নানা ও নাতির গল্প

 প্রকাশিত: ২০১৬-১০-৩১ ২১:২৮:১৭

ফরিদ আহমেদ:

এক তেজস্বী নানা আর তাঁর তেজোদৃপ্ত নাতির গল্প শোনাই।

এই নানার নাম দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়। ঢাকার বিক্রমপুরের মাগুরখণ্ড গ্রামে জন্মেছিলেন তিনি ১৮৪৪ সালে। আর নাতির নাম সুকুমার রায়। তাঁর জন্ম কোলকাতায় ১৮৮৭ সালে। দ্বারকানাথের প্রথম পক্ষের স্ত্রীর দুটো সন্তান ছিলো। একটা মেয়ে, নাম বিধুমুখী। অন্যটা ছেলে। তার নাম সতীশ। এই বিধুমুখীর বিয়ে হয় ময়মনসিংহের জমিদার উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর সাথে। আর তাঁরই গর্ভ থেকে জন্ম নেয় সুকুমার রায়।

এখন আমরা যেটাকে এসএসসি বলি, আগে সেটাকে ব্রিটিশ আমলে এন্ট্রান্স পরীক্ষা বলা হতো। দ্বারকানাথ এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পাশ করতে পারেন নি। কয়বার ফেল করেছিলেন, সে বিষয়ে অবশ্য তথ্যটা সঠিকভাবে জানা যায় না। যাই হোক, এন্ট্রান্স পরীক্ষায় ফেল করে গ্রাম ত্যাগ করেন তিনি। শিক্ষকতার চাকরি শুরু করেন ফরিদপুরের লোনসিং গ্রামে।

তাঁর সময়ে সমাজ মোটেও নারীবান্ধব ছিল না। পুরুষদের মধ্যে নারী-বিদ্বেষ এবং নারীদের হেয় চোখে দেখাটা ছিল খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। মেয়েদের অবস্থা সে সময় পশুর চেয়ে খুব একটা উন্নত কিছু ছিল না। দ্বারকানাথও বাল্য এবং কৈশোরে চাণক্য শ্লোক পাঠ করে প্রবলভাবে নারী-বিদ্বেষী হয়ে ওঠেন। কিন্তু, তাঁর এই নারী-বিদ্বেষ মানসিকতা হঠাৎ করে ধাক্কা খায় এক মর্মান্তিক ঘটনায়।

তখন তাঁর বয়স মাত্র সতেরো। তাঁদের গ্রামের পরিচিত এক কুলীন কন্যাকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করে তার আত্মীয়স্বজনরা। এর কারণ অনুসন্ধানে কৌতূহলী হন সদ্য তরুণ দ্বারকানাথ। এর অনুসন্ধানে নেমে তিনি অবাক হয়ে জানতে পারেন যে, এই কুলীন কন্যা হত্যা বিচ্ছিন্ন কিছু না। তাঁদের গ্রামেই বছরে বত্রিশ-তেত্রিশজন কুলীন কন্যাকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু, কলেরার আক্রমণে এরা মারা গিয়েছে, এই মিথ্যা বলে হত্যাকারীরা নিষ্কৃতি পেয়েছে। কুল হারানোর ভয়ে অকুলীন কারো কাছে কন্যা সম্প্রদান তখন করা হতো না। ফলে, বহু কুলীন কন্যাকেই অবিবাহিত জীবন যাপন করতে হতো, কিংবা বহু সতীনের সাথে সংসার করতে হতো। কাউকে কাউকে আবার অতি বৃদ্ধ কারো কাছেও সম্প্রদান করা হতো। এই মেয়েরাই বয়সের দোষে কলঙ্কময় পথে পা বাড়াতো। সামাজিক এই কলঙ্ককে ধামাচাপা দিতেই পরিবারের লোকেরা তাদের হত্যা করতো।

এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা এমনভাবে দ্বারকানাথের মনে দাগ কাটে যে, তিনি নারীদের দুঃখ, দুর্দশা দুর করার জন্য কঠিন ব্রত গ্রহণ করেন। সেই উদ্দেশ্যে নারীর কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে একটা পত্রিকা বের করেন। এর নাম‘অবলাবান্ধব’।

দ্বারকানাথের নিজের ভাষাতেই এই ঘটনা শুনি আমরা:

“এদেশীয় কুল কন্যাগণ জীবনে যে বিষম দুঃখ দুর্গতি ভোগ করিয়া থাকেন, তাহা যাহাদিগের চক্ষু আছে, তাঁহাদের অগোচরে নাই। কিন্তু যাঁহারা চক্ষু থাকিতে অন্ধ, তাঁহারা ইহা দেখিতে পান না। যদি একটি হৃদয় বিদারক ঘটনা আমাদিগের চক্ষু প্রস্ফুটিত না করিত, হয়ত আমরাও আজীবন অন্ধই থাকিতাম। একটি পরমা সুন্দরী যুবতী কুলীন কন্যাকে তাঁহার আত্মীয়েরা বিষ প্রয়োগ করিয়া হত্যা করেন। তখন আমাদিগের বয়স সপ্তদশ বর্ষ। লোক পরম্পরায় এই ঘটনা আমাদিগের শ্রুতিগোচর হইল। এইরূপে যাহার অপমৃত্যু ঘটিল, আমরা তাহাকে জানিতাম, সুতরাং আমাদিগের হৃদয়ে দারুণ আঘাত লাগিল। আমাদিগের জনৈক সমবয়স্ক ব্যক্তির নিকট শুনিতে পাইলাম, এরূপ ঘটনা বিরল নহে, প্রায় প্রতি বর্ষেই ঘটিয়া থাকে। অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইয়া জানিলাম, তাঁহার কথা সত্য; তৎপূর্ব্ব সপ্তদশ বৎসরে একটি গ্রাম হইতে ৩২/৩৩টি স্ত্রীলোকের এইরূপে মৃত্যু হইয়াছে। মানুষের হৃদয় এককালে পাষাণ না হইলে, এই অবস্থায় দ্রব না হইয়া পারে না। আমরা বাল্যকালে চাণক্য পণ্ডিতের শ্লোক সকল পাঠ করিয়া স্ত্রীজাতির ঘোরতর বিদ্বেষী হইয়া উঠিয়াছিলাম। তাহাদিগকে সর্ব্বদা বিদ্রূপ ও উপহাস করিতে আমাদিগের আমোদ বোধ হইত। কিন্তু, তখন বুঝিলাম, ইহারা উপহাসের পাত্র নহে, কৃপার সামগ্রী। এই সময় হইতে স্ত্রীজাতির প্রতি আমাদিগের মমতা জন্মিল। তখন ভাবিলাম, যদি বিন্দু পরিমাণেও ইহাদের দুঃখ দুর্গতি দূর করিতে পারি, জীবন সার্থক হইবে। এই অভিপ্রায়ে অবলাবান্ধবের জন্ম হয়।”

অবলাবান্ধব পত্রিকা প্রকাশিত হয় ফরিদপুর থেকে। তখন তাঁর বয়স পঁচিশ। কিন্তু, ফরিদপুরে যাবার আগেও কুলীন বিপন্ন নারীদের উদ্ধারকাজ শুরু করেন তিনি। তাঁর সাথে বিক্রমপুরের আরো কয়েকজন তরুণ এসে যোগ দেন। এঁরা হচ্ছেন সারদাকান্ত, বরদাকান্ত, নবকান্ত, শীলাকান্ত, নিশিকান্ত এবং অঘোরনাথ। এঁরা বিপন্ন কুলীন কন্যাদের উদ্ধার করে কোলকাতায় পাঠানোর ব্যবস্থা করতেন। সেখানে সেই সব কন্যাদের সুপাত্রে অর্পণের ব্যবস্থা করতো অন্য একটা দল। এগুলো করতে গিয়ে এঁরা বহুবারই নিজেদের জীবন বিপন্ন করেছেন, কেউ কেউ পুলিশের হাতে ধরা পড়েছেন নারী অপহরণের মামলা হবার কারণে।

‘অবলাবান্ধব’এক পাক্ষিক পত্রিকা ছিল। এই পত্রিকায় নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার জন্য দ্বারকানাথ অনল বর্ষণ করতে লাগলেন। ফরিদপুরের মতো প্রত্যন্ত একটা শহর থেকে প্রকাশিত পত্রিকার আগুনের তাপ গিয়ে লাগলো কোলকাতা এবং ঢাকার মতো বড় শহরের তরুণ ছাত্রদের গায়ে।‘অবলাবান্ধব’দিয়ে দারুণভাবে আন্দোলিত হলো তারা। কোলকাতা থেকে সংস্কৃত কলেজের ছাত্র শিবনাথ ভট্টাচার্য (ইনিই পরে পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী হয়েছিলেন) ও উমেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় (ইনি পরে লেফটেন্যান্ট উমেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় হয়েছিলেন) দ্বারকানাথকে কোলকাতায় আসার জন্য চিঠির পর চিঠি লিখতে থাকলেন। যে উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য দ্বারকানাথ লড়ছেন, তা কোলকাতা থেকে করলে আরো অনুকূল হবে, এটাই ছিল তাঁদের বক্তব্য। তাঁদের অনুরোধে ১৮৭০ সালের এক বর্ষাকালে ফরিদপুর থেকে কোলকাতায় এসে হাজির হন দ্বারকানাথ।

দ্বারকানাথের এই কোলকাতা আগমন সম্পর্কে পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন:

“একদিন কলেজে পড়িতেছি, এমন সময় উমেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় আসিয়া আমাকে বলিল, “ওরে ভাই অবলা-বান্ধবের এডিটর কলিকাতায় এসেছে, আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এখানে এসেছে। অমনি আমাদের‘হিরো’কে দেখিবার জন্য বাহির হইলাম। গিয়া দেখি এক দীর্ঘাকৃতি একহারা পুরুষ, স্কুল মাস্টারের মত লম্বা চাপকান পরা, দাঁড়াইয়া আছে। তিনিই দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় …….. কিছুদিন পরেই তিনি অবলাবান্ধব লইয়া কলিকাতায় আসিলেন এবং পূর্ববঙ্গের যুবকদিগের নেতা স্বরূপ হইয়া ব্রাহ্মসমাজে স্ত্রী স্বাধীনতার পতাকা উড্ডীন করিলেন।”

দ্বারকানাথ কোলকাতায় একটু স্থির হয়ে বসেই দুর্গামোহন দাস, অন্নদাচরণ খাস্তগির, গুরুচরণ মহলানবিশ, ব্যারিস্টার মনোমোহন ঘোষদের মতো ব্রাহ্ম প্রগতিবাদীদের সহায়তায় অত্যন্ত শক্তিশালী একটা সংঘ গঠন করলেন। এই সংঘের মাধ্যমে ‘অবলাবান্ধব’ পরিচালনা শুরু করলেন। সেই সাথে নানা ধরনের কার্যকলাপ শুরু করলেন যা নারীদের জন্য মঙ্গলকর।

দ্বারকানাথের সাহস আর তেজস্বিতার গল্প ছিলো সেকালে সুবিদিত। বিশেষ করে মেয়েদের সম্পর্কে কেউ বাজে কিছু বললে তার টুটি চেপে ধরতেন তিনি আগুপিছু কোনো কিছু চিন্তা না করেই। একবার একটা সাম্প্রদায়িক পত্রিকা প্রগতিশীল মেয়েদের সম্বন্ধে খুব অপমানজনক মন্তব্য করে। এই মন্তব্য দেখে ক্রুদ্ধ হন তিনি। লেখাটার কাটিং নিয়ে সোজা পত্রিকা অফিসে গিয়ে হাজির হন তিনি। সম্পাদককে খুঁজে বের করেন তিনি। একরোখা এবং জেদি দ্বারকানাথকে দেখেই সম্পাদক বেচারা ভয়ে কম্পমান হয়ে ছিলো। সেই ভীত সন্ত্রস্ত সম্পাদককে লেখার কাটিং জল দিয়ে গিলে খেতে বাধ্য করেন তিনি।

এরকম লোকের নাতিও যে জেদি এবং একরোখা হবে, সে বিষয়ে খুব বেশি সন্দেহ থাকার কথা না। আমরা সুকুমার রায়ের শুধু হাস্য রসাত্মক রূপটাই দেখেছি। কিন্তু, এর আড়ালে যে প্রচণ্ড রকমের তেজস্বী একজন মানুষ ছিলো, তার খবর আমরা অনেকেই রাখি না। সুকুমার রায়ের এক তরুণ সহযোগীর ভাষায়: ‘সব সময় তিনি যে মজার কথা বলতেন, তা নয়; কথাও কোনো অন্যায়ের রেশ দেখলেই তিনি উত্তেজিত হয়ে পড়তেন। অন্যায় সহ্য করা তাঁর ধাতে ছিল না।’

সুকুমার রায় ছাত্রদের জন্য প্রকাশিত মিশনারিদের একটা পত্রিকা নিতেন। সেই পত্রিকায় শিক্ষিত মেয়েদের অপমান করে একটা চিঠি ছাপা হয়। সেটা পড়েই পত্রিকা হাতে নিয়ে পত্রিকা অফিসের দিকে রওনা দিলেন সুকুমার রায়। এ বিষয়ে তাঁর বোন পুন্যলতা চক্রবর্তী তাঁর স্মৃতিকথা ‘ছেলেবেলার দিনগুলিতে লিখেছেন,

“সকালে সেটা পড়েই দাদা কাগজখানা হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেল। প্রথমে কাগজের আপিসে গিয়ে পত্রলেখকের ঠিকানা নিয়ে তার বাড়িতে গেল। সে ছেলে স্বীকার করল যে সে ওইরকম লিখেছিল এবং সমস্ত কথা প্রত্যাহার করে ক্ষমা চেয়ে একখানা চিঠি তখনই লিখে দিল। সেই চিঠি নিয়ে দাদা সম্পাদক পাদ্রীসাহেবের কাছে গেল, তাকে কাগজখানা দেখিয়ে বলল, আপনাদের কাগজে এরকম লেখান বড়ই দুঃখের এবং লজ্জার কথা। সাহেব ভারি অপ্রস্তুত হয়ে বললেন যে তিনি ক’দিন কলকাতায় ছিলেন না, তাতেই এরকম হতে পেরেছে। তিনি দেখলে কখনই এরকম অভদ্র চিঠি ছাপতে দিতেন না, এখনই তিনি এর প্রতিবিধান করবেন (পরদিনই ঐ কাগজে সেও লোকটির ক্ষমা চেয়ে লেখা চিঠিটা ছাপা হয়েছিল, তার সঙ্গে সম্পাদকও ত্রুটি স্বীকার করে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন।) এত ঘুরে রোদে তেতে পুড়ে অনেক বেলায় যখন দাদা বাড়ি ফিরল, দাদামশাই (নবদ্বীপচন্দ্র দাস) সব শুনে তাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “হ্যাঁ, দ্বারিক গাঙ্গুলির উপযুক্ত নাতি বটে।”

আপনার মন্তব্য