বর্গমাইলের পদাতিক : ১৪-১৬

 প্রকাশিত: ২০১৬-১০-২৯ ১৭:২৫:৩৫

রাজা সরকার:

ব র্গ মা ই লে র প দা তি ক
১৪
দেবেন সুবোধের মুখ দেখে খুব ভরসা পেলো না। বোঝা যাচ্ছে নেশা হয়েছে বেশ। এদিকে অরিন্দমদের দলটা উঠে পড়লো। গ্লাস শেষ করে সুবোধও উঠে পড়লো। দেবেনকে টাকা দিতে গিয়ে দেখলো অরিন্দমও তাদের বিল মেটাচ্ছে। দোকান থেকে বের হওয়ার মুখে হঠাৎ কী মনে করে সুবোধ অরিন্দমকে বলে উঠলো-

--একটা কথা বলবো?

--বলুন। উত্তর দিতে দিতেই অরিন্দম নির্লিপ্ত চোখে সুবোধকে দেখে নিলো।

--মাফ করবেন, আড্ডার বাইরের কেউ হয়েও আমি আপনার বলা ঘটনাটা শুনেছি।

--ঠিক আছে—তো কথাটা কী?

--না, বলছিলাম যে মেয়েটির এরপর কী হবে?

--তা দিয়ে তোমার কী দরকার?

--দরকার-তো আমাদের সকলেরই।

--মানে, কী বলতে চাও?

--প্লিজ, আপনি রেগে যাবেন না---

হঠাৎ মানস এগিয়ে আসে। অরিন্দমের দিকে তাকিয়ে বললো—

--কী হয়েছে রে?

--হবে আবার কী, এই যে ইনি, ইনি আমাদের কথাবার্তা মন দিয়ে শুনেছেন, এখন বলছেন—মেয়েটার কী হবে—এটা ওনার জানা দরকার।

অরিন্দমের কথা শুনে মানস সুবোধের দিকে তাক করে বললো—

--নেশা হয়েছে, ক’গ্লাস মেরেছো—

--নেশা একটু হয়েছে, কিন্তু কথাটা---

--কিন্তু টিন্তু কী হ্যাঁ—নিজের কাজ করোগে বাছা, অন্যের কথায় নাক গলাতে এসো না।

--সরি! দুঃখিত—আপনাদের ডিস্টার্ব করলাম—

কথাবার্তার মাঝেই দেবেন এসে সুবোধকে ঠেলতে ঠেলতে দূরে নিয়ে গেল।–বললো, যাও তো যাও—বিনা কামে প্যাঁচাল পাইরোনাতো। যাও, ঘরে যাও।

দেবেন দেখলো এই দলটা তার সলিড ‘সলিড কাস্টমার’।সুবোধের সঙ্গে ঝামেলা হয়ে গেলে হয়তো আর এদিকেই আসবে না। সুতরাং সময়মতো পদক্ষেপ।

প্রথম দিকের রাতে সাধারণত সুবোধের ঘুম হয় না। আজ ভেবেছিলো পেটে যখন দু’তিন গ্লাস পড়েছে তখন হয়তো ঘুম আসবে। কিন্তু কোথায়। অরিন্দমের সঙ্গে কথাটা বলতে গিয়ে নেশাটাই কেটে গেল। আর নেশা-কাটা জাগরণে জেগে থাকলো আত্মহত্যার ব্যর্থ চেষ্টা করা মেয়েটি, যার বয়স ছিলো সত্তর সনে মাত্র তেরো বছর। এ ছাড়া হিন্দু ধর্ম—সতীত্ব ইত্যাদি।

এভাবে নির্ঘুম শুয়ে থাকার ভেতর সুবোধ সাধারণত নিজের সঙ্গে এক দীর্ঘ কথোপকথন চালায়। পরিণামে একেবারে বিধ্বস্ত না হওয়া পর্যন্ত। কিন্তু আজ আর কোনো কথোপকথন নয়, যেন কিছু সিদ্ধান্ত নেয়ার দরকার হয়ে পড়েছে। ফলত: একটা ছটফট করা ধারালো অবস্থা। মাঝে একবার ঊর্মিলা জানান দিলো যে রাত অনেক হয়েছে। না ঘুমিয়ে এতো বারবার বিড়ি টানা বা বসে থাকা কেন। টের পেলাম মদও খেয়েছিস—কে খাওয়ায় তোকে মদ? প্রশ্ন করে উত্তরের অপেক্ষা ঊর্মিলা করে না। এটাই তার দস্তুর। দু’ মিনিটও সময় দিতে পারে না। ঘুমিয়ে পড়ে। বোঝা যায় এ-ঘুম তার খুব জরুরী ঘুম। কারণ, তার পরের দিন আছে।

ঘর জুড়ে নিঃসাড় এক ঘুমের তরঙ্গ বয়ে চলেছে। ছিটেফোঁটা রাস্তার আলো বেড়ার ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়া সত্ত্বেও ঘরের এই অন্ধকার ঘুমের পক্ষে খুব অনুকূল। আজ শুধু শুয়ে বা বসে থাকতে পারছে না সুবোধ। মাঝে মাঝে ঘরের মধ্যে এক পা, দু’পা করে হাঁটাহাঁটি করছে বা কখনো দাঁড়িয়েও থাকছে। অন্ধকারে এমনই এক অন্যমনস্কতার ভেতর একটা স্পর্শ পেয়ে বেশ চমকে উঠলো সুবোধ। বোঝাই যাচ্ছে তার স্নায়ু বেশ পীড়িত। টের পেলো স্পর্শটা ঊর্মিলার।চট করে সে যেমন ঘুমোয়, আবার খুব সামান্য শব্দেও সে জেগে ওঠে। খুব নিচু গলায় বললো—কী রে দাঁড়িয়ে আছিস যে?

--কিচ্ছু না, শুয়ে পড়ো তুমি।

--কিন্তু কী হইছে কী তোর?

--কী হইবো আবার—কিছু না—তুমি শোওগে যাও।

এই বলে সুবোধ ঊর্মিলার হাত ছাড়াতে গেল। কিন্তু ঊর্মিলা বেশ দৃঢ় গলায় বলে উঠলো—

--কী হইছে আমারে কওন লাগব।

বলে ঠেলতে ঠেলতে সুবোধকে তার চারপাইয়ের উপর বসিয়ে দিল।

সুবোধের কাছে ঊর্মিলার কোন আড়ষ্টতা নেই আর। এখন তার মতো করে সে সুবোধের কাছে জানার চেষ্টা করতে লাগলো—কীসের জন্য তার এই নির্ঘুম রাত—কেনই বা সে এতোটা অবোধ্য লাগে তার কাছে।

প্রশ্নের উত্তর ঠিক পেলো কি পেলো না ঊর্মিলা আর বুঝতে পারে না। একসময় টের পায় সুবোধ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তার খোলা বুকের উপর সুবোধের হাত। সন্তর্পণে একসময় সুবোধের হাত বুক থেকে নামিয়ে রেখে ঊর্মিলা নিজের বিছানায় চলে গেলো।

১৫
ভোর এই অঞ্চলে একটু আগেই হয় বুঝি। প্রয়োজনীয় জল বা প্রাতঃকৃত্যের জন্য এখানে একটা প্রতিযোগী মনোভাব সকলের মধ্যে ভোর থেকেই প্রকট। তা নিয়ে ঝগড়া, চীৎকার, শাপ শাপান্ত শুনে শুনে সুবোধ এতদিনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। প্রায়শই এই ধরণের কথাবার্তার দাপটে তার ঘুম ভাঙ্গে। কিন্তু আজ ঘুম ভাঙলও এক অদ্ভুত কান্নার আওয়াজে। বুঝতে তার বেশি দেরি হলও না যে ভোর হতে এখনও কিছুটা বাকি এবং কান্নার উৎস জাহানারা।

পাশাপাশি ঘর। জাহানারা কাঁদছে। হয়তো কমল ঘুমোচ্ছে। চাপা কান্না। যেন নিজের কান্না নিজে ছাড়া আর কেউ শুনতে না পায়। ঊর্মিলার কাছেও শুনেছে এরকম নাকি প্রায়শই হয় এবং সেটা ভোরবেলার দিকেই। কিন্তু কেন?

উত্তর কিছুটা জানে সেই ঊর্মিলাই। চাপা গলায় তাই মাঝে মাঝে নিজেই বকতে বকতে বলতে থাকে এ-সব।–হারামিটা মাইডারে শেষ না কইরা ছাড়তো না—শুনছি-তো কিছুদিন আগে একবার খালাসও করাইছে। হেই নিয়া এখন ভুগতাছে মাইয়াডা। মাইয়া মানুষের যন্ত্রণা ঐ হারামির পুতে কী বুঝবো। ভগবানের তো বিচার নাই—থাকলে ঐ হারামিটারে দেখে না ক্যান।

অভিসম্পাতের বয়ান ঊর্মিলার খুব যে জোরদার তা নয়। ফলে এই সব জাগতিক অনাচার, অবিচার দেখে সে শুধু এক তরফা দুঃখই পায়। তবে বোঝা যায় মনে মনে শিবানীকে সে খুব কাছে এনে ফেলেছে।

কমলের সঙ্গে সুবোধের দেখা বা কথা নাহলেও কমলের বাড়ি ফেরা সুবোধ প্রায় দিনই টের পায়। কমল ঘরে ফিরে মধ্য রাতে। সুবোধ টের পায় মধ্যরাতেও লোকের আনাগোনা।গায়ে গা লাগানো নিচু ঘর, কখনো কারো শরীরের সামান্য ধাক্কাতেই নড়ে উঠে। কমল ফিরতেই টের পায় দরজা খোলার শব্দ। বোঝা যায় জাহানারা ঠিক জেগে থাকে। দরজা খোলার পর শোনা যায় চাপা গলায় অস্পষ্ট দু’একটা কথা। ব্যাস, আবার চুপ। হঠাৎ-ই তার মাথায় ঢোকে এই ঘোমটা ঢাকা মেয়েটা, যে শিগগির বিক্রি হয়ে যাবে—আর এই কথা জানার পর তার এই দিন রাত্রির জীবনটা কী রকম ভাবে চলছে। সারাদিন একটা ঘরে আবদ্ধ থেকে বা কোনও কথা না বলে? দণ্ড কার্যকরের অপেক্ষায় থাকা আসামীর মতো কি? কিন্তু তার অপরাধ কী?

ভোরের দিকে আজ বস্তির কে যেন মারা গেছে।শোনা যাচ্ছে বিলাপ। শেষ রাতের দিকে সুবোধের চোখ কিছুটা জড়িয়ে এসেছিলো। ঊর্মিলার ডাকে ঘুম ভাঙলও।ঘুম থেকে উঠে তাকে শ্মশানে যেতে হলও।

সুবোধের ফিরতে সময় লাগছে। বাচ্চাদের একা ঘরে রেখে ঊর্মিলা যেতে চাইছে না। বড়টা ইদানীং একটু বারমুখী হয়েছে। সঙ্গী জুটেছে দেখি। ও থাকলে অন্তত বাইরে যাওয়ার কথা ঊর্মিলা ভাবতো। কিন্তু অনেক দেরি হচ্ছে দেখে একসময় ঊর্মিলা বাচ্চাদের একা রেখেই বেরিয়ে গেল। এরপর না গেলে আর দোকান করবে কখন। তবু যাওয়ার সময় একবার জাহানারার ঘরে উঁকি দিয়ে দেখলও জাহানারা চুপচাপ বসে আছে। আস্তে করে কাছে ডেকে বলে গেল যে একটু খেয়াল রাখে যেন—সুবোধ এসে পড়বে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই। জাহানারা ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালো। কমল ঘুমোবে এখনো অনেকক্ষণ।

১৬
বেশ বেলা করেই সুবোধ ফিরলও। ঘরে না ঢুকে একবারে সরকারী কুয়োর দিকেই গেল সে। ইচ্ছে একবারে স্নান করে ঘরে ঢোকা। কিন্তু বেলা দশটা নাগাদ কুয়ো ঘিরে হাটের মতো ভিড়। তাই সে পায়ে পায়ে মন্টুর চা’এর দোকানে গিয়ে এক কাপ চা নিয়ে বসলো। রোদ্দুর বেশ তাতিয়ে উঠেছে।

এটা কী মাস? সঙ্গে সঙ্গে মনে করতে পারলো না। তবু মনে হলও বর্ষা বুঝি শেষ হতে চলেছে। আকাশ দেখে ভেবে নিলো শরতের কোনও মাস। কাশফুলের সময়। নদীর চর জুড়ে দিগন্ত বিস্তৃত কাশফুল আর গ্রাম বাংলার মানুষের ম্লান মুখ। এ যেন তার আজন্ম চেনা। এ-সময় গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে অভাব আর অভাব। ফসল উঠতে আরও দেড় দু’মাস। দিন যেন আর ফুরোয় না কৃষকের। ক্ষেতে ধান আর পেটে খিদে নিয়েই তো তার জীবন।

অথচ এদিকের দৃশ্যপট একটু আলাদা। দ্রুত বদলানো দৃশ্যের মধ্যে কেটে গেছে প্রায় চার পাঁচ মাস। --কেমন আছো সুবোধ? ভেতর থেকে কেউ যেন নিঃশব্দে প্রশ্নটা করে। সুবোধ এখন আর জানে না কেমন আছো বলতে কী বোঝায়।

সুবোধ জানে না কিছুই। তার ভেতরে যে কী চলছে সে ব্যাখ্যা করতে পারে না নিজের কাছেই। আজকাল শুধু মনে হচ্ছে ঐ রাতে অরিন্দমের মুখোমুখি হওয়ার পর থেকে তার যেন আর কিছুই ঠিক নেই। হঠাৎ এই সামান্য ঘটনা তাকে এমন মোচড়াচ্ছে কেন সে কিছুই বুঝতে পারছে না।

এই অবস্থায় হঠাৎ করে তার মাথায় ধরা পড়ে জাহানারা। আর এক কাপ চা চেয়ে নিলো। মন্টু আড়চোখে একবার দেখে নিলো যে পরপর দু’কাপ চা ! বাইরে থেকে বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু একটা গা’ রি রি করা অনুভূতি হচ্ছে সুবোধের। মুখে থু থু জমে যাচ্ছে। জাহানারার পাশাপাশি মনে আসে কমল। কিন্তু সুবোধ স্থির চোখে যেন নিজেকেই দেখে। দেখে কেমন করে সব ভাবনার মধ্যে নিজেকে কেন্দ্রবিন্দু করে তোলার এক পরিত্রাণ-হীনতা তাকে ঘিরে ধরেছে। টের পায় চিন্তায় ও কাজে সে ক্রমশ: গোলমেলে হয়ে উঠছে। জট খুলে বেরোতে পারছে না কিছুতেই। দু’দিন আগেও রাতে হঠাৎ করে ঊর্মিলাকে জড়িয়ে ধরে চুপচাপ কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো, বলতে পারলো না কিছু। শুধু নীরবে চোখের জল ফেললো। ঊর্মিলাও যেন ছোঁড়াটার এই অস্বাভাবিক আচরণে কিছুটা স্তম্ভিত,উদ্বিগ্ন। বারবার জিজ্ঞেস করেও কান্না ছাড়া কোনও উত্তর পায়নি সে। ঊর্মিলা কিছুটা ভীতও।

অনেকক্ষণ সামনে চা’এ র খালি গ্লাস। অনেকটা দূরের কোনও অনির্দিষ্ট বস্তুর দিকে যেন তাকিয়ে আছে সুবোধ। মন্টু মাঝে একবার বললও—কি ,আর একটা চা দেব নাকি?

কসাইয়ের হাতে মুরগীর পাখা ঝাপটানোর আওয়াজ মাথায়। সুবোধ যেন নেহাত এক মানব শরীরের গা’এ দুটো দুর্বল পাখার অস্তিত্ব বোধ করতে থাকে। ক্রমশ: রক্ত আর কাদা লেগে তা ভারি হয়ে উঠছে। বুকের ভেতর ভীষণ জলতেষ্টা। কোথায় কী ছারখার হচ্ছে—তার ঘাত প্রতিঘাতে সে কেন ভাঙছে? আর এমন ভাবে ভাঙছে যে, সে যেন আর নিজেকে স্থির রাখতে পারছে না।

উঠে পড়ে সুবোধ। স্নান না করে, কুয়োর দিকে আর না গিয়ে সে ঘরে ফেরে। দোকানী মন্টু চা’এর পয়সা না পেয়ে সুবোধের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।

ঘরে বাচ্চাগুলো বাসি খাবার নিয়ে খাচ্ছে, খেলছে। মেঝে জুড়ে তার চিহ্ন ছড়ানো। ঊর্মিলা ঘরে ফেরেনি এখনো। বাচ্চারা তাই আপন মনেই আছে। সুবোধ ঘরে ঢুকে বাচ্চাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে গিয়েই থেমে গেল। দেখতে পেল ঘরের এককোণে জাহানারা বসে বসে ঘুমোচ্ছে। কমলের নিষেধ কি উঠে গেছে না ফাঁকি দিয়েছে, কে জানে?

কতো আর বয়স—এতাবৎ পৃথিবীতে কি তার শুধু ঘুমিয়ে পড়া আছে? স্বাস্থ্য বলতে যা বোঝায় তা তার নেই। পরনে ফ্যাকাসে জীর্ণ, আধ ময়লা কাপড়। কত-টাকায় বিক্রি হবে—টিকবে কতদিন? এই বালিকা সদৃশ শরীর কতদিন ওকে টানতে পারবে? শুধু গাছ হলেই-তো হয় না। ঝড়ের মুখে টিকতে পারা চাই।

হায় টিকে থাকা—আশ্চর্য! শুধু এই এক রত্তি শরীর—শরীরের ভাঁজ, গর্ত—এর বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় হয়ে যাবে! সমস্ত অস্তিত্বের উপর আছড়ে পড়বে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা এক জলপ্রপাত। হয়তো নিজে আর কোনোদিন টের পাবে না এক ভয়াবহ শব্দ-শাসন, যা তার বেঁচে থাকার বিনিময় মূল্য হিসেবে নিজেরই অভ্যন্তরে প্রবল বিক্রমে বয়ে যাবে। হয়তো কোনোদিনই আর মৃত বৃক্ষ টের পাবে না তার নিলাম-মূল্য, শুধু বিক্রি হতে থাকবে বারবার বারবার।

ঘুম ভাঙতেই বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো উঠে দাঁড়ালো জাহানারা। মুখোমুখি সুবোধ, দরজা জুড়ে দাঁড়িয়ে। বের হওয়ার জন্য—গা’ বাঁচিয়ে বের হওয়ার মতোও জায়গা নেই। মুখোমুখি দুজনেই— কিন্তু সম্বিৎ এ নেই যেন কেউ।

বেঁচে থাকা কোনও তোলপাড় করা কিছু নয়। বেঁচে থাকা বেঁচে থাকাই—যা জাহানারার আছে। খিদে পেলে যদি খাবার না পায়, যদি তার জন্য সঞ্চিত কোনও সামাজিক রেশন না থাকে,তবে খিদের আনুপাতিক হারেই তাকে নিজস্ব গতরের গর্ত ব্যবহার করে যেতে হবে। মরা যাবে না। সোমত্ত মেয়ে মরবে কি!! সমাজ তাই বলে—শরীর দিয়েই তো শরীর বাঁচে। শরীর ছাড়া আর আছেটা কী। মেয়ে মানুষ শরীর বোঝ না? এটাই তো বাঁচা—এটাই তো টিকে থাকা।

সুবোধ ঘরে না ঢুকে দ্রুত বেরিয়ে গেল। ফিরেও এলো দ্রুত। হাতে খাবারের ঠোঙা। ঘরের দুয়ারে এসে দেখে জাহানারা ঘরে নেই। কয়েক মুহূর্ত এদিক ওদিক দেখে যা সে কোনোদিন করেনি, তাই করে বসলো। এগিয়ে গিয়ে কমলের ঘরে উঁকি দিল। কমল তখনও ঘুমে। জাহানারা তার পাশে বসে আছে। সুবোধকে ঘরের দরজায় দেখে চমকে উঠলেও চোখ থেকে চোখ সরাতে পারলো না সে। কিন্তু সুবোধ আর না দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে ঘরে ফিরে আসলো। এসে খাবারের ঠোঙাটা বাচ্চাদের সামনে রেখে উঠে দাঁড়াতেই টের পেল পেছনে জাহানারা। দরজায় দাঁড়িয়ে। ঘর থেকে বের হতে গিয়ে আবার মুখোমুখি। যেন অতি চেনা। দৃষ্টি স্বাভাবিক। জাহানারাকে পাশ কাটিয়ে বাইরে যেতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো সুবোধ। ইশারা করলো জাহানারাকে ঘরে ভেতরে যেতে। ঘরের এককোণে দাঁড়িয়ে নিচু গলায় সুবোধ এক তরফা বলে গেল—রাত আটটা। জেলখানার ঘণ্টা শোনা যাবে। পেছন দিকের রেল গুমটি। আমি থাকবো ওখানে। চলে আসবে। ঠিক আটটা। এই বলে আর সুবোধ দাঁড়ায়নি। স্নান করতে বেরিয়ে গেল। কথার পিঠে কোনও কথা নেই। জাহানারা এক দৃষ্টে সুবোধের দিকে তাকিয়ে ছিল। সুবোধ বেরিয়ে যাওয়ার পর সেও দ্রুত ঘরে ফিরে এলো।
[চলবে]

আপনার মন্তব্য