বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, ষষ্ঠ পর্ব : ৫-১০

 প্রকাশিত: ২০১৬-১০-১৪ ০০:৫১:৫১

কাজী মাহবুব হাসান:

বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, ষষ্ঠ পর্ব (দ্য গ্র্যান্ড মার্চ) : ৫ -১০

যারা বিশ্বাস করেন পৃথিবী ঈশ্বরের সৃষ্টি, আর যারা ভাবেন এটি অস্তিত্বশীল হয়েছে স্বেচ্ছায়, তাদের দ্বন্দ্বটি এমন একটি প্রপঞ্চ নিয়ে আলোচনা করে যা আমাদের অভিজ্ঞতা আর যুক্তির সীমানা অতিক্রম করে।বরং আরো অনেক বেশী বাস্তব সেই রেখাটি, যা বিভাজিত করে যারা সন্দেহ করেন, এটি যেমন সেভাবেই মানুষকে দান করা হয়েছে (সেটি কিভাবে বা কার দ্বারা তাতে কিছু আসে যায় না) আর যারা কোনো আপত্তি ছাড়াই বিষয়টি মেনে নেন, তাদের মধ্যে।

ইউরোপীয় সব বিশ্বাসের পেছনে, ধর্মীয় আর রাজনৈতিক, আমরা জেনেসিসের প্রথম অধ্যায়টি খুঁজে পাই, যা আমাদেরকে বলছে পৃথিবী সৃষ্টি করা হয়েছিল নিখুঁতভাবে, আর মানব অস্তিত্ব সে কারণে ত্রুটিহীন আর আমাদের অধিকার আছে এখানে সংখ্যা বৃদ্ধি করা। আসুন এই মৌলিক বিশ্বাসটিকে আমরা নাম দেই - বেঁচে থাকার সাথে নিঃশর্ত বা ক্যাটেগরিকাল ঐক্যমত্য।

বাস্তবিকভাবে, সাম্প্রতিক সময়ে আগে মল শব্দটি সরাসরি মুদ্রিত হতো না এর আদ্যক্ষরটি ছাড়া (যেমন এস.), আর এর সাথে নৈতিক বিবেচনারও কোনো যোগসূত্র নেই। আপনি দাবী করতে পারবেন না যে, মল অনৈতিক কিছু।যাই হোক মলের প্রতি বিরোধিতা মূলত অধিবিদ্যাগত। প্রাত্যহিক মল ত্যাগ পর্বটি হচ্ছে সৃষ্টিতত্ত্বের অগ্রহণযোগ্যতার প্রাত্যহিক প্রমাণ । হয়/অথবা: যদি মল গ্রহণযোগ্য হয় (যে ক্ষেত্রে আপনার বাথরুমে দরজা বন্ধ করা উচিৎ না!) অথবা আমাদের সৃষ্টি হয়েছে অগ্রহণযোগ্য কোনো উপায়ে।

তাহলে এখান থেকে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি যে, অস্তিত্বের সাথে নিঃশর্ত ঐক্যমত্যের নন্দনতাত্ত্বিক আদর্শ হচ্ছে একটি পৃথিবী যেখানে মলকে অস্বীকার করা হয় এবং সবাই এমনভাবে আচরণ করেন যেন এর কোনো অস্তিত্ব নেই। এই নন্দনতাত্ত্বিক আদর্শ হচ্ছে ‘কিচ’।

Kitsch - কিচ হচ্ছে একটি জার্মান শব্দ যার জন্ম ভাবালুতাপূর্ণ উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যাংশে, এবং জার্মান ভাষা থেকে এটি সব পশ্চিমা ভাষায় প্রবেশ করেছে। পুনঃব্যবহার, যদিও, মুছে দিয়েছে এর মূল অধিবিদ্যাগত অর্থটিকে।যেমন কিচ হচ্ছে মলের অস্তিত্বকে চূড়ান্ত অস্বীকার, শব্দটির আক্ষরিক ও ভাবগত উভয়ার্থে ।কিচ তার আওতা থেকে সব কিছু বহিষ্কার করে যা মানব অস্তিত্বের জন্য মূলত অগ্রহণযোগ্য।


কমিউনিজমের বিরুদ্ধে সাবিনার প্রাথমিক মানসিক বিদ্রোহটি এর চরিত্রে নীতিগত নয় বরং নন্দনতাত্ত্বিক। কমিউনিস্ট জগতের কদর্যতা (ধ্বংসপ্রাপ্ত দুর্গ রূপান্তরিত হয়েছি গবাদি পশুর খোঁয়াড়ে) তাকে যতটুকু বিকর্ষিত করেছিল, তারচেয়ে অনেক বেশী তাকে বিকর্ষণ করেছিল সৌন্দর্যের যে মুখোশটি এটি পরার চেষ্টা করেছিল, অন্যার্থে - কমিউনিস্ট ‘কিচ’। কমিউনিস্ট কিচের আদর্শ মডেল হচ্ছে একটি উৎসব, মে দিবস।

মে দিবসের প্যারেড সে দেখেছিল সেই সময়ে, যখন মানুষের তখনও উৎসাহ ছিল অথবা তারা তখনও আগ্রহ দেখাবার ভান করার জন্য তাদের সেরা চেষ্টা করেছিল । মহিলারা সবাই লাল কাপড় লাল, সাদা আর নীল ব্লাউজ পরেছে, আর জনগণ তাদের বারান্দা আর জানালা দিয়ে তাকিয়ে নানা ধরনের পাঁচ কোণ বিশিষ্ট তারা,হৃদপিণ্ড, এবং নানা অক্ষর শনাক্ত করতো, যখন মিছিলকারীরা দল বেধে কুচকাওয়াজ করে হেটে যেতো রাস্তা দিয়ে। ছোট একটি ব্যান্ড প্রতিটি গ্রুপের সাথে থাকতো, যারা সবাইকে পায়ে পা মিলিয়ে চলা নিশ্চিত করতো। গ্রুপ হিসাবে যখন তারা কুচকাওয়াজ করে মূল মঞ্চের দিকে এগিয়ে যেতো, তখন এমনকি সবচেয়ে বীতস্পৃহ চেহারাও চমৎকার উজ্জ্বল হাসিতে ভেসে যেত, যেন তারা প্রমাণ করার চেষ্টা করছে তারা সঠিকভাবেই আনন্দিত, অথবা আরো বেশী সুনির্দিষ্টভাবে বললে, তারা সবাই ঐক্যমত্যে। তারা যেমন শুধুমাত্র রাজনৈতিক ঐক্যমত্য প্রকাশ করছে না কমিউনিজমের সাথে।না, তাদের ঐক্যমত্য এইভাবে বেঁচে থাকার সাথে। মে দিবসের উৎসবটি এর অনুপ্রেরণা পেতো বেঁচে থাকার সাথে নিঃশর্ত ঐক্যমত্যের গভীরতা থেকে। প্যারেডের অলিখিত আর অনুচ্চারিত সংক্ষিপ্ত নীতিবাক্য ‘কমিউনিজম দীর্ঘজীবী হোক’ ছিল না, বরং ছিল ‘জীবন দীর্ঘজীবী হোক’! কমিউনিস্ট রাজনীতির ধূর্ততা ও শক্তি শায়িত সেই বাস্তব সত্যে, যে এটি সেই শ্লোগানকে আত্তীকৃত করেছে। কারণ এটি ছিল নির্বোধ টটোলজী বা অর্থহীন পুনরাবৃত্তি (জীবন দীর্ঘজীবী হোক!) যা মানুষকে আকর্ষণ করতো, যে মানুষগুলা এইসব কমিউনিজমের মূলমন্ত্র থেকে কমিউনিস্ট প্যারেডের প্রতি ছিল নির্বিকার।।


দশ বছর পরে (তখন সাবিনা যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছে), তার কোনো বন্ধুদের বন্ধু, একজন আমেরিকার সিনেটর, তার দানবীয় গাড়িতে সাবিনাকে নিয়ে একদিন বেড়াতে নিয়ে বের হয়েছিলেন, গাড়ির পেছনের আসনে লাফালাফি করছিল তার চার ছেলে মেয়ে। সিনেটর একটি স্টেডিয়ামের সামনে এসে তার গাড়িটি থামান যেখানে কৃত্রিম একটি স্কেটিং রিঙ্ক আছে এবং শিশুরা গাড়ি থামতেই লাফ দিয়ে বের হয়ে রিঙ্কের চারপাশে ঘিরে রাখা সবুজ ঘাসের মাঠের দিয়ে দৌড়ে যায়। ড্রাইভিং হুইলের পিছনে বসে স্বপ্ন ভরা চোখে উচ্ছল চার শিশুদের দেখতে দেখতে তিনি সাবিনাকে বলেন, ‘ওদের দেখো’ ! এরপর হাত দিয়ে শূন্যে একটি বৃত্ত এঁকে , যা বোঝাতে চাইছে এই স্টেডিয়াম, ঘাস আর শিশু, তিনি বলেন, ‘এটাকে আমি বলবো সুখ’।

তার শব্দগুলোর পেছনে শিশুদের দৌড়ে যাওয়ার বা ঘাসের বেড়ে ওঠার দৃশ্য দেখার আনন্দের চেয়েও বেশী কিছু ছিল, কমিউনিস্ট কোনো দেশ থেকে আসা শরণার্থীদের দুর্দশা সম্পর্কে এখানে একটি গভীর বোধ আছে, সিনেটর বিশ্বাস করেন যে দেশে কোনো ঘাসের জন্ম হয়না বা শিশুরাও দৌড়ায় না।

সেই মুহূর্তে প্রাহা চত্বরে বিশাল মঞ্চের উপর দাড়িয়ে থাকা সিনেটরদের ছবি হঠাৎ করেই সাবিনার মনে কিছুক্ষণের জন্য ভেসে উঠেছিল।তার মুখের হাসি হচ্ছে কমিউনিস্ট রাষ্ট্রনেতার মুখের হাসির মত, যা প্রদর্শনী মঞ্চের উচ্চতা থেকে বিকিরিত হচ্ছে নীচে প্যারেড করা একই ভাবে উচ্ছল সাধারণ জনতার দিকে।


কিভাবে এই সিনেটর জেনেছিলেন, শিশু মানে সুখ? তিনি কি তাদের আত্মার ভিতরটি দেখতে পেরেছিলেন? কি হতে পারে, যে মুহূর্তে তারা দৃষ্টিসীমানার বাইরে, যদি তিনজন শিশু ঝাঁপিয়ে পড়ে চতুর্থ জনের উপর আর তাকে মারধর করতে শুরু করে?

তার স্বপক্ষে সিনেটরের মাত্র একটি যুক্তি আছে, তার অনুভূতি। যখন তার হৃদয় কথা বলছে, তখন তার মন এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার কাজটিকে অশোভন বোধ করে। ‘কিচ’ জগতে, হৃদয়ের একনায়কতন্ত্র চূড়ান্তভাবে রাজত্ব করে।

‘কিচ’ দ্বারা অনুপ্রাণিত অনুভূতি অবশ্যই এমন কিছু হতে হবে যা বহু মানুষ ভাগ করে নিতে পারে। ‘কিচ’, সেকারণে, অদ্ভুত কোনো পরিস্থিতির উপর নির্ভর নাও করতে পারে। একে অবশ্যই আসতে হবে মানুষের মনের গভীরে খোদাই করা স্মৃতির মৌলিক কোনো চিত্র থেকে: অকৃতজ্ঞ কোনো কন্যা, অবহেলিত বাবা, ঘাসের উপর দৌড়ানো শিশুরা, বিশ্বাসঘাতকতার শিকার মাতৃভূমি, প্রথম ভালোবাসা।

‘কিচ’ খুব দ্রুত পর পর দুটি অশ্রু বিন্দুর কারণ হয়। প্রথম অশ্রু বলে, ঘাসের উপর শিশুদের এই দৌড়ে বেড়ানো দেখতে কত ভালো লাগে!

দ্বিতীয় অশ্রু বলে, কত ভালো লাগছে আবেগে উদ্বেলিত হতে, সমগ্র মানবজাতির সাথে একসাথে, ঘাসের উপর শিশুদের খেলা দেখে!

দ্বিতীয় অশ্রুটি হচ্ছে সেটি যা কিচকে ‘কিচ’ বানায়।

পৃথিবীতে মানব জাতির ভ্রাতৃত্ব সম্ভব শুধুমাত্র ‘কিচে’র ভিত্তির উপর।


আর রাজনীতিবিদের চেয়ে এত ভালো ভাবে এটি আর কেউই জানেন না।যখনই কোনো ক্যামেরা উপস্থিতি তারা টের পান, তারা প্রথমেই নিকটবর্তী কোনো শিশুর নিকটে যান, তাকে কোলে তুলে নিয়ে গালে চুমু খান। ‘কিচ’ হচ্ছে সব রাজনীতিবিদ আর সব রাজনৈতিক দল আর আন্দোলনের নন্দনতাত্ত্বিক আদর্শ ।

আমরা যারা এমন সমাজে বাস করি যেখানে নানা ধরনের রাজনৈতিক প্রবণতা সহাবস্থান করে এবং প্রভাব খাটানোর জন্য যারা পরস্পর দ্বন্দ্বরত, তারা পরস্পরকে বাতিল কিংবা সীমিত করে কম বেশী এই ‘কিচে’র বিচারকে পাশ কাটিয়ে যাবার ব্যবস্থা করতে পারে : একক ব্যক্তি তার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যতাকে সংরক্ষণ করতে পারেন; শিল্পী কোনো অদ্ভুত চিত্রকর্ম আঁকতে পারেন। কিন্তু যখনই কোনো একটি একক রাজনৈতিক আন্দোলন সমগ্র ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে, তখন আমরা নিজেদের আবিষ্কার করি একদলীয় মতবাদপুষ্ট ‘কিচে’র জগতে।

আমি যখন একদলীয় মতবাদ বলছি, আমি যা বোঝাতে চেয়েছি তা হচ্ছে সবকিছু যা ‘কিচে’র জগতে অনুপ্রবেশ করে, তাদের অবশ্যই চিরদিনের জন্য নির্বাসিত করতে হবে: ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যতার প্রতিটি প্রদর্শন (কারণ সামগ্রিক থেকে বিচ্যুতি হাস্যরত ভাতৃত্বের চোখে থুতু মারার মত); প্রতিটি সংশয় ( কারণ খুঁটিনাটি বিষয়ে কেউ সন্দেহ করা শুরু করলে একসময় সে জীবনকেই সন্দেহ করা শুরু করবে); সব নিয়তির পরিহাস ( কারণ ‘কিচে’র জগতে সবকিছুই খুব গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করতে হয়), এবং মা, যে তার পরিবারকে ত্যাগ করে বা যে পুরুষ রমণীর চেয়ে পুরুষের সঙ্গ পছন্দ করে, আর সেকারণে তারা সেই স্বর্গীয় নির্দেশকে প্রশ্নের সম্মুখীন করে ( উর্বর হও আর বংশ বৃদ্ধি করো)।

এই আলোকে আমরা গুলাগকে* গণ্য করতে পারি এক ধরনের সেপটিক ট্যাঙ্ক বা মলশোধনী হিসাবে, যা একদলীয় মতবাদী ‘কিচ’ ব্যবহার করে এর বর্জ্যকে পরিত্যাগ করার জন্য।

১০
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ঠিক পরের দশক ছিল এমন একটি সময়, যখন স্তালিন তার সবচেয়ে নিষ্ঠুরতা সন্ত্রাসগুলো করেছিলেন। এটাই সেই সময় যখন তেরেজার বাবাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল তুচ্ছ কোনো অভিযোগে এবং দশ বছরের তেরেজাকে বের করে দেয়া হয়েছিল তাদের বাসা থেকে। এটাই সেই সময়, যখন বিশ বছরের সাবিনা অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে পড়ছিল। সেখানে, মার্কসবাদের একজন অধ্যাপক সমাজতান্ত্রিক শিল্পকলার এই তত্ত্বটিকে ব্যাখ্যা করছিলেন এভাবে: ‘সোভিয়েত সমাজ এতটাই অগ্রগতি অর্জন করেছিল যে, সেখানে মূল সংঘর্ষ আর শুভ আর অশুভের মধ্যে ছিল না, বরং সেই দ্বন্দ্ব ছিল ভালো আর ভালোর চেয়ে আরো উত্তম কিছুর মধ্যে। সুতরাং মলে (এর মানে সব কিছু, যা আবশ্যিকভাবে অগ্রহণযোগ্য) অস্তিত্ব থাকতে পারে শুধুমাত্র অন্য পাশে (যেমন, আমেরিকায়), আর শুধুমাত্র সেখান থেকে, বাইরে থেকে, যেমন কোনো কিছু ভিনদেশি (একজন গুপ্তচর, যেমন) পারে ভালো আর আরো ভালোর জগতে অনুপ্রবেশ করার জন্য।

আর বাস্তবিকভাবে, সোভিয়েত চলচ্চিত্রগুলো, সব কমিউনিস্ট দেশের সিনেমা হলগুলো যা প্লাবিত করেছিল সবচেয়ে স্থুলতম সেই সময়ে, সেগুলো পুরোপুরি পরিপৃক্ত ছিল অবিশ্বাস্য নিষ্পাপতা আর বিশুদ্ধতায়।সেখানে দুজন রুশ নাগরিকের মধ্যে সবচেয়ে বড় যে সংঘর্ষ হতে পারতো সেটি হলো প্রেমিক প্রেমিকার মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি: প্রেমিক ভাবছে প্রেমিকা তাকে আর ভালোবাসে না, প্রেমিকা ভাবছে প্রেমিক তাকে আর ভালোবাসে না, কিন্তু শেষ দৃশ্যে তারা আলিঙ্গন করে, সুখের অশ্রু তাদের গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে।

বর্তমানের প্রথাগত ব্যাখ্যায় এই ছবিগুলো হচ্ছে : তারা কমিউনিস্ট ‘আদর্শ’ প্রদর্শন করেছিল, যখন কমিউনিস্ট ‘বাস্তবতা’ ছিল আরো খারাপ।

সাবিনা সবসময় এই ব্যাখ্যার বিরোধিতা করেছে। যখনই সে কল্পনা করেছে সোভিয়েত ‘কিচে’র জগত বাস্তবে পরিণত হয়েছে, সে তার মেরুদণ্ডে একটি শীতল কম্পন অনুভব করেছে। কোনো ইতস্ততটা ছাড়াই সত্যিকারের কমিউনিস্ট শাসনের সব নির্যাতন আর মাংসের জন্য লাইনে দাঁড়ানোর বাস্তব জীবনকে সে শ্রেয়তর হিসাবে মেনে নিতে পারতো। সত্যিকার কমিউনিস্ট পৃথিবীতে জীবন ছিল তখনও যাপনযোগ্য। কমিউনিস্ট আদর্শ বাস্তব হয়েছে এমন পৃথিবীতে, হাস্যরত নির্বোধদের সেই পৃথিবীতে, তার কিছুই বলার থাকবে না। এক সপ্তাহের মধ্যেই সে আতঙ্কে মৃত্যুবরণ করবে।

সোভিয়েত ‘কিচ’ তার মনে যে অনুভূতি জাগিয়ে তোলে, আমরা কাছে সেটি মনে হয় সেই একই ভয়ের মত যা তেরেজা তার সেই স্বপ্নে অনুভব করেছিল, সুইমিং পুলের চারপাশে এক গ্রুপ নগ্ন নারীর সাথে সে মার্চ করছে, বাধ্য হচ্ছে তাদের সাথে আনন্দময় কোনো গান গাওয়ার জন্য, যখন কিনা পুলের পানির নীচেই ভাসছে নারীদের মৃতদেহ। তেরেজা সেই নারীদের কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে পারে না, একটি মাত্র শব্দও না, শুধুমাত্র যে একটি প্রতিক্রিয়া সে পায়, সেটি হলো তারা যে গানটি গাইছিল সেই গানের পরের অনুচ্ছেদটি। সে তাদের কোনো গোপন ইশারাও করতে পারেনা। যদি করে তারা তাকে সাথে সাথেই চিহ্নিত করে দেবে সেই মানুষটার কাছে, যে পুলের উপর একটি ঝুড়িতে দাড়িয়ে আছে বন্দুক হাতে, যে তাকে গুলি করে হত্যা করতে পারে।

তেরেজার স্বপ্ন উন্মোচন করে ‘কিচে’র সত্যিকারের কাজটিকে: ‘কিচ’ হচ্ছে ভাজ করা যায় এমন পর্দা যা তৈরি করা হয়েছে মৃত্যুকে পৃথক রাখার জন্য।
(চলবে)

* গুলাগ (Gulag) এটি মূলত সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি প্রতিষ্ঠানের নামের সংক্ষিপ্ত রূপ, যা অনুবাদ করা যেতে পারে - Main administration of the camps; এই এজেন্সিটি স্তালিনের শাসনামলে (১৯৩০ এর দশক থেকে ১৯৫০ এর দশকে) সোভিয়েত ইউনিয়নে লেবার ক্যাম্প বা ভিন্নমতাবলম্বীদের বন্দী করে রাখার শিবিরগুলো পরিচালনা করতো।

আপনার মন্তব্য