বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, ষষ্ঠ পর্ব : ১ - ৪

 প্রকাশিত: ২০১৬-১০-১২ ১২:৫১:৪০

কাজী মাহবুব হাসান:

বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, ষষ্ঠ পর্ব (দ্য গ্র্যান্ড মার্চ) : ১ - ৪

১৯৮০ সালের আগে ‘সানডে টাইমস’ এ আমরা পড়তে পারিনি, কিভাবে স্তালিনের ছেলে, ইয়াকভ মারা গিয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ার পর, একদল বৃটিশ অফিসারদের সাথে একটি ক্যাম্পে তাকে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। তারা সবাই একটি পায়খানা ব্যবহার করতেন। অভ্যাসগতভাবেই স্তালিনের ছেলে পায়খানা ব্যবহার করার পর সেটি খুবই বাজেভাবে ময়লা করে রাখতেন। বৃটিশ অফিসাররা ক্ষুব্ধ হতেন তাদের পায়খানা এভাবে মল দিয়ে নোংরা করে রাখার জন্য, এমনকি যখন সেই মল পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তির ছেলের। বিষয়টির দিকে বারবার তারা তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন।আর ইয়াকভ অপমানিত বোধ করেছিলেন। তারা অনেকবার বিষয়টি নিয়ে ইয়াকভের মুখোমুখি হন এবং তাকে দিয়ে পায়খানা পরিষ্কার করানোর চেষ্টাও করা হয়। কিন্তু ইয়াকভ অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়, সে তাদের সাথে তর্ক এবং হাতাহাতিও করেন। অবশেষে, বিষয়টি নিয়ে তিনি জার্মান বন্দী শিবিরের কমান্ডারের কাছে নালিশ করেন। তিনি চেয়েছিলেন এই বিতর্কে কমান্ডার যেন মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নেয়। কিন্তু অত্যন্ত অহঙ্কারী সেই জার্মান মল নিয়ে কোনো কথা বলতে অস্বীকৃতি জানায় । স্তালিনের ছেলে সেই অপমান সহ্য করতে পারেননি। গলা ফাটিয়ে ভয়ঙ্কর সব রুশ গালি গালাজসহ তিনি দৌড়ে বন্দী শিবিরের চারপাশে ঘেরা বিদ্যুতায়িত কাটা তারের বেড়ায় ঝাঁপিয়ে পড়েন ও তিনি লক্ষ্য ভেদে সফলও হয়েছিলেন। তার শরীর - যা আর কখনোই বৃটিশ অফিসারদের পায়খানা মল দিয়ে ময়লা করার সুযোগ পায়নি - কাটা তারের সাথে গেঁথে গিয়েছিল।


স্তালিনের ছেলের জীবন আদৌ সহজ ছিল না। সব প্রমাণগুলোই সেই উপসংহারের দিকে নির্দেশ করছে যে, তার বাবা যে রমণীর সাথে তার জন্ম দিয়েছিলেন তাকে হত্যা করেছিলেন।তরুণ স্তালিন তাই একই সাথে ঈশ্বর পুত্র ( কারণ তার পিতাকে ঈশ্বরের মতই সমীহ করা হতো) এবং তার পরিত্যক্ত পুত্র। মানুষ তাকে ভয় করতো দুটি কারণে: সে তাদের ক্ষতি করতে পারে তার প্রতিহংসাময় ক্রোধ দিয়ে (কারণ, যাই হোক না কেন, তিনি স্তালিনের ছেলে) এবং তার বিশেষ নজর দিয়ে (পিতা হয়তো তার ত্যাজ্য পুত্রকে শাস্তি দেবার জন্য তার বন্ধুদেরও শাস্তি দিয়ে পারেন)।

প্রত্যাখ্যান আর বিশেষাধিকার, সুখ এবং দুঃখ - ইয়াকভের মত এত এত মূর্তভাবে আর কেউই অনুভব করেননি।বিপরীত সবকিছু কত সহজেই প্রতিস্থাপনযোগ্য, মানুষের অস্তিত্বের এক মেরু থেকে অন্য মেরুদের যাবার পত কত সংক্ষিপ্ত।

তারপর, যুদ্ধ শুরুতেই তিনি জার্মানদের হাতে সে বন্দী হয়েছিলেন, আর জার্মানদের অন্য বন্দীরা, যারা অবোধ্য রকম শীতল অনুভূতিপূর্ণ একটি জাতির প্রতিনিধিত্ব করছে, তার প্রতি অন্তর্গতভাবে একটি বিতৃষ্ণা অনুভব করেছে সবসময়ই - তাকে অভিযুক্ত করেছিল তাদের পায়খানা মল দিয়ে নোংরা করার জন্য। যে কিনা তার কাঁধে বহন করছে সুবিশাল মাত্রার একটি নাটক (স্বর্গচ্যুত দেবদূত আর ঈশ্বর পুত্র), তাকে কি এমন কোনো বিচারের মুখোমুখি করা যেতে পারে, যা কিনা স্বর্গীয় নয় ( ঈশ্বর ও দেবদূতদের জগত সংক্রান্ত) বরং মলের জন্য? খুব উঁচুমানের নাটক আর খুব নীচুমানের নাটক কি মাথায় ঝিম ধরিয়ে দেবার মতই নিকটবর্তী?

ঝিম ধরানো নিকটবর্তী? খুব নিকটবর্তিতা কি মাথা ঘুরিয়ে দিতে পারে?

হ্যাঁ পারে। যখন উত্তর মেরু দক্ষিণ মেরুকে স্পর্শ করার মত খুব নিকটে আসে, পৃথিবী হারিয়ে যায় এবং মানুষ একটি শূন্যতায় তাকে আবিষ্কার করে, যা তার মাথা ঘুরিয়ে দেয়, তাকে আহবান করে নীচে পড়ে যেতে।

যদি প্রত্যাখ্যান আর বিশেষাধিকার একই হয়, যদি সাধারণ আর স্বর্গীয় কোনো কিছুর মধ্যে কোনো পার্থক্য না থাকে, যদি ঈশ্বর পুত্রকে মল দিয়ে পায়খানা অপরিচ্ছন্ন করার জন্য বিচারের মুখোমুখি হতে হয়, তাহলে মানব অস্তিত্ব তার মাত্রাটি হারিয়ে ফেলে, রূপান্তরিত হয় দুঃসহ নির্ভার কোনো কিছুতে। যখন স্তালিনের ছেলে দৌড়ে গিয়েছিল বিদ্যুতায়িত কাঁটাতারে বেড়ার দিকে, আর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তারের ওপর; সেই কাটা তারের বেড়া ছিল তুলাদণ্ডের পাত্রের মত, করুণভাবে যেটি আকাশে ঝুলে আছে, যাকে উত্তোলিত করেছে একটি পৃথিবীর অসীম নির্ভারতা, যা কিনা এর সব মাত্রা হারিয়েছে।

স্তালিনের ছেলে তার জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন মলের জন্য। কিন্তু মলের জন্য কোনো মৃত্যু, অর্থহীন মৃত্যু নয়। যে জার্মানরা তাদের জীবন বিসর্জন দিয়েছিল পূর্বদিকে তাদের দেশের সীমানা সম্প্রসারণ করতে, যে রুশরা মারা গেছেন পশ্চিমে তাদের দেশের শক্তি বাড়াতে - হ্যাঁ, তারা মারা গেছে এমন কিছুর জন্য যা নির্বুদ্ধিতার এবং তাদের মৃত্যুর কোনো অর্থ আর সাধারণ সত্যতা নেই। যুদ্ধের সাধারণ এই অর্থহীনতায়, স্তালিনের ছেলের মৃত্যু স্বতন্ত্র হয়ে থাকে একটি মাত্র আধ্যাত্মিক মৃত্যু হিসাবে।


যখন আমি ছোট ছিলাম, শিশুদের জন্য নতুন করে বলা ওল্ড টেস্টামেন্ট, গুস্তাভ দোরের ছাপচিত্রে অলঙ্কৃত বইটির পাতা উল্টাতাম, আমি দেখেছিলাম, মহান ঈশ্বর মেঘের উপর দাড়িয়ে আছেন।তিনি চোখ, নাক, লম্বা দাড়িসহ একজন বৃদ্ধ মানুষ।আর আমি নিজেকে বলতাম, তার যদি কোনো মুখ থাকে, তাকে খাদ্য গ্রহণ করতে হবে। আর যদি তিনি খাদ্য গ্রহণ করেন, খাদ্য পরিপাকের জন্য তার অন্ত্রনালীও থাকবে। কিন্তু সেই চিন্তাটি সবসময়ই আমাকে ভীত করতো, কারণ এমনকি যদিও আমি এমন একটি পরিবার থেকে এসেছি যারা বিশেষভাবে ধার্মিক ছিল না, কিন্তু স্বর্গীয় অন্ত্রনালী ভাবনাটি আমি অনুভব করেছিলাম যেন সেটি অপবিত্রকর আর ধর্মদ্রোহীতাপূর্ণ।

স্বতঃস্ফূর্তভাবে, কোনো ধর্মতাত্ত্বিক প্রশিক্ষণ ছাড়াই, আমি, একজন শিশু হিসাবে, ঈশ্বর আর মলের ধারণাটির অসঙ্গতিটাকে বুঝতে পেরেছিলাম এবং এভাবে খ্রিস্টীয় নৃতত্ত্ববিদ্যার মূল থিসিসের সেই প্রশ্নটি এসেছিল, যেটি হচ্ছে, মানুষকে ঈশ্বরের প্রতিরূপে সৃষ্টি করা হয়েছে। হয়/অথবা: হয় মানুষকে ঈশ্বরের মত করেই সৃষ্টি করা হয়েছে - এবং ঈশ্বরের অন্ত্রনালী আছে - অথবা ঈশ্বরের অন্ত্রনালী নেই এবং মানুষ তার মত নয়।

প্রাচীন খ্রিস্টীয় নস্টিক বা জ্ঞানবাদীরা একইভাবে অনুভব করেছিলেন যা আমি অনুভব করেছিলাম আমার পাঁচ বছর বয়সে। দ্বিতীয় শতাব্দীতে, বিখ্যাত জ্ঞানবাদী শিক্ষক ভালেন্টিনাস এই ক্ষতিকর উভয়সংকটটি সমাধান করার চেষ্টা করেছিলেন এমন দাবী করে যে, যীশু খেতেন ও পান করতেন, তবে মল ত্যাগ করতেন না।

পৃথিবীতে মল আরো বিরক্তিকর সমস্যা, ইভিল বা অশুভ সত্ত্বার উপস্থিতির চেয়ে। যেহেতু ঈশ্বর মানুষকে স্বাধীনতা দিয়েছিলেন, যদি দরকার হয়, সেই ধারণাটিকে আমরা মেনে নিতে পারি, যে মানুষের অপরাধের জন্য তিনি দায়ী নন। তবে মলের দায়িত্ব, পুরোপুরিভাবে তার কাঁধেই ন্যস্ত, যিনি মানুষের স্রষ্টা।


চতুর্থ শতাব্দীতে, সেইন্ট জেরোম স্বর্গে আদম ও হাওয়া যৌন সঙ্গম করেছেন এমন ধারণাটিকে পুরোপুরিভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন । আবার অন্যদিকে ইয়োহানেস স্কোটাস ইরিজেনা, নবম শতাব্দীর মহান ধর্মতত্ত্ববিদ,ধারণাটি গ্রহণ করেছিলেন। উপরন্তু তিনি বিশ্বাস করতেন, আদমের পৌরুষ পূর্ণ পুরুষাঙ্গটি হাতপা যেভাবে ওঠানামা করা যেতে পারে, সেভাবে তৈরি করা হয়েছিল আর যখনই এই অঙ্গটির মালিক চেয়েছেন, তা তিনি ইচ্ছামত ব্যবহার করতে পেরেছিলেন। আমাদের অবশ্যই তার এই কল্পনাটিকে এমন এক মানুষের স্বপ্ন হিসাবে বাতিল করা ঠিক হবেনা, যে কিনা সারাক্ষণই শঙ্কিত ছিলেন নপুংসক হয়ে যাবার ভাবনায়।কিন্তু ইরিজেনার ধারণাটির একটি ভিন্ন অর্থ আছে। যদি আসলেই সম্ভব হতো শুধুমাত্র নির্দেশের মাধ্যমে লিঙ্গোত্থান করতে, সে ক্ষেত্রে পৃথিবীতে যৌন উত্তেজনা বিষয়টির আর কোনো অস্তিত্ব থাকতো না। লিঙ্গ উত্থিত হতো তার কারণ আমরা উত্তেজিত নই বরং আমরা এটিকে তা করার জন্য নির্দেশ দিচ্ছি । মহান সেই ধর্মতাত্ত্বিক স্বর্গের ধারণার সাথে যা অসঙ্গতিপূর্ণ ভেবেছিলেন সেটি যৌন মিলন বা সেটি সংশ্লিষ্ট সুখানুভূতির বিষয় ছিল না, তিনি স্বর্গের সাথে যা অসঙ্গতিপূর্ণ পেয়েছিলেন সেটি ছিল যৌন উত্তেজনা। মনে রাখতে হবে: স্বর্গে অবশ্যই আনন্দ আছে, কিন্তু কোনো উত্তেজনা নেই।

ইরিজেনার এই যুক্তি মলের ধর্মতাত্ত্বিক যথার্থতার (অন্যার্থে, একটি থিওডিসি বা খারাপ কিছুর অস্তিত্বের জন্য ঐশ্বরিক যথার্থতা) মূল চাবিকাঠিটি ধারণ করে। যতক্ষণ মানুষকে স্বর্গে থাকার অনুমতি দেয়া হয়েছিল, হয় সে (যেমন ভ্যালেন্টেনাসের যীশু) আদৌ মল ত্যাগ করেনি, অথবা (যা ঘটার সম্ভাবনা আছে বেশী) সে মলের দিকে এমন ভাবে তাকায়নি, যেন সেটি অসহনীয় যা বিকর্ষণ আর ঘৃণার জন্ম দেয়। স্বর্গ থেকে মানুষকে বহিষ্কার করার পরই কেবল ঈশ্বর মানুষকে সেই ঘৃণার অনুভূতিটি দিয়েছিলেন। যা কিছু তাদের লজ্জিত করে, মানুষ সেটাই লুকাতে শুরু করেছিল এবং যখন সে সেই পর্দাটি সরিয়ে দিয়েছিল, একটি তীব্র আলোয় সে অন্ধও হয়ে যায়। এভাবে, তার ঘৃণা ও বিরক্ত হবার সূচনা পর্বের ঠিক পরেই, সে উত্তেজনার সাথেও সে পরিচিত হয়। মল (শব্দটির আক্ষরিক এবং ভাবগত উভয়ার্থে) ছাড়া, আমার যেভাবে জানি, সেভাবে কোনো যৌন ভালোবাসা থাকতো না, যার সাথে যুক্ত অন্ধ হওয়া ইন্দ্রিয়ানুভূতি আর তীব্রভাবে কম্পমান হৃদপিণ্ড।

এই উপন্যাসটির তৃতীয় খণ্ডে আমি একটি গল্প বলেছিলাম, যেখানে আয়নার সামনে মাথায় একটি বোওলার টুপি পরে অর্ধনগ্ন সাবিনা সম্পূর্ণ কাপড় পরা টমাসের পাশে দাড়িয়ে ছিল। সেই সময় আমি একটি বিষয় উল্লেখ করতে ভুলে গিয়েছিলাম। যখন আয়না সে নিজেকে দেখছিল আত্ম-অবমূল্যায়নে উত্তেজিত হয়ে, তার মনে একটি কল্পনার জন্ম হয়েছিল, যেখানে টমাস তাকে বোওলার টুপি মাথায় পরিয়ে টয়লেট সিটে বসে দিয়েছে এবং দেখছিল সাবিনা মল ত্যাগ করছে। হঠাৎ করেই প্রায় অজ্ঞান হয়ে যাবার উপক্রম, সাবিনার হৃৎ স্পন্দন দ্রুততর হয়ে উঠেছিল, সে দ্রুত টমাসকে কার্পেটের উপর টেনে শোওয়ায়, এবং তাৎক্ষণিকভাবে চরম যৌন সুখে চিৎকার করে উঠেছিল।
(চলবে)

আপনার মন্তব্য