চে গুয়েভারা ; অসামান্যতার খেরোখাতা

 প্রকাশিত: ২০১৬-১০-১৯ ২০:০২:৫৬

মাসুদ পারভেজ:

চে এমন এক চরিত্রের লোক ছিলেন যিনি ব্যক্তিগত পদ, ক্ষমতা, বা উপরস্থ মর্যাদা লাভের ধার ধারতেন না। তিনি কেবল দৃঢ়তার সঙ্গে বিশ্বাস করতেন লাতিন আমেরিকার জনগণের মুক্তিতে বিপ্লবী যুদ্ধের মৌলিক ধরন হবে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার ভিত্তিতে আর মিলিটারি ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব হবে একতাবদ্ধ।
                                                                                         -ফিদেল ক্যাস্ট্রো

১৯২৮ সালের ১৪ ই জুন থেকে ১৯৬৭ সালের ৯ ই অক্টোবর। সাত সমুদ্র তের নদী পার হওয়ার মত এক অধ্যায়। স্বপ্ন ছিল লাতিন আমেরিকার গণ্ডি পেরিয়ে বিপ্লবের ঝাণ্ডা হাতে নিয়ে ঘুরবেন দেশ থেকে দেশে, মুক্তিকামীদের একজন হয়ে সারা বিশ্বকে নিপীড়ন থেকে মুক্ত করবেন,মানুষে মানুষে সাম্য প্রতিষ্ঠা করবেন, সাম্রাজ্যবাদের ভয়াল থাবা থেকে মুক্ত করবেন একে একে সকল দেশকে (যে সব দেশে তখন চলছিল সাম্রাজ্যবাদের নির্লজ্জ হানা) কারণ তার তো কোন দেশ ছিল না, তিনি সারা বিশ্বকেই নিজের স্বদেশ বানিয়েছিলেন, তাই তো বর্ডার বিহীন একটি ধরার স্বপ্ন দেখতেন, স্বপ্ন দেখতেন এমন এক পৃথিবীর যেখানে সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নেই- এ প্রবাদ টি প্রাণ পাবে। প্রিয় লেখক গোরকি বলেছিলেন- পৃথিবীতে এসেছি বটে তবে জি হুজুরদের দলে নেই। এটিকেই ধারণ করেছিলেন মনে প্রাণে, তাই দেখা যায় কিউবা হয়ে বলিভিয়া মাঝে কঙ্গো, হয়তোবা পরিকল্পনা ছিল তারপরে উপমহাদেশের ছোট এক তটে, যেখানে মানবতার বালাই ছিল না, ছিল শুধুই সীমাহীন অত্যাচার আর বঞ্চনার ইতিহাস।

চের জীবনের অনেক দিক নিয়ে লিখা শুরু করা যায় কিন্তু বাস্তবে এর কোন শেষ নেই। আর অনেকে ভিন্ন ভিন্ন কোণ থেকে তাকে বিবেচনা করেন। এর মাঝে অনেক ইতিহাস আজ সবার মুখে মুখে, আমি এ লেখায় আলোকপাত করার চেষ্টা করবো কিউবা বিপ্লব পরবর্তী চের ভূমিকা নিয়ে।

চে বিপ্লব পরবর্তী বিপ্লবী সরকারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন ১৯৬১-১৯৬৫ সাল পর্যন্ত। এসময় তিনি কিউবার কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। বিপ্লবের পরে লাতিন বলয়ে কিউবার মর্যাদা, আদর্শিক প্রভাব বেড়ে গিয়েছিল অনেকখানি। সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ব্রাজিলের সাথে মর্যাদাবান সম্পর্কের জের ধরে বিপ্লবী সরকারের সাফল্য ছড়িয়ে পড়ছিল লাতিন আমেরিকা থেকে আফ্রিকা পর্যন্ত। কিন্তু আমেরিকার প্রভাব খাটানোর ফন্দি তখনো অব্যাহত ছিল এমনকি বিপ্লবের পরেও কেনেডি সরকারের নানান পদক্ষেপ, ফরমান এবং বৈদেশিক নীতিতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হচ্ছিল কিউবায় হামলা করতে যাচ্ছে আমেরিকা অথবা কিউবা নিয়ন্ত্রণে বেশ কিছু ক্যু সংঘটিত করার প্ল্যান করছে। এরই ধারাবাহিকতায় কেনেডি সরকার আলোচনার ডাক নিয়ে আসলো “অ্যালায়েন্স ফর প্রোগ্রেস” এর। বস্তুত কিউবা কে একঘরে করার ঘৃণ্য চক্রান্ত এবং বিপ্লবের অবস্থান মাপার জন্য এটিকে সামনে নিয়ে আসা হয়েছিল।

১৯৬১ সালে আয়োজিত এই আলোচনার মুল লক্ষ্য ছিল লাতিন আমেরিকাকে আমেরিকান কব্জায় আনা, সোভিয়েত প্রভাব থেকে কিউবা কে বের করা। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল এই কারণে যে এটির মাধ্যমে কিউবা নির্ধারণ করেছিল তারা কোন পথে হাঁটবে। বিপ্লব না হয় আমেরিকা কেন্দ্রিক গণতন্ত্র যেটা প্রকারান্তরে সামরিকতন্ত্রের নামান্তর। বলা বাহুল্য বিপ্লবের পরে কিউবা সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে বিভিন্ন আলোচনায় প্রতিনিধিত্ব করার ডাক পড়েছিল চে গুয়েভারার। যা চের অন্যান্য অনেক গুনের সাথে পরিলক্ষিত হয়েছে আপন মহিমায়।“অ্যালায়েন্স ফর প্রোগ্রেস” এ চের নেতৃত্বে প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছিল কিউবা।

চে’র কারিশমার কাছে ধরা দিতে বাধ্য হয়েছিল “অ্যালায়েন্স ফর প্রোগ্রেস”। শুরু থেকেই চে বুঝতে পেরেছিলেন এটি কিউবাকে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক দিক দিয়ে একঘরে করার কৌশল। ১৯৬১ সালের ১৩ই মার্চ হোয়াইট হাউসে কেনেডি আমেরিকা মহাদেশের মহান বিপ্লবীদের স্মরণ করে বলেছিলেন এ অ্যালায়েন্স আমেরিকা জুড়ে অসমাপ্ত পথ সমাপ্ত করবে এবং এ গোটা মহাদেশের শান্তি ও সমৃদ্ধির নতুন যুগের সূচনা করবে, কিন্তু বিপ্লব পরবর্তী “বে অব পিগস” উপকূল দিয়ে কিউবা আক্রমণের চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার কয়েক মাস পরেই এ আলোচনার ডাক দেই আমেরিকা। তাছাড়া ১৯৬১ সালের এপ্রিলে কিউবা আক্রমণ করে আমেরিকা রাজনৈতিক ও সামরিক পরাজয়ের মুখে পড়েছিল; যেটার প্রতিফলন দেখা মেলে এ অ্যালায়েন্সে।

আলোচনা শুরুর সময়েও ১৯৬১ সালের ১৩ই মার্চ “সান্তিয়াগো দে”র তেল শোধনাগারে চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়েছিল আমেরিকা। একই বছরের ১৩ই এপ্রিলে বিমান বন্দরে হামলা করা হয়েছে এবং এসব হামলাকে বিপ্লবী সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের রোষানল বলে প্রচার করেছিল আমেরিকান সরকার। এর আগে ১৯৬০ সালে আমেরিকার বাজারে কিউবার চিনি রপ্তানি একেবারে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এত অর্থনৈতিক চাপ, অস্থিতিশীল পরিবেশ স্বত্বেও “অ্যালায়েন্স ফর প্রোগ্রেস” এ যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কিউবা। আগে থেকে ঠিক করা হয়েছে কিউবাকে দমন করার যে কোন ফর্মুলার তীব্র বিরোধিতা করা হবে।

১৯৬১ সালের ৮ই আগস্ট উরুগুয়ের “পুন্তা দেল এসতে” স্থানে“অ্যালায়েন্স ফর প্রোগ্রেস” অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কনফারেন্সে চে’র দেওয়া বক্তব্যের কিঞ্চিত অংশ ছিল –
“কনফারেন্সটিকে কিউবা একটি রাজনৈতিক কনফারেন্স হিসেবে দেখছে। কিউবা কখনোই বিশ্বাস করে না যে রাজনীতি থেকে অর্থনীতিকে বিচ্ছিন্ন করা যায় এবং এও বোঝে যে এই দুটো সবসময় হাত ধরে চলে”।

প্রস্তাবিত ১০ টি পয়েন্টের মধ্যে একটিতে একমত পোষণ করেছিলেন চে। ৫নং পয়েন্টটি ছিল- “ গোটা আমেরিকার সমস্ত জনগণের মধ্যে একটি নতুন সম্পর্কের ভিত্তি রচিত হতে শুরু করেছে” কিন্তু এর কর্তৃত্ব কিউবার হাতে। চে বলেন- গোটা আমেরিকার মুক্ত স্বাধীন অঞ্চল কিউবার নক্ষত্রতলে। একটি দেশ অস্ত্র হাতে নিতে পারে, একটি সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করে দিতে পারে, একটি জনমুখী সেনাবাহিনী প্রতিষ্ঠা করতে পারে, একটি অপরাজেয় দানবের দাঁড়াতে পারে এবং তাকে পরাজিত করতে পারে। বস্তুত বিপ্লব পরবর্তী কিউবার অগ্রগতি জানানোর জন্য চে এটিকে বেঁচে নিয়েছিলেন।

চে বলেন- কিউবা বিপ্লবের ইতিহাস বেশি দিনের না হলেও অর্জনের দিক থেকে বেশ সমৃদ্ধ। চে কিউবায় (বিপ্লব পরবর্তী) সাম্প্রতিক সময়ের হাতে নেওয়া বেশ কিছু পদক্ষেপ তুলে ধরেন – ভূসম্পত্তি সংস্কার, সোভিয়েত ইউনিয়নে ৩.৬ মিলিয়ন তেল রপ্তানি, ১৯৬০ সালে আখশিল্পে আমেরিকার আগ্রাসনের পরেও এই খাতে এগিয়ে চলা, শিক্ষার হার বাড়ানোর জন্য ১০৪০০ স্বেচ্ছাসেবকের দিন-রাত কাজ করে যাওয়া, নবম গ্রেড পর্যন্ত প্রাইমারি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা, স্বাস্থ্যসেবা প্রান্তিক পর্যায়ে বিস্তৃত করার কথা জানান দেন সম্মেলনে আগতদের।

তিনি আরও বলেন- ১৯৮০ সালের মধ্যে মাথাপিছু ৩০০০ ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে কিউবা, এও বলেন, “আমাদেরকে শান্তিতে থাকতে দিন, উন্নয়নের পথে হাঁটতে দিন। ২০ বছর পর আবার মিলিত হয়ে দেখাতে চাই- সাইরেনে কোন সুর বাজে, কিউবার বিপ্লবী সংগীত না অন্য কিছু”। বস্তুত এর মাধ্যমে তিনি জানান দিয়েছিলেন, কিউবা পিছিয়ে নেই এবং আমেরিকার সাহায্য ছাড়া অগ্রগতির পথে হাঁটতে সক্ষম। চে’র শক্ত অবস্থান এবং ব্রাজিল, মেক্সিকো, বলিভিয়া সহ অনেকের সমর্থনে কিউবাকে লাতিন বলয় থেকে বের করতে পারে নি। সম্মেলনে আগত অনেকের প্রশ্নের উত্তরে চে বলেন- কিউবা লাতিন বলয় ছেড়ে যায় নি বরং আমাদের যেন বিতাড়িত করা না হয়, যেন বলয় ছেড়ে যেতে বাধ্য করা না হয় সেজন্য লড়ে যাচ্ছি।

চে শুধুই যোদ্ধা ছিলেন না, ছিলেন কূটনীতিকও। তিনি বিপ্লবের পরে কিউবাকে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন, বিপ্লবের গুরুত্ব বুঝিয়েছেন, কিউবাকে এক ঘরে করার সাম্রাজ্যবাদের চক্রান্ত থেকে রক্ষা করেছেন। তিনি ছিলেন সফল শিল্পমন্ত্রী। কিউবার তেল শিল্পে সমৃদ্ধ হওয়া, আখ শিল্পে বিশ্বের প্রধান হওয়া, আকরিক, নিকেল, টিন প্রভৃতি শিল্পে প্রভাব বিস্তার করা সহ অনেক উন্নয়নের রূপকার। ব্যাংকিং খাত কে রাষ্ট্রীয়করণ করে জনগণের চাহিদা পূরণ, আবাসন খাতের সমাধান, শিক্ষা ক্ষেত্রে সাফল্যেও চের অবদান ছিল অপরিসীম।

এবং পথে যদি বাধা দেয় কোনো প্রতিবন্ধকতা
চেয়ে নেব কিউবান অশ্রু মোছা আঁচল
যাতে তা আচ্ছাদিত করে গেরিলা যোদ্ধার হাড়
আমেরিকান ইতিহাসের পরিবর্তনশীলতায়
আর কোনো কিছুই নয়।
চে গুয়েভারা।

চে একজন সু-লেখক ছিলেন। অবসর পেলেই যেমন কবিতা পড়তেন তেমনি নিজেও লিখতেন। কবিতা খুব প্রিয় ছিল, প্রিয় কবি পাবলো নেরুদা। চের সবুজ নোটবুকের অনেক পাতায় নেরুদার কবিতা লিপিবদ্ধ আছে। কখনো লিখেছেন ফিদেল কে নিয়ে, আবার কখনো নিজ স্ত্রী সন্তানকে আবার কখনো প্রিয় কিউবা নিয়ে। ডায়েরিতে লেখা চের গেরিলা যুদ্ধের রণকৌশল বর্তমান সময়ের বা ভবিষ্যতের স্বাধীনতাকামীদের জন্য এক অনন্য সম্পদ। বিপ্লব নিয়ে চের ধারনা, গেরিলাদের নিয়ন্ত্রণের কৌশল এবং শৃঙ্খলার এক অপরুপ সমন্বয় চের লেখাগুলো।

নিজের হারিয়ে যাওয়া সময় সম্পর্কে চে বলেছেন- 'আমার কিছু সময় আছে,হারিয়ে যাওয়া সময়, ঠিক বলতে গেলে নৈরাশ্যের... যখন এমনটি হয়, সেই স্বল্পস্থায়ী সময়কে আমি সমাধান করে ফেলি এক গ্লাস মদে ও একগুচ্ছ কবিতার মাধ্যমে।' নেরুদার অনেক প্রিয় কবিতার মধ্যে খুব প্রিয় ছিল এই কবিতাটি – '
স্ট্যালিনগ্রাদের প্রতি ভালোবাসার নতুন গান'—

'লিখেছিলাম সময় এবং জল নিয়ে

আবিষ্কার করেছিলাম বিষাদ এবং তাঁর পিঙ্গল বর্ণ
লিখেছিলাম আকাশ আর আপেল নিয়ে
এখন লিখছি স্ট্যালিনগ্রাদ সম্পর্কে'

নেরুদা ছাড়াও চে নিকোলাস গিইয়েনের অনুরাগী ছিলেন। চে’র প্রতি উৎসর্গ করা এক কবিতা ছিল –

'এ জন্য নয় যে পড়ে গিয়েছ
তোমার কণ্ঠস্বর একটু নিচু।
এক আগুনের ঘোড়া
ঊর্ধ্বে তুলে ধরে তোমার গেরিলা ভাস্কর্য।
পর্বতমালার বাতাস এবং মেঘেদের মধ্যে।'

ক্যাম্পে একবার তিনি এক গেরিলা যোদ্ধাকে বেশ বকাঝকা করলেন নিয়ম ভঙ্গের জন্য। তিনি তাকে সতর্ক করে বললেন- পরেরবার তাকে ক্যাম্প থেকে বের করে দেওয়া হবে, উত্তরে গেরিলা যোদ্ধাটা বললেন, তার আগে যেন তাকে গুলি করে মারা হয়। চে নিজেকে অন্যের উদাহরন হিসেবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সেটা গেরিলা ক্যাম্পে, মন্ত্রীসভায় বা আলোচনা সভায় সবখানে নিজে অনন্য ছিলেন। চে লিখেছিলেন- 'সব কিছুর আগে নিজের হৃদয় দিয়ে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে যেকোনো মানুষের বিরুদ্ধে সংঘটিত অবিচারকে বোঝার মতো ক্ষমতা তৈরি কর। এটাই একজন বিপ্লবীর সবচেয়ে সুন্দর গুণ।' 


চের মৃত্যুতে তাঁকে বিদায় জানিয়ে নেরুদা লিখেছিলেন 'এক বীরের মৃত্যুতে বিষণ্নতা' নামক কবিতাটি—'

এই ইতিহাসে যারা বাস করতাম
এই মৃত্যু এবং পুনরুত্থান
আমাদের অবরুদ্ধ আশা
যারা বেছে নিয়েছিলাম যুদ্ধ।
যারা দেখতাম পতাকাগুলো বড় হচ্ছে
জানতাম যারা সবচেয়ে শান্ত
তাঁরাই আমাদের একমাত্র বীর...'

সেনা-প্রশিক্ষণের জন্য মেক্সিকোতে থাকাকালীন চে তাঁর বিপ্লবী বন্ধু ফিদেল কাস্ত্রোকে উত্সর্গ করে একটি কবিতা লিখেছিলেন—

'চলো যাই আমরা
ভোরের আলোয় উজ্জ্বল পয়গম্বর
যোগাযোগহীন লুকানো পথ দিয়ে
যাকে এত ভালোবাস
সেই সবুজ কুমিরটিকে মুক্ত করতে।'

চের কাব্য প্রতিভা এবং লেখনির দেখা মেলে অনেক পরে, অর্থাৎ মৃত্যুর পরে। বলিভিয়ায় আটক হওয়ার পরে ৩টি ডায়েরির সন্ধান মেলে। যার মধ্যে বলিভিয়া এবং কঙ্গোর দিনলিপি লেখা ছিল। দুইটা ডায়েরির রাজনৈতিক গুরুত্ব বুঝতে পেরে বলিভিয়ান সেনাবাহিনী এবং সিআইএ-র প্রতিনিধিরা ডায়েরি দুইটা সরিয়ে ফেললেন তড়িৎ গতিতে, ফরেনসিক পরীক্ষার পরে নিশ্চিত হয়েই এগুলো বলিভিয়ান সেনাবাহিনীর কাছে রক্ষিত করা হয়। কিন্তু একজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তার হাত ধরে ডায়েরির বেশ কিছু অংশ কিউবার হাতে চলে যায় ... যা আজ চে গুয়েভারার ডায়েরি নামে খুবই জনপ্রিয় এবং বহুল পঠিত।

চে গুয়েভারার ডায়েরিতে ফিদেল ক্যাস্ট্রো ভুমিকায় লিখেছেন- এই ডায়েরিগুলো কিভাবে আমাদের হাতে এসেছে তা বলা যাবে না, তবে এর জন্য আমাদের কোন অর্থ দিতে হয় নি, তার অর্থ এই যে সরবারহ করা কর্মকর্তার সাথে হয়তোবা কোন গোপন চুক্তি ছিল, যে নাম প্রকাশ করা যাবে না।

আর পড়ে থাকা সবুজ নোট বুক জুড়েই ছিল কবিতা আর কবিতা। অনেক প্রিয় কবির কবিতা ছাড়াও নিজের লেখা অনেক কবিতা ছিল যদিওবা তিনি লেখকের নাম উল্লেখ করেন নি। বিশ্লেষণগতভাবে এসব লেখা চের ছিল বলেই ধারণা করা হয়। কারণ গেরিলাদের অনেক কথায় উঠে এসেছে চের সবুজ নোট বুকের কথা, যেটা তিনি সময় পেলেই লিখতেন আর পড়তেন।

সোভিয়েত ইউনিয়ন নিয়ে চের সঙ্গে মৃদু বিরোধ, আফ্রিকার দুর্দশা এবং বিপ্লবের নেশায় চে তার পরবর্তী বিপ্লবের স্থান ঠিক করলেন কঙ্গোয়। কিন্তু কঙ্গোতে বিপ্লবের চেষ্টা সফল হয়নি তাঁর। সেনাদের অদক্ষতা, বিপ্লবের জন্য তৈরি না হওয়া এবং দুর্নীতির কারণে কঙ্গো অভিযান সাফল্যের দেখা পেল না। তারপরে তিনি ছদ্মবেশে তিনি গেলেন বলিভিয়ায়। কিন্তু বলিভিয়ান্দের বিশ্বাসঘাতকতা, সিআইএ'র প্রত্যক্ষ সহযোগিতা,অস্ত্র ও কমান্ডো সরবরাহের কারণে পরিস্থিতি প্রতিকূল হয়ে ওঠে, এখানেও তথাকথিত বামদের সয়াহতা পান নি চে।

১৯৬৭ সালের ৭ অক্টোবর তাকে যুদ্ধরত অবস্থায় গ্রেফতার করা হয়, বলিভিয়ান সেনাবাহিনীর ভাষ্যমতে ৯ অক্টোবর তাকে এক মদ্যপ সেনা সদস্যের দ্বারা হত্যা করা হয়। ১৯৯৭ সালে ভ্যালেগ্রান্দের একটি গণকবরে চে ও তাঁর সহযোদ্ধাদের দেহাবশেষ আবিষ্কৃত হয়।

চের মৃত্যুর পরে নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা সে সময় লিখেছিল, একজন মানুষের সঙ্গে সঙ্গে একটি রূপকথাও চিরতরে বিশ্রামে চলে গেল।’ কিন্তু তা ভুল প্রমাণিত হচ্ছে সময়ের সাথে সাথে। সাম্রাজ্যবাদের বাণিজ্যিকরণ অব্যাহত থাকলেও চে তার আপন মহিমায় ভাস্বর। চে নিয়ে টি-শার্ট, গেঞ্জি বা নানান পণ্যের দেখা মিললেও চের আদর্শ তার চাইতে বহুগুণ শক্তিশালী। লাতিন বলয় ছাপিয়ে চে এখন সারা বিশ্বের মুক্তিকামী পাগলদের। নিপীড়িতদের সাথে বঞ্চিতদের পাশে চের আদর্শ থাকবে চিরকাল। যখন কিউবার কোমল মতি শিশুরা চের মত হওয়ার স্বপ্ন দেখে, যেখানে সুদুর বাংলাদেশেও চের আদর্শ ছড়িয়ে পড়ছে ... সেখানে চে অনন্য।

তার বিপ্লবী জীবনের অনেক অনুসারী আছে যারা সাম্য, শান্তি ও মানবতার কথা প্রচারের পাশাপাশি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কথা বলে, কলম ধরে, গর্ব সহকারে চের আদর্শের জানান দেই। বলাবাহুল্য সংখ্যায় কম হলেও এরা একেক জন হাজার হাজার বুর্জোয়ার চাইতেও শক্তিশালী। তারা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার সাথে সাথে গলা ছেড়ে চে কে নিয়ে লেখা কবিতা আবৃতি করে, চের মত হওয়ার সাহস সঞ্চয় করে এবং কিছু করতে না পারার অপরাধে ভোগে। নিজেকে সময়ের সাথে সাথে তৈরি করে, অদুর ভবিষ্যতে কোন এক দিন হলেও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়ার স্বপ্ন দেখে। চের মৃত্যু নেই, চের আদর্শের বিনাশ নেই। কারন বিপ্লব অমরত্ব লাভ করেছে।

চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়।

আমার ঠোঁট শুকনো হয়ে আসে, বুকের ভেতরটা ফাঁকা
আত্মায় অবিশ্রান্ত বৃষ্টিপতনের শব্দ
শৈশব থেকে বিষণ্ণ দীর্ঘশ্বাস

চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরধী করে দেয়-
বলিভিয়ার জঙ্গলে নীল প্যান্টালুন পরা
তোমার ছিন্নভিন্ন শরীর
তোমার খোলা বুকের মধ্যখান দিয়ে
নেমে গেছে
শুকনো রক্তের রেখা
চোখ দুটি চেয়ে আছে।
সেই দৃষ্টি এক গোলার্ধ থেকে
ছুটে আসে অন্য গোলার্ধে

চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়।
শৈশব থেকে মধ্য যৌবন পর্যন্ত দীর্ঘ দৃষ্টিপাত
আমারও কথা ছিল হাতিয়ার নিয়ে তোমার পাশে দাঁড়াবার
আমারও কথা ছিল জঙ্গলে কাদায় পাথরের গুহায়
লুকিয়ে থেকে
সংগ্রামের চরম মুহূর্তটির জন্য প্রস্তুত হওয়ার।
আমারও কথা ছিল রাইফেলের কুঁদো বুকে চেপে প্রবল হুঙ্কারে
ছুটে যাওয়ার।

আমারও কথা ছিল ছিন্নভিন্ন লাশ ও গরম রক্তের ফোয়ারার মধ্যে
বিজয়-সঙ্গীত শোনাবার-কিন্তু আমার অনবরত দেরি হয়ে যাচ্ছে!
এতকাল আমি এক, আমি অপমান সয়ে মুখ নীচু করেছি
কিন্তু আমি হেরে যাই নি, আমি মেনে নিই নি
আমি ট্রেনের জানলার পাশে, নদীর নির্জন রাস্তায়,
ফাঁকা মাঠের আলপথে, শ্মশানতলায়
আকাশের কাছে, বৃষ্টির কাছে, বৃক্ষের কাছে,
হঠাৎ-ওঠা ঘূর্ণি ধুলোর ঝড়ের কাছে
আমার শপথ শুনিয়েছি, আমি প্রস্তুত হচ্ছি, আমি
সব কিছুর নিজস্ব প্রতিশোধ নেবো।
আমি আবার ফিরে আসবো।
আমার হাতিয়ারহীন হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়েছে, শক্ত হয়েছে চোয়াল,
মনে মনে বারবার বলেছি, ফিরে আসবো!

চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়-
আমি এখনও প্রস্তুত হতে পারি নি, আমার অনবরত
দেরি হয়ে যাচ্ছে
আমি এখনও সুড়ঙ্গের মধ্যে আধো-আলো ছায়ার দিকে রয়ে গেছি,
আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে চে,
তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়!

দোহাই – 

  • ১) চের ডায়েরি এবং সবুজ নোটবুক।
  • ২) প্রয়াত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর লেখা কবিতা “চে গুয়েভারার প্রতি”।
  • ৩) চে গুয়েভারার ডায়েরি।
  • ৪) আমাদের আর তাহাদের আমেরিকা।
  • ৫) ডাক দিয়ে যায় – চে গুয়েভারা।
  • ৬) মোটর সাইকেল ডায়েরি – চে গুয়েভারা।

আপনার মন্তব্য