা আবার সবাই জীবিত অবস্থায় মিলিত হতে পারব, এটা এখনো একদম বিশ্বাস হয় না আমার।

সেই রাতে আমরা পৃথিবীর ভাষা হারিয়ে সবাই যেন এক রহস্যময় অচেনা ভাষায় পরস্পর কেবল কথা বলেছি। কী আশ্চার্য আমাদের সেই ভাব বিনিময়ে কোনো ভাষা না থাকলেও, আমরা ঠিকই সবাই পরস্পরের স্পর্শ আর ভাবের সুস্পষ্ট বিনিময় করতে পেরেছিলাম। স্বয়ং ঈশ্বর যেন আমাদের মধ্যে তখন নতুন একটা শক্তি প্রদান করেছিলেন, যাতে আমরা কেবল কান্না দিয়ে সবাই সবার সেই অবুঝ ভাষা বুঝতে পারি। সেই রাতে আমরা কেউ আর এক মিনিটের জন্যও ঘুমাইনি। কেবল সবাই প্রাণ ভরে সবাইকে খুব কাছ থেকে বারবার, হাজারবার দেখেছি। আর পরস্পর পরস্পরকে গভীর মমতায় জড়িয়ে ধরেছি। সেই গভীর মমতাময়ী স্পর্শের স্বাদ পৃথিবীতে জীবদ্দশায় যদি আর কোনোদিনও আমরা না পাই, আমরা যে সবাই তখনো জীবিত আছি, কেবল সেটুকু পরস্পর বোঝার জন্য আমরা যেন সবাই কেবল বারবার-হাজারবার সবাই সবাইকে স্পর্শ করেছি আর কেঁদেছি। অমন সুখের রাত হয়তো পৃথিবীতে আমরা আর কোনোদিনও পাব না। তাই সবাই সেই রাতে কেবল গভীর আন্তরিকতায় পরম নৈকট্যে জেগেছি। সকালের সূর্যের আলো না ফোটা পর্যন্ত আমরা কেউ সেই রাতে মুহূর্তের জন্য একবারও ক্লান্ত হইনি। সেই রাত থেকে আমরা আবার নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম।

 


বসনা- ১

বসনা- ২

বসনা-৩



বসনা- ৪


বসনা- ৫


বসনা- ৬


বসনা-৭


বসনা- ৮

 
 

আপনার মন্তব্য