বর্গমাইলের পদাতিক : ৬-৮

 প্রকাশিত: ২০১৬-১০-২৬ ০০:৫১:৫৩

রাজা সরকার:

ব র্গ মা ই লে র প দা তি ক

সকালে স্টেশনের কাছে এক জায়গায় বাজার বসে। ঊর্মিলার জায়গা আছে সেখানে। সকালেই যেতে হয় দোকান সাজাতে। অফিস বাবুদের বাজার সকালে। ঘণ্টা দুই তিনেকের বাজার। যাওয়ার সময় দেখে যায় সুবোধ গভীর ঘুমে। তার বাচ্চাদের নিয়ে ভাবনা নেই। ঘুম থেকে উঠে পড়লে তারা ইচ্ছে হলে মায়ের রেখে যাওয়া মুড়ি চিবোবে। জানে, মা আসতে বেশি দেরি হবেনা। কিন্তু ঘুম থেকে উঠে সুবোধ ঊর্মিলাকে না দেখলে অপ্রস্তুত হয়ে পড়তে পারে। তাই জাহানারাকে বলে গেছে যেন একটু খোঁজ রাখে। কিন্তু তার কিছুই ঘটল না। সুবোধ ঘুম থেকে উঠে দেখে ঘরে ঊর্মিলা নেই। বাচ্চারা তখনও ঘুমে। সে লুঙ্গি ছেড়ে প্যান্ট শার্ট পরে দরজা টেনে বেরিয়ে পড়লো। দিনের আলো যে কতটা তফাৎ করতে পারে রাত্রির সঙ্গে আজ এই সকালে সুবোধ ভীষণ ভাবে অনুভব করলো।

বস্তির ব্যস্ততা আর কলরোলে জায়গাটা রীতিমত এই সকালেই জমজমাট। ঘন্টাখানিক এদিক ওদিক হেঁটে সুবোধ ঘরে ফেরার পথ ধরে। মফস্বল শহর। এ দিকটা বেশ পড়ো জায়গা। বোধ হয় সেই কারণে বস্তির পত্তন সম্ভব হয়েছে। কলকাতা যাওয়ার পরিকল্পনা সে মনে মনে পরিত্যাগ করতে শুরু করে। আত্মগোপনে থাকার জন্য এখানেই যাহোক একটা ব্যবস্থা করে নিতে হবে।

ভেজানো দরজাটা খোলা। ঘরে ফিরে দেখে বাচ্চা সবকটা ঘুম থেকে ওঠেনি। দু’একজন জেগেছে। তার চারপাইয়ের উপর একটা চায়ের কাপ ঢাকা অবস্থায় আছে। সে কাপটা যখন তুলতে যাবে তখনি পেছন থেকে এক সরু নারী কণ্ঠ—মুখে দিয়েন না,মুখে দিয়েন না—গরম করে আনি—ঠাণ্ডা হয়ে গেছে বোধ হয়। পেছন ফিরে দেখলও শীর্ণ চেহারার এক নারী। নারী-তো নয়, যেন নারীর এক ছায়া। বেশ কুণ্ঠিত অবস্থায় দাঁড়িয়ে। সুবোধ তার সামনেই চা মুখে দিল। দিয়ে বললও—না ঠিক আছে। ঈষদুষ্ণ আছে। চলবে। নারীটি আর কোন কথা বললও না। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রইলো। চা খাওয়া শেষ হলে কাপ নিয়ে চলে গেল।

ঊর্মিলা সময়মতও ঘরে ফিরলও। এবার শুরু হলও তার সংসারের আসল কাজ। প্রায় দশ হাতে সে শুরু করলো তার সাংসারিকতা। চারপাইতে বসে বসে সুবোধ দেখতে লাগলো। এক ঝটকায় সব কটা বাচ্চাকে ঘুম থেকে তুলে মুখ ধোয়ার জন্য বাইরে পাঠিয়ে দিল। বাইরে একটা কুয়ো আছে। সরকারী। সবার ব্যবহারের জন্য। বড়টি ছেলে। কত হবে বয়স, নয় দশ। সে হাতে একটা দড়ি লাগানো বালতি নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। গুটি গুটি বাকিগুলোও তাকে অনুসরণ করলো। ঊর্মিলা শতচ্ছিন্ন কাঁথা চাদর বালিশ সমেত এক গাদা কাপড়চোপড় টেনে টুনে এদিক ওদিক ঝেড়েঝুড়ে একরকম গুছিয়ে ফেললো বিছানা। পাশাপাশি সুবোধের সঙ্গে টুকটাক কথাও চালাতে লাগলো। একবার বললও যে অসুবিধা না হলে দু এক দিন থেকে যেতে।

এ কথা অতিথিকে বলতে হয়, তাই বলা। বলার পরই ভাবলও, ঠিক হলও কি বলাটা? আঃ এত প্রশ্নের খোঁচা খেতে হচ্ছে কেন, কে জানে। এর মধ্যেই সুবোধ জিজ্ঞেস করলো আপনার বাচ্চারা ইস্কুলে যায়-তো? কাছেই-তো একটা ইস্কুল দেখলাম। উত্তরে ঊর্মিলা বললও—না এখন আর যায় কই, বড়টারে দিছিলাম। আমি থাকিনা ঘরে, ছোটগুলারে দেখন লাগে। আমাদের এই সব হয় না। আর বছর খানিক পর বড় ছেলেডারে আমার সঙ্গেই দোকানে বসাবো ভাবতাছি। টিকে থাকার জন্য ঊর্মিলার পরিকল্পনা ঠিক আছে। কিন্তু সুবোধের যুক্তিবাদী শিক্ষিত মন অবাক। চেষ্টা করছে এর পেছনের অসহায়তার কথাটা বুঝতে। কিছুটা বিষণ্ণ বোধও হচ্ছে তার। ঊর্মিলার ঘর ঝাড় পোঁছ করে ফেলেছে। এবার মনে হচ্ছে রান্না বসাবে।

সুবোধ আবার বাইরে বের হলও। বস্তির সামনেই চায়ের দোকান। সকালে চা খাওয়া হয় নি। ঊর্মিলার ঘরে চা’এর পাট নেই বোধ হয়। দোকানে বসে চা খেতে খেতে হাতে পেয়ে গেল একটা বাসি খবরের কাগজ। সিগারেট ধরিয়ে তন্ন তন্ন করে খুঁজে একটাও বাংলাদেশের খবর দেখলও না। মনটা খারাপ হয়ে গেল। এদিকের মিডিয়ার বোধ হয় বাংলাদেশ বিষয়ে আগ্রহ কম। অথচ দেশটা বিক্ষোভের বারুদের উপর দাঁড়িয়ে। ছাত্রদের আর মিলিটারি শাসকরা সহ্য করতে পারছে না। আসলে ছাত্রদের দমানো যে বাংলাদেশে অসম্ভব, এটা এই শাসকশ্রেণী মানতে চাইছে না।পাকিস্তান আমলেই-তো সেই পরীক্ষা হয়ে গেছে। এই সত্য বর্তমান শাসকরা কবে বুঝবে কে জানে! কিছুটা বিরক্ত মনেই সুবোধ দোকান থেকে বেড়িয়ে পড়লো। এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করে দু’একজন কে জিজ্ঞেস করে ঠিক জেনে নিলো মাছ বাজারটা কোন দিকে। বেশ গোছানো বাজার। দুটো বাজারের ব্যাগ কিনে সুবোধ একটায় কিনে নিয়ে রাখলও মাছ। আরেকটায় কিছু সবজি। ঘরে ফেরার পথে মিষ্টির দোকান থেকে কিনে নিলো গোটা দশেক ভালো মিষ্টি।

ঘরে ঢুকতেই সুবোধকে দেখে ঊর্মিলা কিছু বলতে চাইছিল। কিন্তু হাতে বাজারের থলি দেখে কথা হারিয়ে ফেললো। ঊর্মিলাকে নির্বাক দেখে সুবোধই বললও, এই একটু বাজার করলাম। আত্মীয় যখন সাজিয়েছও,তখন একটু বাজার ঘাট করতেই হয়। আর এই নাও মিষ্টি, বাচ্চাদের দিও। সুবোধ খেয়াল করেনি ঊর্মিলা শুধু নির্বাকই না। তার চোখও ছল ছল করছে। বাজার ঘাট-তো তাদের জীবনে নেই। শুধু কিছুটা সস্তার চাল আর নিজের বাড়তি অবিক্রীত সবজি আর সঙ্গে নুন লংকা।এইতো তাদের আহার্য্য। কালে ভদ্রে ডাল। আবার কদাচিৎ কখনো পেলে অর্ধেক অর্ধেক ডিম। মাছমাংস তারা বছরে কখনো সখনো চেখে দেখে। সেটা শুধু দামের জন্য নয়। সেটা মাছ রান্নার তেলের জন্য। মাছ রান্নায় যা তেল লাগে তা তাদের ঘরে থাকে না।

সুবোধ এই কাণ্ডটা করে একটু গোলমালই করে ফেললো। চারপাইতে বসে সুবোধ লক্ষ্য করছে ঊর্মিলা ব্যাগ থেকে বের করে করে সব দেখছে। একসময় উঠে দাঁড়িয়ে সুবোধের উদ্দেশ্যে বললও –আপনি বসেন— একটু আসি, বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরে হাতে বেশ কিছু টুকিটাকি জিনিষ আর এক শিশি সরষের তেল নিয়ে ফিরে আসলো। সুবোধ দেখে লজ্জা পেয়ে গেল। মনে মনে ভাবলও এটা-তো মাথায় ঢোকে নি যে মাছ রান্নার জন্য তেল লাগে। ওটাও আনা উচিত ছিল। কথাটা ঊর্মিলাকে বলতে গিয়ে বললও না। পাছে সে লজ্জা পায়।


জাহানারা এখানে এসে শিবানী হয়ে গেছে। এটা ঘরের বাইরে জানে শুধু ঊর্মিলা। সুবোধ জেনেছে অনেক পরে। সুবোধের এখানে এমন অনেক কিছু জানার আছে। সামাজিক সুরক্ষা বলয়ে বাঁচা আর এই খোলা সমুদ্রে ভেসে ভেসে বাঁচার পার্থক্যটা তার উপলব্ধিতে হানা দিচ্ছে বার বার। সুবোধ ঊর্মিলার কথা অনুযায়ী ‘আরো দু’একদিন’ পার করে ফেলেছে বেশ কিছুদিন আগে। এরমধ্যে মাঝে মাঝে সে বাবুদের মতো বাজার করেছে। কিছু বিছানাপত্র,বাচ্চাদের জন্য কিছু সস্তা জামাকাপড়,এই সব কিনেছে। শুনেছে জায়গাটা ম্যালেরিয়াপ্রবন। তাই মশারিও কিনেছে। যেটা সবচেয়ে অবাক করা কাজ সে করে যাচ্ছে তা হলো বড় দুটো বাচ্চার জন্য বই খাতা স্লেট পেন্সিল কিনে তাদের পড়াশোনা করাচ্ছে ঘরে। ভাবছে কিছুদিন পর থেকে ও-গুলোকে ইস্কুলেও পাঠাবে। বাচ্চারা হঠাৎ করে তাদের এই মামাটি পেয়ে যেন আহ্লাদে আটখানা। কিছুটা বদলাতেও শুরু করেছে। এই সব একপ্রকার ভালো লাগলেও ঊর্মিলা প্রথম প্রথম এই সব খরচ পত্রে ভয় পেয়েছিল। সুবোধ হাত তুলে জানিয়েছিল চিন্তা করোনা, টাকা কিছু আছে এখনও। সব শেষ করে ফেলিনি।

সুবোধের সরে পড়ার লক্ষণ দেখা গেল না। কেমন যেন ক্রমশঃ সেঁধিয়ে পড়ছে। কম কথা, কম উপস্থিতি, কিন্তু আছে। দিনের বেলা বাইরে কম যায়। বেরোয় রাতে। অনুযোগ তৈরির সুযোগ দেয় না। বরং এক আত্মীয়তার বানানো গল্পের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সুবোধ থেকে যাচ্ছে এক দূর সম্পর্কের ভাই হয়ে। কাজ কর্মের ধান্দায় এসেছে। কোথা থেকে এসেছে—এসব প্রশ্ন এখানে ঠাঁই পায় না। কে বাংলাদেশ, কে নেপাল, কে বিহার—দেশ বা জাতীয়তার চলতি ধারণা গুলো এখানে জীবন জীবিকার কাছে অপ্রাসঙ্গিক। কারণ সবাই এখানে বাইরের থেকেই আসে। কেউ এখানে গজায় না।

অসুবিধা প্রথম প্রথম ছিল না যে তা নয়। ছিল চেহারাটা নিয়ে। যদিও সেটা অল্প সময়ের জন্য। ক্রমশঃ পরিবেশ আর নিজস্ব চাপা আতংকের দৌলতে অনেকটা স্থানীয় হয়ে পড়েছে। এখন আর সাদা চোখে এটা ধরা পড়বে না যে সুবোধ একসময় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তো, সমসাময়িক রাজনীতি বা ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়ার কাজে তার ওতপ্রোততা ছিল। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং রক্ষার লড়াইয়ে যুক্ত থাকার দায়ে তাকেও অনেকের মতোই আত্মগোপন করতে হয়েছে।

সুবোধের এই উপস্থিতি ঊর্মিলার ব্যবহারিক জীবনের ভার কিছুটা লাগব করে দিয়েছে। সপ্তাহে দুই/তিনদিন ঊর্মিলার সবজি লোকালে সকাল বিকেল আসা যাওয়া চলতে লাগলো। শুনতে অবাক লাগলেও এটাই সত্যি যে সুবোধ এখন দুপুরের ভাত রাঁধে, দিনভর বাচ্চা সামলায়। কিন্তু তাতে যে জাহানারার খাঁচা থেকে বেরোনোর সুযোগ বন্ধ হয়ে গেল। এই অভিযোগ ঊর্মিলার কানেও পৌঁছেছে। ঊর্মিলা কপট হেসে বলেছে—ক্যান, আমিতো শুনি সারা দুপুর তুই আমার ভাইয়ের লগে গপ্পো করস। জাহানারা রাগ করে চোখে জল নিয়ে ঘরে চলে যায়। পরে ঊর্মিলা সেই রাগ ভাঙ্গাতে গিয়ে জাহানারার ঘরে বসে গল্প করে। তার ভেতর ক্রমে শোনা হয়ে যায় জাহানারার শিবানী হওয়ার গল্প। হায়, জাহানারার গল্প-তো আর গল্প নয়। শুধুই রক্তক্ষরণ। ঊর্মিলা থমথমে মুখ নিয়ে একসময় ঘরে ফেরে। আবার একদিন শুনতে যায়।

ঊর্মিলার সঙ্গে সুবোধের কথা হলে তা রাতের দিকেই হয়। ক্রমে রাত আর দিনের পরস্পর সম্বোধনের পার্থক্যটা মুছে গিয়ে দিনেরটাই স্থায়ী হয়ে গেছে। প্রথম দিনের সম্বোধনের পাঠ আর নেই। আসলে এটা তাদের ইচ্ছা-নিরপেক্ষ ভাবেই ঠিক হয়ে গেছে একসময়। দিদি হিসেবে ঊর্মিলা পেয়েছে ‘তুমি’সম্বোধন। আর ঊর্মিলা এখন ভাই হিসেবে সুবোধকে ‘তুই তোকারি’ করে। এটা যেন সুবোধের প্রতি দূরত্ব-সূচক সম্ভ্রমের পর্দাটা খুলে ফেলা। কারণ ঊর্মিলার পক্ষে দিনভর পরিশ্রমের ধকল সামলে একই ঘরে এতো দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব নয়। তা ছাড়া ছোঁড়াটার ভবিষ্যৎ কী--এভাবেই কি ওর দিন কাটবে—কাটলেও কতদিন? তেমন ভাবে চাপ না দিলেও ঊর্মিলা কাজকর্মের ব্যাপারে মাঝে মাঝে সুবোধকে স্মরণ করায়। যেন একটা কাজ কম্ম পেয়ে গেলে সুবোধ চাইলে এ তল্লাটেই একটা আলাদা ঘর নিয়ে থাকতে পারে।

স্থিতি চায় ঊর্মিলা। ভাসমান সুবোধকে নিয়ে তার ভয়। তার ধারণা ওপার থেকে মানুষ যে কারণে আসে সুবোধও সেই রকম কোনো কারণে এসেছে। এতদিন হয়ে গেলেও ঊর্মিলা সুবোধের এই অভিযাত্রার মূল কারণ সম্বন্ধে অন্ধকারে। কোন তথ্যাদিই তার কাছে নেই। জানতে চাইলে সুবোধ হেয়ালী করে। বলে তাড়িয়ে দিয়েছে। সে আর বেশি জানতেও চায় নি বা খোঁজও করেনি কখনো। সে না জানলেও তার ভেতর সম্পর্ক গড়ার একটা সুপ্ত কামনা হয়তো ছিলই। ফলে এই কতদিনে শুধু একপ্রকার মায়া আর বিশ্বাস দিয়ে যেন এই সুবোধকে সে গড়ে নিয়েছে। আর এই গড়ার গৌরবে জীবনে প্রথম নিজেকে যেন কিছুটা গর্বিতও ভাবতে পারছে।


সুবোধ এখানে আসার পর আজকাল ঊর্মিলা বিকেলের বাজারেও দোকান দেয়। বাইরে গেলে সারাদিন এতকাল মনের মধ্যে বাচ্চাগুলো থাকতো। এখন সেখানে সুবোধও থাকে। বেড়ে গেছে পরিশ্রম। রাতে ফিরে শ্রান্ত শরীরে শুয়ে পড়ে ঊর্মিলা ঘুমনোর আগে তাই সুবোধের সঙ্গে দু’ চারটে কথা বলে।

--সুবোধ ঘুমাইলি?

--না।

--দিনে-ত খালি পড়ে পড়ে ঘুমাস

--না, ঘুম আর হয় কই,পোলাপানের যন্ত্রণা

--হাতের একটা কাজ শিখ না—এখানে হাতের কাজে পয়সা।

--হ;--ঘুমোও-তো এখন

ঊর্মিলার চোখ এমনিতেই ভারী হয়ে আসে। বয়সে বড় বলে এই সব উপদেশমূলক কথা বলে দু’চারটে। এটা বলা কর্তব্যও মনে করে সে।কিন্তু সুবোধ শুনলে-তো। হু হা করে এড়িয়ে যায়। এদিকে ঘুম কম সুবোধের। রাতে দু’তিনবার ওঠে। বাইরে যায়। ফিরে এসে জল খায়।বিড়ি খায়। বাচ্চারা কোনটা কাশতে কাশতে জেগে যায়। ওটাকে বাইরে নিয়ে গিয়ে পেচ্ছাব করিয়ে আনে। ঊর্মিলা তখন হয়তো ঘুমে বেহুশ।

রাত নিঝুম হয় এখানে খুব অল্প সময়ের জন্য। সুবোধ টের পায় ঘরের পাশ দিয়ে মানুষের আনাগোনা, কথাবার্তা।রাত জেগে জেগে সুবোধ এসবে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।প্রান্তিক জীবন বলতে আসলে কী বোঝায় সুবোধ এখন বুঝতে পারছে। প্রতিরাতেই তার মাথার ভেতর চলে এক তীক্ষ্ণ হিসেব নিকেশ। কী হবে এরপর? কীভাবেই বা হবে? ঊর্মিলার ঐ ‘হাতের কাজ’ এর কথার গুরুত্ব না দিলেও তার ভেতর চলতে থাকে একটা বেরোবার পথের সন্ধান।

দরজার শব্দ শুনে সুবোধ একটু গলার আওয়াজ করলো।

--কী রে এখনও জাইগা আছিস?—বলতে বলতে ঊর্মিলা বাইরে গেল। ফিরে এসে বললো—শরীরটা ঠিক আছেতো সুবোধ?

-হ, ঠিক আছে।

মশারি তুলে সুবোধের কপালে হাত দিয়ে দেখলো জ্বর আছে কিনা। আজ দিনের বেলা নাকি একটু জ্বর জ্বর ভাব ছিল। ঊর্মিলা ঘরে এসেই শুনেছিল। না, এখন গা গরম নেই। কিন্তু কপাল থেকে হাত সরাতে গিয়ে টের পেল সুবোধ হাত টেনে ধরেছে।

--কী রে

--বও-না একটু , কথা কই

--কী কথা—হাত ছাড়, বসছি।

ছোঁড়াটার গলাটা কেমন যেন ভারী ঠেকলো না! নিজের গা-টাও যেন কেমন গুলিয়ে উঠলো।

মশারিটা সরিয়ে ঊর্মিলা বসলো সুবোধের কাছে। হাই তুললো। বলল—বল, কী বলবি।এত রাইতে আবার কী মনে পড়লো তোর। বলতে বলতে ভাবলো ছোঁড়াটার মতি গতি বোঝা দায়। রাতভর জাগে। কী ভাবে কে জানে? দেশের কথা বললে বেশি উত্তর দেয় না।কতদিন থাকবে কে জানে! নিজের থেকে-তো কিছু কয়-ও না। জিজ্ঞেস করলে হু হা ছাড়া উত্তর নেই।–কীরে ক, কী কইবি।

--বলছি তুমি এই কামটা ছাড়। সবজি আনার কামটা, খাটনি খুব—

--ও মা কী কস, ছাড়লে খাওন দেবে কে শুনি

--আমি ব্যবসা করবো।

--আচ্ছা!—কীয়ের ব্যবসা, কী বেচবি—

--কেন মদ!

--মারা পড়বি, একদম মারা পড়বি

--কেন অনেকেই-তো করে

--তুই পারবি না।

--পারবো।

--আচ্ছা এখন ঘুমো।–এই বলে ঊর্মিলা উঠতে যাবে, আবার টের পেল শাড়িতে টান।

--কী হলো?-

--না।

ঊর্মিলা টের পেল টানে যথেষ্ট জোর। বুকটা তার ধক করে উঠলো।

--কী রে, পাগলামি করিস না, ছাড়—

কোন কথা নেই। শুধুই টান। আরো—

--কী হলো তোর—হ্যাঁ—কী রে,--কথা বলছিস না যে বড় ---

ঊর্মিলা আর কিছু বলতে পারলো না।গলার কাছে একটা অবোধ্য যন্ত্রণা যেন দলা পাকিয়ে আটকে যাচ্ছে। সংসারে সবটাই যেন আর গা সওয়া হয় না। গা-সওয়ার বাইরেও যে সওয়ার জন্য একটা আলাদা কিছু লাগে। কথা বলতে গেলে আর বলা যাচ্ছে না, গলা বুজে আসছে। সুবোধ যেন আর সুবোধ নয়। অচেনা লাগছে।

অন্ধকার ততক্ষণে ভাঙতে শুরু করেছে। ভাঙা ভাঙা অন্ধকারে যেন শুরু হয়েছে প্রাণ সঞ্চার।তার মধ্যে কে ঊর্মিলা, কে সুবোধ—প্রশ্নগুলো আর কাজ করছে না। শুধু সন্তর্পণে ভাসতে ভাসতে তারা পরস্পরের কাছে আরো গভীর হয়ে উঠতে লাগলো।
[চলবে]

আপনার মন্তব্য