বর্গমাইলের পদাতিক : ১১-১৩

 প্রকাশিত: ২০১৬-১০-২৮ ০০:৪২:৩৪

রাজা সরকার:

ব র্গ মা ই লে র প দা তি ক
১১
কল্পনাথ চলে যেতেই সুবোধ একটু মুচকি হেসে নিজের অবস্থানে চলে গেল আবার। এসব এলাকার আবার নিজস্ব আইন থাকে। সুবোধ ঐ আইনটাকে রক্ষা করে, প্রয়োগ করে। প্রয়োজনে শাস্তিও দেয়। আলো অন্ধকারের এমন একটা আড়াল সুবোধ এই সন্ধ্যা এবং রাত্রির জন্য বেছে নেয়। বেছে নেয় তার মূল কারণ ঊর্মিলা, ঊর্মিলার নিরাপত্তা, কিংবা যে কোনো মাতলামির মাত্রা বা অচেনা কোন গতিবিধি,--সবই যেন সে লক্ষ্য করতে পারে। এ-ছাড়া যেটা এই অবস্থানের পক্ষে সবচেয়ে জরুরী, তা হলো পুলিশ।

ঊর্মিলার বিক্রি এখন শেষের দিকে। সন্ধ্যে নামার পর থেকেই তার এই রোজকার তৎপরতা। কেন্দ্রবিন্দু সেই ঊর্মিলা। দূর থেকে ঊর্মিলাকে লক্ষ্য করার মধ্য দিয়ে প্রায়শই সুবোধের ভেতর অদ্ভুত এক জাগরণ ঘটে। তখন আর ঊর্মিলার দিকে সে খুব বেশি তাকিয়ে থাকতে পারে না। নিজের কাছে ব্যাখ্যাতীত এক জীবনের পালা সূচিত হয়ে পড়ে। অথচ এই জীবন-তো সে চিনতো না কোনোদিন। না-চেনা রাত্রির এই বাস্তবতা আজ কেমন করে তার কাছে অমোঘ হয়ে উঠলো! এহেন বাস্তবতা সে উপেক্ষা করবে কী ভাবে—জানে না।

দমবদ্ধ ভাবটা বোধহয় এই জন্যই উদয় হয় মাঝে মাঝে। তার মধ্যেই কখনো হঠাৎ একটা নদী, একটা মানুষ,একটা জনপদ তাকে ঘিরে ফেলে। প্রশ্ন করে—

--কী নাম ছিল তোমার?

--সুবোধ মুস্তাফি

--বাবার নাম?

--করুণানিধান মুস্তাফি।

--ঠিকানা?

--গ্রাম: অতিথপুর। জেলা: ময়মনসিংহ।

--ভৌগলিক অবস্থান?

--কংস নামের এক নদ ঘেরা জনপদ। নাবাল জমির ভেজা মাটির গন্ধ—যেখান থেকে উত্তরে তাকালে গারো পাহাড় চোখে পড়ে। তার উত্তরে কী আছে—ছোট বেলায় কাউকে এই প্রশ্ন করলে রহস্য করে বলা হতো ‘তর মামার বাড়ি’। একসময় মনে হতো শীত গ্রীষ্ম বর্ষায় খিদের মোচড়ে নুয়ে থাকা এই জীবনের ঘেরাবন্দির বাইরে বোধ হয় আর যাওয়া হবে না। কিন্তু আমার যে খুব যেতে ইচ্ছে করতো!

--শিক্ষা?

--বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষ।

--দেশত্যাগের কারণ?

--রাষ্টশক্তির অপছন্দ। অপছন্দের তালিকায় যে রাজনীতি থাকে তার সঙ্গে কার্য-কারণে যুক্ত হওয়া। পুলিশের চোখে পড়া। একে নামে হিন্দু তায় আবার বামপন্থী! নিশ্চয়ই হিন্দুস্থানের দালাল। পেছনে লাগানো যায় দু’তিনটে মার্ডার কেস। তারপর একটু চাপ। ব্যাস, সীমানা পার। আপদ বিদায়। রয়ে গেল সম্পত্তি। কাফের ছেঁটে ফেলার এই এক জলচল রাস্তা। বেশ লাভ।

সুবোধ জানে এরপর তার বাবাকে নিয়ে চলবে টানাহ্যাঁচড়া। স্কুল মাস্টারি টিকবে কিনা কে জানে! যদিও বাবা অভিজ্ঞ। তবু এখন তার বয়স হয়েছে। এক সময়কার মুক্তিযুদ্ধের কর্মীর সামাজিক পরিচিতির শেকড়টা মাটির একটু বেশি গভীরে প্রোথিত। তবু রাষ্ট্রের গোপন এজেন্ডা বাস্তবায়নের হাত তাকে রেহাই দেবে কিনা কে জানে! সারাজীবন এক শিক্ষামুখী মানুষ হিসেবেই কাটিয়েছেন জীবন। লোভনীয় সহায় সম্পত্তি বলে কিছু নেই। বরং এখনও তাঁর জীবনে মানুষ এবং মানুষ নির্ভর এক উজ্জ্বল সারবত্তা জেগে আছে। ফলে এ-যাবত কায়েমি শক্তিকে তার কাছ থেকে কিছুটা ব্যর্থতা নিয়েই ফিরে যেতে হয়েছে। কিন্তু ক্রমাগত গাছটার শাখা প্রশাখা ছাঁটতে থাকলে গাছটার মৃত্যু ত্বরান্বিত হবে বৈ কি।

১২
মানুষ তার প্রত্নসুত্র সঙ্গে নিয়েই ঘোরে। যেন বা এই বিশ্বাসে সাদা পোশাকে কল্যাণ সেন নিয়ম মাফিক এই অঞ্চলে আসে। সঙ্গে কেউ না কেউ থাকে। এখানে এসে একটু দাঁড়ানো, এক আধটা সিগারেট খাওয়া বা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কোনোদিন এক কাপ চা খাওয়া এবং চলে যাওয়া—এই তার রুটিন। ইদানীং দেবেনের হোটেলটার প্রতি তার নজর।হোটেল-তো দিনের বেলায়। সন্ধ্যা নামতেই সেটা মদের দোকান। আজকাল তার ভেতর একটা দলকে দেখা যায়। তারা মদ খেতেই আসে। তবে শুধু মদ খাওয়া নয়, সঙ্গে চলে তুমুল আড্ডা, তর্ক বিতর্ক। তবে একটা অদৃষ্ট নিয়ন্ত্রণ আছে যেন। সাধারণ মাতলামি তারা করে না। এ অঞ্চলের সাধারণ খদ্দেরদের সঙ্গে এদের কথাবার্তা নেই তেমন। ভাষা বা চেহারাতেও অমিল বেশ। এরা ঊর্মিলার কাছে ভিড় করে না। সামান্য খোঁজ খবরে জানা গেছে যে এরা কেউ কেউ লেখক কবি নাট্যকার—ইত্যাদি। কিন্তু এরা এখানে কেন?—কল্যাণ সেন মেলাতে পারেন না। বে-আইনি মদের দোকানের সূত্রে এদের একদিন তুলবে কিনা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। সুবোধের কাছ থেকে একদিন এদের নামগুলো জেনে নিয়েছেন। সার্চ করে এদের সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক ঘটনা দুর্ঘটনার সূত্র তেমন মিলছে না। সোর্স লাগিয়ে সংগ্রহ করা এদের লেখা-পত্র কিছু পড়ে দেখার চেষ্টা করেছে।কিন্তু অর্থহীন দুর্বোধ্যতা ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায় নি। তাতে অবশ্য এদের সম্পর্কে কৌতূহল কমেনি বরং বেড়ে গেছে।

যদিও এ-বিষয়ে বাহাত্তর সনের অভিজ্ঞতা তার রয়েছে। তখন নতুন চাকরি। বহুবার লেখক কবিদের মুখোমুখি হতে হয়েছে তখন। কিন্তু কিছুটা খোঁচাখুঁচির পর বেরিয়ে পড়তো সেই রাজনীতি। তখন আর সাহিত্য নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার হতো না। রাজনীতির সূত্রেই হাড় মাংস আলাদা করা যেতো।

সুবোধের হাতে একদিন কুড়ি টাকার একটা নোট গুঁজে দিলেন কল্যাণ সেন। বললেন ওখানে কী কথাবার্তা হয় শুনতে হবে। শুধু দেখলে হবে না।পারলে পাশে বসে কথাবার্তায় যোগ দিতে হবে। মনে রাখতে হবে মার্কস, লেনিন, মাও, ইয়েনান ফোরাম, শ্রেণীশত্রু, শ্রেণী সংগ্রাম—এই জাতের শব্দগুলো কথাবার্তায় আসে কি না। এ-ছাড়াও যদি খুব আন-কমন কোনো কথা কানে লাগে তো ওটাও ক্যাচ করতে হবে।–কী পারবি না?

সুবোধ চোখে চোখ রাখে না কল্যাণ সেনের। মাটির দিকে তাকিয়ে শোনে সব কথা, মাঝে মাঝে একটা আশংকা তার ভেতরে মোচড় দ্যায় শুধু।মনে মনে ভাবে পান দোকানের সুবল ঐ দিন উপকার করতে গিয়ে এই স্যারের কাছে তাকে ভিড়িয়ে না দিলেই পারতো।

প্রায় বিনা ভূমিকায় এমনই একদিন রাতের দিকে সে যখন সুবলের দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে সুবলের সঙ্গেই গল্প করছিল তখন কল্যাণ সেন এলেন সিগারেট নিতে। সুবলের পান দোকান আর দেবেনের হোটেল রাস্তার এপার ওপার—প্রায় মুখোমুখি। কল্যাণ সেনের তাই এখানকার সিগারেটই বেশি পছন্দ। সেদিন সুবোধের উপকারের উদ্দেশ্যে সে কল্যাণ সেন’এর কাছে একটা আর্জি জানায়।

--স্যার, দিন না আমার এই শালাবাবুকে একটা কাজে লাগিয়ে। ছেলে ভাল স্যার। পড়াশোনাও জানে একটু আধটু।

কথা শুনে উত্তর দেয়ার আগেই সুবোধের আপাদমস্তক পুলিশি চোখে জরিপ করে নিলেন। তারপর বললেন—

--কোথায় থাকে?

--এখানেই স্যার। ঊর্মিলার ভাই। ওর কাছেই থাকে।

--হু, দেখি।

ব্যাস, এইটুকুই। তারপর থেকেই আলাপ। কিন্তু যেহেতু পুলিশ, কল্যাণ সেন’এর মুখোমুখি হলে সুবোধ এখনও কেমন জড়সড় হয়ে থাকে।

--কী, মনে থাকবে-তো?

--আজ্ঞে হ্যাঁ স্যার।

--এক সপ্তাহ পর রিপোর্ট নেব।

বলেই কল্যাণ সেন চলে গেলেন। সাধারণত বেশিক্ষণ দাঁড়ান না। খুব বেশি হলে পাঁচ সাত মিনিট। আজ তাই সুবোধ লক্ষ্য করলো। লক্ষ্য করলো তার ভরাট গলার আওয়াজ। চমৎকার স্বাস্থ্য। হাফ শার্ট পরা। কোমরে নিশ্চিত পিস্তল আছে। সঙ্গে ছায়ার মত দু একজন থাকে। তবে বেশ তফাতে। উনি চলে গেলে ছায়ারাও মিলিয়ে যায়।

সুবোধ তারপরও অনেকক্ষণ এদিক ওদিক দাঁড়িয়ে শুধু এই লোকটার কথা ভাবে। ঐদিনের ঐটুকু কথা—তারপর থেকেই এখানকার সব খবরাখবরের জন্য লোকটা তাকেই নির্দিষ্ট করে বেছে নিলো! জিজ্ঞাসা না করেও নামটা কী করে জেনে নিলো! ঊর্মিলার ভাই—তাকে কি সত্যিই পুলিশি চোখে ঊর্মিলার ভাই বলেই মনে হয়? অথচ কোথা থেকে সে এসেছে, এখানে কি সত্যি কাজ খুঁজতে এসেছে, না অন্য কিছু—কোন কিছুতেই যেন তার কৌতূহল নেই। নাকি সবই সে জানে। মনে মনে ভাবে বিষয়টা একদিন ঊর্মিলাকে বলতে হবে।

১৩
কল্যাণ সেন’এর দেয়া কুড়ি টাকার দায় মেটাতে একদিন সুবোধ সময়মতই দেবেনের দোকানে ঢুকলো। দেবেন তো দেখে অবাক। এলেও যে দিনের বেলা কখনো চা খেতে আসে, সে কিনা আজ এই সময়!

--কী হলো শালাবাবু আজ হঠাৎ এই সময়?

--এই একটু এলাম আর কি।

--চলবে নাকি একটু?

--হ্যাঁ, এই সময়-তো আর চা চলেনা—মানে ঐ আর কি।

--বসেন বসেন।

-- দ্যাও এক গ্লাস।

পাশে ততক্ষণ আড্ডা জমজমাট। ঋত্বিক ঘটকের কোন সিনেমা নিয়ে চলছে। কিছুদিন হলো উনি বুঝি মারা গেছেন। সুবোধ গ্লাসে এক চুমুক দিয়ে টেবিলে নামিয়ে রাখলো গ্লাস। মনে মনে ভাবতে লাগলো কল্যাণ সেন’কে কী কী বলতে হবে। অনেকটাই তাকে বানাতে হবে। ঋত্বিক ঘটকের পর আবার শুরু হয়েছে সাহিত্যের অশ্লীলতা, মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছে সশস্ত্র বিপ্লব—না সশস্ত্র বিপ্লব নিয়ে কিছু বলা যাবে না—বরং ‘ময়নামতি’ নাটকের নারী চরিত্রের রহস্য তাৎপর্য নিয়ে কিছুটা বললেও চলবে।

আসলে ওদের আলাপ আলোচনা খুব বৃত্ত-বন্দী। নিজেরাও অনেকটা তাই। এই যে আজ সুবোধ অনেকক্ষণ ওদের কাছাকাছিই বসে আছে সেটা ওদের গ্রাহ্যের মধ্যে একেবারেই নেই। যাই হউক, রিপোর্ট একটা তাকে দিতেই হবে। বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলার তার খ্যাতি আছে। এটা ছাত্র জীবনের বন্ধু মহলে জানতো অনেকেই। এই কারণে বিশেষ করে কুসুম তাকে গল্প লেখার জন্য খুব বলতো। কিন্তু তার বক্তব্য ছিল আমি লেখক নই কথক। আসলে লেখা-কাজ তার কাছে এক শ্রমসাধ্য বিষয় ছিল বরাবর।

এদিকে হঠাৎ-ই সুবোধের মন আবার আড্ডার দিকে ঘুরে গেল। এখন একটা গল্প বলছে অরিন্দম। গল্প ঠিক নয়, শুনে মনে হচ্ছে সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা। ঘটনা স্থলও মনে হচ্ছে অরিন্দমের নিকট প্রতিবেশীর বাড়ি। আত্মীয় হলেও হতে পারে। যেমন, সেখানে সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে একটি পরিবার এসেছে।পরিবারের বিবাহযোগ্যা একটি মেয়ে আছে। ওদেশে যুবতী হিন্দু মেয়ে নিয়ে পরিবারের নানা বিপদ-তো আছেই, তারমধ্যে আছে যোগ্য পাত্রের অভাব।মূলত সেই কারণে তাদের এই দেশে আসা।

এখানে ইতিমধ্যে কয়েকটি পাত্রের খোঁজ খবর পাওয়া গেছে। দেখাশোনাও হয়েছে কয়েকটি। কথাবার্তা চলছে। দু’এক পক্ষের পছন্দও হয়েছে। এরমধ্যেই একদিন সেই বাড়িতে হৈ চৈ ব্যাপার। কারণ বিবাহযোগ্যা ঐ মেয়েটি নাকি ভীষণ ভেঙ্গে পড়েছে।একবার সে আগুনে পুড়ে আত্মহত্যা করার চেষ্টাও করেছে। দেখে শুনে সারা বাড়ির লোকজন তটস্থ। শোনা যাচ্ছে এক পাত্রপক্ষের লোক ঐদিন বাড়িতে এসে বলে গেছেন—মেয়ে-তো সুন্দরী—আমাদের পছন্দই, কিন্তু একাত্তর সনে, হিসেব করে দেখা যাচ্ছে মেয়ের বয়স ছিলো তেরো।সুতরাং ঐ সময়, সবাই জানে, গোপন করার কিছুই নেই, ওদেশে-তো আইন কানুন বলে কিছু ছিলো না, যে যা খুশি করেছে। ঐ অরাজকতার মধ্যে একটা মেয়ের নষ্ট হওয়া বিচিত্র কিছু নয়।

আমরা দুঃখিত। হিন্দু ধর্মে সতীত্ব একটি ঘোরতর ব্যাপার, আপনারাও মানেন নিশ্চয়ই। আমরা আর এগোতে চাই না। অতঃপর পরস্পর আরো শোনা যায় যে পাত্র পক্ষের ঐ ভদ্রলোক নাকি একাত্তর সালের পর এই দেশে এসেছেন। এখানে পাত্রী বাংলাদেশের—এই কথা শুনে তিনি পাত্রপক্ষের একজন একান্ত সুহৃদ হিসেবে পাত্রীর বয়স নিয়ে হিসেব নিকেশ করে তার মতামত শুধু পাত্রপক্ষকেই দিলেন না, বাড়ি বয়ে এসে পাত্রীপক্ষের দরজায় দাঁড়িয়ে মুক্ত কণ্ঠে তাদেরকেও বলে গেলেন।

সতীত্বের এই গল্পটি সুবোধ সহ্য করতে পারলো না। গ্লাসের বাকি মদটা খেয়ে আর এক গ্লাস দিতে বললো দেবেনকে।

--কী ব্যাপার আজ খুব ফুর্তি মনে হচ্ছে। ভর্তি আর এক গ্লাস টেবিলে রেখে দেবেন প্রশ্ন করলো সুবোধকে।

--হ্যাঁ, আজ খুব ফুর্তি—ফুর্তির রাত।
[চলবে]

আপনার মন্তব্য