বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, ষষ্ঠ পর্ব : ২৩-২৫

 প্রকাশিত: ২০১৬-১০-২৬ ২২:৩০:৫৭

কাজী মাহবুব হাসান:

বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, ষষ্ঠ পর্ব (দ্য গ্র্যান্ড মার্চ) : ২৩ -২৫
২৩
আমাদের প্রত্যেকেরই কাউকে দরকার যে আমাদের দেখবে। আর কোন ধরনের দৃষ্টির অধীনে আমরা বাস করতে চাই তার উপর ভিত্তি করে আমরা নিজেদের চারটি শ্রেণীতে বিন্যস্ত করতে পারি।

প্রথম শ্রেণীর আকাঙ্ক্ষা নামহীন অসীম সংখ্যক চোখের দৃষ্টি জন্যে, অন্যার্থে, জনসাধারণের দৃষ্টি। যেমন আমরা দেখি সেই জার্মান গায়কটির ক্ষেত্রে, আমেরিকার অভিনেত্রীটির ক্ষেত্রে, আর এমনকি সেই দীর্ঘদেহী, খানিকটা সামনে ঝুঁকে পড়া, বড় চিবুক সহ সম্পাদকটির ক্ষেত্রেও, তিনি অভ্যস্ত তার পাঠকদের সাথে, আর যখন একদিন রুশরা তার পত্রিকাটির প্রকাশনা নিষিদ্ধ করেছিল, তার সেই অনুভূতি হয়েছিল যেন চারপাশের বায়ুমণ্ডল হঠাৎ করে শতগুণ লঘু হয়ে গেছে। কোনো কিছুই সেই নামহীন চোখগুলোর দৃষ্টিকে প্রতিস্থাপিত করতে পারেনা। তিনি ভেবেছিলেন আর শ্বাস নিতে পারবেন না। তারপর একদিন তিনি অনুধাবন করেছিলেন, সারাক্ষণই তাকে অনুসরণ করা হচ্ছে, তার কথা শোনার জন্য আড়িপাতা হচ্ছে, গোপনে রাস্তায় তার ছবি তোলা হচ্ছে। হঠাৎ করেই আবারও তিনি তার উপর সেই অজ্ঞাতনামা চোখগুলোর দৃষ্টি অনুভব করতে শুরু করেন আর আবারো তিনি শ্বাস নিতে সক্ষম হন! দেয়ালে লুকিয়ে থাকা মাইক্রোফোনের উদ্দেশ্যে তিনি নাটকীয় বক্তৃতা দিতে শুরু করেন।রাষ্ট্রীয় গোপন পুলিশের মধ্যে, তিনি তার হারানো জনগণকে খুঁজে পেয়েছিলেন।

দ্বিতীয় শ্রেণীটি গড়ে উঠেছে সেই সব মানুষগুলোকে দিয়ে, যারা সবসময়ই একটি আবশ্যিক প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন যেন পরিচিত বহু চোখের দৃষ্টি তাদের উপর থাকে। এরা সাধারণত বিরামহীন ককটেল কিংবা ডিনার পার্টির আতিথ্যকর্তা। প্রথম শ্রেণীর সেই মানুষগুলোর তুলনায় এরা অপেক্ষাকৃত সুখী, কারণ প্রথম শ্রেণীর মানুষগুলো যখন তাদের জনগণকে হারান, তারা সেই অনুভূতিতে আক্রান্ত হন যেন তাদের জীবনের সব কক্ষ থেকেই আলো হারিয়ে গেছে।এবং তাদের সবার সাথে আগে কিংবা পরে, কোনো না কোনো এক সময় অবশ্যই এমন ঘটনা ঘটে।কিন্তু দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষগুলো,যখনই তাদের দরকার তারা সবসময়ই সেই চোখগুলোর সন্ধান করে নিতে পারেন। মারি-ক্লদ ও তার মেয়ে এই দ্বিতীয় শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত।

তারপর আছে তৃতীয় শ্রেণীটি, এই শ্রেণীতে আছেন সেই মানুষগুলো, যে মানুষকে তারা ভালোবাসেন, তার চোখের সামানে সারাক্ষণ থাকার প্রয়োজনীয়তা তারা অনুভব করেন। তাদের পরিস্থিতি প্রথম শ্রেণীর মানুষগুলোর মতই বিপদজনক। একদিন যখন তাদের ভালোবাসার মানুষটি চোখ বন্ধ করবেন, তাদের সেই পুরো কক্ষটাই অন্ধকার হয়ে যাবে। তেরেজা আর টমাস এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত।

আর পরিশেষে চতুর্থ সেই শ্রেণীটি, সবচেয়ে দুর্লভ, যে শ্রেণীর মানুষগুলো, অনুপস্থিত এমন মানুষদের কাল্পনিক চোখের সামনে বাস করেন। এরা হচ্ছে স্বাপ্নিক, ফ্রাঞ্জ, যেমন। সে কম্বোডিয়ার সীমান্তে এসেছিল শুধুমাত্র সাবিনার জন্য। থাই রাস্তায় ঝাঁকুনি খেতে খেতে বাসটি এগিয়ে যাবার সময়, সে অনুভব করতে পারছিল যে সাবিনার তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

টমাসের ছেলেও এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। আমি তার নাম দিচ্ছি শিমন। (খুবই খুশী হবে সে, তার বাবার মত একটি বাইবেল ভিত্তিক নাম পেলে)। শিমন যে চোখের আকাঙ্ক্ষা করেছে সেগুলো টমাসের। রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনার সেই আবেদন আন্দোলনে যুক্ত থাকার কারণে তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত করা হয়েছিল। যে তরুণীটির সাথে সেই সময় তার ঘনিষ্ঠতা ছিল, সে ছিল একটি গ্রামের পাদ্রীর ভাইঝি। শিমন তরুণীটিকে বিয়ে করে এবং গ্রামের সমবায় সমিতির ট্রাক্টর চালক হিসাবে চাকরী নেয়, এছাড়া ক্যাথলিক ধর্মানুসারী ও পিতাও হয়েছিল। যখন সে জানতে পেরেছিল তার বাবা টমাসও তারই মতো কোনো গ্রামে বাস করছে, সে খুবই আনন্দিত হয়েছিল: নিয়তি তাদের জীবনে অবশেষে প্রতিসাম্যতা এনেছে! বিষয়টি তাকে উৎসাহ দেয় টমোসকে চিঠি লেখার জন্য। সে তাকে অবশ্য উত্তর দিতে অনুরোধ করেনি। সে শুধু চেয়েছিল টমাসের দৃষ্টি যেন তার জীবনের প্রতি নিবদ্ধ থাকে।

২৪
ফ্রাঞ্জ আর শিমন এই উপন্যাসে কল্পনাবিলাসী দুই চরিত্র। ফ্রাঞ্জের ব্যতিক্রম, শিমন কিন্তু কখনোই তার মাকে পছন্দ করতে পারেনি। শৈশব থেকেই সে তার বাবাকেই খুঁজে বেড়িয়েছে। সে বিশ্বাস করতে ইচ্ছুক ছিল যে, তার বাবা কোনো না কোনো এক ধরনের অবিচারের শিকার হয়েছেন, যা আগেই ঘটেছে এবং সেটি তার বাবা তার সাথে যে অবিচার করেছিল তা ব্যাখ্যা করে। তার বাবার উপর কখনোই সে ক্ষোভ অনুভব করেনি, কারণ সে কখনোই তার মায়ের সাথে জোট বাধতে চায়নি, যিনি প্রায় সারাক্ষণই মানুষটির বিরুদ্ধে নানা কুৎসা রটনা করতেন।

তার আঠারো বছর অবধি সে তার মায়ের সাথে বসবাস করেছে ও স্কুল শেষ করেছিল, তারপর সে প্রাহায় আসে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে। সে সময় ইতিমধ্যেই টমাস জানালা পরিষ্কার করার কাজটি শুরু করেছে। প্রায়ই শিমন দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতো, টমাসের সাথে ঘটনাচক্রে যেন তার দেখা হয়ে যায় এমন কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু টমাস কখনোই থেমে তার সাথে কথা বলেনি।

শুধুমাত্র একটি কারণে সে বড় চিবুক ওয়ালা প্রাক্তন সম্পাদকের সাথে যুক্ত হয়েছিল, সেটি হচ্ছে এই সম্পাদকের নিয়তি তাকে তার বাবার নিয়তির কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল। সম্পাদক এর আগে কখনোই টমাসের নাম শোনেননি। ইডিপাসের সেই নিবন্ধটাও সবাই ভুলে গিয়েছিল। শিমনেই সেটি তাকে মনে করিয়ে দিয়েছিল, তাকে বলেছিল টমাসকে রাজি করাতে এই পিটিশনের সই করানোর জন্য। আর একটি মাত্র কারণে সম্পাদক রাজী হয়েছিলেন, তিনি চেয়েছিলেন ছেলেটির জন্য ভালো কিছু করতে, যাকে তিনি পছন্দ করতেন।

যখনই শিমনের সেই দিনটার কথা মনে পরে যখন তাদের দেখা হয়েছিল, সে লজ্জিত হয়েছে তার আড়ষ্টতার জন্য।সে ভেবেছে তার বাবা তাকে পছন্দ করতে পারেন না। কিন্তু, এর বিপরীত, সে তার বাবাকে পছন্দ করেছিল। টমাসের প্রতিটি শব্দ তার মনে আছে, আর যতই দিন গেছে সে বুঝতে পেরেছ কত সত্য ছিল তার সেই কথাগুলো।যে কথাগুলো তার উপর সবচেয়ে গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছিল, সেটি ছিল, ‘এমন কোনো মানুষকে শাস্তি দেয়া যে জানেনা সে কি করেছে, তা আসলেই বর্বরতা’। যখন তার প্রেমিকার চাচা তার হাতে একটি বাইবেল দিয়েছিলেন, সে বিশেষভাবে আলোড়িত হয়েছিল যীশুর সেই বাক্যটি দ্বারা - ‘তাদের ক্ষমা করো, কারণ তারা জানে না তারা কি করছে’। সে জানতো যে তার বাবা একজন ধর্ম অবিশ্বাসী, কিন্তু দুটি বাক্যের মিলের মধ্যে সে গোপন একটি সংকেত দেখতে পেয়েছিল: তারা বাবা একমত হয়েছেন তার বেছে নেয়া পথের সাথে।

গ্রামে তার তৃতীয় বছরে, সে টমাসের কাছ থেকে একটি চিঠি পায়, টমাস তাকে তার ওখানে আসতে বলেছে।তাদের সেই সাক্ষাৎকার বন্ধু-ভাবাপন্ন ছিল।শিমনও যথেষ্ট উদ্বেগহীন ছিল আর একটুও তোতলায় নি। সে সম্ভবত অনুধাবন করতে পারেনি যে তারা পরস্পরকে ভালোভাবে বুঝতে পারেনি। এর চার মাস পরে, একটি টেলিগ্রাম পায় সে, যা জানিয়েছিল যে একটি সড়ক দুর্ঘটনায় টমাস ও তার স্ত্রী ট্রাকের নীচে পিষ্ট হয়ে নিহত হয়েছেন।

প্রায় সেই সময়েই, সে একটি নারীর কথা জানতে পারে, যিনি কোনো একসময় তার বাবার প্রেমিকা ছিলেন, আর তিনি এখন ফ্রান্সে বাস করেন। শিমন তার ঠিকানা খুঁজে বের করেছিল। কারণ সে মরিয়া হয়েই প্রয়োজন বোধ করেছিল কোনো কাল্পনিক চোখ যেন তার জীবনকে অনুসরণ করা অব্যাহত রাখে। মাঝে মাঝেই সাবিনাকে সে দীর্ঘ চিঠি লিখতো।

২৫
জীবনের শেষ দিন অবধি সাবিনা তার সেই দুঃখী গ্রাম্য পত্রলেখকের চিঠি পেয়ে আসছিল নিয়মিত। তার অনেকগুলো কখনও পড়া হয়নি, কারণ নিজের মাতৃভূমি নিয়ে তার আগ্রহও ক্রমশ কমে গিয়েছিল।

বৃদ্ধ মারা গেলে সাবিনা ক্যালিফোর্নিয়ায় বসতি গড়েছিল। আরো পশ্চিমে, যে দেশে তার জন্ম হয়েছিল তার থেকে আরো দূরে।

তার কোনো সমস্যা হয়নি তার আঁকা চিত্রকর্মগুলো বিক্রি করতে, এবং আমেরিকাও সে পছন্দ করতো। কিন্তু শুধুমাত্র উপরিপৃষ্ঠে । উপরিপৃষ্ঠের নীচে সবকিছুই ছিল তার অপরিচিত।মাটির নীচে, সেখানে তার কোনো দাদা বা চাচা নেই, ভয় পেতো যেন সে কোনো কবরে নিজেকে আটকে ফেলেছে, আর আমেরিকার মাটিতে সে ডুবে যাচ্ছে।

সুতরাং একদিন সাবিনা একটি উইল খসড়া করেছিল, যেখানে সে অনুরোধ করেছিল তার মৃতদেহটি যেন দাহ করা হয় আর তারপর বাতাসে তার দেহভষ্ম ছড়িয়ে দেয়া হয়। তেরেজা আর টমাস মারা গিয়েছিল ভারের চিহ্নের নীচে, সে নির্ভারতার চিহ্নের নীচে মরতে চেয়েছিল। সে বাতাসের চেয়েও হালকা হবে। যেমন পারমেনিডেস হয়তো বলবেন, নেতিবাচকতা বদলে যাবে ইতিবাচকতায়।
(চলবে)

আপনার মন্তব্য