বর্গমাইলের পদাতিক : ১-৩

 প্রকাশিত: ২০১৬-১০-১৯ ২২:০৫:০৬

রাজা সরকার:

ধারাবাহিক : বর্গমাইলের পদাতিক

মানুষের গন্ধ পশু আর দেবতারা চেনে ভাল। শেষপর্যন্ত বাঘ যখন লাশটাকে টেনে নিয়ে যায়,তখন তার পা’এর ছাপ বা রক্ত-চিহ্ন থাকে নিশানা। দেবতারা কোন ছাপ-চিহ্ন রাখে না। কিন্তু জীবন এক নিরুপম গন্ধময় অভিযাত্রা। পশু আর দেবতা ঘেরা এই জীবন। এই জীবনে মানুষের গন্ধই ঠিক করে দেয় মানুষের নিশানা।

ক’দিন যাবত এই বস্তি অঞ্চলের দোকানগুলোর খুব মন্দা। খদ্দের কম। রাত আটটার পরই কেমন শুনশান, ঝিমিয়ে পড়া।

‘বস্তি’ মানে আবহমান কালের বাস্তুহারা। দেশ খোয়ানো, বর্ণ খোয়ানো, ভাষা খোয়ানো, জীবন জীবিকার নিত্য নতুন অনুষঙ্গে তাড়িত—চোর ডাকাত, ফড়ে দালাল,মেয়ে চালান, চোরা চালান এ লিপ্ত মানুষ, মানুষের সমষ্টি, যারা শরীরী শ্রমের আইনানুগ দক্ষতাকে যেন এক ভিন্ন মাত্রায় ঠাট্টা করতে ভালবাসে। ‘বস্তি’ মানে এদের ঘর ছাউনি, ছাউনির সমষ্টি, জল নর্দমা তথা যাবতীয় অস্বাস্থ্যের সমাহার।

রেল কোম্পানির জায়গা। এক পাশে হিমালয়-গামী পতিত রেল লাইন। আরেক পাশে দুমড়ানো মুচড়ানো ঘরের সারি। সবকিছুই গায়ে গা লাগানো। শিলিগুড়ি টাউন স্টেশন সংলগ্ন নাম গোত্রহীন বস্তিটাকে রেল-বস্তি হিসেবেই সবাই জানে।

এখানে সব পাওয়া যায়। কী পাওয়া যায় না বলা মুশকিল। মধ্য শিলিগুড়ির এই অংশটা নিজের প্রয়োজনে নিজের মত করেই জন্ম নিয়েছে। আধা বিহার, আধা বাঙাল, আধা পাহাড়, আধা তরাইয়ের এই বিচিত্র সহাবস্থান। ফলে নানা পেশাজীবীর আধার এই রেল-বস্তি। শহর বাণিজ্যের হংকং মার্কেট কিছুটা তফাতে হলেও তার অতি প্রয়োজনীয় শ্রম শক্তিরও এক চমৎকার জোগানদার এই বস্তি। সময়টা ১৯৮০র দশক। ক্ষমতার পালা বদল হয়ে গেছে রাজ্যে। বামপন্থীরা ক্ষমতায়।

ক’দিন যাবত এদিকে বেড়ে গেছে সাদা পোশাকের আনাগোনা। কোথায় কে মরে, কোথায় কোন হাঙ্গামা,--পুলিশি কর্তব্যের শেষ ভরসা এই বস্তি। তাই ওদের এদিকে আনাগোনা মানেই শহর- শরীরে কোথাও আঘাত লেগেছে। আর এই আঘাতের পরিণাম যে এখানকার দু’একজনের জেল হাজত তা বলাই বাহুল্য।

সাধারণত এখানে সন্ধ্যে হলেই ভিড়ের মাত্রা বেড়ে যায়। ভিড় বলতে চারপাশে ছড়ানো ছিটানো মদের দোকান। সঙ্গে চা পানের দোকান। কিন্তু ভিড় বলতে এই পঞ্চাশ টাকা পুঁজির তেলেভাজার দোকানে আবার আলাদা এক মাত্রা। কারণ দোকানদার ঊর্মিলা। কুপির আলোয় ফুটন্ত এক কড়াই তেলের সামনে জলচৌকির উপর বসে থাকা ঊর্মিলা। মনে হবে গর্জন তেল মাখা এক প্রতিমা কাজে ব্যস্ত, আর তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা খদ্দেরের জোড়া জোড়া চোখ। সেখানে মদের অনুষঙ্গ তেলেভাজা না দৃশ্যপটের ঊর্মিলা বোঝা যায় না। এর মধ্যে পুলিশ বা পুলিশের টিকটিকি কেউ কেউ ভাবে ডিউটিতে এলে মদটা বিনে পয়সায় হলেও তেলেভাজাটা হয় না।‘মাগি দজ্জাল বড়’।

মুখ দেখে মনে হবে না ভিড়ের রহস্য ঊর্মিলা জানে। এই সন্ধেবেলায় কেন, ঊর্মিলা কোন সময়ই তার শরীর বিষয়ে খুব সচেতন থাকার অবকাশ পেয়েছে বলে মনে হয় না। এই সন্ধেবেলার দু’তিন ঘণ্টা দোকানদারিতে সে এতটাই মগ্ন থাকে যে কে কোন দৃষ্টিতে তাকে দেখছে সে সব নিয়ে ভাবার মুহূর্তও তার কাছে থাকে না। পাশাপাশি মদ আর তেলেভাজার গন্ধ সারা অঞ্চলময় ক্রমে ছড়িয়ে পড়ছে। তাতে তার মেজাজও খুব তীব্র পর্যায়ে থাকে। যত রাত বাড়তে থাকে ততই যেন গলতে থাকে অন্ধকার। যেন বা আত্মহারা কিছুটা। অবশ্য তারমধ্যেই কিছু মানুষের চোখ থাকে চকচকে। সতর্ক। কেননা তাদের ডিউটি রয়েছে। যেমন সুবোধ।


এই ভিড়ের রহস্য আর প্রকৃতি জানে সুবোধ। সুবোধ মাকাল ফল। বস্তির অনেকে তাকে আড়ালে তাই ডাকে।কারণ বস্তির অনেকের চোখে সে দেখতে সুন্দর,কিন্তু কোনো কাজ করে না।বসে বসে ঊর্মিলার রোজগার খায়। ঊর্মিলার চারটে ছানাপোনা মানুষ করে।
সন্ধেবেলা এই মজা ড্রেনের ধারে বস্তির গা-লাগা একটা চালার তলায় কুপি, উনুন,কড়াই আর তেলেভাজার সাজ সরঞ্জাম সাজাতে দেখলে মনে হতে পারে যেন সুবোধ নিজেই বসবে একটু পরে। কিন্তু না, সব রেডি হওয়ার পর বস্তির আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে ঊর্মিলা। শুরু হয় তার দোকান। কেনা বেচা। সুবোধ আনাড়ি। সাহায্য বলতে এটুকুই পারে সে।

সুবোধের সঙ্গে ঊর্মিলার আলাপ বছর খানেকের। হলদিবাড়ির লোকাল ট্রেনে।সবজি লোকাল। হাটের শেষে ফেরার সময়।সেই কোন সকালে লোকাল ধরে হলদিবাড়ি যাওয়া। আবার এই রাতের লোকালে শিলিগুড়ি ফেরা।সবজি আনতে এই ট্রেনে মেয়েরাই বেশি যায়। ফেরার সময় যেহেতু রাত হয়ে যায় তাই যেন সব একসাথে এক কামরায় পাশাপাশি। বয়সের বিভিন্নতার কারণে ফেরার সময় তাই হুল্লোড় আর গল্পগাছাও বিভিন্ন রঙের হয়ে থাকে।

যেদিন সুবোধের সঙ্গে ঊর্মিলার আলাপ সেদিন একটা ব্যতিক্রমই ঘটেছিল তাদের কামরায়।হঠাৎ মোট-গাঁট ছাড়া এই সোন্দরপানা ছেলেটা তাদের মধ্যে কেন? কামরাটা-ত সবজিওলাদের। বাকিগুলোতে বাবুরা সব। ওর-তো ওগুলোতেই বসার কথা। আঃ মরণ!

মুখেচোখে কেমন একটা অচেনা দেখার বিহ্বল-ভাব। কিছুটা হতচকিতও। কামরার মেঝে ভর্তি মোটগাঁটএর মধ্যে কোন ক্রমে দাঁড়ানো। একসময় ঊর্মিলার চোখ পড়াতে ঠেলে ঠুলে সে-ই ছেলেটাকে বসতে দিল নিজের পাশে। আলাপে বুঝতে পারলো জিনিস ওপারের। হুজুর সাহেবের মেলার সুযোগে গলে গেছে এপারে। কোন ঝামেলা হয়নি। সদ্য পার হয়ে আসা ভাষা আর চেহারার পালিশে সামনের সিটে বসা উঠতি ছুঁড়িগুলানের কী মশকরা! ছেলেটি পরিষ্কার বুঝতে পারছে কিনা কে জানে—তবু এই সব লক্ষ্য করে ঊর্মিলা ওদের মৃদু ধমকায়।

বগির সব ছেলে মেয়ে বুড়োবুড়ির অলিখিত নেত্রী ঊর্মিলা। গলায় ও গতরে তার বল আছে। এই লাইনের বদ-মতলবি লোকজন তাকে ভয় পায়। কিন্তু এখন তার ধমকে ছুঁড়িগুলান যেন দমেও দমে না। ফেরার পথে আজ আর কেউ ঝিমচ্ছে না। গুজগুজ ফুসফুস চলছেই। ঊর্মিলা বুঝতে পারে এসবের কারণ এই ছেলেটি। এরমধ্যেই কেউ আবার ইশারা করে অন্যরকম।ধরিয়ে দেয়ার ভয় দেখালে পাওয়া যাবে নগদ টাকা। কিন্তু মাল যে খোদ ঊর্মিলার। সাহস হয় না। বেইমানি হয়ে যাবে। ভয়ও আছে। জিনিশ যেহেতু ঊর্মিলার, ঊর্মিলা না চাইলে-ত আর হয় না। এই লাইনে এ নিয়ম নেই। ইস্টিশন কাছাকাছি হতেই যে যার নিয়ম মত হৈ চৈ শুরু করে দিল। সারা দিনের ধকলের পর এই সময় কারোর আর তর সয় না। বাড়ি ফেরার তাড়া থাকে সবার। আর সেই তাড়ায় সবাই যেন অচেনা ছেলেটিকে ভুলেও যায়। প্ল্যাটফর্ম আসতেই যে যার মত বাড়ির দিকে দে ছুট। পারলো না শুধু ঊর্মিলা। এতক্ষণ আলাপের পর ছেলেটিকে কিছু না বলে যেন ঊর্মিলা নড়তে পারলো না।

ইতিমধ্যে ছেলেটার মুখ থেকে যা টুকটাক কথা শোনা গিয়েছিল তাতে বোঝা গিয়েছিল যে তার যাওয়ার সেরকম কোন নির্দিষ্ট জায়গা নেই। তবে কলকাতার কাছাকাছি কোথায় যেন তার মানুষজন থাকে। সবই ভাসা ভাসা কথা। তার আগে রাতটা সে ইস্টিশনেই কাটাতে চায়। কিন্তু ঊর্মিলা জানে যে এই ইস্টিশন চত্বরটা ভাল নয়। কোন নির্দিষ্ট ঠিকানা ছাড়া এখানে রাতে থাকতে গেলে পুলিশের ঝামেলা আছে। কোথায়ই বা যাবে। এক যেতে পারে শহরের কোন হোটেলে।

কিছু সময়ের আলাপ পরিচয় ঊর্মিলার এখন বেশ ভারি ঠেকছে। মালপত্র প্ল্যাটফর্মে রেখে সে দাঁড়িয়ে আছে। পারছে না অন্যদের মত বিনা ভূমিকায় চলে যেতে। ছেলেটাও কোনদিকে যাচ্ছে না। তার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে শুধু এদিক ওদিক দেখছে। কতই বা বয়স। পঁচিশ ছাব্বিশ, না আরো কম। সঙ্গে ব্যাগপত্তর নেই কিছু। চোখ মুখে উৎকণ্ঠা, ধকলের ছাপ। খারাপ লোকের পাল্লায় পড়লে বিপদে পড়বে। ঊর্মিলার এত সময় থাকে না ট্রেন থেকে নামার পর। এখান থেকে আবার রিক্সা নিয়ে তার যেতে হয় কিছুটা পথ।
এদিকে সারাদিন ঘরে ছানাপোনাগুলো একলা আছে প্রায়। এই সময় তার মায়ের মন খুব ছটফট করে উঠে। নীরবতা ভেঙ্গে ঊর্মিলাই জিজ্ঞেস করে বসলো—আপনি কোন দিকে যাবেন—রাত ত অনেক হলো। কলকাতা যাওয়ার গাড়ি আজ আর নেই। আবার কাল সন্ধেবেলা। যদি হোটেলে যেতে চান তা হলে এখান থেকে রিক্সা করে যেতে হবে শিলিগুড়ির হিলকার্ট রোডে। আমিও রিক্সা নিয়ে যাব—কিন্তু আমার রিক্সায় জায়গা হবে না— মালপত্র অনেক। এতগুলো কথার পর ছেলেটি শুধু বললো—হোটেলে যাওয়ার অসুবিধা আছে। কী মুশকিল, মাথা নিচু করে কথাটা বলে ঊর্মিলাকে যেন আরো বিপদে ফেলে দিল।

এদিকে প্ল্যাটফর্মও জনশূন্য হতে শুরু হয়েছে। ঊর্মিলা আর কিছু না ভেবে বললো—ধরেনত মালটা মাথায় তুলে দেন। মাথায় একটা বিড়া লাগিয়ে ঊর্মিলা মালের ঝুড়িতে হাত লাগাতে দেখা গেল ছেলেটিও হাত লাগিয়েছে। ঝুড়িটা মাথায় তুলে দিয়ে বাকি দুটো ব্যাগ আর ঊর্মিলার হাতে না দিয়ে ছেলেটি নিজের দু’হাতে নিয়ে নিলো। বিনা বাক্যে তারা হাঁটতে শুরু করলো স্টেশনের বাইরে যাওয়ার জন্য।


মালের ঝুড়ি মাথায় ঊর্মিলা আগে আগে, পেছনে সুবোধ। মাথায় একটা ভার থাকা সত্ত্বেও ঊর্মিলা ছেলেটাকে নিয়ে চিন্তাটা তার মাথা থেকে দূর পারছে না। তাতে ভার যেন আজ বেশি মনে হচ্ছে। আচ্ছা ফ্যাসাদ হলোতো! কী মতলব বোঝাও যাচ্ছে না। সঙ্গে সঙ্গেই তো দেখি চলছে। এসব ভাবতে ভাবতে তারা রিক্সা স্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ালো। ঊর্মিলা মাথার বোঝা নামাতে চাইছে না। একবারে রিক্সায় নামাতে চাইছে। ছেলেটি হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল বোঝাটা নামানোর জন্য। ঊর্মিলা বারণ করলো। উল্টে জিজ্ঞেস করলো আপনি কী করবেন—যাবেন কোথায়—কিছু ভাবছেন? উত্তরও-তো দেখি দ্যায় না। এদিক ওদিক তাকায়—কখনো মাথা নিচু করে কী ভাবে। কী ভাবে কে জানে! উপায়ান্তর না দেখে ঊর্মিলা একটা রিক্সা ডেকে মাথার বোঝা নিজেই রিক্সার ফুটবোর্ডে নামিয়ে রাখলো। এবার কিছুটা বিরক্তও ঊর্মিলা।

এতক্ষণ একটা মান্য বাংলায় কথোপকথন চালাচ্ছিল। বিরক্তির কারণে সে কিছুটা আত্মবিস্মৃত হয়ে এবার তার মুখ দিয়ে তার নিজের ভাষা বেরিয়ে এলো।–কিছু কইলে কন, আর দেরি করন যাইতো না। উত্তরে মিন মিন করে ছেলেটি যা জানালো তাতে সে আজ রাতের জন্য আশ্রয় চাইছে। শুনে ঊর্মিলা আরো চাপে পড়ে গেল মনে হলো। কিন্তু এখানে আর কথা বাড়ানো নিরাপদ মনে না হওয়ায় ঊর্মিলা তাকে তার রিক্সাতেই উঠে আসতে বললো। বইতে কষ্ট হইবো, তবু উডেন আর কি করন যাইবো অহন।
ছেলেটি উঠে ঊর্মিলার পাশে বসতে বসতেই রিক্সাওলা জানিয়ে দিলো পাঁচটাকা ভাড়া বেশি দেওন লাগবো। ঊর্মিলার কাছে পাঁচ টাকা যথেষ্ট টাকা। কিন্তু রাত বিরেতে তর্ক করা বৃথা।কী উটকো ঝামেলায় পড়া গেল—ভাবতে ভাবতে যখন তারা চলছিল তখনই ছেলেটি এতক্ষণ পরে একটা স্পষ্ট কথা বললো যে তার কাছে কিছু ইন্ডিয়ান টাকা আছে। ভাড়া দিতে অসুবিধে হবে না। কিন্তু ততক্ষণে ঊর্মিলায় মাথায় ভাড়া নিয়ে আর কোন ভাবনা ছিল না। গেলে আরো পাঁচ টাকা না হয় গচ্চা যেতো। ভাবনাটা হলো এই ছেলেকে এখন রাখে কোথায়। তাদের বস্তিও আর এক রেল ইস্টিশন সংলগ্ন। সেই জন্য তার নামই হয়েছে রেলবস্তি। স্টেশনের নাম টাউন স্টেশন। নামেই স্টেশন।

ট্রেনের তেমন যাওয়া আসা নেই। এক সময় নাকি ছিল। স্টেশন প্ল্যাটফর্মে রাত কাটানোর জন্য পাঠানো যায়। কিন্তু সেখানে কিছু ভিখারি ছাড়া আর কে থাকে—রাত বিরেতে সেখানে রাতের পুলিশ আর গুণ্ডা বদমাইশদের নানা কুকীর্তি কথা প্রায় দিনই শোনা যায়। ছেলের-তো সেখানেও বিপদ হতে পারে। কুটুম পরিচয় দিয়ে নিজের ঘরে নিয়ে তোলার কথা যে ভাবে নি তা না। একজন মানুষের তার ঘরে থাকার মতো জায়গা আছে ঠিকই। একটা রাত্তিরের ব্যাপার। কিন্তু এইরকম চেহারার একজনকে কীভাবে রাখে।এই চেহারা-তো তাদের মতো পোড়-খাওয়া নয়। কেমন আলগা আলগা ঠেকে। রাত্তিরটা না হয় কাটানো যায়। কিন্তু সকালে? যে দেখবে সেইই প্রশ্ন করবে। ঊর্মিলাকে উত্তরও দিতে হবে।

বাস্তব অভিজ্ঞতা আর ঊর্মিলা তেমন পৃথক কিছু নয়। প্রতিমুহূর্তে তার টান টান জীবন। সংসার ছেড়ে অনাদির সেই চলে যাওয়ার পর থেকে ঘরে চার চারটে বাচ্চা নিয়ে আর দম ফেলার সময় কোথায়। ভাবলে এতদিন পরেও ঘেন্নায় রাগে দুঃখে মুখে থুতু আসে তার। কীভাবে শিকারি বেড়ালের মতো মাগীটা অনাদির ঘাড় কামড়ে নিয়ে চলে গেলো। মাগী বলতে পড়শি মালতী। নিজের ঘর পুড়িয়ে অন্যের ঘরে আগুন লাগিয়ে চলে গেল। চলে গেল বলতে হাওয়া হয়ে গেল। আর পুরুষ অনাদি ঊর্মিলার বুকে সারা জীবন ধরে পোড়ার মত আগুন রেখে গেল। এসব আজকাল আর ভাবে না। কখনো ভাবলে ঊর্মিলার সারারাত জাগতে হয়। শুধু জ্বালা ছাড়া এই যন্ত্রণার আর কোন মাত্রা থাকেনা তখন। একমাত্র ছানাপোনাগুলোর দিকে তাকিয়ে এই সব আগুন তার ধীরে ধীরে গা-সওয়া হয়ে গেছে।

কিন্তু আজ এই রাত্রির প্রথম প্রহরে সমাজ সংসারে এত যুদ্ধ করা ঊর্মিলা বেশ মুষড়েই পড়লো। বস্তির সামনে এসে রিক্সা থামলো। দুজনে নেমে ধরাধরি করে মালও নামালো। ভাড়া দেয়ার সময় ছেলেটি উর্মিলাকে ভাড়া দিতে বাঁধা দিয়ে নিজেই সম্পূর্ণ ভাড়াটা মিটিয়ে দিল। রাত হয়ে গেছে। আধা অন্ধকার জায়গাতে তারা আবার ধরাধরি করে মাল নিয়ে তুললো ঊর্মিলার ঘরে। ঊর্মিলা ঘরে ঢোকার পর স্বাভাবিক ভাবে তার ছানাপোনারা তাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরলো। এটাই হয়।

সারাদিন পর শুধু মায়ের দেখা পেয়ে তারা তৃপ্ত হয় না। মাকে জড়িয়ে ধরে মায়ের গায়ের গন্ধ নিয়ে যেন তারা একটা আশ্বাস পায়। তাদের মুখে কথা ফোটে। তারা খানিক লাফালাফি করে। তাদের জন্য আনা লেবেঞ্চুসের প্যাকেটটা নিয়ে একসময় তারা শান্ত হয়ে কচরমচর করে তা খেতে শুরু করে। ওদের হাত থেকে নিস্তার পেতে আজ তাই ঊর্মিলা প্যাকেটটা তাড়াতাড়িই বাড়িয়ে দেয়। দরজায় দাঁড়িয়ে মন্ত্র মুগ্ধের মতো এতক্ষণ সুবোধ গোটা ঘটনাক্রম দেখে যাচ্ছিলো। হঠাৎ ঊর্মিলার ডাকে হুশ ফিরলো।– দাঁড়াইয়া রইলেন যে, ঘরে ঢোকেন—রাতে আর কই যাইবেন—দিন কালও ভাল না—কেমন মানুষ আপনে—বলি এই ভাবে কেউ বাড়ির বাইরে যায়? যাউক, রাত হইছে—যা ভাবার কাইল ভাইবেন—ঘরে ঢুইক্যা বসেন—বসার কিছু নাই—এই চৌকিতেই বসেন। কচরমচর শব্দ থেমে গেছে।

বাচ্চাগুলো হা করে তাদের মা আর আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে আছে।
চলবে...

আপনার মন্তব্য