বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, পঞ্চম পর্ব: ১৯-২১

 প্রকাশিত: ২০১৬-১০-০৭ ১৩:০৫:৩৬

কাজী মাহবুব হাসান:

বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, পঞ্চম পর্ব (নির্ভারতা এবং ভার) : ১৯, ২০ ও ২১
১৯
টমাসের দেশে রুশ সেনাবাহিনীর আগ্রাসনের পর অতিক্রান্ত হওয়া পাঁচ বছরে প্রাহাও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে পরিবর্তিত হয়েছিল।যে মানুষগুলোকে টমাস রাস্তায় দেখে তারা ভিন্ন। তার বন্ধুদের অর্ধেকই দেশ ত্যাগ করেছে, যারা দেশে থেকে গিয়েছিলেন তাদেরও অর্ধেকের অর্ধেক মারা গেছে।কারণ এটি একটি বাস্তবতা, যা ইতিহাসবিদরা লিপিবদ্ধ করবেন না, রুশ আগ্রাসনের পরের বছরগুলো ছিল শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের পর্ব: মৃত্যুর হার বেড়ে গিয়েছিল অনেক। আমি শুধু সেই মানুষগুলোর কথা বলছি না ( যদিও বরং দুর্লভ অবশ্যই) যাদের মানসিক ও শারীরিক নিপীড়ন করে মারা হয়েছিল, যেমন ইয়ান প্রোশাজকা,ঔপন্যাসিক। প্রতিদিন তার ব্যক্তিগত কথোপকথন রেডিওতে সম্প্রচার করার দুই সপ্তাহ পর, তিনি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। তার শরীরে যে ক্যান্সারটি খুব সম্ভবত ঘুমিয়ে থাকতো, সেটি হঠাৎ করে গোলাপের মত ফুটে উঠেছিল।পুলিশের উপস্থিতিতে তার উপর অস্ত্রোপচার করা হয়, আর যখন তারা বুঝতে পারে, যা কিছুই হোক না কেন, তার নিয়তি এখন মৃত্যু, পুলিশ তার উপর আগ্রহও হারিয়ে ফেলেছিল, ।অবশেষে তার স্ত্রীর আলিঙ্গনে তাকে মরার সুযোগ দেয়া হয়েছিল।

কিন্তু বহু মানুষও মারা গিয়েছিলেন সরাসরি নির্যাতনের স্বীকার হয়ে; পুরো দেশ জুড়ে বিস্তার করা আশাহীনতা শরীর ও আত্মায় প্রবেশ করেছিল, শরীরকে যা ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করেছে পরে।কেউ মরিয়া হয়ে পালিয়েছে রাষ্ট্রের কোনো সুবিধা থেকে, যা তাদের পুরস্কৃত করতে চেয়েছিল এর নতুন নেতাদের পাশাপাশি প্রদর্শন করার সম্মান দিয়ে। এভাবে মারা গিয়েছিলেন কবি ফ্রান্টিসেক রুবিন - দলের ভালোবাসা থেকে পালাতে গিয়ে।সংস্কৃতি মন্ত্রী, যার হাত থেকে পালাবার জন্য কবি তার সাধ্যমত চেষ্টা করেছিলেন, তিনি রুবিনকে ধরতে পারেনি তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আগে। যেখানে তিনি কবির কবরের উপর বক্তৃতা দিয়েছিলেন কবির সোভিয়েত প্রেম নিয়ে।হয়তো তিনি আশা করেছিল তার শব্দগুলো শুনতে এতই জঘন্য মিথ্যা শোনাবে যে সেগুলো হয়তো রুবিনকে মৃত্যু থেকে জাগিয়ে তুলবে আবার। কিন্তু পৃথিবী তখন ছিল অনেক বেশী কুৎসিত, আর কেউই তাদের কবর থেকে বের হয়ে উপরে ওঠার সিদ্ধান্ত নেয়নি।

একদিন, টমাস ক্রিমাটোরিয়াম বা শব-দাহ করার প্রতিষ্ঠানে গিয়েছিল একজন বিখ্যাত জীববিজ্ঞানীদের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে, যাকে বিশ্ববিদ্যালয় ও অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। তার মৃত্যুসংবাদ ঘোষণার সময় কর্তৃপক্ষ নিষিদ্ধ করেছিল, তার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের সময়সূচী যেন ঘোষণা করা না হয়, তারা ভয়ও পেয়েছিল, এই অনুষ্ঠানটি না আবার সমাবেশে পরিণত হয়।শোকাহতরা নিজেরাই জানতেন না যে, সকাল সাড়ে ছটায় তার দেহ ভস্ম করা হবে।

ক্রিমাটোরিয়ামের ঢোকার সময় টমাস বুঝতে পারেনি কি ঘটছে: পুরো হলটাই আলোয় উজ্জ্বল কোনো চলচ্চিত্র স্টুডিওর মত। বিস্ময়ের সাথে চারপাশে তাকানোর পর, সে লক্ষ্য করেছিল যে তিনটি জায়গায় ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। না এটা টেলিভিশন না, এটা পুলিশ। শেষকৃত্য অনুষ্ঠানটির ভিডিও ধারণ করা হচ্ছে যেন এখানে যারা আজ উপস্থিত হয়েছেন তাদের সম্বন্ধে বিস্তারিত জানা যায়।মৃত বিজ্ঞানীর এক পুরোনো সহকর্মী, এখনো যিনি অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস এর একজন সদস্য, যথেষ্ট সাহসের পরিচয় দেন অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেবার জন্য। তিনি কখনোই চলচ্চিত্র তারকা হবার স্বপ্ন দেখেননি।

যখন অনুষ্ঠানটি শেষ হয়েছিল এবং মৃত পরিবারের প্রতি সবাই তাদের শেষ সম্মান দেখানো শেষ করেছিল। টমাস হলের এক কোণায় একদল মানুষের মধ্য লম্বা, খানিকটা কুঁজো হয়ে থাকা সেই সম্পাদককে শনাক্ত করে তাদের মধ্যে।তার দৃশ্যটি তাকে মনে করিয়ে দেয় টমাস কত তীব্রভাবে অনুভব করে সেই সব মানুষগুলোর অনুপস্থিতি যারা অকুতোভয়, মনে হয় যেন গভীর বন্ধুত্বের বাধনে বাধা।সে হাসি মুখ আর সম্ভাষণ ঠোটে নিয়ে সম্পাদকের দিকে এগিয়ে যায়, কিন্তু যখন সম্পাদক তাকে লক্ষ্য করেন, তিনি বলেন, ‘সাবধান, আর কাছে আসবেন না’।

খুব অদ্ভুত কথা এমন কোনো পরিস্থিতিতে বলার জন্য।টমাস নিশ্চিত হতে পারে না কিভাবে সেটি ব্যাখ্যা করবে, এটা কি আন্তরিক বন্ধুসূলভ সতর্কতা ( সাবধানে, আমাদের ভিডিও করা হচ্ছে, যদি তুমি আমার সাথে কথা বলো, তোমাকে পুলিশ জেরার জন্য তুলে নিয়ে যেতে পারে) অথবা একটি পরিহাস হিসাবে ( যদি তুমি সাহসই না পাও রাষ্ট্রপতির প্রতি পিটিশনের সই করার জন্য, তাহলে সেভাবে আচরণ করো, চেষ্টা করো না আমাদের সাথে পুরোনো বন্ধু হিসাবে আচরণ করার জন্য।), বার্তাটি যাই বোঝানোর চেষ্টা করুক না কেন, টমাস সেটি গ্রাহ্য করে সরে যায়। তার সেই অনুভূতি হয়েছিল, সুন্দরী কোনো রমণী, যে কিনা রেলওয়ে প্ল্যাটফর্মে দাড়িয়ে ছিল, কেবলই ট্রেনে উঠলো কিন্তু যখন সে তার প্রতি তার প্রশংসা জানাতে যাচ্ছিল, সে তার ঠোটের তার আঙ্গুল দিয়ে তাকে কথা বলতে নিষেধ করলো।

২০
সেই বিকালে, টমাসের আরেকটি অদ্ভুত সাক্ষাতকার হয়েছিল। একটি বিশাল দোকানের সামনে সামনের বড় জানালার কাচ পরিষ্কার করছিল সে তখন, তার ঠিক পাশে এসে থামলো এক তরুণ, জানালার উপর কাছ থেকে হেলান দিয়ে সে দামগুলো পরীক্ষা করতে চেষ্টা করছিল।

‘দাম সব বেড়ে গেছে’, কাচের উপর দিয়ে নেমে আসা পানির ধারা মোছা অব্যাহত রেখে টমাস তাকে বলে।

লোকটি তার দিকে তাকালো, সে হাসপাতালে একসময় টমাসের সহকর্মী ছিল, যাকে আমি নাম দিয়েছিলাম, এস., সেই ডাক্তারটি যে টমাসকে ব্যঙ্গ করেছিল সেই ভাবনায় যে, টমাস আত্মসমালোচনামূলক কোনো বিবৃতি লিখবে। টমাস খুব খুশী হয়েছিল তাকে দেখে ( বোকার মত যদিও, যেমন আমরা অপ্রত্যাশিত ঘটনায় আনন্দিত হই), কিন্তু যখনই সে তার প্রাক্তন সহ কর্মীর চোখের দিকে চোখ রাখে ( এস. নিজেকে গুছিয়ে নেবার আগে) সেখানে খুব আনন্দময় বিস্ময় নেই। ‘কেমন আছেন আপনি’? এস. তাকে জিজ্ঞাসা করে।

টমাস উত্তর দেবার আগে, সে অনুভব করে যে, এস. লজ্জা পেয়েছে এমন প্রশ্ন করার জন্য। স্পষ্টতই হাস্যকর, কোনো একজন পেশাজীবী ডাক্তারের আরেক জন ডাক্তারকে সে কেমন আছে এমন কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা যখন কিনা সে তার পেশা বাদ দিয়ে জানালা পরিষ্কার করছে।

পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে টমাসই যতটুকু পারে ততটুকু উৎসাহের চেষ্টা করে উত্তর দিতে, ‘ভালো, ভালোই আছি’। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবেই সে অনুভব করে যতই সে চেষ্টা করুক না কেন (বাস্তবিকভাবেই, কারণ সে খুবই চেষ্টা করেছে) তার ‘ভালো’ শুনতে খুব তিক্তভাবেই প্রহসনমূলক। এখন সে দ্রুত যোগ করে, ‘হাসপাতালের নতুন খবর কি’?

‘কিছু না’, এস. উত্তর দেয়, ‘কিছুই না, সব কিছুই আগের মত আছে’।তার প্রত্যুত্তরও, যদিও যথাসম্ভব নিরপেক্ষ একটি অর্থ বোঝানোর চেষ্টা সত্ত্বেও পুরোপুরিভাবে বেমানান ছিল এবং তারা দুজনেই সেটা বুঝতে পারে। এবং তারা জানতো যে তারা দুজনেই সেটা জানে। কিভাবে সব কিছুই একই থাকে আগের মত, যখন তাদের একজন জানালা পরিষ্কার করছে? ‘কেমন আছেন, প্রধান সার্জন’? টমাস জিজ্ঞাসা করে। ‘তার মানে আপনার সাথে তার দেখা হয় না’? এস. জিজ্ঞাসা করে। ‘না’, বলে টমাস।

এটা সত্য ছিল, যে দিন থেকে সে হাসপাতাল পরিত্যাগ করেছে, তার সাথে প্রধান সার্জনের সাথে তার আর একবারও দেখা হয়নি। তারা একসাথে এত ভালোভাবে কাজ করেছিল, এমনকি নিজেদের বন্ধু হিসাবে ভাবার প্রবণতাও ছিল তাদের। যে ভাবেই সে বলুক না কেন, তার ‘না’ শব্দটা বিষণ্ণ শুনিয়েছিল। এবং টমাসের সন্দেহ হয়েছিল যে এস. তার সাথে রাগ করেছে বিষয়টি তোলার জন্য: প্রধান সার্জনের মতই এস. কখনো টমাসের খোজ নেয়নি, সে কি করছে কেমন আছে বা কোনো কিছু লাগবে কিনা তা জানার জন্য কখনো দেখা করতেও আসেনি।

দুই প্রাক্তন সহকর্মীর মধ্যে সব কথোপকথনই অসম্ভব হয়ে গিয়েছিল, যদিও তারা দুজনেই বিষয়টি নিয়ে অনুশোচনা করেছেন, বিশেষ করে টমাস। তার সহকর্মীরা তাকে ভুলে গেছে, এর জন্য তাদের উপর সে কোনো রাগ পুষে রাখেনি, শুধুমাত্র যদি সে সেটা তার পাশে দাঁড়ানো এই তরুণ সহকর্মীকে বোঝাতে পারতো কোনোভাবে। সে আসলেই যা বলতে চাইছিল তা হলো, লজ্জা পাওয়ার কোনো কারণ নেই। খুবই স্বাভাবিক আমাদের পরস্পরের সাথে দেখা না হওয়াটা।এর জন্য হতাশ হবারও কোনো দরকার নেই, আমি তোমাকে দেখে খুশি হয়েছি! কিন্তু এমন কিছু বলতে সে ভয় পায়, কারণ এ অবধি যা সে বলেছে সেগুলো তার উদ্দেশ্য মোতাবেক বের হয়ে আসেনি আর এই সব আন্তরিক শব্দগুলো, তার সহকর্মীর কাছে শুনতে শ্লেষাত্মকই মনে হবে।

দীর্ঘ বিরতির পর এস. বলে, ‘আমি দুঃখিত’, আমার সত্যি খুব তাড়া আছে আজ, সে তার হাত বাড়িয়ে বলে, ‘আমি পরে আপনার সাথে দেখা করবো’।

সেই পর্বটি চলাকালীন সময়ে যখন তার সহকর্মীরা সবাই তার দিকে নাক উঁচু করে তাকিয়েছিল তার তথাকথিত কাপুরুষতার জন্য, তারা সবাই তার দিকে তাকিয়ে হেসেছে। এখন তারা আর তাকে তিরস্কার করতে পারবে না, এখন যখন তারা চাপে পড়েছে তাকে শ্রদ্ধা করার জন্য, তারা তাকে বেশ এড়িয়েও চলছে।

কিন্তু এমনকি তার পুরানো রোগীরাও তাকে ডাকা বন্ধ করছে, শ্যাম্পেন নিয়ে তাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে কিছু বলার জন্য। শ্রেণীচ্যুত কোনো বুদ্ধিজীবীর পরিস্থিতি দেশে আর ব্যতিক্রম কিছু নয়। বরং এটি রূপান্তরিত হয়েছে এমন কিছু যা স্থায়ী এবং মুখোমুখি হবার জন্য অস্বস্তিকর।

২১
সে বাসায় ফিরে যায়, বিছানায় শুয়ে পড়ে, নিত্যদিনের ব্যতিক্রম, সময়ের আগেই ঘুমিয়ে পড়ে সে। এক ঘণ্টা পর তার ঘুম ভাঙ্গে তীব্র পেটের ব্যথায়। এটি তার পুরোনো অসুখ, আর এটি ফিরে আসে যখনই সে হতাশায় আক্রান্ত হয়। সে ঔষধের ক্যাবিনেট খোলে, গালি দিয়ে ওঠে, পুরোপুরি খালি সেটি। সে ভুলে গেছে সেখানে প্রয়োজনীয় ঔষধ জমা করে রাখার জন্য। সে তার ইচ্ছাশক্তি দিয়ে ব্যথাটি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে এবং বাস্তবিকভাবেই বেশ সফল হয়, তবে টমাস আর ঘুমাতে পারে না। যখন রাত দেড়টায় তেরেজা বাড়ি ফেরে, সে তার সাথে কথা বলতে চায়। সে তাকে শেষকৃত্য অনুষ্ঠানটি কথা বলে, কিভাবে সম্পাদক তার সাথে কথা বলতে অস্বীকার করেছেন, তার সাথে পুরোনো সহকর্মী এস, এর দেখা হবার পর্বটিরও বিবরণ দেয়।

‘ইদানীং প্রাহা এত কুৎসিত হয়ে গেছে’, তেরেজা বলে।

‘আমি জানি’, বলে টমাস।

তেরেজা খানিকটা বিরতি নিয়ে মৃদুভাবে বলে,‘সবচেয়ে ভালো হবে, এখান থেকে দূরে কোথাও চলে যাওয়া’।

টমাস বলে, ‘আমি একমত, কিন্তু কোথাও তো যাবার জায়গা নেই’।

পাজামা পরে তখন টমাস বিছানার উপর বসে আছে, আর তেরেজা এসে তার পাশে বসে, তাকে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে।

সে বলে, ‘কেন গ্রামে গেলে হয়না’?

বিস্মিত হয়ে টমাস জিজ্ঞাসা করে, ‘গ্রাম’?

‘সেখানে আমার একা থাকবো, যেখানে তোমার পুরোনো কোনো সহকর্মী আর সম্পাদকের সাথে দেখা হবে না, মানুষগুলো সেখানে ভিন্ন , আর আমরাও প্রকৃতির কাছে ফিরে যাবো। প্রকৃতি এখনও সবসময় যা ছিল তেমনই আছে’।

ঠিক তখনই টমাস তার পেটে তীব্র যন্ত্রণার আরো একটি আক্রমণ অনুভব করে। এটি তাকে মনে করিয়ে দেয় তার বয়সের কথা, সে অনুভব করে, শান্তি আর নীরবতাই সে চায় অন্য যে কোনো কিছুর চেয়ে।

‘হয়তো তুমি ঠিক বলেছো’, খুব কষ্ট করে সে বলে। পেটের ব্যথাটি তার শ্বাস নেওয়ার প্রক্রিয়াটিকে কষ্টকর করে তুলেছিল।

‘আমাদের একটা ছোট বাসা আর বাগান থাকবে, কিন্তু যথেষ্ট বড় হবে যেন কারেনিন একটু দৌড়ে বেড়াতে পারে’।

‘হ্যাঁ’, টমাস বলে।

সে মনে মনে সে দৃশ্যটি ভাবার চেষ্টা করে কেমন লাগবে যদি তারা ছোট কোনো গ্রামে চলে যায়। প্রতি সপ্তাহে নতুন রমণী পেতে তার কষ্ট হবে, এর অর্থ হচ্ছে তার সব যৌন অভিযানগুলোরও সমাপ্তি হবে।

তেরেজা বলে, ‘একটাই সমস্যা, আমার সাথে গ্রামে থাকলে তুমি বিরক্ত হয়ে পড়বে তাড়াতাড়ি’, যেন সে তার মনের কথাগুলো পড়তে পারছে।

ব্যথাটি আরো তীব্রতর হয়ে ওঠে। টমাস কথা বলতে পারে না। মনে হয়েছিল, তার রমণী বশীকরণ ছিল তার একটি ‘এস মুস সাইন!’ ( যা করতেই অবশ্যই করতে হবে) এর মতই - একটি বাধ্যবাধকতা যা তাকে দাসত্বে বন্দী করে রেখেছিল। একটি ছুটি সে কামনা করছিল। কিন্তু চূড়ান্তভাবে কোনো ছুটি হবার জন্য, সব বাধ্যবাধকতা থেকে বিশ্রাম দরকার, সব ‘এস মুস সাইন’ থেকে। যদি সে বিশ্রাম নিতে পারে ( একটি স্থায়ী বিশ্রাম) হাসপাতালের অপারেটিং টেবিল থেকে, তাহলে ‘বিশ্বের’ অপারেটিং টেবিল থেকেও কেন নয়, তার কাল্পনিক ছুরি যেখানে রমণীদের গোপন সিন্দুক খুলেছিল, যে সিন্দুকে তারা তাদের অলীক এক মিলিয়ন ভাগের এক ভাগ ভিন্নতা লুকিয়ে রাখে?

‘তোমার পেটে আবার ব্যথা করছে’, তেরেজা বুঝতে পারে চিৎকার করে ওঠে। শুধুমাত্র তখনই সে বুঝতে পেরেছিল টমাসের কিছুটা একটা সমস্যা হচ্ছে। টমাস শুধু মাথা নাড়ায়।

‘তুমি তোমার ইনজেকশনটা নিয়েছিলে’?

সে মাথা নাড়ায়, ‘ঔষধ কিনে রাখতে আমি ভুলে গেছি’।

যদিও তার খামখেয়ালীপনায় বিরক্ত, তেরেজা তার কপালে হাত বোলায়, তীব্র ব্যথায় সেখানে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে।

‘আমরা কিছুটা ভোলো লাগছে এখন’।

‘শুয়ে পড়ো’, তেরেজা তাকে বলে আর একটা কম্বল দিয়ে ঢেকে দেয়। সে বাথরুমে যায় আর এক মিনিটের মধ্যে ফিরে এসে তার পাশে শুয়ে পড়ে।

বালিশ থেকে মাথা না তুলেই টমাস তার দিকে ফিরে তাকায়, আর প্রায় আঁতকে ওঠে: তার চোখের জ্বলন্ত কষ্টটা দুঃসহ।

‘আমাকে বলো তেরেজা, কি সমস্যা হয়েছে’? ইদানীং লক্ষ্য করছি তোমার মনের ভিতরে কিছু চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে, আমি অনুভব করতে পারছি, আমি জানি তুমি কিছু নিয়ে অস্থির’।

‘না’, তেরেজা মাথা নাড়ায়, ‘কোনো সমস্যা হয়নি’।

‘অস্বীকার করে কোনো লাভ নেই’।

তেরেজা বলে, ‘এখনও সেই একই জিনিসগুলো’।

সে একই জিনিস মানে তার হিংসা আর টমাসের অবিশ্বস্ততাগুলো।

কিন্তু টমাস হার মানতে রাজি নয়। ‘না তেরেজা, ভিন্ন কিছু ঘটেছে এবার, এরকম খারাপ এর আগে কখনো দেখিনি’।

‘বেশ তাহলে, আমি তোমাকে বলবো. যাও তুমি তোমার চুল ধুয়ে আসো’।

টমাস বুঝতে পারে না।

তার ব্যাখ্যার কণ্ঠস্বর বিষণ্ণ, দ্বন্দ্বহীন, প্রায় শান্ত। ‘বহু মাস ধরেই তোমার চুলে খুব শক্ত একটি গন্ধ পাচ্ছি আমি। কোনো মহিলার যোনীর গন্ধের মত। তোমাকে আমি বলতে চাইনি, কিন্তু রাতের পর রাত আমাকে তোমার কোনো প্রেমিকার যোনীর গন্ধ শুকতে হয়েছে’।

যে মুহূর্তে সে কথাটি শেষ করে, টমাসের পেটের যন্ত্রণাটিও আরো তীব্রতর হয়। টমাস হতাশ হয়, যে পরিমাণে ঘষে ঘষে সে নিজেকে পরিষ্কার করেছে, শরীর, হাত, মুখ, নিশ্চিত করতে যে তার প্রেমিকাদের সামান্যতম গন্ধ যেন তার শরীরে অবশিষ্ট না থাকে। সে এমনকি তাদের সুগন্ধি সাবানও প্রত্যাখ্যান করেছিলে, সবসময় সে তার নিজের কর্কশ গন্ধ সহ সাবান সাথে রাখতো নিজের ব্যবহারের জন্য। কিন্তু সে তার চুলের কথা সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছিল, তার কাছে কখনোই মনে হয়নি এখানে গন্ধ থাকতে পারে!

তারপর সে একজন রমণীর কথা মনে করেছিল যে, তার মুখের উপর দুই পা ছড়িয়ে বসে বলতো মুখ দিয়ে অথবা মাথা দিয়ে তাকে যৌনতৃপ্তি দিতে। এখন সে তাকে ঘৃণা করছে।কি নির্বোধ ধারণা! টমাস বুঝেছিল অস্বীকার করে কোনো লাভ নেই।শুধুমাত্র বোকার মত একটু হাসতে পারলো সে এবং মাথা পরিষ্কার করে ধোবার উদ্দেশ্যে বাথরুমে যাবার জন্য সে উঠতে চেষ্টা করে।

কিন্তু সে তার কপালে আবার হাত রেখে বললো, ‘এখানে বিছানায় শুয়ে থাকো, ধোয়ার কোনো দরকার নেই, আমি এতদিনে অভ্যস্ত হয়ে গেছি’।

তার পেটের ব্যথাটি তাকে দারুণ যন্ত্রণা দিতে শুরু করে, আর শুধু শান্তি আর নীরবতা কামনা করে টমাস। ‘আমি আমার সেই রোগীকে চিঠি লিখবো, যার সাথে স্পা’তে দেখা হয়েছিল, ‘তুমি কি জানো কোন জেলায় পড়েছে তার গ্রামটি’? ‘না’ তেরেজা বলে। টমাসের কথা বলতে খুবই কষ্ট হচ্ছিল, শুধুমাত্র সে বলতে পারে, ‘জঙ্গল.. ঢেউয়ের মত পাহাড়’।

‘ঠিক আছে, আমরা সেটাই করবো, আমরা এখান থেকে চলে যাবো, কিন্তু এখন কোনো কথা না…’, তেরেজা তার কপালে হাত বুলাতে থাকে। পাশাপাশি শুয়ে থাকে তারা, কেউ কোনো কথা না বলে। ধীরে ধীরে তার ব্যথাটা কমে যেতে শুরু করে, শীঘ্রই দুজনেই ঘুমিয়েও পড়ে।
(চলবে)

আপনার মন্তব্য