বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, পঞ্চম পর্ব: ২২-২৩

 প্রকাশিত: ২০১৬-১০-০৮ ১৮:২৩:৪৪

কাজী মাহবুব হাসান:

বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, পঞ্চম পর্ব (নির্ভারতা এবং ভার ) : ২২ ও ২৩
২২
আরো গভীর রাতে আবারো টমাস ঘুম ভেঙে যায়, আর বিস্ময়ের সাথে সে অনুধাবন করে একটার পর একটা যৌন স্বপ্ন সে দেখেছে। একটি মাত্র স্বপ্ন যা সে খানিকটা সুস্পষ্টভাবে মনে করতে পারে, সেটি সে সর্বশেষ দেখেছিল - বিপুল শরীরের একজন নগ্ন রমণী, কমপক্ষে টমাসের চেয়ে পাঁচ গুণ বড় হবে সে আকারে, একটি সুইমিং পুলে পিঠের উপর শুয়ে পানিতে ভাসছে, তার নাভি থেকে যোনী অবধি ঢেকে রেখেছে ঘন কালো চুল। পুলের একপাশ থেকে তাকে দেখে টমাস বেশ উত্তেজনা অনুভব করে।

কিভাবে সে উত্তেজিত হতে পারে যখন তার শরীর অসাড় হয়ে আছে তীব্র পেটের যন্ত্রণায়? আর কিভাবেই বা সে এমন কোনো রমণীকে দেখে উত্তেজিত হতে পারে, যে নারী তাকে বিকর্ষণ করতো, যদি জ্ঞান থাকতে সে তাকে দেখতো?

টমাস ভাবছিল: তার মাথার যন্ত্রের মধ্যে দুটি খাঁজকাটা চাকা পরস্পরের বিপরীত দিকে ঘুরছে, যার একটিতে আছে ছবি, আর অন্যটিতে. তার শরীরের প্রতিক্রিয়া। যে চাকাটি একটি নগ্ন রমণীর ছবি বহন করছে সেটি যুক্ত আছে তার লিঙ্গোত্থান নিয়ন্ত্রণকারী চাকাটির সাথে। কিন্তু যখন কোনো কারণে এই চাকাগুলো ঠিক মত কাজ না করে আর উত্তেজনার চাকাটি যুক্ত হয় এমন একটি চাকার সাথে যা হয়তো উড়ন্ত শোয়ালো পাখির ছবি বহন করছে, তখন কোনো শোয়ালো পাখির ছবি দেখলেও লিঙ্গোত্থান হতে পারে।

এছাড়াও, টমাসের এক সহকর্মী তার গবেষণা অনুযায়ী - যিনি মানব নিদ্রা বিশেষজ্ঞ - দাবী করেছিলেন, ‘যে কোনো ধরনের’ স্বপ্নের সময় পুরুষদের লিঙ্গোত্থান হতে পারে, যার মানে, লিঙ্গ উত্থান আর নগ্ন রমণীর মধ্যে সংযোগ হাজার উপায়ের একটি মাত্র উপায় যা দিয়ে সৃষ্টিকর্তা পুরুষের মাথায় স্থাপিত যন্ত্রটিকে চলার জন্য ধার্য করেছেন ।

আর এর সাথে ভালোবাসার সম্পর্ক কি? কিছুই না, যদি টমাসের মাথার যন্ত্রের একটি চাকা তার কাজ না করে এবং সে যদি কোনো শোয়ালো পাখি দেখে যৌন উত্তেজিত হয়, সেটির সাথে তেরেজার প্রতি তার ভালোবাসার উপর কোনো প্রভাব নেই।

যদি উত্তেজনা কোনো একটি প্রক্রিয়া হয় যা আমাদের সৃষ্টিকর্তা ব্যবহার করেছিলেন ‘তার’ নিজের আনন্দের জন্য, তাহলে ভালোবাসা হচ্ছে এমন কিছু যা শুধুমাত্র আমাদের নিজেদের, যা আমাদের সক্ষম করে তোলে সৃষ্টিকর্তার পরিকল্পনা থেকে থেকে পালাতে। ভালোবাসাই হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতা, ভালোবাসার অবস্থান ‘এস মুস সাইন’! বা আমাদের সব বাধ্যবাধকতার অপর পাশে!

যদিও সেটি পুরোপুরি সত্য নয়, এমনকি ভালোবাসা যৌনতার মত যান্ত্রিক কোনো কিছু যদি নাও হয়, যা সৃষ্টিকর্তা ব্যবহার করেছেন ‘তার’ নিজের মজার জন্য, তারপরও এটি এর সাথে যুক্ত থাকে এখনও। এটি এর সাথে যুক্ত যেমন করে কোনো কোমল নগ্ন রমণী সুবিশাল কোনো ঘড়ির পেন্ডুলামের সাথে যুক্ত।

টমাস ভাবছিল: ভালোবাসাকে যৌনতার সাথে যুক্ত করাটা সৃষ্টিকর্তার ভাবা সবচেয়ে উদ্ভটতম ধারণার একটি।

সে আরো ভাবছিল: ভালোবাসাকে যৌনতার নির্বুদ্ধিতা থেকে মুক্ত করার একটি উপায় হচ্ছে আমাদের মাথার সেই যন্ত্রটাকে এমনভাবে ঠিক করা যেন, আমরা সোয়ালো পাখি দেখলেও উত্তেজিত হই।

আর সেই মধুর চিন্তা নিয়ে টমাস আবার তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়, কিন্তু ঘুমের ঠিক চৌকাঠে, এলোমেলো চিন্তার সেই নো-ম্যান্স-ল্যান্ডে, সে হঠাৎ করেই নিশ্চিত হয় যে, সে সব ধাঁধাঁর একটি সমাধান কেবলই আবিষ্কার করেছে। সব রহস্য সমাধানের চাবিকাঠি, একটি নতুন ইউটোপিয়া, একটি স্বর্গ: একটি পৃথিবী যেখানে মানুষ সোয়ালো পাখি দেখলেও উত্তেজিত হয় আর টমাস তেরেজাকে ভালোবাসাতে পারে যৌনতার আক্রমণাত্মক নির্বুদ্ধিতা দ্বারা অত্যাচারিত হওয়া সত্ত্বেও।

এরপর সে ঘুমিয়ে পড়ে।

২৩
বেশ কিছু অর্ধ নগ্ন রমণী চারপাশ থেকে তাকে পেঁচিয়ে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করছে, কিন্তু সে খুবই ক্লান্ত, আর তাদের হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করার জন্য, পাশের ঘরে যাবার একটি দরজা খোলে। সেখানে ঠিক তার বিপরিতে কাউচের উপর পাশ ফিরে শুয়ে থাকা এক তরুণীকে দেখে। সেও, অর্ধনগ্ন, শুধুমাত্র নীচের অন্তর্বাস ছাড়া তার পরনে কিছু নেই। কনুইয়ের উপর ভর দিয়ে উঠে সে টমাসের দিকে হাসি মুখে তাকায় আর বলে সে জানতো টমাস আসবে।

টমাস তরুণীটির কাছে যায়।অবর্ণনীয় আনন্দের একটি অনুভূতিতে সে পূর্ণ হয় সেই চিন্তায়, অবশেষে সে তাকে খুঁজে পেয়েছে এবং তার সাথে এখন সে থাকতে পারবে। টমাস তরুণীর পাশে গিয়ে বসে এবং তাকে কিছু বলে, এবং সেও তাকে কিছু বলে। প্রশান্তি বিকিরিত হচ্ছে তার শরীর থেকে, তরুণীটির হাত ধীর সূক্ষ্ম অঙ্গভঙ্গি করে। সারাটা জীবন টমাস এই তরুণীর অঙ্গভঙ্গির প্রশান্তি কামনা করেছে। রমণীয় প্রশান্তি চিরকালেই তার কাছে নাগালের বাইরেই রয়ে গেছে।

ঠিক তখনই স্বপ্নটি পিছলে ফিরে আসে বাস্তবতায়, সে নিজেকে আবারো সেই নো-ম্যানস- ল্যান্ডে আবিষ্কার করে, যেখানে সে না ঘুমিয়ে কিংবা না জেগে। তীব্র আতঙ্কের শিকার হয় টমাস চোখের সামনে সেই তরুণীর অদৃশ্য হয়ে যাবার সম্ভাবনায়, সে স্বগতোক্তি করে, ‘ঈশ্বর, আমি আসলেই তাকে হারাতে চাইনা, আমার জন্য সেটি দুঃসহ হবে!’ মরিয়া হয়ে সে চেষ্টা করে মনে করতে, কে ছিল সেই তরুণীটি, কোথায় তার সাথে হয়েছিল তার, তাদের সম্মিলিত সেই অভিজ্ঞতার খুঁটিনাটি বিষয়গুলো। কিভাবে সে ভুলে যেতে পারলো যখন সে তাকে এত ভালোভাবে চেনে? সে প্রতিজ্ঞা করে কাল সকালে প্রথমে তাকেই ফোন করবে। কিন্তু তার প্রতিজ্ঞা শেষ করতে না করতেই টমাস অনুধাবন করে সে প্রতিজ্ঞাটি রাখতে পারবেনা। সে তার নাম জানে না, কিভাবে সে এমন কারো নাম ভুলে যেতে পারলো, যাকে কিনা সে এত ভালো করেই চেনে?।ততক্ষণে তার ঘুম পুরোপুরি ভেঙে গেছে , আর সে নিজেকেই জিজ্ঞাসা করে, আমি কোথায়? হ্যাঁ, আমি প্রাহায়, কিন্তু সেই তরুণীটি, সেও কি এখানেই থাকে? আমার সাথে কি তার অন্য কোথাও দেখা হয়েছিল? সে কি সুইজারল্যাণ্ডের কেউ হতে পারে? বেশ কিছুটা সময় লাগে তার পুরোপুরি অনুধাবন করতে, তরুণীকে সে আসলেই চেনেনা, আর সে প্রাহা কিংবা সুইজারল্যান্ডেরও কেউ নয়, সে তার স্বপ্নে বাস করে, অন্য কোথাও না।

খু্বই হতাশ হয়েই সে বিছানায় সোজা হয়ে উঠে বসে। তেরেজা তার পাশে শুয়ে গভীরভাবে শ্বাস নিচ্ছে। তার স্বপ্নের সেই রমণীটি, টমাস ভাবে, তার সাথে দেখা হওয়া সব রমণী থেকে যে অনেক ভিন্ন। টমাস অনুভব করে যে রমণীটিকে সে সবচেয়ে বেশী অন্তরঙ্গভাবে চেনে, দেখা গেল সেই রমণীর সাথে তার এমনকি কখনো দেখাই হয়নি। কিন্তু তারপরও সে সব সময় তাকেই কামনা করে এসেছে। যদি কোনো ব্যক্তিগত স্বর্গ তার জন্য কোথাও থেকে থাকে, সেই স্বর্গে তাকে তার পাশেই থাকতে হবে। তার স্বপ্নের এই রমণীটি তার ভালোবাসার ‘এস মুস সাইন’!

হঠাৎ করেই প্লেটোর সিম্পোজিয়ামের সেই বিখ্যাত পুরাণ কাহিনীটির কথা টমাসের মনে পড়ে: মানুষ মূলত উভলিঙ্গ ছিল যতদিন না ঈশ্বর তাদের দুটি লিঙ্গে বিভাজিত করেছিলেন।এখন অর্ধেক সেই মানুষগুলো সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ায় তার হারিয়ে যাওয়া বাকী অংশটির অনুসন্ধানে।ভালোবাসা হচ্ছে আমাদের সেই বাকী অর্ধাংশের জন্য কামনা যা আমরা হারিয়েছিলাম।

আসুন আমরা কল্পনা করি এমন কিছুই আসলে ঘটেছিল, আর পৃথিবীর কোথাও না কোথাও আমাদের প্রত্যেকেরই একজন সঙ্গী আছে, যারা একসময় আমাদের শরীরেরই একটি অংশ তৈরি করেছিল। টমাসের আরেক অংশ হচ্ছে সেই তরুণীটি যাকে সে স্বপ্নে দেখেছিল। সমস্যা হচ্ছে, মানুষ তাদের আরেকটি অংশকে খুঁজে পায় না। তার পরিবর্তে, নলখাগড়ার ঝুড়িতে করে যেমন টমাসের কাছে একটি তেরেজাকে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু কি ঘটবে যদি কোনো না কোনো ভাবে পরে তার জন্য যে মানুষটি উপযুক্ত, সে তাকে খুঁজে পায়, যে তার আরেকটি অংশ? কাকে তখন সে বেছে নেবে? নলখাগড়ার ঝুড়িতে শোয়া রমণীটি নাকি প্লেটোর পুরাণের রমণী?

টমাস চেষ্টা করে ভাবতে যে সে একটি আদর্শ জগতে বাস করছে তার স্বপ্নের সেই তরুণীর সাথে। তার আদর্শ বাড়ীর জানালা দিয়ে সে তেরেজাকে তার বাসার সামনে দিয়ে হেটে যেতে দেখছে। তেরেজা একা, থেমে সে টমাসের দিকে তাকায় চোখে অসীম দুঃখের অভিব্যক্তি নিয়ে।টমাস তার দৃষ্টিকে সহ্য করতে পারেনা।আবারো সে তার নিজের বুকের যন্ত্রণাটি অনুভব করে। আবারও সে সহমর্মিতার শিকার হয় এবং তার আত্মার গভীরে নিমজ্জিত হয়। সে জানালা দিয়ে লাফ দিয়ে বের হয়ে হয়ে আসে। কিন্তু তেরেজা তাকে তিক্ততার সাথে বলে, সেখানেই থাকতে যেখানে সে সুখী, আর সে তার সেই তীর্ঘক, আকস্মিক অঙ্গভঙ্গি করে, যা টমাসকে অনেক বিরক্ত আর অসন্তুষ্ট করে।তাকে শান্ত করার জন্য টমাস তার ভীরু চিন্তিত হাত জাপটে ধরে তার দুই হাতে এবং সে জানে বার বার সে তার এই সুখের বাড়ি পরিত্যাগ করবে, বার বার সে তার স্বর্গ আর তার স্বপ্নের তরুণীকে পরিত্যাগ করবে এবং তার ভালোবাসার ‘এস মুস সাইন’ এর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে, তেরেজার সাথে চলে যাবার জন্য, যে রমণীর জন্ম হয়েছিল ছয়টি হাস্যকর দৈব ঘটনায়।

এই পুরোটা সময় সে বিছানায় বসে ছিল আর তার পাশে শুয়ে থাকা রমণীটির দিকে তাকিয়ে ছিল, যে ঘুমের মধ্যে তখনও তার হাত ধরে আছে। সে তেরেজার জন্য অবর্ণনীয় একটি ভালোবাসা অনুভব করে। তার ঘুম অবশ্যই খুব হালকা কারণ যে মুহূর্তে তেরেজা তার চোখ খোলে, প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে সে তাকায়।

জিজ্ঞাসা করে, ‘কি দেখছো তুমি’?

টমাস জানে, তার ঘুম না ভাঙ্গিয়ে বরং তার উচিৎ হবে তাকে আবার ঘুম পড়িয়ে দেয়া, সুতরাং সে চেষ্টা করে এমন একটি উত্তর দেবার জন্য, যা তার মনে একটি নতুন স্বপ্ন রোপণ করবে।

‘আমি তারাদের দিকে তাকিয়ে আছি’, সে বলে।

‘বলো না যে তুমি তারাদের দিকে তাকিয়ে আছো, সেটা মিথ্যা হবে, তুমি নীচের দিকে তাকিয়ে আছো’।

‘তার কারণ আমরা একটি উড়োজাহাজে বসে আছি, আর তারারা আমাদের নীচে’।

‘ওহ, উড়োজাহাজে’, তেরেজা বলে, টমাসের হাতে আরো জোরে চাপ দিয়ে সে ঘুমিয়ে পড়ে আবার। আর টমাস জানতো যে তেরেজা তারাদের অনেক উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া একটি উড়োজাহাজের গোল জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে।
(পঞ্চম পর্ব সমাপ্ত)

আপনার মন্তব্য