শচীন কর্তার রাজকীয় সমাচার

 প্রকাশিত: ২০১৬-১০-০৮ ১২:৪২:৩৩

রেজা ঘটক:

গান তখনই আপনার আরো কাছের হয়ে ওঠে, যখন আপনি মাটির গন্ধটা মেখে হয়ে ওঠেন রাজসিক। গান আপনার আত্মার আরো কাছাকাছি চলে আসে, যখন আপনি সেটাকে ছুঁতে পারেন। গান তখনই আপনার আরো মনের কাছের হয়ে যায়, যে মুহূর্তে আপনি বলে উঠতে পারেন, আরে এটা তো আমার গান!

আজ লিখব শচীন কর্তাকে নিয়ে। শিল্পী শচীন দেব বর্মন। শচীন কর্তা নামেই আমরা যাকে বেশি চিনি। তাঁর একহাতে ক্লাসিক্যালের ক্লাসিক, অন্যহাতে পল্লীর মেঠো সুর। আজ আমার বলতে কোনো দ্বিধা নেই যে, শচীন দেব বর্মন ছাড়া ভারতবর্ষের গানের বর্ণ, গন্ধ, ছন্দ, গীতি কোনোটাই সম্পূর্ণ হতে পারে না।

বর্ণে গন্ধে ছন্দে গীতিতে হৃদয়ে দিয়েছো দোলা, রঙেতে রাঙিয়া রাঙাইলে মোরে, একি তব হরি খেলা। তুমি যে ফাগুন রঙেরও আগুন, তুমি যে রসেরও ধারা, তোমার মাধুরী তোমার মদিরা, করে মোরে দিশাহারা; মুক্তা যেমন শুক্তিরও বুকে তেমনি আমাতে তুমি, আমার পরাণে প্রেমের বিন্দু তুমি শুধু তুমি! প্রেমের অনলে জ্বালি যে প্রদীপ, সে দীপেরও শিখা তুমি, জোনাকি পাখায় ঝিকিমিকি নেচে, এ রীতি নাচালে তুমি, আপনও হারায়ে উদাসী প্রাণের লহগো প্রেমাঞ্জলি, তোমারে রচিয়া ভরেছি আমার, বাউল গানের ঝুলি; মুক্তা যেমন শুক্তিরও বুকে তেমনি আমাতে তুমি, আমার পরাণে প্রেমের বিন্দু তুমি শুধু তুমি।

চমকি দেখিনু আমার প্রেমের জোয়ারও তোমারই মাঝে, হৃদয় দোলায় দোলাও আমারে তোমারও হিয়ারিই মাঝে; তোমারও প্রাণের পুলকও প্রবাহ নিশীথে চাহিয়া মাতে, যত মোর নাম গাহ মোর গান আমারই একতারাতে; মুক্তা যেমন শুক্তিরও বুকে তেমনি আমাতে তুমি, আমার পরাণে প্রেমের বিন্দু তুমি শুধু তুমি। গানটি লিখেছিলেন মীরা দেব বর্মন। যিনি শচীন কর্তার এক সময়ের ছাত্রী, পরবর্তীকালে জীবনসঙ্গিনী। আর গানটিতে সুর ও কণ্ঠ দিয়েছিলেন শচীন কর্তা নিজেই।

দেখুন, বর্ণ গন্ধ আর ছন্দ দিয়ে তো আর একটা মানুষকে বিচার করা যায় না। বরং তাঁর ইনার কোয়ালিটিগুলো কোনো একজন মানুষকে সাধারণ মানুষ থেকে তাঁকে একটু উঁচু পর্যায়ে পৌঁছে দেয়। আর সেরকমই ছিলেন স্বয়ং শচীন দেব বর্মন। কি করি আমি কি করি, বনে ফাগুন মনে আগুন! পলে পলে দহে মোর, ধিকি ধিকি হিয়া রে; হিয়া যদি হয় ছাই, বাঁচিব কি নিয়া রে। কি করি, আমি কি করি, বনে ফাগুন, মনে আগুন। সজনীগো রজনীগো এনে দেরে চাঁদরে, অন্দরে অঙ্গার হয়ে জ্বলে জ্বলে পাঁজরে। কি করি, আমি কি করি, বনে ফাগুন, মনে আগুন। একাকিনী আমি ডরি বিরহে সঁপিরে, বধূ বিনা নাহি যেন পলক না জোড়ে। কি করি, আমি কি করি, বনে ফাগুন, মনে আগুন।

মনে আগুন লাগে বটে। কখনো কখনো কোনো চেনা মানুষের কাছ থেকে ধাক্কা পেলে সেখানেও মনে আগুন লাগে। শচীন কর্তার জীবনের অনেক জানা-অজানা গপ্পো আছে। তাঁর কম্পোজ করা এমন অনেক গান, যে গানগুলোর উপর কখনো ধুলো পড়ে না, সময়ের ধুলোগুলো যে গানগুলোকে কখনো মলিন করে দেয় না, যেগুলো চির রোমান্টিক, চির অক্ষয়। শচীন কর্তার সেই গানগুলোকে এখনো নতুন কোনো প্রেমে পড়লে নতুন করেই আবার প্রপোজ করা যায় যেন।

একবার এক বিখ্যাত গীতিকার শচীন কর্তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা বৌদি নতুন কোন গানটা লিখেছে, একটু শোনান না? শচীন কর্তা তো কিছুতেই গানটা শোনাবেন না! আর সেই গীতিকারও নাছোড়বান্দা। প্লিজ একটু শোনান, শুনি না, কেমন হয়েছে? শচীন কর্তা একটু ভ্রু কুচকে সেই গীতিকারকে জিজ্ঞেস করলেন, ভাই তুমি আবার মেরে দেবে নাতো? এখনো গানটার রেকর্ড হয়নি। আমার সুর, আমার গানের আইডিয়া কেউ যদি মেরে দেয়, তখন বুকে বড্ড ব্যথা লাগে। মজার ব্যাপার হলো, শচীন কর্তা কখনো রেকর্ড না হওয়া গান কাউকে শোনাতেন না। সত্যি, শোনাবেন বা কেন? আশেপাশে তো আর দুষ্টু লোকের অভাব নেই! কে কখন কোথা থেকে কার আইডিয়া চুরি করে নেবে, কে বা বলতে পারে!

মীরা দেব বর্মনের লেখা এই গানটিরও সুর ও কম্পোজ করেছেন শচীন কর্তা। শোন গো দখিনো হাওয়া, প্রেম করেছি আমি, লেগেছে চোখেতে নেশা দিক ভুলেছি আমি; মনেতে লুকানো ছিল সুপ্ত যে পিয়াসা, জাগিল মধু লগনেতে বাড়ালো কি আশা; উতলা করেছে মোরে, আমারি ভালোবাসা। অনুরাগে প্রেম শরীরে ডুব দিয়েছি আমি, শোনগো মধুর হাওয়া প্রেম করেছি আমি। দহনো বেলাতে আমি, প্রেমেরো তাপসী, বরষাতে প্রেম ধারা, শরতের শশী। রচিগো হেমন্তে মায়া, শীতেতে উদাসী, হয়েছি বসন্তে আমি বাসনা বিলাসী; শোনগো মধুর হাওয়া প্রেম করেছি আমি, লেগেছে চোখেতে নেশা দিক ভুলেছি আমি।

ও মনো দিল না বধূ, মনো নিল যে শুধু, আমি কি নিয়ে থাকি। ও মহুয়া মাতায় ঢোলক, দোলে পলাশের নোলক, বাঁধে কেউ বাহুরও রাখি, আমি কি নিয়ে থাকি। পিয়া তোর অবুঝ হিয়া, খোঁজে কোন সবুজ টিয়া, দিতে চাস আমায় ফাঁকি, আমি কি নিয়ে থাকি। এই গানটা আপনি যতবার শুনবেন, ততবার আপনি প্রেমে পড়বেন। এটা প্রেমে পরার গান। যতদিন ধরে কোনো মানুষের বুকে প্রেম ব্যাপারটা থাকবে, রোমান্টিকতা থাকবে, ততদিন আপনি প্রেমে পড়বেন। এই গানটাও ততদিন সুপার হিট থাকবে। এটা একটা অসামান্য গান। এই গানটি কোনোদিনই পুরনো হবে না। আমার বিশ্বাস আপনিও এই কথাটি বিশ্বাস করবেন!

আগে একটা নিয়ম বা রীতি ছিল এমন যে, আগে গীতিকার গান লিখবেন, তারপর সেই গীতিকারের পছন্দ অনুযায়ী সুরকার সেই গানে সুর করবেন। কিন্তু শচীন কর্তা গানের সেই প্রচল ভেঙে দিয়ে সেখানে নতুন চমক দিলেন। শচীন কর্তা আগে সুর করতেন। তারপর সেই সুর অনুযায়ী গীতিকার লিরিক বসাতেন। কী অদ্ভুত ব্যাপার তাই না!

নিটোল পায়ে রিনিক ঝিনিক, পায়েলখানি বাজে, মাদল বাজে সেই সংকেতে, শ্যামা মেয়ে নাচে। পাগলপারা চাঁদের আলো, নাচের তালে মেশে, নিটোল পায়ে রিনিক ঝিনিক। চাঁদের আলোয় কালো কাকা, নাচের তালে দোলেরে আহা মরি, ঢলে ঢলে দোলে, যেন সাদা মেঘের কোলে, কালো তড়িৎ খেলেরে খেলে ঐ, কি কৌতুকে খেলে; ঝলক ভরা দামিন সে যে, ঝিলিক মারে হেসে। কালো মেয়ের চপল বুকে, সভ্রম নিঃশ্বাস নাচেরে তারই তালে, বুকের মালা নাচে; থরে থরে ঝুমকা জবা, কবরীতে রাজে রে রাজে ঐ, রঙে রঙে রাজে; শ্যামল বনভূমি শিহরে ঐ, শ্যামের পরশে। পল্লীগানের ব্যাপারটা শচীন কর্তার এই গানে এমন অসাধারণ মাধুর্য মিশিয়েছে যে, আপনি যদি চোখ বন্ধ করে এই গানটি শোনেন, আপনি চোখের সামনেই পুরো ফিলটা পাবেন। আপনার সেই ছোটবেলায় ফেলে আসা পুরনো বাড়িটার কথা। যে বাড়ির দাওয়ায় আপনি একসময়ে খেলা করতেন।

একবার সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় একটা স্টেজে পারফর্ম করতে গেছেন। তখন তাঁর বয়স খুবই কম। ঘটনাচক্রে সেখানে উপস্থিত ছিলেন শচীন কর্তা। তখন শচীন কর্তার খ্যাতি গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে। তিনি যেখানে যান সেখানেই বীরের সম্মান পান। তখন তিনি ভারতের এককথায় সুপার স্টার। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় তখনো তেমন নাম করেননি। একেবারে বাচ্চা বয়স। অনেক ছোট। সময়টা কিন্তু শীতকাল। খোলা আকাশের নীচে অনুষ্ঠান। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় স্টেজে পারফর্ম করতে উঠেছেন, ঠিক তখন স্টেজে বসা শচীন কর্তা গান শুরুর আগে সন্ধ্যাকে থামিয়ে দিলেন! যারা ওই অনুষ্ঠানের আয়োজক, তাদের তো তখন চোখ ছানাবড়া। সেকি! শচীন কর্তা কী করছেন এটা! হঠাৎ শচীন কর্তা এই বাচ্চা মেয়েটির গান থামিয়ে দিলেন কেন? রহস্য কী?

শচীন কর্তা নিজের গায়ের শালটা খুলে মাটিতে পেতে দিলেন। আর বললেন, তুমি বাচ্চা মেয়ে। মাটিতে বসলে তোমার ঠাণ্ডা লেগে যাবে। গলা খারাপ হয়ে যাবে। আমার শালের উপর বসে তুমি গানটা গাও। ভাবুন একবার, একটা মানুষের মন কতটা উদার হলে, গানের প্রতি কতটা কমিটমেন্ট থাকলে, নিজের গায়ের দামি শাল দিয়ে একেবারে অপরিচিতা একটা বাচ্চা মেয়ের জন্য আসনের মত করে সেটি বিছিয়ে দিতে পারেন! এই বিষয়টা মনে হয় শব্দে বা ভাষায় ঠিক বোঝানো যাবে না। এ কারণেই ত্রিপুরার রাজ পরিবারের এই মানুষটি সত্যি সত্যিই রাজসিক। গানের ক্ষেত্রেও শচীন কর্তা ছিলেন রাজসিক, তেমনি ব্যক্তিত্বের বেলায় ছিলেন এমন উঁচুতে।

ও…ও বাঁশি, ঘাটে লাগাইয়া ডিঙ্গা পান খাইয়া যাও, বাঁশি আল্লাহ’র দোহাই। এই পরাণের বিনিময় তোমার পরান দিও বাঁশি আল্লাহ’র দোহাই। ও…ও বাঁশি, বানের টানে টানে আইসো আমার পাণে, মধু লাগাইও মনে মজিও পানের গুনে আসিও। আমার রঙ্গে পানের রঙ্গে রাঙ্গা হইও বাঁশি, আল্লাহ’র দোহাই। ও…ও বাঁশি, ঘাটে আসিও পিড়ি পেতে দেব পাশে বসাব মুখেতে পান দিব, দিব রে, অন্যের হাতের পান ছাইড়া, আমার হাতের পান খাইয়ো। ও…ও বাঁশি, নাহি পান পানি দিনের পাখানি আছে, জগতে জানি আসিও গুল মনি আসিও; কোন রসেতে ডুইবা তুই দিনের অধিকারী, দিনের অধিকারী হইও। এই গানটিও মীরা দেব বর্মনের লেখা আর শচীন কর্তার সুর ও কম্পোজ করা।

শচীন কর্তার এই গানটি যখন আপনি শুনছেন, তখন কিন্তু আপনি আর আপনার ঘরে নাই। কম্পিউটারের সামনেও নাই। বিছানায় উবু হয়ে শুয়েও নাই। আপনার চারপাশের সবকিছু পাল্টে গেছে। আপনি তখন সত্যি সত্যি চলে গেছেন আপনার গ্রামে। যেখানে নদীর ঘাটে একটা ডিঙ্গা আছে। আপনি নিশ্চয়ই জানেন যে, শচীন টেন্ডুলকারের নাম শচীন হয়েছে কার কারণে? শচীন টেন্ডুলকারের বাবা রমেশ টেন্ডুলকার কী শখ করে ছেলের নাম রেখেছেন শচীন টেন্ডুলকার? মোটেও না। রমেশ টেন্ডুলকার ছিলেন শচীন কর্তার একনিষ্ঠ একজন ভক্ত। তাই নিজের ছেলের নাম তিনি শচীন কর্তার নামেই রেখেছিলেন। একজন সুরের সম্রাট। সুর তুলেছেন গান গানে। অন্যজন ক্রিকেট সম্রাট। সুর তুলেছেন ক্রিকেট খেলায়। ক্রিকেটের চার ছক্কায় সুর লাগাতেন শচীন টেন্ডুলকার।

সুরে ছয় মারা তারই সাজে যিনি বাঁশির সুরে মনের ডাকাত পড়াতে পারেন। চলুন, শুনে আসি শচীন কর্তার আরেকটা অদ্ভুত সুরের অবিস্মরণীয় গান। ও... বাঁশি শুনে আর কাজ নাই, সে যে ডাকাতিয়া বাঁশি। সে যে দিন-দুপুরে চুরি করে রাত্রিরেতে কথা নাই, ডাকাতিয়া বাঁশি। ও... শ্রবণে বিষ ঢালে শুধু বাঁশি পোড়ায় প্রাণ গড়লে, ঘুচাব তার নষ্টামি আজ আমি, সপিব তা অনলে; সে যে দিন-দুপুরে চুরি করে রাত্রিরেতে কথা নাই, ডাকাতিয়া বাঁশি; বাঁশি শুনে আর কাজ নাই সে যে ডাকাতিয়া বাঁশি। ও... বাঁশেতে ঘুণ ধরে যদি কেন বাঁশিতে ঘুণ ধরে না, কতজনায় মরে শুধু পোড়া বাঁশি কেন মরে না। চোরা দিন-দুপুরে চুরি করে রাত্রিরেতে কথা নাই, ডাকাতিয়া বাঁশি, বাঁশি শুনে আর কাজ নাই সে যে ডাকাতিয়া বাঁশি। সে যে দিন-দুপুরে চুরি করে রাত্রিরেতে কথা নাই, ডাকাতিয়া বাঁশি, বাঁশি শুনে আর কাজ নাই সে যে ডাকাতিয়া বাঁশি। এই কালজয়ী গানটির গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। আর এটি সুর ও কম্পোজ করেছেন শচীন কর্তা।

তুমি যে গিয়াছ বকুল-বিছানো পথে, নিয়ে গেছ হায়– একটি কুসুম আমার কবরী হতে। নিয়ে গেছ হিয়া কী নামে ডাকিয়া, নয়নে নয়ন দিয়া, আমি যেন হায় ফেলে-যাওয়া মালা, কূলহারা নদী স্রোতে। খেলাঘরে কবে ধূলির খেলায়, দু’টি হিয়া ছিল বাঁধা, আমার বীণাটি তোমার বাঁশিটি একসুরে ছিল সাধা। সে খেলা ফুরালো, সে সুর মিলালো, নিভিলো কনক আলো; দিয়ে গেছ মোরে শত পরাজয় ফিরে এসো জয়রথে। এই গানটি লিখেছিলেন অজয় ভট্টাচার্য আর এটি সুর ও কম্পোজ করেছেন শচীন কর্তা।

রবি গুহ মজুমদার লিখেছিলেন নিচের এই গানটি। আর এটি সুর ও কম্পোজ করেছিলেন শচীন দেব বর্মন। তুমি আর তুমি আর, তুমি আর নেই সে তুমি, জানি না জানি না কেন এমনও হয়, জানি না; জানি না জানি না কেন এমনও হয়, তুমি আর নেই সে তুমি, তুমি আর তুমি আর, তুমি আর নেই সে তুমি। তোমার চোখেরও পাতা নাচে না, নাচে না আমারো পথ চেয়ে, তোমার পায়ে পায়ে মল বাজে না, বাজে না আমারো সাড়া পেয়ে; হাসো না হাসো না সে হাসি মধুময়, তুমি আর নেই সে তুমি, জানি না জানি না কেন এমনও হয়, জানি না, জানি না জানি না কেন এমনও হয়, তুমি আর নেই সে তুমি, তুমি আর তুমি আর, তুমি আর নেই সে তুমি। তোমার সাপেরও বেণী দোলেনা, দোলে না হাওয়ার বাঁশি শুনে, তোমার চোখে বিজলী খেলে না, খেলে না মেঘেরো গর্জনে; গুণগুণ গুণগুণ করো না অসময়, গুণগুণ, গুণগুণ গুণগুণ করো না অসময়, তুমি আর নেই সে তুমি; জানি না জানি না কেন এমনও হয়, জানি না, জানি না জানি না কেন এমনও হয়, তুমি আর নেই সে তুমি, তুমি আর তুমি আর, তুমি আর নেই সে তুমি।

হায় কি যে করি এ মন নিয়া, সে যে প্রণয়ও হুতাশে ওঠে উথলিয়া, ওই দুষ্টু পাপিয়া বলে পিয়া পিয়া, পিয়া পিয়া... তার মিষ্টি কুজন তবু জ্বলে হিয়া, মুখে অভিমান ওঠে মনে উছলিয়া। আছে সবারি কেহ না কেহ মরমিয়া, হায় একেলা আমারই শুধু নাই প্রিয়া, ওই দুষ্টু পাপিয়া বলে পিয়া পিয়া, পিয়া পিয়া... ঐ ফুলেরও বাসরে দেখি বনলতা, বুঝি তরুণও তরুর সনে বলে কথা, তারা কেহতো বুঝেনা মোর আকুলতা, তাই মরমে মরিগো আমি গুমরিয়া, ওই দুষ্টু পাপিয়া বলে পিয়া পিয়া, পিয়া পিয়া... দেখ একটি চাঁদের সাথী কত তারা, মেশে একটি সাগরে কত জল ধারা, শুধু আমি কি একেলা রব সাথী হারা, মোরে কেহ কি বাঁধিবে না গো মালা দিয়া, ওই দুষ্টু পাপিয়া বলে পিয়া পিয়া, পিয়া পিয়া। এই গানটি লিখেছেন মোহিনী চৌধুরী আর এটি সুর ও কম্পোজ করেছেন শচীন কর্তা।

অজয় ভট্টাচার্যের লেখা এবং হিমাংশু কুমার দত্তের সুর করা এই গান গেয়েছিলেন শচীন কর্তা। গানটি হলো- মম মন্দিরে এলে কে তুমি? তব পূজা-ধূমে লুকায়ে আজি, আমারে পূজিলে ওগো কে তুমি? প্রেম-দেবতার আরতি লাগি, আঁখি-দীপ তব রয়েছে জাগি, মোরে দিলে মালা ভুলে কে তুমি? অন্ধ বাতাস হেথা নিশাসে, পাষাণ দেবতা আমি যে আজ, শত বেদনার হিম-পরশে। ওগো পূজারিণী যাও গো ফিরে, পাষাণ গলে না এ-আঁখিনীরে, মরুতে মলয় চাহ কে তুমি?

অজয় ভট্টাচার্যের লেখা এবং হিমাংশু কুমার দত্তের সুর করা এই গানটিও গেয়েছিলেন শচীন কর্তা। গানটি হলো- আলো-ছায়া-দোলা উতলা ফাগুনে বনবীণা বাজে, পথচারী অলি চলে যেথা কলি জাগে মধু লাজে। মৃদু ফুলবাসে সমীর নিশাসে, অজানা আবেশ ধীরে ভেসে আসে আজি হিয়া-মাঝে। দোলে লতা-বেণী, সাজে বন-পরী, বাঁধে ফুল-রাখী বুঝি মোরে স্মরি; চারুদিঠি তার, ডাকে অনিবার, এ শুভ লগনে আজিকে কেমনে রহি আন কাজে?

শচীন দেব বর্মন নিজেও কিছু গান লিখে সেই গানে সুর করেছেন এবং নিজেই কণ্ঠ দিয়েছেন। শচীন কর্তার তেমন একটি গান হলো- তুমি এসেছিলে পরশু কাল কেন আসোনি, তুমি কি আমায় বন্ধু কাল ভালবাসনি। নদী, নদী যদি হয়রে ভরাট কানায় কানায়, হয়ে গেলে শূন্য হঠাৎ তাকে কি মানায়; তুমি কি আমায় বন্ধু কাল মনে রাখোনি, কাল কেন আসোনি কাল ভালোবাসনি, তুমি এসেছিলে পরশু কাল কেন আসোনি। আকাশে ছিল না বলে হায় চাঁদের পালকি, তুমি হেঁটে হেঁটে সন্ধ্যায় আসোনি কাল কি! তুমি কি আমায় বন্ধু কাল অভিলাসনি, কাল কেন আসোনি, তুমি এসেছিলে পরশু কাল কেন আসোনি। বনে, বনে বনে পাখি ডেকে যায় আবোল তাবোল, থেকে থেকে হাওয়া ডেকে যায়, দিয়ে যায় দোল। তুমি কি আমায় বন্ধু একবারও ডাকোনি, কাল কেন আসোনি কাল ভালোবাসনি, কাল ভালোবাসনি।

শচীন লেখা আরেকটি বিখ্যাত গান, যেটি নিজেই সুর করেছেন এবং নিজেই কণ্ঠ দিয়েছেন। শচীন কর্তার তেমন একটি গান হলো- তাকডুম তাকডুম বাজাই, আমি তাকডুম তাকডুম বাজাই, বাংলাদেশের ঢোল, সব ভুলে যাই, তাও ভুলি না বাংলা মায়ের কোল। বাংলা জনম দিলা আমারে, তোমার পরাণ আমার পরাণ, এক নাড়িতে বাঁধা রে, মা-পুতের এ বাঁধন ছেড়ার, সাধ্য কারো নাই, সব ভুলে যাই তাও ভুলি না বাংলা মায়ের কোল। মা তোমার মাটির সুরে সুরেতে, আমার জীবন জুড়াইলা মাগো, বাউল ভাটিয়ালিতে। পরাণ খুইলা মেঘনা তিতাস, পদ্মারই গান গাই, সব ভুলে যাই তাও ভুলি না বাংলা মায়ের কোল। বাজে ঢোল নরম গরম তালেতে, বিসর্জনের ব্যথা ভোলায়, আগমনের সুরেতে; বাংলাদেশের ঢোলের বোলে ছন্দ পতন নাই, সব ভুলে যাই তাও ভুলি না বাংলা মায়ের কোল।

হিন্দি গানের জগতে শচীন কর্তা একেবারে জুলিয়াস সিজারের মত। এলেন, দেখলেন আর জয় করলেন। এমন একটা সময় তিনি রাজত্ব করেছেন, যখন তাঁর চারপাশে অজস্র প্রতিভা, অজস্র মণিমুক্তো ছিল। কিন্তু তিনি ঠিক রাজার মতই রাজত্ব করেছেন। একটা সময় বড় সাফল্যের জন্য শচীন কর্তা বোম্বে গেলেন। কিন্তু তিনি বাংলা ছাড়লেও, বাংলা গানকে তিনি একদম ছাড়েননি। বরং বাংলার মাটির সুরকে তিনি সর্বদা, তাঁর গানে, তাঁর গায়কীতে, তাঁর মননে, তাঁর আত্মায় সবসময় স্থান দিয়েছেন।

শচীন কর্তার আগেও বোম্বে বাঙালি সুরকার গিয়েছেন। প্রাণ চন্দ্র পাল গেছেন। অনীল বিশ্বাস গেছেন। কিন্তু শচীন কর্তা বোম্বে গিয়েই যেন ঘোষণা করলেন, তিনি যেন প্রমাণ করলেন, তিনি সবার কাছে এই মেসেজটি পৌঁছে দিলেন যে, তিনি এখানে রাজত্ব করতেই এসেছেন। তাঁর সুরের মাধ্যমে, তাঁর গায়কীর মাধ্যমে। তাঁর অবিস্মরণীয় সেই সব সৃষ্টির মাধ্যমে।

একই সময় আরেকজন বাঙালি বোম্বে গিয়েছিলেন। তাঁর নাম কৃষ্ণ চন্দ্র দে। মান্না দে'র কাকা। তিনি কিন্তু বোম্বে বেশি দিন থাকতে পারেননি। শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে তিনি কলকাতা ফেরত আসেন। কিন্তু শচীন কর্তার কাছে রেখে আসেন মান্না দে-কে। মান্না দে তখন শচীন কর্তার এসিসট্যান্ট হিসেবে কাজ শুরু করেন। আমার বিশ্বাস এই কথাটি শোনার পর আপনার মনের ঝিলে ঢেউ উঠেছে।

ঝিলমিল ঝিলমিল ঝিলের জলে ঢেউ খেলিয়া যায়রে, ঝির ঝির ঝির হাওয়ায়রে ঢেউ খেলিয়া যায়, ঝিলমিল ঝিলমিল, ঝিলমিল ঝিলমিল। মল বাজায়ে মন মাতায়ে জল নিতে কেউ যায় না, বউ কথা কউ পাখি ডাকে বউ তো ফিরে চায় না, মন কাঁদে হায় হায় রে, আজ তুমি কোথায় কোথায় রে তুমি কোথায়, টলমল টলমল, টলমল টলমল ধানের ক্ষেতে ঢেউ খেলিয়া যায় রে, শনশন শন হাওয়ারে, ঢেউ খেলিয়া যায়, ঝিলমিল ঝিলমিল। চুল উড়ায়ে ফুল ছড়ায়ে আলপথে কেউ যায় না, পাগল হাওয়া আঁচল টেনে আর তো নাগাল পায় না, মন কাঁদে হায় হায় রে, আজ তুমি কোথায় কোথায় রে তুমি কোথায়, ছলছল ছলছল, ছলছল ছলছল আঁখির জলে ঢেউ খেলিয়া যায়রে, রিমঝিমঝিম বরষায়রে ঢেউ খেলিয়া যায়, ঝিলমিল ঝিলমিল। ও... গুণগুণায়ে গান শুনায়ে কেউ ব্যথা ভোলায় না, একলা থাকার দিন যে আমার শেষ হতে আর চায় না, মন কাঁদে হায় হায় রে, আজ তুমি কোথায় কোথায় রে তুমি কোথায়, ঝিলমিল ঝিলমিল ঝিলের জলে ঢেউ খেলিয়া যায়রে, ঝির ঝির ঝির হাওয়ায়রে ঢেউ খেলিয়া যায়, ঝিলমিল ঝিলমিল, ঝিলমিল ঝিলমিল।

একবার আরডি বর্মন (রাহুল দেব বর্মন, শচীন কর্তার ছেলে) তাঁর জন্মদিনে শচীন কর্তার বাড়িতে এলেন। দরজা খুলে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে যাবেন, হঠাৎ তিনি চমকে গেলেন। বাড়িতে তাঁর গান বাজছে। মানে আরডি বর্মনের কম্পোজ করা গান বাজছে। শুনছেন তাঁর বাবা, স্বয়ং শচীন কর্তা। দরজার সামনে থমকে দাঁড়িয়ে রইলেন আরডি বর্মন। কিছুক্ষণ পর যখন গান থামলো তখন আরডি বর্মন বাড়িতে ঢুকলেন। বাবা তাঁকে বললেন, তোমারই গান শুনছিলাম। বাবা তাঁর গান শুনছেন, এটি আরডি বর্মনকে রীতিমত চমকে দিল। এটাকে একটা বিরাট বড় পুরস্কার বলে মনে হলো আরডি বর্মনের। প্রণাম করলেন তিনি বাবাকে। বাবা বিখ্যাত সুরকার, ভারতবর্ষের লিজেন্ড এসডি বর্মন ছেলে আরডি বর্মনের মাথায় হাত রেখে বললেন, আমার জীবনে সবচেয়ে আনন্দের ঘটনা কী জানো? ছেলের কাছে বাবার হার।

আসলে এই ঘটনা একজন গ্রেট আরেকজন গ্রেটকে মন থেকে স্বীকৃতি দিলেন। যে গ্রেট কিনা জীবনের শেষপ্রান্তে গিয়েও আকড়ে ধরবেন সেই বাবাকেই। ফিরে আসতে চাইবেন সেই মাটির কাছাকাছি, যে মাটি থেকেই সুর বানাতেন সম্রাট এসডি বর্মন। আমাদের বাংলা গানের অঘোষিত সম্রাট শচীন দেব বর্মন।

আপনার মন্তব্য