জীবনানন্দ দাশের চাকরিচ্যুতি

 প্রকাশিত: ২০১৬-১০-১১ ২২:৩৮:৫৮

ফরিদ আহমেদ:

জীবনানন্দ দাশ ১৯১৯ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্সসহ বি.এ. পাস করেন। এরপর তিনি ইংরেজিতে এম.এ. পড়ার জন্য কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। একই সাথে তিনি আইনেও ভর্তি হন। এম.এ. পরীক্ষার আগে অসুখে ভুগেছিলেন তিনি। পরীক্ষার ফল ভালো হবে না ভেবে শুরুতে পরীক্ষা দেবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। পরে আত্মীয়স্বজনদের চাপে পরীক্ষা দিতে বসেন। এম.এ. তে সেকেন্ড ক্লাস পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু, আইনের উপর ডিগ্রি নেওয়া তাঁর হয় নি। আইন পড়তে পড়তেই ১৯২২ সালে কোলকাতার সিটি কলেজে লেকচারার হিসাবে চাকরি হয়ে যায় তাঁর। আইন পড়া ছেড়ে দেন তিনি।

সিটি কলেজের বেশিরভাগ ছাত্রই ছিল হিন্দু। কিন্তু, এই কলেজটি ছিল ব্রাহ্মদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এবং পরিচালিত। জীবনানন্দ দাশেরাও ব্রাহ্ম ছিলেন। শুধু যে ব্রাহ্ম ছিলেন, তাই নয়। জীবনানন্দ দাশের পিতা সত্যানন্দ দাসগুপ্ত, ব্রহ্মবাদী পত্রিকার সম্পাদক পিসেমশায় মনমোহন চক্রবর্তী সেই সময়কার ব্রাহ্ম সমাজের নেতৃস্থানীয় লোক ছিলেন। খুব সম্ভবত এদেরই কারো সুপারিশে সিটি কলেজে চাকরি হয় তাঁর।

১৯২২ থেকে ১৯২৮ পর্যন্ত এখানে ছিলেন তিনি। তারপর একদিন হুট করে সিটি কলেজের চাকরিটা চলে যায় তাঁর। সিটি কলেজে চাকরি যাবার বিষয়ে বহুল প্রচলিত মিথ হচ্ছে যে, তাঁর কবিতায় অশ্লীলতা আছে, এই অভিযোগ আনা হয়েছিল তাঁর বিরুদ্ধে। সে কারণে কলেজ কর্তৃপক্ষ চাকরিচ্যুত করে তাঁকে। এটা কতটা সত্য আর কতটা মিথ্যা, সেটা পরীক্ষা করে দেখবো আমরা। আসুন, দেখা যাক আসলে কী কারণে চাকরি চলে গিয়েছিল তাঁর।

সিটি কলেজ থেকে তাঁর চাকরি যাবার বিষয়ে বুদ্ধদেব বসু, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তদের মতো বিখ্যাত সাহিত্যিকেরা লিখেছেন। মূলত এদের কারণেই প্রচলিত হয়ে গিয়েছে যে, কবিতায় অশ্লীলতার অভিযোগ এনেই তাঁকে ছাটাই করা হয়েছিল।

বুদ্ধদেব বসু তাঁর 'জীবনানন্দ দাশ এর স্মরণে' প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন যে, "আজ নতুন করে স্মরণ করা প্রয়োজন যে জীবনানন্দ তাঁর কবি জীবনের আরম্ভ থেকে মধ্যভাগ পর্যন্ত অসুয়াপন্ন নিন্দার দ্বারা এমনভাবে নির্যাতিত হয়েছিলেন যে, তারই জন্য কোনো এক সময়ে তাঁর জীবিকার ক্ষেত্রেও বিঘ্ন ঘটেছিল। এ কথাটা এখন আর অপ্রকাশ্য নেই যে, 'পরিচয়ে' প্রকাশের পরে 'ক্যাম্পে' কবিতাটি সম্বন্ধে অশ্লীলতার নির্বোধ ও দুর্বোধ্য অভিযোগ এমনভাবে রাষ্ট্র হয়েছিল যে, কলকাতার কোনো এক কলেজের শুচিবায়ু-গ্রস্ত অধ্যক্ষ তাঁকে অধ্যাপনা থেকে অপসারিত করে দেন। অবশ্য প্রতিভার গতি কোনো বৈরিতার দ্বারাই রুদ্ধ হ'তে পারে না এবং পৃথিবীর কোনো জন কিটস অথবা জীবনানন্দ কখনো নিন্দার ঘায়ে মূর্ছা যান না - শুধু নিন্দুকেরাই চিহ্নিত হয়ে থাকেন মূঢ়তার, ক্ষুদ্রতার উদাহরণস্বরূপ।"

শুচিবায়ু-গ্রস্ত অধ্যক্ষকে নিয়ে আলোচনার আগে জীবনানন্দ দাশের ক্যাম্পে কবিতাটা দেখি।

ক্যাম্পে
এখানে বনের কাছে ক্যাম্প আমি ফেলিয়াছি;
সারারাত দখিনা বাতাসে
আকাশের চাঁদের আলোয়
এক ঘাইহরিণীর ডাক শুনি –
কাহারে সে ডাকে!
কোথাও হরিণ আজ হতেছে শিকার;
বনের ভিতরে আজ শিকারিরা আসিয়াছে,
আমিও তাদের ঘ্রাণ পাই যেনো,
এইখানে বিছানায় শুয়ে শুয়ে
ঘুম আর আসে নাকো
বসন্তের রাতে।
চারিপাশে বনের বিস্ময়,
চৈত্রের বাতাস,
জোছনার শরীরের স্বাদ যেনো!
ঘাইমৃগী সারারাত ডাকে;
কোথাও অনেক বনে —যেইখানে জোছনা আর নাই
পুরুষহরিণ সব শুনিতেছে শব্দ তার;
তাহারা পেতেছে টের
আসিতেছে তার দিকে।
আজ এই বিস্ময়ের রাতে
তাহাদের প্রেমের সময় আসিয়াছে;
তাহাদের হৃদয়ের বোন
বনের আড়াল থেকে তাহাদের ডাকিতেছে
জোছনায় –
পিপাসার সান্ত্বনায় —অঘ্রাণে —আস্বাদে!
কোথাও বাঘের পাড়া বনে আজ নাই আর যেনো!
মৃগদের বুকে আজ কোনো স্পষ্ট ভয় নাই,
সন্দেহের আবছায়া নাই কিছু;
কেবল পিপাসা আছে,
রোমহর্ষ আছে।
মৃগীর মুখের রূপে হয়তো চিতারও বুকে জেগেছে বিস্ময়!
লালসা —আকাঙ্ক্ষা —সাধ —প্রেম স্বপ্ন স্ফুট হয়ে উঠিতেছে সব দিকে
আজ এই বসন্তের রাতে;
এইখানে আমার নক্‌টার্ন –
একে একে হরিণেরা আসিতেছে গভীর বনের পথ ছেড়ে,
সকল জলের শব্দ পিছে ফেলে অন্য এক আশ্বাসের খোঁজে
দাঁতের —নখের কথা ভুলে গিয়ে তাদের বোনের কাছে অই
সুন্দরিগাছের নীচে —জোছনায়!
মানুষ যেমন করে ঘ্রাণ পেয়ে আসে তার নোনা মেয়েমানুষের কাছে
হরিণেরা আসিতেছে।
–তাদের পেতেছি আমি টের
অনেক পায়ের শব্দ শোনা যায়,
ঘাইমৃগী ডাকিতেছে জোছনায়।
ঘুমাতে পারি না আর;
শুয়ে শুয়ে থেকে
বন্দুকের শব্দ শুনি;
চাঁদের আলোয় ঘাইহরিণী আবার ডাকে;
এইখানে পড়ে থেকে একা একা
আমার হৃদয়ে এক অবসাদ জমে ওঠে
বন্দুকের শব্দ শুনে শুনে
হরিণীর ডাক শুনে শুনে।
কাল মৃগী আসিবে ফিরিয়া;
সকালে —আলোয় তারে দেখা যাবে –
পাশে তার মৃত সব প্রেমিকেরা পড়ে আছে।
মানুষেরা শিখায়ে দিয়েছে তারে এই সব।
আমার খাবার ডিশে হরিণের মাংসের ঘ্রাণ আমি পাবো,
মাংস খাওয়া হল তবু শেষ?
কেনো শেষ হবে?
কেন এই মৃগদের কথা ভেবে ব্যথা পেতে হবে
তাদের মতন নই আমিও কি?
কোনো এক বসন্তের রাতে
জীবনের কোনো এক বিস্ময়ের রাতে
আমারেও ডাকে নি কি কেউ এসে জোছনায় —দখিনা বাতাসে
অই ঘাইহরিণীর মতো?
আমার হৃদয় —এক পুরুষহরিণ –
পৃথিবীর সব হিংসা ভুলে গিয়ে
চিতার চোখের ভয় —চমকের কথা সব পিছে ফেলে রেখে
তোমারে কি চায় নাই ধরা দিতে?
আমার বুকের প্রেম ঐ মৃত মৃগদের মতো
যখন ধূলায় রক্তে মিশে গেছে
এই হরিণীর মতো তুমি বেঁচেছিলো নাকি
জীবনের বিস্ময়ের রাতে
কোনো এক বসন্তের রাতে?
তুমিও কাহার কাছে শিখেছিলে!
মৃত পশুদের মতো আমাদের মাংস লয়ে আমারও পড়ে থাকি;
বিয়োগের —বিয়োগের —মরণের মুখে এসে পড়ে সব
ঐ মৃত মৃগদের মতো –
প্রেমের সাহস সাধ স্বপ্ন বেঁচে থেকে ব্যথা পাই, ঘৃণা মৃত্যু পাই;
পাই না কি?
দোনলার শব্দ শুনি।
ঘাইমৃগী ডেকে যায়,
আমার হৃদয়ে ঘুম আসে নাকো
একা একা শুয়ে থেকে;
বন্দুকের শব্দ তবু চুপে চুপে ভুলে যেতে হয়।
ক্যাম্পের বিছানায় রাত তার অন্য এক কথা বলে;
যাহাদের দোনলার মুখে আজ হরিণেরা মরে যায়
হরিণের মাংস হাড় স্বাদ তৃপ্তি নিয়ে এল যাহাদের ডিশে
তাহারাও তোমার মতন –
ক্যাম্পের বিছানায় শুয়ে থেকে শুকাতেছে তাদের ও হৃদয়
কথা ভেবে —কথা ভেবে —ভেবে।
এই ব্যথা এই প্রেম সব দিকে রয়ে গেছে –
কোথাও ফড়িঙে —কীটে, মানুষের বুকের ভিতরে,
আমাদের সবের জীবনে।
বসন্তের জোছনায় অই মৃত মৃগদের মতো
আমরা সবাই।

এই কবিতায় অশ্লীলতা খুঁজে পেতে গেলে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের প্রয়োজন রয়েছে। কিংবা প্রয়োজন রয়েছে অতি স্পর্শকাতর নীতিবাগীশ কাউকে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও‘প্রজ্বলন্ত সূর্য এবং সাতটি তারার তিমির’প্রবন্ধে লিখেছেন যে, ‘ক্যাম্পে কবিতাটি সম্পর্কে নাকি অশ্লীলতার অপবাদ উঠেছিল। এ এক মহাবিস্ময়। তন্নতন্ন করে খুঁজেও এ কবিতায় তথাকথিত অশ্লীলতার অভিযোগ ওঠার মতন কিছুই পাওয়া যায় না। শুধু এরকম একটি লাইন আছে; ‘মানুষ যেমন করে ঘ্রাণ পেয়ে আসে তার নোনা মেয়েমানুষের কাছে’।‘নোনা মেয়েমানুষ’দোষের? বলতে ইচ্ছে করে, হা কপাল! ওইখানে ওই‘নোনা’শব্দটা ব্যবহার করে জীবনানন্দ অপর কবিদের থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন।’

এবার আসা যাক, বুদ্ধদেব বসুর উল্লেখিত শুচিবায়ু-গ্রস্ত অধ্যাপকের প্রসঙ্গে। বুদ্ধদেব বসু তাঁর প্রবন্ধে ঠিক কোন কলেজ থেকে জীবনানন্দের চাকরি চলে গিয়েছিল, তা উল্লেখ না করলেও, সহজে বোঝা যায় যে, এটি সিটি কলেজ। কারণ, জীবনানন্দ তখন কোলকাতার সিটি কলেজেই চাকরি করতেন। বুদ্ধদেব বসুর লেখার রেশ ধরে অম্বুজ বসু তাঁর 'একটি নক্ষত্র আসে' বইতে সিটি কলেজের নাম উল্লেখ করেই লেখেন যে, "ক্যাম্পে কবিতাটি পরিচয় পত্রিকায় প্রকাশিত হ'লে অশ্লীলতার অজুহাতে সিটি কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেন।"

জীবনানন্দ দাশ যখন সিটি কলেজে চাকরি করতেন, তখন কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন হেরম্বচন্দ্র মৈত্র। শুধু সেই সময় নয়, ইনি দীর্ঘকাল কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন এবং কলেজের পরিচালনা সমিতিরও অন্যতম প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন। এই ভদ্রলোক আদর্শবাদী, নীতিবাগীশ এবং সত্যবাদী হিসাবে সেই সময়ে খুবই বিখ্যাত ছিলেন। কী রকম লোক তিনি ছিলেন, তার একটা উদাহরণ দিচ্ছি।

একদিন তিনি কর্নওয়ালিস স্ট্রীট দিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছিলেন। পথে এক অল্পবয়সী তরুণ ছেলে তাঁকে থামায় এবং জিজ্ঞেস করে যে, স্টার থিয়েটারটা কোন দিকে। হেরম্ববাবুর মতো নীতিবাগীশের কাছে স্টার থিয়েটার ভয়াবহ খারাপ জিনিস। এ দেখলে ছেলেপেলে অকালপক্ব হয়, তারপর বিপথে গমন করে। তাই তিনি খুব রূঢ়ভাবে ছেলেটিকে বললেন যে, জানি না।

এটা বলে কিছু দূর চলে গেছেন তিনি হনহনিয়ে। হঠাৎ করেই তাঁর মনে হয়েছে যে, তিনি তো মিথ্যা বলেছেন। স্টার থিয়েটার কোথায় এটা তো তিনি জানেন। তখন তিনি ফিরে এসে ছেলেটাকে ডেকেছেন। ডেকে বলেন যে, শোনো, স্টার থিয়েটার কোথায়, সেটা জানি আমি। কিন্তু, তোমাকে বলবো না।

তো এরকম একজন নীতিবাগীশ ব্যক্তির পক্ষে ক্যাম্পে-র মতো নিরীহ কবিতাকেও অশ্লীল ভেবে বসা সম্ভব। আর সে কারণে একজন শিক্ষককে চাকরীচ্যুত করাও অবাস্তব কিছু না। কারণ, হেরম্বচন্দ্রের কাছে শিক্ষক হতে হবে ছাত্রদের কাছে আদর্শস্থানীয়।

কিন্তু, মুশকিল হচ্ছে, বুদ্ধদেব বসুর বক্তব্যকে সঠিক বলে মেনে নেওয়া যায় না। কারণ, 'ক্যাম্পে' কবিতাটা পরিচয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে ১৯৩২ সালে। কবিতাটি ছাপাই হতো না পরিচয় পত্রিকায়। এর সম্পাদক ছিলেন বাংলা আধুনিক কবিতার আরেক দিকপাল কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। তিনি জীবনানন্দের কবিতা পছন্দ করতেন না। এর আগে ডাকে জীবনানন্দের কবিতা এসেছে পরিচয় পত্রিকায়। তিনি না ছাপিয়ে বাতিল করে দিয়েছেন। এই কবিতাটি কবি বিষ্ণু জীবনানন্দের কাছ থেকে চেয়ে হাতে হাতে নিয়ে এসেছিলেন। বিষ্ণু দে-র সম্মান বাঁচাতে তিনি এটা ছাপতে রাজি হন। পরিচয় পত্রিকায় ক্যাম্পে কবিতাটি ছাপা হবার চার বছর আগে জীবনানন্দের চাকরি গিয়েছে। তার মানে“ক্যাম্পে”-র সাথে তাঁর চাকরি যাবার কোনো সম্পর্ক নেই। অশ্লীলতার অভিযোগ হলেও সেটা তাহলে অন্য কোনো কবিতাকে ঘিরে উঠেছে, ক্যাম্পে-কে নিয়ে নয়।

তাঁর চাকরি গেছে কবিতায় অশ্লীলতার অভিযোগে, এই বক্তব্য শুধুমাত্র বুদ্ধদেব বসুর নয়। আরো অনেকেই আছেন তাঁর পাশে। ড. সুকুমার রায় তাঁর বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস (৪র্থ খণ্ড) গ্রন্থেও এই বিষয়ে লিখেছেন। তিনি বলেছেন, "ইংরেজিতে এম.এ. পাস করিয়া জীবনানন্দ কলিকাতার একটি বড় বেসরকারি কলেজে অধ্যাপক নিযুক্ত হন (১৯২২)। কলেজ কর্তৃপক্ষের মতে, তাঁহার কোনো কোনো কবিতার ভাব সুরুচির গণ্ডী উল্লঙ্ঘন করায় তাঁহার কর্মচ্যুতি হয় (১৯২৮)।" তাঁর হাওড়া কলেজের সহকর্মী অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় 'তাঁকে সহকর্মী হিসাবে দেখেছি' প্রবন্ধে লিখেছেন, " তিনি গার্লস কলেজে বিনা আবেদনে অধ্যাপনায় বৃত হলেন, এবং শুধু অধ্যাপক নন, একেবারেই ইংরেজি বিভাগের প্রধান হয়েই যোগদান করলেন।অধ্যক্ষ বিজয়কৃষ্ণের মানুষ চিনবার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল।তিনি সহজেই জীবনানন্দের প্রতিভা বুঝতে পেরেছিলেন। ইতিপূর্বে রুচি-বিরোধী কবিতা লেখার অপরাধে ব্রাহ্ম নেত্রীদের সহযোগিতায় গড়ে ওঠা সিটি কলেজের চাকরি খোয়ালেন। পরে পূর্ববঙ্গের দু'একটি কলেজে যোগ দিলেন, কিন্তু অধ্যাপক হিসাবে বিশেষ খ্যাতি লাভ করতে পারেন নি।"

অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তও তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ 'কল্লোল যুগ'- এ লিখেছেন, "সিটি কলেজে লেকচারারের কাজ করত জীবনানন্দ। কবিতায় শস্যশীর্ষে স্তন-শ্যাম-মুখ কল্পনা করেছিল বলে শুনেছি, সে কর্তৃপক্ষের কোপে পড়ে। অশ্লীলতার অপবাদে তার চাকরিটি কেড়ে নেয়। যত দুর দেখতে পাই, অশ্লীলতার হাড়িকাঠে জীবনানন্দই প্রথম বলি।"

অচিন্ত্যকুমার যে বিষয়টা উল্লেখ করেছেন, এর সাথে জীবনানন্দ দাশের অবসরের গান কবিতাটা কিছুটা মেলে। সুবিশাল কবিতা এটা। কিছুটা অংশ তুলে দিচ্ছি এখানে।

শুয়েছে ভোরের রোদ ধানের উপরে মাথা পেতে
অলস গেঁয়োর মতো এইখানে কার্তিকের ক্ষেতে ;
মাঠের ঘাসের গন্ধ বুকে তার,- চোখণ,- তার শিশিরের ঘ্রাণ,
তাদের আস্বাদ পেয়ে অবসাদে পেকে ওঠে ধান,
দেহের স্বাদের কথা কয় ;-
বিকালের আলো এসে (হয়তো বা) নষ্ট ক’রে দেবে তার সাধের সময়!
চারিদিকে এখন সকাল,-
রোদের নরম রং শিশুর গালের মতো লাল!
মাঠের ঘাসের’পরে শৈশবের ঘ্রাণ,-
পাড়াগাঁর পথে ক্ষান্ত উৎসবের পড়েছে আহ্বান!
চারিদিকে নুয়ে প’ড়ে ফলেছে ফসল,
তাদের স্তনের থেকে ফোঁটা ফোঁটা পড়িতেছে শিশিরের জল!
প্রচুর শস্যের গন্ধ থেকে থেকে আসিতেছে ভেসে
পেঁচা আর ইঁদুরের ঘ্রাণে ভরা আমাদের ভাঁড়ারের দেশে!
শরীর এলায়ে আসে এইখানে ফলন্ত ধানের মতো ক’রে
যেঁই রোদ একবার এসে শুধু চ’লে যায় তাহার ঠোঁটের চুমো ধ’রে
আহ্লাদের অবসাদে ভ’রে আসে আমার শরীর,
চারিদিকে ছায়া –রোদ –ক্ষুদ –কুঁড়া –কার্তিকের ভিড় ;
চোখের সকল ক্ষুধা মিটে যায় এইখানে, এখানে হতেছে স্নিগ্ধ কান,
পাড়াগাঁর গায় আজ লেগে আছে রূপশালী –ধানভানা রূপসীর শরীরের ঘ্রাণ!
আমি সেই সুন্দরীরে দেখে লই- নুয়ে আছে নদীর এপারে
বিয়োবার দেরি নাই,- রূপ ঝ’রে পড়ে তার,-
শীত এসে নষ্ট করে দিয়ে যাবে তারে৪!
আজো তবু ফুরায়নি বৎসরের নতুন বয়স,
মাঠে মাঠে ঝ’রে পড়ে কাঁচা রোদ,- ভাঁড়ারের রস!

অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত যদি এই কবিতার কথাই বুঝিয়ে থাকেন, তবে এটিও বাতিল হয়ে যায় ক্যাম্পে যে যুক্তিতে বাতিল হয়েছে, ঠিক সেই একই যুক্তিতে। অবসরের গান কবিতাটা প্রথম প্রকাশিত হয়েছে প্রগতি পত্রিকায় ১৯২৯ সালে। তার মানে জীবনানন্দের চাকরি চ্যুতির এক বছর পরে।

তাহলে প্রশ্ন আসছে, ঠিক কী কারণে চাকরীচ্যুত হলেন তিনি? কোন অপরাধে? সিটি কলেজ থেকে তাঁর যে চাকরি চলে গিয়েছিলো এতে কোনো সন্দেহই নেই।

হাওড়া গার্লস কলেজের জীবনানন্দের এক সহকর্মী অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় যেখানে জানাচ্ছেন যে, রুচি-বিরোধী কবিতা লেখার কারণে চাকরীচ্যুত হয়েছিলেন কবি, সেখানে আরেক সহকর্মী অজিতকুমার ঘোষ জানাচ্ছেন ভিন্ন কথা।

জীবনানন্দ দাশ থাকতেন ল্যান্সডাউন রোডে।এই বাড়ি থেকে মাত্র দুই মিনিটের হাঁটার দূরত্বে থাকতেন অধ্যাপক অজিতকুমার ঘোষ। তিনি জীবনানন্দ: জীবন ও কবিতার আলোচনা বইয়ের লেখক দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলেন যে, “অচিন্ত্য সেনগুপ্তর কল্লোল যুগ বইটা পড়ে আমি একদিন জীবনানন্দবাবুকে বলেছিলাম, আপনার কবিতা পড়লে কোনো কবিতাকেই অশ্লীল বলে তো মনে হয় না। অথচ অচিন্ত্য সেনগুপ্ত তাঁর কল্লোল যুগ বইয়ে যা লিখলেন, আপনার কবিতায় অশ্লীলতার জন্যেই সিটি কলেজ থেকে আপনার চাকরি চলে যায়, ব্যাপারটা কী বলুন তো?”

এখানে পাঠকদের সুবিধার্থে উল্লেখ করে দেই যে, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের কল্লোল যুগ বইটা প্রথম প্রকাশিত হয়েছে ১৯৫১ সালে। জীবনানন্দ দাশ এর পরেও বছর চারেক বেঁচে ছিলেন। কল্লোল যুগের বিখ্যাত সবার সাথেই তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল এই বইয়ের লেখক অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের সাথেও। কাজেই, এই বইয়ে সন্নিবেশিত এই তথ্য যে তাঁর চোখে পড়েছে, এ নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।

অজিতকুমার ঘোষের প্রশ্ন শুনে তাই জীবনানন্দ একেবারেই বিস্মিত হন নি। নির্লিপ্ত উত্তরে তিনি বলেছেন, ‘অচিন্ত্য ওই ঘটনাটাকে নিয়ে একটু সাহিত্য করেছে। আসল ব্যাপারটা মোটেই তা নয়। সম্পূর্ণ অন্য।’সাহিত্য করেছে এই শব্দদ্বয়ের মাধ্যমে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত যে বেঠিক তথ্য দিয়েছেন, সেটাই ভদ্রভাষায় বলার চেষ্টা করেছেন তিনি।

স্বাভাবিকভাবেই অজিতবাবু আসল কারণ জানার চেষ্টা করেছেন। জীবনানন্দও কোনো রাখঢাক না রেখে পরিষ্কারভাবে বলেছেন, ‘সেই সময় সিটি কলেজের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ যাচ্ছিল। তাই কলেজ কর্তৃপক্ষ তখন কয়েকজন জুনিয়র অধ্যাপককে ছাঁটাই-এর ব্যবস্থা করেছিলেন। আমি ছাড়া আরও কয়েকজন অধ্যাপকেরও তখন এই কারণেই চাকরি যায়। চাকরি চলে যাওয়া আমরা এই সকলেই তখন স্টাফের মধ্যে জুনিয়র ছিলাম।”

তাঁর চাকরি চলে যাবার ক্ষেত্রে তাঁর নিজস্ব বক্তব্যই হচ্ছে কলেজের আর্থিক অনটন, কবিতা সংক্রান্ত কিছু নয়। কবির এই বক্তব্য তাঁর ছোট ভাই অশোকানন্দের মাধ্যমেও সমর্থিত হয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘অচিন্ত্যবাবুর ও কথা ঠিক নয়। সেই সময়ে কলেজের আর্থিক টানাটানির জন্য কয়েকজন অধ্যাপক ছাঁটাই হওয়ায় দাদাও দলে পড়েছিলেন। দাদাকে চাকরি থেকে ছাঁটাই করা হলেও, কলেজের অধ্যক্ষ হেরম্ববাবু তখন বাবাকে একটা চিঠি দিয়েছিলেন। তার ভাবটা ছিল এইরূপ: আর্থিক কারণে আপাতত আপনার ছেলেকে ছাঁটাই করা হলেও, আবার যখন অধ্যাপক নেওয়া হবে, তখন তাঁকে নেব।’

যে সময়ে সিটি কলেজ থেকে জীবনানন্দের চাকরি চলে যায়, সে সময়ে সিটি কলেজের আর্থিক অবস্থা আসলেই খুব খারাপ ছিল। এটা বহুদিন পর্যন্ত চলেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সিটি কলেজকে কলেজ সংলগ্ন হোস্টেলে সরিয়ে নেওয়া হয়। মূল কলেজ বিল্ডিংকে ভাড়া দিয়ে দেওয়া হয়। এছাড়া মির্জাপুর স্ট্রীটে সিটি কলেজ স্কুলে সকাল ও সন্ধ্যায় কমার্স সেকশন খোলা হয়। এর মাধ্যমে সিটি কলেজের আর্থিক সমস্যা মেটে। কিন্তু, এর মাঝে পার হয়ে গিয়েছে অনেকগুলো বছর। জীবনানন্দ ফিরিয়ে নেবার সময় পার হয়ে গিয়েছে বহু আগেই।

জীবনানন্দ দাশ যখন সিটি কলেজে যোগ দেন, তখন এর আর্থিক অবস্থা মোটেও খারাপ ছিল না। ছাত্র দিয়ে পরিপূর্ণ ছিল কলেজ। মাত্র কয়েক বছরের কী এমন ঘটলো যে, কলেজ এমন দৈন্য দশার মধ্যে পতিত হলো? আশ্চর্যজনক হচ্ছে, এর পিছনে রবীন্দ্রনাথের একটা অনিচ্ছুক ভূমিকা রয়েছে এখানে।

আগেই উল্লেখ করেছি যে, সিটি কলেজের প্রতিষ্ঠাতা এবং পরিচালকেরা সব ব্রাহ্ম হলেও এর বেশিরভাগ ছাত্রই ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বী। এই ছাত্ররা পরিকল্পিতভাবে কলেজের রামমোহন হোস্টেলে সরস্বতী পূজা করার জন্য আবেদন জানায়। ব্রাহ্মদের ধর্মবিশ্বাসে আঘাত হচ্ছে এই অজুহাতে কলেজ কর্তৃপক্ষ এতে বাধা দেয়। হিন্দু ছাত্ররাও জেদ ধরে থাকে। তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতায় কলেজ কর্তৃপক্ষ বাঁধা দিচ্ছে, এটাই হচ্ছে মূল অভিযোগ। ধর্মীয় ইস্যুতে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে কলেজ ক্যাম্পাস। এই ইস্যু শুধু কলেজেই সীমাবদ্ধ থাকে না। ছড়িয়ে পড়ে বাইরেও। হিন্দু সমাজ এবং ব্রাহ্ম সমাজের মধ্যে বিরোধ তৈরি হয়। সত্যাগ্রহ, অনশন ইত্যাদি নানা রাজনৈতিক কর্মসূচী নিয়ে ছাত্ররা শহরে তুমুল আন্দোলন গড়ে তোলে। সেই সময় হিন্দু সমাজে ব্রাহ্ম বিদ্বেষ বেশ ভালো ভাবেই ছিল। ছাত্রদের এই আন্দোলনে অনেক হোমড়া-চোমড়া ক্ষমতাবান লোকেরাও জড়িয়ে পড়েন, ইন্ধন জোগাতে থাকেন। রাজনৈতিক নেতারাও এসে হাজির হন ছাত্রদের আন্দোলনে পৃষ্ঠপোষকতা দেবার জন্য। সামান্য এক সরস্বতী পূজো নিয়ে কদাকার এক সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি তৈরি হয়।

এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য রবীন্দ্রনাথ এবং এন্ড্রুজ সাহেব দুটো প্রবন্ধ লেখেন। এন্ড্রুজ সাহেবের প্রবন্ধের কারণে কী হয়েছিল, সেটা এখন আর জানা যায় না, তবে রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ সিটি কলেজে কর্তৃপক্ষের জন্য হিতে-বিপরীত হয়ে এসেছিল। কেনো হিতে বিপরীত হলো, সেটা বুঝতে গেলে রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধটা দেখা প্রয়োজন। রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধটা দীর্ঘ ছিল। এর এক জায়গায় তিনি লিখেছিলেন, ‘ধর্মের স্বাধীনতাই যদি কাম্য হয়, তবে সে স্বাধীনতা শুধু রামমোহন হস্টেলের হিন্দু ছাত্ররা পাইবে এমন তো নহে, মুসলমান ছাত্ররাও পাইবে। মুসলমানদের পক্ষে, গো-কোরবানির ধর্মের অঙ্গ। সুতরাং এভাবে যুক্তি চলে না। একটা প্রতিষ্ঠিত সমাজের বিধিবদ্ধ কতকগুলি নিয়ম আছে, সেগুলিকে ভাঙিতে চেষ্টা করায় সৌজন্যের অভাব প্রকাশ পায়। সিটি কলেজ ব্রাহ্মদের এবং ব্রাহ্মরা প্রতিমা পূজক নহে, একথা প্রত্যেক ছাত্রই জানেন।’

রবীন্দ্রনাথের যুক্তি বেশ ভালোই ছিল। সমস্যা হলো এর মাঝে মুসলমানদের টেনে এনে আর গরু কোরবানির কথা বলে। ব্রাহ্মদের ধর্মীয় স্বাধীনতা দিতে হিন্দুদের অতো বেশি আপত্তি হয়তো ছিল না, কিন্তু মুসলমানদের এই স্বাধীনতা দিতে হবে, এই যুক্তিতে অন্তরজ্বালা তৈরি হলো তাদের। রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ তাই তাদের প্রশমিত করার চেয়ে ক্ষিপ্তই বেশি করলো।

হিন্দু ছাত্ররা শেষে প্রতিশোধ হিসাবে দলে দলে সিটি কলেজ ত্যাগ করে চলে যেতে থাকলো। নতুন কোনো হিন্দু ছাত্রও আর এই কলেজে ভর্তি হয় না। ব্রাহ্মসমাজ এতো বিশাল না যে, তাদের সন্তানদের দিয়েই কলেজ ভর্তি থাকবে। ফলে, এক বছরের মধ্যেই কলেজের আর্থিক অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়লো। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্যই কলেজ কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়ে কয়েকজন জুনিয়র শিক্ষককে ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্ত নিলেন।

আর, এদের মধ্যেই পড়ে গেলেন আমাদের দুর্ভাগা কবি জীবনানন্দ দাশ।

হিন্দু এবং ব্রাহ্মদের এই বিবাদ মিটতে কয়েক বছর সময় লেগেছিল। পরে আবার আস্তে আস্তে হিন্দু ছাত্ররা ফিরে আসে সিটি কলেজে। শুধু ফিরে আসা হয় না জীবনানন্দ দাশেরই।

আপনার মন্তব্য