বর্গমাইলের পদাতিক : ৯-১০

 প্রকাশিত: ২০১৬-১০-২৬ ২২:২৬:১০

রাজা সরকার:

ব র্গ মা ই লে র প দা তি ক

জাহানারাদের ঘর আর ঊর্মিলার ঘরের মধ্যেকার দূরত্ব খুব বেশি হলে তিন হাত। প্রথম প্রথম সুবোধের অস্বস্তি হতো। শুনেছে ওর স্বামীর নাম কমল। দু’ একদিন দেখেওছে,কিন্তু কথা হয় নি। একটু গম্ভীর প্রকৃতির। ক’দিন আগে ঊর্মিলার সূত্রে জানা গেছে যে জাহানারাকে এই নামে এখানে কেউ চেনে না। সবাই শিবানী বলেই জানে। জানে কমলের দ্বিতীয় পক্ষের বউ। ক’মাস আগে দেশ থেকে বিয়ে করে এনেছে। কার কোথায় দেশ, কে কোথা থেকে আসে, কে কোথায় যায়—এসব নিয়ে এখানে মাথা ঘামানোর চল নেই। কিন্তু ঘটনা এতো সরল পথে চলছে না।

গত ক’দিন ধরেই একটা চাপা কান্নার আওয়াজ জাহানারাদের ঘর থেকে প্রায়ই শোনা যাচ্ছে। ঊর্মিলাকে বলা হলে ঊর্মিলা শুধু মাথা ঘামাতে বারণ করে। বলে, ছেলেটা, অর্থাৎ কমল, খুব ভালো ছেলে নয়। পেশায় সে রিক্সা চালক। এটাই জানে সবাই। কিন্তু আদতে সে রিক্সা চালক হলেও আরো অনেক গোপন কাজের সঙ্গে যুক্ত। যেমন মাঝে মাঝে তার থানা পুলিশ করতে হয়। জেল হাজতে যেতে হয়। মাঝে মাঝে কিছুদিনের জন্য উধাও-ও হয়ে যায়। এই যেমন জাহানারাকে নিয়ে আসার আগেও কয়েক মাস উধাও ছিল। সেই সময় নাকি ও বাংলাদেশে গিয়ে লুকিয়ে ছিল।ঐ সময়েই জাহানারাকে বিয়ে করবে বলে ফুসলিয়ে নিয়ে আসে। জাহানারা জানতো ও মুসলমান।

একদিন কমলের হাত ধরেই জাহানারা পালায়। কোন স্বপ্ন দেখেছিল কে জানে। বিয়ের বয়স হওয়া মেয়ে বাড়ি থেকে পালানোতে দরিদ্র বাবা নুরু মিয়া সমাজের কাছে কিছুটা অপদস্থই হয়। যদিও নীতি কথার পেছনে একটা দায়মুক্তির ব্যাপার থাকায় বিষয়টা ধীরে ধীরে চাপা পড়ে যায়। তা ছাড়া দারিদ্র আর কন্যাসন্তান সংসারে অবাঞ্ছিত; সেটা বলা বাহুল্য বলে কথা আর বেশি এগোয় না। জাহানারার মা, কুলসুম, অন্য আর দশটা দমিত নারী-সত্তার মতো অবগুণ্ঠনের আড়ালে একটা গোপন বিবেচনা ছিল যে,--দেখতে শুনতে-তো কমল উপযুক্ত। ইন্ডিয়ার ছেলে। মেয়েটার হয়তো একটা হিল্লে হয়ে যাবে। কিন্তু এখানে এসে বস্তিতে ঢোকার আগেই তাকে হাতে শাখা আর মাথাতে সিঁদুর পরতে হলো। নাম বলে দিল—বলতে হবে শিবানী। কিন্তু বিয়ে-তো দূরের কথা কমল হিন্দু কি মুসলমান তাও আজ অবধি বুঝতে পারলো না। জানতে চাইলে ধমক দেয়। ঊর্মিলা এ-সব বেশ কিছুটা জানে। কিছুদিন আগে নাকি কমল জাহানারাকে ঊর্মিলার ঘরে যাতায়াতের ব্যাপারে শাসিয়েছে। সেই থেকে মেয়েটি যেমন আর আসে না, ঊর্মিলাও আর যায় টায় না।

যে কাজগুলো ভদ্রলোক-সমাজের লোকেরা সাধারণত খবরের কাগজে পড়ে, সেই কাজগুলো বা সেই সব কাজের লোক এখানে ঘর থেকে বের হলেই দেখা যায়। সুবোধ যেহেতু এখানে এখন পরিচিত, তাই সেও এখন এসব জানতে পারে চা এর দোকান বা সিগারেটের দোকানে গিয়ে দাঁড়ালে। তাদের একান্ত প্রতিবেশী কমল সম্পর্কে সে অনেক তথ্য এভাবেও জেনেছে। বস্তির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা অপরাধের চিত্রটা এখন তার কাছে বেশ পরিষ্কার। যেমন কমল, সারাদিন ঘরে থাকে। রিক্সা নিয়ে বের হয় সন্ধ্যের পর। রাত দু’টো বা তিনটে পর্যন্ত সে রিক্সা চালায়। আসলে সে তখন নানা ধরনের চোরাচালানের কাজ করে। কখনো সে নির্দিষ্ট স্থান থেকে বিশেষ কিছু মহিলাদের নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দেয়। এক কথায় রাতের শহর শিলিগুড়িতে সে একটি গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। ভালো রোজগার।এক সময় সে ডাকাতিও করেছে।দেখেছে তাতে ঝুঁকি বেশি। এটাই এখন তার পছন্দের জীবিকা। এই সূত্রে তার পরিচয় হয়েছে যেমন শহরের মান্য গন্য মানুষের সঙ্গে, তেমনি পরিচয় হয়েছে পুলিশ বা গোয়েন্দাদের সঙ্গেও। গোয়েন্দাদের সোর্স হিসেবেও তার একটা আলাদা কাজ আছে। তবু মাঝে মাঝে থানা জেল হাজত করতে হয় আইনের প্রতি মান্যতা দেখানোর জন্য।

কিন্তু খুব সম্প্রতি সুবোধ যা জানতে পারলো সেটা ঠিক সে হজম করতে পারলো না। সেটা হলো কমল একটি অন্তর্দেশীয় মেয়ে-পাচার চক্রের সঙ্গে যুক্ত। কথাটা শোনার পর ঊর্মিলাকে জানাতে গিয়ে শোনে ঊর্মিলা তা আগেই জানে। --হ ,এই সব আমার জানা আছে, তুই আর কী শোনাবি। আগের বউটার বেলায় বলছিল, হে নাকি বাপের বাড়ি গিয়া মারা গেছে। কীসের মারা গেছে—মিছা কথা—হারামজাদা বেইচ্যা দিছে—এই-ডারেও হুনতাছি বেচবো— শিবানীরে কইছি বাইরে যাইতে কইলে যাইবি না একদম। কথাবার্তা চলতাছে—লোক জন রাইত বিরাতে আসে—হেই দেইখ্যা মাইয়া ভয়ে কান্দে--। সুবোধ স্তব্ধ হয়ে শোনে।

১০
রেল বস্তির মানচিত্রে সামনের দিকে কিছুটা খোলা জায়গা। তার মধ্যে একটা পাড় বাঁধানো বড় কুয়ো। বাকি খোলা জায়গাটা বস্তির বাচ্চাদের। ভোট আসলে মাঝে মধ্যে সেখানে রাজনৈতিক দলের জমায়েত হয়। তারপরেই রাস্তা। আর রাস্তার ধারেই মালার মতো নানা কিসিমের ছোট বড় দোকান। এই দোকানের সারি রাস্তা ধরে অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত। সন্ধেবেলা দূর থেকে দেখলে আলোর মালার মতো লাগে। তখন ভিড়ও থাকে।

এই অঞ্চলের খদ্দেরদের অনেককেই সুবোধকে চেনে। চিনে নিতে হয়েছে।সুবোধ আসার কিছুদিন পর থেকেই ঊর্মিলার জীবিকার বদল ঘটে গেছে।হলদিবাড়ি লোকালে যাতায়াত,ঝুড়ি ভর্তি সবজি, নিত্য নতুন উৎপাত, শরীরী অপদস্থটা, তার উপর ঘরের ছানাপোনাদের টান—এই সমস্ত কিছু ছেড়ে ছুঁড়ে ঊর্মিলা এখন রাস্তার পাশে তেলে ভাজার দোকান দিয়েছে। এর মূলে আছে সুবোধ। কিছুদিন যাবত সুবোধকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে তার জেগে ওঠার অভ্যাস। পেছনে আনাড়ি হাতের সাহায্য ছাড়াও রয়েছে তার সতর্ক উপস্থিতি। যদিও স্বভাবে সে কিছুটা উদ্যত, কিন্তু বুদ্ধি-নির্ভর বটে। ফলে প্রথম প্রথম সুবোধকে নিয়ে ওঠা কথা এখন সব ঝিমিয়ে পড়েছে।অবশ্য সবারই আত্মরক্ষার ব্যস্ততাও সেই সব কথা কিছুটা টেনে নিয়েছে। রয়ে গেছে সুবোধ, ঊর্মিলার এক সম্পর্কের ভাই হয়ে। যদিও প্রতিবেশী ময়না টগরদের কাছে হয়তো এখনো সে ঊর্মিলার ‘নয়া নাঙ’হয়েই আছে। তবু এতে বিপদের কিছু নেই। প্রতিবেশী গোপাল,অধীর বা বসন্তদের কাছে ‘শালাবাবু’ হয়ে মিশে আছে। এটা ঊর্মিলার পক্ষে বড় পাওনা।

কল্পনাথ একজন চেনা খদ্দের।প্রতিদিন দেখা যায় প্রায় একই দৃশ্য—মাতাল কল্পনাথ বাড়ি যাওয়ার সময় ঊর্মিলার কাছে ক্ষমা চায়।কেন চায় ঊর্মিলা জানে না।ভাবে মাতালের এটাই বুঝি দস্তুর।অভ্যস্ত হাসিতে ঊর্মিলাও কখনো কখনো বলে—হ, হ, যান অখন, বাড়ি যান।

কিন্তু আজ কল্পনাথ যায় না। কথা বলার একটু সুযোগ পেয়েই শুরু করে বকবক। নীরবে ঊর্মিলাকে দোকান সামলানোর ফাঁকে ফাঁকে শুনে যেতে হচ্ছে তার বকবকানি। মাঝে মাঝে তার ইচ্ছে হয় তেলে ভাজার ঝাঝরিহাতাটা দিয়ে ওকে তাড়া করতে। কিন্তু দোকান বলে কথা। মাথা গরম করলে পেট চলবে না। এই সময় সুবোধটা যে কোথায় থাকে।

শোনা যায় কল্পনাথের মাছের আড়ত আছে। মরা মাছ আর সাদা বরফ নিয়ে তার কারবার। চমৎকার মধ্যবয়স, স্মার্ট চেহারা। টাকা পয়সা তার কাছে খুব সহজ। আর সহজ টাকা পয়সা দিয়েই নাকি সে সব কিছু কেনে।
এখানে রাত বাড়লে সুবোধকে সে ঘন ঘন ফরমাস দেয়। সিগারেট আন। দেশলাই আন। চানাচুর আন। ঊর্মিলার জন্য একটা ভাল দেখে পান নিয়ে আয়তো—ইত্যাদি। অবশ্যই সে কখনো খুচরো ফেরত নেয় না। বর্তমানে এই সাদা পোশাকের আনাগোনার মধ্যে বারণ করা সত্ত্বেও তার ফরমাসের বিরাম নেই। কিন্তু সুবোধটাকে-তো আর কাছে পাওয়া যাচ্ছে না।

এর মধ্যেই হঠাৎ করে—এ-ই শালা সুবোধ,শালাবাবু—কোথায় গেলি বাবা? জড়ানো গলা। হঠাৎ উঁচুতে উঠে আবার খাদে নেমে এলো।

রাস্তার দুদিকেই রেলের জমি। জবর দখল। একদিকে দোকান, অন্যদিকে বস্তি। বস্তির দিকে দু’একটা মুদি দোকান।এই মুদি দোকান কয়টা বাদ দিলে এখানে সবই একপ্রকার হোটেল কাম গ্যারেজ কাম রাতের বেআইনি দেশী মদের দোকান কাম পানের দোকান কাম শুকনো নেশার দোকান কাম আরো কতো কী--। এই অঞ্চলেই একটা ফাঁকা জায়গা ঊর্মিলা পূরণ করে তার তেলেভাজার দোকান দিয়েছে। যারা দোকানে বসে মদ খাচ্ছে তারা অনেক সময় তেলেভাজাটা নিজেরাই কিনে নিয়ে গিয়ে বসেছে। কেউ কেউ দোকানে মদের গ্লাস রেখে মাঝে মাঝে এক ঢোঁক খেয়ে এসে রাস্তায় দাঁড়িয়ে তেলে ভাজা খাচ্ছে। যেন সে তেলেভাজাই খাচ্ছে। মদ নয়। এটা পুলিশের হঠাৎ হামলা বা মাসিক হামলার হাত থেকে বাঁচার জন্য। মান্থলি পাওয়া সত্ত্বেও পুলিশকে এটা চাকরির খাতিরে করতে হয় মাঝে মাঝে। এটা পুলিশ দোকানী আর খদ্দের তিন পক্ষই জানে। এর জন্য ঝামেলা বা ক্ষতি যেটা হয় তা মানিয়ে নেয়াই এখানকার স্থানীয় রীতি।

কল্পনাথ এমনই একজন ফ্লাইং খদ্দের। যার বোতল গ্লাস দোকানে তো নিজে সে বাইরে। বাইরে বলতে ঊর্মিলার দোকানের সামনে।

--‘স--শালা সোবোধ’—আবার হঠাৎ উঁচু গলা। কিন্তু কোন সাড়া না পেয়ে যেন নিজের আওয়াজেই একটু ধাতস্থ হলো। এবার গলার স্বর যথাসম্ভব নামিয়ে নরম করে বলে—কি গো ঊর্মিলা, সুবোধকে দেখছিনা তো!

--কেন সুবোধরে দিয়ে কী হবে? ঊর্মিলা খুব রুক্ষভাবে ঝামটে উঠলো।

--না, মানে, সিগারেট লাগবে---।

--লাগবেতো নিজেই কিনে নেন না—ঐ তো দোকান।

--কিন্তু ব্যাটা গেল কই?

--যেখানেই যাক, এখানে চেঁচাবেন না।

--অঃ

ঊর্মিলার মাথা গরমের আঁচ টের পেল কল্পনাথ। একটু দূরে গিয়ে নিজের মনেই বলে চললো—শালীর দেমাগ কতো—মাগ ভাতারে জমেছে ভাল—পিরিতের ঢল নেমেছে গতরে—বুঝি না, না—শালা, আমার নাম কল্পনাথ—বরফ সরিয়ে কেমন করে মাছ তুলতে হয় জানি—তোকেও মাগী তুলবো—তুলবোই একদিন--।

বিড় বিড় করতে করতে এগিয়ে যায় কল্পনাথ। সামনেই পানের দোকান। হঠাৎ টের পায় গা’য়ে গা ঠেকিয়ে চলছে সুবোধ।

--আরে সুবোধ যে—কখন থেকে ডাকছি ভায়া।

সুবোধ চাপা গলায়—আস্তে,--ডাকছি মানে? সুবোধ তোমার বাপের চাকর নাকি—বাঞ্চোৎ!

আর একদিন যদি শুনি গলা ছেড়েছো একদম ফাঁসিয়ে দেবো বলছি।

পাঁজরের নিচে হাল্কা একটা খোঁচা খেয়ে কল্পনাথ তাকিয়ে দেখে সুবোধের হাতে একটা খাপে ঢাকা ছোরা। এমন ভাবে ধরা আছে যে খুব কাছে না এলে বোঝা যাবে না।

কল্পনাথ যেন সম্বিৎ ফিরে পেল। কিছুটা তোতলানো অবস্থায় বললো—না না, মানে ঠিক আছে, ঠিক আছে।

বলতে বলতে পান দোকানের সামনে আলোতে এসে দাঁড়াতেই সুবোধ অন্য মানুষ। বলে উঠলো—এ-ই সুবল, কল্পনাথ দা’কে পান দে। দুটো সিগারেটও দিস। কী দাদা, আজ মাছের দর কেমন উঠলো? আজ আসতে দেরি হলো যেন মনে হয়?

কল্পনাথ অনেকটা ফ্যাল ফ্যাল করে সুবোধের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো

--ভাল, ভালই উঠেছিল দাম। আচ্ছা আজ যাই।
[চলবে]

আপনার মন্তব্য