লোকলজ্জা অথবা বিচার

 প্রকাশিত: ২০১৬-১১-০২ ০০:১৯:০৭

আজমিনা আফরিন তোড়া:

সানজিদা চুপচাপ চেয়ারে বসে আছে। তার মুখোমুখি চেয়ারে একজন পুলিশ বসা। পুলিশ লোকটার পদবী কি, তার জানা নেই। জানার অবশ্য প্রয়োজনও নেই। আশেপাশের পরিবেশ তার গায়ে আজ খুব একটা লাগছেনা। লোকটা তার দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।অবশ্য ঘটনার বিবরণ শুনলে যে কেউ এভাবেই তাকাবে! লোকটা বুঝতে পারছে না তার কি করা উচিৎ, তাই উচ্চপদস্থ কারো জন্য অপেক্ষা করছে। লোকটার কিংকর্তব্যবিমূঢ় চেহারা দেখার মত হয়ে আছে। পাশের চেয়ারে মা বসা।তার নাক-চোখ দিয়ে অনর্গল পানি ঝরছে। সানজিদা মার এত কান্নাকাটির কারণ খুঁজে পাচ্ছে না। ভেঙে পড়ার কথা তার নিজের, অথচ সে দিব্যি মন শক্ত করে বসে আছে দীর্ঘ সাত মাস!

মার পাশে বসে আছেন ড কামরুজ্জামান শিকদার। নাম করা বিজ্ঞানী ও প্রফেসর। শহরে সবাই এক নামে চেনে। উনি একটু পরপরই কাকে যেন খুঁজছেন। বার বার ফোনে সম্ভবত বড় কোন পুলিশ কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করছেন। যত দ্রুত সম্ভব থানার ঝামেলা শেষ করার চেষ্টায় আছেন তিনি। কিন্তু এত সাত সকালে বড় কর্মকর্তা কোথায় পাবেন? সরকারী চাকুরী বলে কথা! বড় বাবুরা বেলা এগারটা-বারোটায় আসবেন হেলতে-দুলতে। চাইলেই তাদের এখন পাওয়া যাবে না।

শিকদার সাহেবের পুনঃ পুনঃ ব্যর্থ চেষ্টা দেখে এই পরিস্থিতিতেও সানজিদার হঠাৎ ভীষণ হাসি পাচ্ছে। আহা, তার পাপ ঢাকার কতই নয়া চেষ্টা! সানজিদা হাসি চেপে রাখে, পাছে শিকদার সাহেব রেগে যান!ওহ, পরিচয়ই দেয়া হয়নি। কামরুজ্জামান শিকদার সানজিদার বাবা হন। শুধু বাবা বললে ভুল হবে। সানজিদার জীবনের আইডল, তার জীবনের প্রথম নায়ক। ওর জীবনে বাবার মত সুপুরুষ সে খুব কমই দেখেছে। যেমন রাশভারী লোক, তেমনি তার ব্যক্তিত্ব!যার ব্যক্তিত্ব দেখলেই সম্মান করতে ইচ্ছে করে।
এমন একটা মানুষকে তার জেল হাজতের এই পরিস্থিতিতে দেখে বেশ খারাপ লাগছে। এই শেষ মুহূর্তে এসে তার কিছুটা মায়া জন্মাচ্ছে লোকটার জন্য।

“আর কত কাঁদবে? এই সব মেয়েলি কান্না আর ভাল্লাগে না, ছাই! কান্নাকাটির কি আছে? আরে মানুষেরই তো ভুল হয়! এবার একটু থামবে, প্লিজ?”-শিকদার সাহেবের ধমকে সানজিদার ঘোর ভাঙে।

-“ওসি সাহেব কখন আসবে, বলতে পারেন?”

-“আরে বসেন তো! কি এত ঝামেলা করছেন বার বার? দেখছেন তো, শুধু আপনারা না, আরো কত কত লোক ওসি সাহেবের জন্য অপেক্ষা করছে!ওসি আসলে তো নিজেই দেখতে পাবেন, বার বার ফোন করে আর এখানে খোঁজ নিয়ে লাভ কি? যান, জায়গায় বসেন।”

শিকদার সাহেবও বোঝেন, বিপদে পড়লে সামান্য কনস্টেবলও কত কথা শোনায়!

ছোটবেলায় একটা সময় সানজিদার খুব শখ ছিল জেল-হাজতে একটা রাত থাকার। ছোটবেলার ঐ সময়টা কেটেছে হুমায়ূন আহমেদের হিমু চরিত্র পড়ে পড়ে। হিমু জেলখানার এত ইন্টারেস্টিং অভিজ্ঞতা বলত যে একসময় তার মনে হত জীবনে একবার যে হাজত খাটেনি তার জীবন বৃথা। আজ যা দেখছে সে আশেপাশে, তাতে তার হাজত সম্পর্কে রাজ্যের শখ নিমেষে উধাও হয়ে গেল। আশে পাশে মলমূত্রের যে পরিমাণ বাজে গন্ধ তাতে যে কোন সুস্থ মানুষের ডাইরিয়া বেঁধে যাবে। একটা ঘর থেকে বাঁচার আকুতি দেয়ালে বাড়ি খাচ্ছে। কোন আসামীকে বেদম পেটানো হচ্ছে, তার গলা দিয়ে কাটা গরু ছাগলের মত গোঙানির শব্দ আসছে! তাদের পাশে একটা টেবিলে একটা মেয়েকে জেরা করা হচ্ছে। খানিকক্ষণ কান পেতে যা বোঝা গেল, রেপ কেস। মেয়েটাকে যে কি আজে বাজে আর অযাচিত প্রশ্ন করা হচ্ছে, শুনেই রাগ লাগছে!

“আপনার শরীরের কোথায় কোথায় ক্ষত চিহ্ন আছে? কত সময় ধরে ধরে আপনাকে তারা ধর্ষণ করল? আপনার কি নিজের কোন ইচ্ছেই ছিল না? প্রথম বারেই ই কি.........? ”

“খানিক বাদে আমাকেও এইসব প্রশ্ন করা হবে!”-ভেবে কান্না চেপে রাখতে পারেনা সানজিদা। চোখের সামনে দুনিয়া ঝাপসা হয়ে দুলোতে থাকে। তারপর ওর আর কিছু মনে নেই।

কতক্ষণ পর চোখ খুলল মনে নেই। হঠাৎ মাথার দিকটা থেকে খুব চেনা একটা গলার স্বর ভেসে আসে। মাথায় চাপা ব্যথায় মাথা ঘুরিয়ে দেখতে কষ্ট হয় কিন্তু তারপর যা দেখে তা তে তার আরেক বার জ্ঞান হারানোর উপক্রম।

শিকদার সাহেবের পাশে অভি বসা। খুব নিবিড়ে শিকদার সাহেব তাকে কি কি যেন বলছেন। নিচু গলার কথা শোনা দায় কিন্তু তাও যা অল্প বাতাসে ভেসে আসে- সানজিদার বুঝতে বাকি থাকে না শিকদার সাহেব অভির উপর ওর ভার চাপাতে চাইছেন।

ইশ, এই অভি তার অভি। কত কত রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা তার অভির সাথে। ভালোবাসতে হলে অভির মত করেই বাসা উচিৎ।

ওর সাথে প্রথম পরিচয়টা খুব সাধারণ ছিল। কিন্তু প্রথম পরিচয়েই অভির কি যেন একটা ব্যাপার ওকে খুব করে নাড়া দেয়। মনে আছে, সেদিন সেই আড্ডা থেকে উঠতেই মন চাইছিল না। পরে অবশ্য বুঝেছে অভির জোরালো ব্যক্তিত্বই তাকে ওখানে আটকে রেখেছিল। প্রেমটা খুব অদ্ভুত ওদের। কখনো বলা হয় নি ‘ভালোবাসি’। একদিন হঠাৎ রিক্সায় বসে কি মনে করে যেন হাত ধরা! ওই থেকেই শুরু। প্রেম নিবেদন করার মত কাঙ্ক্ষিত আনুষ্ঠানিকতার প্রয়োজন পড়েনি ওদের। জীবনে এমন স্বপ্নবাজ একটা মানুষই চেয়েছিল ও। কিন্তু অভি ওকে নিয়ে খুশী কি না কখনো জিজ্ঞেস করা হয় নি। ভালোবাসা-বাসিতে বোধ হয় এসব জিজ্ঞেস করতে নেই।

বাড়িতে আঁচ করত সানজিদার সম্পর্কের কথা। কিন্তু কেউ মুখ খুলে কিছু বলত না। শিকদার সাহেব গোপনে গোপনে ছেলে দেখতেন। অথচ আজ সাত মাসের একটা পাপ লুকাতে গিয়ে সেই অভিকেই বাবা ডেকে এনেছে! বাহ, লোকটা পারেও বটে।

অভি ঘটনাগুলো কিছু কিছু জানে। প্রতি রাতে যখন সানজিদা বাবার জোর জবরদস্তির সাথে পেরে উঠত না, মাঝে মাঝে নিজেকে ধরে রাখতে পারত না, সকালের অপেক্ষা করত। অভির সামনে নিজেকে ধরে রাখার প্রয়োজনবোধ করত না ও। নিজের বাবা, তাই সবটা খুলেও বলতে পারত না। অভিও ওর কষ্টটা বুঝে জোর করতে পারত না। একবার খুব রাগ করে বলল, “চল, আন্টিকে জানাই। এখনই জানানো দরকার!”

কিন্তু সানজিদা জানত মা বাবার ব্যাপারে এসব কখনোই বিশ্বাস করবে না। মা ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমান। সেই সুযোগে বাবা বার গত আট বছর ধরে প্রতি রাতে সানজিদার ঘরে আসে। শরীরে হাত দেয় বিশ্রীভাবে আদর করতে চায়। সানজিদা যতই বাবাকে বোঝায়, সে ততই হিংস্র হতে থাকে।

পরদিন সকালে আবার সেই দায়িত্ববান বাবা। প্রথম প্রথম খুব অবাক লাগত সানজিদার। এক সময় সানজিদা অনেক বুঝিয়েছে, “বাবা, চল তোমাকে মানসিক ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই”। কিন্তু কে শোনে কার কথা?

এক সময় সহ্য করতে না পেরে অভি বলেছিল, “চল বিয়ে করি!”

কিন্তু সানজিদা ভালোই জানত সে অভিকে বিয়ে করে চলে গেলে মান সম্মানের ভয়ে বাবা তাকে কবর খুঁড়ে হলেও বের করবে। এক সময় অভির জীবনে ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ নেই ভেবে দূরত্ব তৈরি করেছে। সেই অভির সাথে দূরত্ব যার সাথে মুহূর্ত যোগাযোগ না করতে পারলে ওর ছটফট লাগত!

আজ আবার সেই লোক-লজ্জার ভয়েই শিকদার সাহেব তাকে অভির কাছে দিয়ে দিতে চাইছে। হ্যাঁ, শিকদার সাহেব। এই লোকটাকে অন্তত বাবা বলা যায় না! আজ সানজিদা সাত মাসের গর্ভবতী।

“আচ্ছা, কেউ কি বিশ্বাস করবে যে এই সন্তান কামরুজ্জামান শিকদারের?”- উত্তর পায় না সানজিদা।

ঘোর ভাঙে অভির মৃদু কণ্ঠে, “আমি সানজিদাকে ওর এই বাচ্চা সহ সর্ব অবস্থায় নিতে রাজি। আমি ওর দায়িত্ব নিতে চাই। আর সেটা আজ এবং এখনই!”

সানজিদা খুবই অবাক হল। কেউ এখানে তার প্রতি দীর্ঘ আট বছরের নির্যাতনের বিচার চাইছে না। এমন কি মাও না! সবাই লোকলজ্জার ভয় পাচ্ছে। শিকদার সাহেবের নামে একটা কেস পর্যন্ত হল না। উপর দিয়ে সবাই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল সানজিদার এখন কি গতি হবে তার! কেউ একটা বার তাকে জিজ্ঞেস করল না সে কি চায়! সে তো থানা পর্যন্ত এসেছিল বাবা নামের কুকুরটার বিচার চাইতে।

অথচ ওসি পর্যন্ত তাকে বুঝিয়ে বলল, “মা রে, পরিবারের ব্যাপার। এসব বাইরে যেতে দিতে নেই। কি আর করা। ভুল হয়ে গেছে তোমার বাবার! মেনে নাও। তোমারই তো বাবা!”

গত সাত মাসে সানজিদা কাঁদে নি, কাঁদতে পারেনি।

আজ তার আর কোনও বাঁধা নেই! পৃথিবীর উপর আজ তার কোন ঘৃণা নেই, লজ্জা নেই, নেই অভিমান। ভালোবাসার মানুষটার কাছে সারা জীবন ছোট হয়ে থাকতে হবে? এও কি মানা সম্ভব সানজিদার পক্ষে?

চোখের কোণা বেয়ে এক বিন্দু পানি গড়িয়ে পড়ে। মেয়েরা জীবনে বড় কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে কেঁদে নেয়...

আপনার মন্তব্য