বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, পঞ্চম পর্ব : ১৬-১৮

 প্রকাশিত: ২০১৬-১০-০৪ ১১:৩২:১৭

কাজী মাহবুব হাসান:

বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, পঞ্চম পর্ব (নির্ভারতা এবং ভার)
১৬
বেশ কিছুদিন পর, আরও একটি চিন্তা টমাসকে ভাবিয়েছিল, আর আমি এখানে সেটি যোগ করবো আগের অধ্যায়ের একটি সংযুক্তি হিসাবে : মহাশূন্যে কোথাও একটি গ্রহ আছে, যেখানে সব মানুষেরই আবার জন্ম হবে । আর যে জীবন তারা কাটিয়েছিল পৃথিবীতে, সেই জীবন আর তাদের সঞ্চয় করা সব অভিজ্ঞতা সম্বন্ধেও তারা সচেতনও থাকবে সেখান।

আর হয়তো আরও অন্য কোনও গ্রহ আছে, যেখানে আমাদের জন্ম হবে তৃতীয় বারের মত, প্রথম দুই জীবনের সব অভিজ্ঞতাসহ।

আর এছাড়াও হয়তো আরও বহু গ্রহ আছে, যেখানে মানব জাতির জন্ম হবে আরও এক ডিগ্রী বেশী (একটি জীবন) পরিণত হয়ে।

চিরন্তন প্রত্যাবর্তন ধারণাটির এটাই ছিল টমাসের সংস্করণ।

অবশ্যই এখানে, এই পৃথিবীতে আমরা ( গ্রহ নং ১, অনভিজ্ঞতার গ্রহ যেটি) শুধুমাত্র অস্পষ্ট কল্পকাহিনী বানাতে পারি, কি হতে পারে এই সব অন্য গ্রহে মানুষের জীবনে। সে কি আরও অভিজ্ঞ আর প্রাজ্ঞ হবে? পরিণত হওয়া কি মানুষের ক্ষমতার আওতাধীন? পুনরাবৃত্তি করে সে কি তা অর্জন করতে পারে?

শুধুমাত্র এমন একটি ইউটোপিয় দৃষ্টিকোণ থেকে হতাশাবাদ আর আশাবাদের ধারণাগুলোকে পূর্ণ যৌক্তিকতার সাথে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। একজন আশাবাদী হচ্ছেন সেই ব্যক্তি, যিনি মনে করেন পাঁচ নম্বর গ্রহে মানব জাতির ইতিহাস কম রক্তাক্ত হবে। একজন হতাশাবাদী হচ্ছেন সেই ব্যক্তি, যিনি এর ভিন্ন কিছু ভাবেন।

১৭
জুল ভার্নের বিখ্যাত উপন্যাসগুলোর একটি, টমাসের শৈশবে খুব প্রিয় সেই বইটির নাম, ‘টু ইয়ারস অন হলিডে’, এবং আসলে দুই বছরই হচ্ছে সর্বোচ্চ। জানালা পরিষ্কারের কাজে টমাস তৃতীয় বর্ষ এটি।

গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই সে অনুধাবন করছিল ( অর্ধেক বিষণ্ণতা আর অর্ধেক নিজের প্রতি কৌতুক হিসাবে) শারীরিকভাবে সে অনেক ক্লান্ত হয়ে পড়েছে ( কোনও এক সময় দিনের মধ্যে তার একটি, কখনোও বা দুটি সাক্ষাৎ ছিল যৌন সংসর্গের) এবং যদিও রমণীদের প্রতি তার আগ্রহ সে হারায়নি, কিন্তু সে বুঝতে পারে সে তার সর্বোচ্চ শক্তির ব্যবহার করছে (এখানে আমি যোগ করতে চাই যে, পরিশ্রমটি তার শারীরিক শক্তির, তার যৌনশক্তির নয়, তার সমস্যা হচ্ছে তা শ্বাস-প্রশ্বাসে, তার পুরুষাঙ্গে নয়, এমন পরিস্থিতির হাস্যকর একটি দিকও আছে)।

একদিন বিকালে, যখন তার অবসরে সময়ে একটি সম্ভাবনার কাছে পৌছাতে তার বেশ সমস্যা হচ্ছে এবং মনে হচ্ছিল যে সেদিন সে তার দুর্লভ প্রেমহীন একটি দিন কাটাতে যাচ্ছে। সে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। প্রায় দশ বার সে একটি তরুণীকে ফোন করে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিল, অভিনয় শিখছে এমন একজন চমৎকার তরুণী, যার শরীরের চামড়া যুগোস্লাভিয়ার নগ্ন বেলাভূমিতে এমন রোদে পুড়েছে যে দেখে মনে হয়, যান্ত্রিক কোনও লোহার শিকে বেধে ধীরে ধীরে ঘুরিয়ে তাকে ঝলসানো হয়েছে।

দিনের শেষ কাজটি থেকে শেষবারের মত যোগাযোগ করার চেষ্টা করে চারটার দিকে সে অফিসে ফিরে আসতে শুরু করেছিল, দিনের খদ্দেরদের সই করা অর্ডার স্লিপগুলো জমা দিতে। প্রাহার ঠিক কেন্দ্রে এক রমণীর সাথে তার দেখা হয়, যাকে সে চিনতে ব্যর্থ হয় আর যে তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘তুমি কোথায় হাওয়া হয়ে গিয়েছিলে? বহু দিন তোমাকে দেখিনি’!

টমাস খুব চেষ্টা করে মনে করতে, কে এই মহিলা। কোনও সময় সে কি তার একজন রোগী ছিল? সে ব্যবহার করছে যেন তার অন্তরঙ্গ বন্ধু। এমনভাবে টমাস উত্তর দেবার চেষ্টা করেছিল যেন তা সেই সত্যটাকে গোপন করে যে সে তাকে আসলে চিনতে পারেনি। অবশ্য ইতিমধ্যেই সে চিন্তা করতে শুরু করেছিল, কিভাবে তাকে তার বন্ধুর ফ্ল্যাটে লোভ দেখিয়ে নিয়ে যাবে সে ( কারণ তার পকেটে সেই চাবি আছে), তখনই একটি আকস্মিক মন্তব্যে সে হঠাৎ করেই বুঝতে পারে রমণীটি কে: নিখুঁত রোদে ঝলসানো চামড়াসহ সেই উঠতি নায়িকাটি, যাকে ফোন করার জন্য সে সারাদিন ধরে চেষ্টা করেছে।

ঘটনাটি তাকে একই সাথে হাসিয়েছিল আর আতঙ্কিতও করেছিল: এটি প্রমাণ করে মানসিক ও শারীরিকভাবে সে ক্লান্ত। দুই বছরের ছুটি অনির্দিষ্টকালের জন্য বৃদ্ধি করা যাবে না।

১৮
অস্ত্রোপচারের টেবিল থেকে তার ছুটি তেরেজার কাছ থেকেও ছুটি। ছয়দিন তাদের প্রায় না দেখা হবার পর, অবশেষে রোববারগুলোয় কামনায় পূর্ণ হয়ে তাদের একত্র হবার সুযোগ হয়। কিন্তু, জুরিখ থেকে ফিরে আসার সেই সন্ধ্যার মত, তারা যেন বিচ্ছিন্ন এবং পরস্পরকে অনেকটা পথ পার হতে হয় স্পর্শ করা আর চুমু খাবার আগে। শারীরিক ভালোবাসা তাদের আনন্দ দেয় কিন্তু কোনও সান্ত্বনা দেয়না। অতীতের মত আর সে জোরে চিৎকার করে ওঠে না, এবং তার চরম মুহূর্তে, তার মুখভঙ্গি দেখে মনে হয়, সে যন্ত্রণা আর একটি অদ্ভুত অনুপস্থিতি প্রকাশ করছে। শুধুমাত্র রাত্রে, ঘুমের সময় তারা ভালেবাসায় যুক্ত থাকে, টমাসের হাত ধরে তেরেজা ভুলে যায় সেই বিশাল ব্যবধানটি ( দিনের সেই ব্যবধান) যা তাদের বিচ্ছিন্ন করে আছে। কিন্তু তেরেজাকে রক্ষা আর দেখাশুনা করার জন্য, রাত টমাসকে না দেয় কোনও সময়, না দেয় কোনও উপায়; সকালবেলায় তেরেজাকে দেখা আসলেই কষ্টকর, তার জন্য ভয় পায় টমাস: তাকে দেখে মনে হয় বিষণ্ণ আর অসুস্থ।

এক রোববার, প্রাগের বাইরে একটি জায়গায় তেরেজা তাকে নিয়ে যেতে বলেছিল। তারা একটি স্পা’তে গাড়ি চালিয়ে যায়, যেখানে তারা আবিষ্কার করেছিল সব রাস্তাগুলোকে নতুন করে রুশ নাম দেয়া হয়েছে, আর ঘটনাক্রমে সেখানেই টমাসের পুরোনো এক রোগীর সাথে তাদের দেখা হয়েছিল। এই সাক্ষাৎকারটি টমাসকে ভয়ানক নাড়া দিয়েছিল, হঠাৎ একজন তার সাথে আবার কথা বলছে যেন কোনও ডাক্তারের সাথে কথা বলছে। সে অনুভব করতে পেরেছিল তার অতীত জীবন এই ব্যবধানটির মধ্যে সেতু রচনা করছে, তার কাছে ফিরে এসেছে রোগী দেখা ও তার উপর তাদের নির্ভরতার দৃষ্টির সুখকর স্বাভাবিকতা হিসাবে, যে দৃষ্টিগুলোকে সে উপেক্ষা করার ভান করেছে ঠিকই, কিন্তু আসলেই যা সে খুব উপভোগ করে এবং তাদের অনুপস্থিতি তীব্রভাবে সে অনুভবও করে।

ফেরার পথে গাড়িতে , টমাস জুরিখ থেকে প্রাহায় ফিরে আসার সেই সর্বনাশা ভুলটি নিয়ে ভাবে। তেরেজার দিকে তাকানো এড়াতে রাস্তা থেকে সে তার দৃষ্টি সরায়না। তেরেজার উপর তখন তার তীব্র ক্ষোভ। তার পাশে তেরেজার উপস্থিতি আরও বেশী দুঃসহ দৈবাৎ ঘটনা মনে হয়। কি করছে সে তার পাশে বসে? কে তাকে ঝুড়িতে রেখে তার কাছে আসার জন্য ভাসিয়ে দিয়েছিল উজানে? কেন ‘তার’ বিছানাটিকে নির্বাচন করা হয়েছে কিনারে ফেরার ঘাট হিসাবে? আর কেনই বা ‘সে’, কেন অন্য কোনও রমণী নয়?

পুরোটা পথে তারা কেউ কোনো কথা বলেনি।

বাসায় ফিরলে নীরবে দুজনে তাদের রাতে খাবার শেষ করে।

তাদের মধ্যে নীরবতা জমে ছিল তীব্র কোনও কষ্টের মত, প্রতি মিনিটে সেটি আরও ভারী হয়ে উঠেছিল। সেই নীরবতার হাত থেকে পালাতে তারা সরাসরি বিছানায় শুয়ে পড়ে। গভীর রাতে টমাস তেরেজাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলে, সে কাঁদছিল। তেরেজা তাকে বলে, ‘আমাকে কবর দেয়া হয়েছে, অনেকক্ষণ ধরে আমাকে কবর দেয়া হয়েছে। প্রতি সপ্তাহে একদিন তুমি আমাকে দেখতে আসো, প্রতিবারই যখন তুমি কবরে টোকা দাও আর আমি বের হয়ে আসি। আমার চোখ ভরা ধুলায়।

তুমি জিজ্ঞাসা করলে, কিভাবে তুমি দেখতে পাচ্ছো? আর আমার চোখ থেকে ময়লা মোছার চেষ্টা করলে।

আর আমি বলছি, ‘এমনিতেই আমি কিছু দেখতে পারি না, চোখের জায়গায় আমার শুধু দুটো গর্ত আছে’।

এরপর একদিন তুমি লম্বা একটা ভ্রমণে চলে গিয়েছিলে, আর আমি জানতাম, তুমি অন্য কোনও মহিলার সাথে আছো। সপ্তাহ কেটে গেল, অথচ তোমার কোনও দেখা নাই। তোমাকে হারাবার ভয়ে আমি শঙ্কিত, ঘুমানো বন্ধ করে দিয়েছি। অবশেষে তুমি আবার আমার কবরে টোকা দিলে, আমি এক মাস নির্ঘুম রাত পার করার এতই ক্লান্ত ছিলাম যে আমি আর বের হয়ে আসতে পারছিলাম না । আর যখন অবশেষে আমি বের হয়ে আসতে পারলাম, তুমি খুব হতাশ হলে, তুমি বললে আমাকে ভালো দেখাচ্ছে না। আমি অনুভব করতে পারছি তোমার কাছে আমার ভাঙ্গা চোয়াল আর উৎকণ্ঠিত আচরণ কত জঘন্য লাগছিল।

‘আমি দুঃখিত’ আমি ক্ষমা চাইলাম।‘ তুমি যাবার পর এক মুহূর্ত আমি ঘুমাতে পারিনি’।

‘দেখেছো তুমি’?, মিথ্যা উচ্ছ্বাস ভরা কণ্ঠে তুমি বলেছিলে, ‘তোমার যা দরকার তা হলো ভালো বিশ্রাম, এক মাসের ছুটি’!

যেন আমি জানিনা তোমার মনে কি আছে! এক মাসের ছুটি মানে তুমি আমাকে একমাস দেখতে চাও না। তোমার জীবনে এখন অন্য রমণী আছে। এরপর তুমি চলে গেলে, আমি আবার আমার কবরে প্রবেশ করি খুব ভালোভাবে জেনে যে, আমার আরও একমাস নির্ঘুম রাত কাটাতে হবে তোমার অপেক্ষায়। আর তুমি যখন ফিরে আসবে, আমি আরও বেশী কুৎসিত হবো দেখতে আর তুমি আরও বেশী হতাশ হবে।

এর চেয়ে বেশী ভয়ঙ্কর রকম অস্বস্তিকর কিছু টমাস আগে কখনো শুনেনি। তাকে শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরে টমাস অনুভব করে, তেরেজার শরীরটা কাঁপছে। সে ভাবছিল সে তার ভালোবাসা সহ্য করতে পারবে না।

সব গ্রহগুলো বোমার মত বিস্ফোরিত হয়ে মহাশূন্যকে কাপিয়ে দিক, নতুন কোনও বর্বরের দল এসে প্রতিদিন দেশটাকে ধ্বংস করুক, তার সব প্রতিবেশীদের ঘর থেকে বের করে গুলি করে হত্যা করা হোক - সব কিছু সে সহজে মেনে নিতে পারবে, যতটা সাহস হবে না তার স্বীকার করে নিতে। কিন্তু তেরেজার স্বপ্নে নিহিত দুঃখ হচ্ছে এমন কিছু যা সে সহ্য করতে পারবে না।

যেমন করে তাকে সে স্বপ্নটি বলেছিল, সেখানে সে পুনপ্রবেশ করার চেষ্টা করে। সে নিজেকে দেখতে পারে তেরেজার মুখে সে হাত বোলাচ্ছে এবং হালকাভাবে - সে যেন অবশ্যই টের না পায় - তার চোখের কোটর থেকে ধুলা পরিষ্কার করছে। তারপর সে তাকে বলতে শোনে অবিশ্বাস্যরকম মর্মভেদী, ‘যাই করো না কেন, আমি তো দেখতে পাবো না চোখের বদলে আমার দুটি গর্ত আছে কেবল’।

তার হৃদয় ভাঙ্গার উপক্রম হয়। অনুভব করে তার হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া প্রায় বন্ধ হবার উপক্রম।

তেরেজা আবার ঘুমিয়ে পড়েছিল, কিন্তু টমাস ঘুমাতে পারে না। সে তেরেজার মৃত্যুর দৃশ্যটি কল্পনা করে।তেরেজা মৃত আর ভয়ঙ্কর সব দুঃস্বপ্ন দেখছে, কিন্তু যেহেতু সে মরে গেছে, সে আর তার দুঃস্বপ্ন থেকে তাকে জাগিয়ে তুলতে পারে না। হ্যাঁ, সেটাই মৃত্যু: তেরেজা ঘুমিয়ে, ভয়ঙ্কর সব দুঃস্বপ্ন দেখছে, তাকে জাগানোর কোনও ক্ষমতা নেই তার।
(চলবে)

আপনার মন্তব্য