জাস্টিন ট্রুডো’র আত্মজীবনী ‘কমন গ্রাউন্ড’-১৪

 প্রকাশিত: ২০১৬-১০-২৬ ০০:৪৫:২৬

মনিস রফিক:

আমাদের দলে আমরা কেউ নেতা ছিলাম না
১৪
আমি ধরেই নিয়েছিলাম, এই কিছুটা নতুন আর বুঝে না উঠতে পারা পরিবেশে নিজের সামাজিক পরিচয়টা আমার নিজের মত করে তুলে ধরতে হলে আমার বিশেষভাবে চলা প্রয়োজন। আমার আরো মনে হয়েছিলো, আমার এই নিজের মত চলার যে ধারণা আর আমার স্বকীয় বৈশিষ্ট্য ধরে রাখার যে চেতনা তাকে বজায় রাখতে হলে আমাকে গতানুগতিক লোকজন থেকে দূরে থাকতে হবে। আমি তখনকার দিনে যে কোনো ধরনের হৈ চৈ আর আমার পছন্দ না হওয়া মানুষজন থেকে দূরে থাকতাম। নিজের এই বৈশিষ্ট্য ও রুচিমত চলার চিন্তা থেকেই আমি জিনসের সাথে উজ্জ্বল সবুজ সাসপেন্ডার আর গোলাপি ফ্লেমিংগো টাই পড়তাম।

তবে আমি এটা বলবো না যে, আমার জীবনে নেয়া সবচেয়ে সেরা সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে সেটা একটা। আসলে আমার উদ্দেশ্য ছিলো, আমার আশেপাশের আমার মানতে না পারা বিষয়গুলোর প্রতি একটু ব্যঙ্গাত্মক ভাব দেখানো, তবে এক্ষেত্রে আমি যে সম্পূর্ণভাবে সফল হতাম তা বলবো না। আমার মধ্যে আবার নিজেকে একটু ভিন্নভাবে তুলে ধরার একটা চিন্তা কাজ করতো। এটা করার জন্য আমি মাঝে মাঝে বন্ধুদের কাছে জাগলিং বল বা জাদুকরী সব জিনিসপত্র, এমনকি আমার এক চাকার সাইকেল নিয়ে হাজির হতাম। (হ্যাঁ, আমার তখন একটা এক চাকার সাইকেল ছিলো)। সেই সময় মনে হতো, আমি ওগুলো যা করছি, সবই ঠিক, কিন্তু এখন যখন একটু অতীতের দিকে ফিরে তাকাই, তখন মনে হয়, সেগুলো ঠিক তেমন কিছু ছিলো না।

আমার মুখে যখন প্রচণ্ড ব্রণ উঠা শুরু হলো, তখন সেটা ছিলো আমার জন্য এক চরম খারাপ আর অস্বস্তির সময়, আমার বাবাও যখন তাঁর সেই অস্বস্তিকর বয়ঃসন্ধিকাল পার করছিলেন তখন তিনিও এমন পরিস্থিতিতে পড়েছিলেন। একেবারে অল্প কয়েক মাসের মধ্যেই আমি নিজে নিজেই অন্যদের কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে শুরু করলাম। আমার গালের চামড়ার অবস্থা এত বেশী এবড়ো থেবড়ো হয়ে গেলো যে আমাকে এক্যুইটেন ঔষধ দেয়া হলো, ঔষধটা কিন্তু কাউকে ভয়ংকর ধরনের ব্রণ না হলে দেয়া হয় না। বাবার বয়স যখন আমার মত ছিলো আর যখন তার ব্রণ হয়েছিলো, তখন সেই উদাসীন কিশোর ব্রণ-ট্রর্ণকে কোনো পাত্তাই দিতো না, যার ফলে তিনি সেই সময় সামান্য এসপিরিন জাতীয় ঔষধও নিতেন না, ফলে স্বভাবতই তিনি আমার এমন ঔষধ নেয়ার ব্যাপারে ঘোর আপত্তি জানাতেন। এই বিষয়টাও কিন্তু আমার বাবা-মা'র মধ্যে একটা তর্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। শেষ পর্যন্ত আমার মা'ই জিতেছিলেন, আমি মনে মনে মায়ের পক্ষেই ছিলাম। আমাকে দুই ধাপে এর জন্য ঔষধ খেতে হয়েছিলো এবং শেষ পর্যন্ত ঔষধে কাজও হয়েছিলো।

এখনকার দিনে যখন কেউ আমার চেহারার প্রশংসা করে, তখন সেই শব্দগুলো শুনতে আমার ভালোই লাগে। কিন্তু আমার মধ্য একটা ধারণা কাজ করে যে, মানুষজন সাধারণত নিজেরা নম্র থাকতে চাই। আমার এই ধারণাটা আমার ভিতর ঢুকে গেছে সেই ব্রেবিউফ এর বছরগুলো থেকে, এবং আমার মনে হয়ে, যারা আমার মতো সেই কিশোর বয়সে নিজেদের চেহারা নিয়ে এমন বিব্রতকর অবস্থার মধ্য দিয়ে সময় পার করেছে তারা সবাই আমার মত কথায় বলবে।

মেয়েরা ছেলেদের সাথে মেলামেশা শুরুর আগ পর্যন্ত ব্রেবিউফ এ সাধারণত সেই ছেলেরাই মেয়েদের কাছ থেকে বিশেষ সমীহ বা ভালোবাসা পেতো যারা পড়াশুনা বা খেলাধুলায় খুবই চৌকশ পর্যায়ে থাকতো। এমন সময়ে হকি দলের ক্যাপ্টেনকে ধরা হতো ক্লাসের সবচেয়ে চৌকশ ছেলে। সে এমন আকর্ষণীয় ছেলে বলে বিবেচিত হতো যে মেয়েরা তার আশে পাশে ঘুর ঘুর করতো। সেই হকি ক্যাপ্টেনের শৌর্যের কাছে একজন লেখাপড়ায় যতই ভালো হোক না কেনো সে পাত্তাই পেতো না। খেলাধুলায় সর্বোচ্চ পর্যায়ের থাকা, সামাজিকভাবে খুবই সম্মানজনক অবস্থান করা এবং যারা ভালো ঘোড়া ছুটাতে পারতো, তাদের চাহিদা থাকতো সবার ওপরে। আর যারা তাদের মস্তিষ্ক খাটিয়ে পরীক্ষায় অনেক বেশী নম্বর পেতো তাদের চাহিদা সাধারণত এদের পর্যায়ে পড়তো না।

ফলে বেবিউফ এ ছেলেরা নিজেদের মর্যাদা বজায় রাখতে বা নিজেদেরকে সবার চোখে ফেলতে বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলা বা কাজকর্মে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতো। আবার কিছু ছেলে থাকতো যাদের কেউ হয়তো দাবা খেলতো, কেউ কৌতুক-তামাশা করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতো, আবার কেউ একেবারে চুপচাপ থাকতো। স্কুলের প্রথম বছর থেকেই ফরাসী ও ইংরেজি ভাষায় কথা বলা দ্বিভাষিক ছাত্রদের সাথে আমার ভাব হয়ে গিয়েছিলো এবং তাদের সাথেই আমার বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিলো। আমার যে স্বল্প যোগ্যতা বা দক্ষতা ছিলো তা বিভিন্ন দলের কাছে আমাকে খুববেশী গ্রহণীয় করে তুলতো না আর অন্যদের কাছে নিজেকে এমন গ্রহণীয় করে তোলার কোনো বাসনাও আমার মধ্যে কাজ করতো না।

খেলাধুলায় আমার যে ক্ষমতা ছিলো তাতে আমি খুব সুন্দরভাবে ঘোড়দৌড়ে অংশ নিতে পারতাম বা ক্লাসে সবচেয়ে বড় পাণ্ডা হবার সমস্ত শারীরিক ও মানসিক ক্ষমতাও আমার ছিলো। সেই সময় আমি অনেক জায়গা ভ্রমণ করে ফেলেছি, এমনকি যারা ইউরোপে স্কি করার ভাব দেখাতো, তাদের চেয়েও অনেক বেশী ক্ষমতা আর অভিজ্ঞতা আমার হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু সবকিছুর পরও সেই প্রথম ক্লাস থেকে আমার যারা বন্ধু হয়েছিলো তারাই শেষ পর্যন্ত আমার বন্ধু থেকে গেছে। আমার সেই আসল বন্ধুরা হচ্ছে, মার্ক মিলার, ইয়ান র‍্যাকে, ম্যাথিউ ওয়াকার, গ্রেগ ওয়াওন, এলেন স্টিভারম্যান, নাভিদ ল্যাজেন্ডার।

আমাদের দলে আমরা কেউ নেতা ছিলাম না - আমরা আসলে ছিলাম এমন একটি দলের সদস্য যারা ছিলাম এক গভীর সম্পূরক আর সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ। আমি কিন্তু সব সময় নতুন কিছু করার উদ্যোগ নিতাম। আমি একটি সংগীত দল তৈরি করেছিলাম যার লক্ষ্য ছিলো ব্রেবিউফ এ যাদের সংগীতে প্রতিভা আছে তাদেরকে প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে খুঁজে বের করা। আমার উদ্যোগেই একবার আমরা একটা পুরানো পরিত্যক্ত ভবনে দুঃসাহসিক অভিযান চালিয়ে ছিলাম। আর একবার অভিযান চালিয়েছিলাম অটোয়ার স্ট্রর্ম-ড্রেইন ব্যবস্থা দেখার জন্য।

এমন এক যোগ্য ও কাজের সদস্যদের নিয়ে তৈরি একটা দল থেকে আমি যে প্রধান বিষয়টা শিখেছিলাম তা হচ্ছে নেতৃত্বের সেই আনন্দিত মুহূর্ত উপভোগ করার জন্য প্রয়োজন সঠিক চিন্তা ভাবনা আর দক্ষতা, এ নেতৃত্ব কারো দ্বারা আরোপিত হয় না, বরং এ নেতৃত্ব নিজ ক্ষমতা আর ভাবনায় অর্জন করতে হয়।
(চলবে)

আপনার মন্তব্য