বর্গমাইলের পদাতিক : ২০-২১

 প্রকাশিত: ২০১৬-১১-০২ ১০:২০:২১

রাজা সরকার:

ব র্গ মা ই লে র প দা তি ক
২০
ঊর্মিলার গ্রেফতারের খবর স্থানীয় পত্রিকায় আগেই বেরিয়েছিল। এবার বেরোল গল্প। বস্তির অবৈধ কাজ-কারবার নিয়ে। বেশ সরস, রগরগে। গল্পের কেন্দ্র বিন্দু ঊর্মিলা। ব্যবসাটা তার তেলে ভাজা না অন্য কিছু? পার্শ্বচরিত্রে আরও অনেকে। সুবোধ, কমল, জাহানারা ওরফে শিবানী তো আছেই।

ব্যাস, ওতেই কাজ হয়েছে। মহিলা সংগঠনের মধ্যে শুরু হয়েছে টানা পোড়েন। কেউ বলছে—মানে কী, এভাবে একটা নিষিদ্ধ পল্লী গজিয়ে উঠবে চোখের সামনে—আর আমরা বসে বসে সহ্য করবো? কেউ বলছে—আরে না না, কাগজ একটু বাড়িয়ে বলছে। বস্তি মানেই নিষিদ্ধ পল্লী নয়। হতে পারে, সেখানে কিছু অবৈধ কাজ কম্ম হয়, তাই বলে এতটা ভাবার বা উত্তেজিত হবার মত কিছু নেই। কেউ বলছে—আসলে এই বস্তিগুলো সব বিহারী আর বাংলাদেশীদের ঘাঁটি। ক্রাইম করাটাই ওদের পেশা। রাজ্যটাকে এরা সব মিলে শেষ করছে। নেতা পুলিশ ফিট। না হলে কবেই-তো শালাদের গুলি করে মারার কথা।

মহিলা সংগঠন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাদের কর্মসূচি স্থগিতও রাখল। এর মধ্যে সুযোগ বুঝে পুলিশ একদিন অনেকগুলো দোকান ভাঙল। মদের বোতল ভাঙল। তাতে জায়গাটা অনেকক্ষণ দেশি মদের গন্ধে আমোদিত হয়ে থাকল। দূর থেকে, আড়াল আবডাল থেকে কেউ কেউ দেখল আর নিজের কপাল চাপড়ালও। কিন্তু কোন ক্ষোভ দানা বাঁধলও না।

জীবিকা আইনি হউক আর বেআইনি হউক, তা বেশি দিন স্থগিত থাকতে পারে না। একটু একটু করে আবার দোকানও খুলতে হলো। সময়ের নিয়মে পরিস্থিতি একসময় কিছুটা শান্ত হয়ে এলো। সন্ধের পর ধীরে ধীরে সতর্কতার সঙ্গে মদ বিক্রিও শুরু হলো।
এরমধ্যে একদিন সমীর, মানস, অরিন্দমরাও এলো। কিছু কিছু খবর বৃত্তান্ত শুনে নিজেরাও খুব মানবিক মতামত দিল। দোষারোপ করলো মিডিয়ার প্রতি। প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে যারপরনাই বিরক্তি প্রকাশ করলো। তবে এর মধ্যেই যতটা সম্ভব দ্রুত কিছুটা পান করে নিলো। দেবেনের কথা অনুযায়ী বুঝলো আবহাওয়া ভাল নয়। তাড়াতাড়ি করাই ভাল। ধরা পড়লে পরিণতি যাই হউক বদনাম হবে খুব। আর একবার বদনাম হলে তা মুছে ফেলা খুব মুস্কিল।

বস্তির কেউ পুলিশে ধরা পড়লে সাধারণত বস্তির লোক খুব বেশি মাথা ঘামায় না। এটা তাদের জীবন যাপনের অঙ্গ হিসবেই দেখা হয়। বিশেষ কোন ক্রিমিনাল না হলে পুলিশও জানে কেস দিয়ে খুব একটা কিছু হয় না। মাঝ খানে হয়রানি হয় নিজেদের। তাই স্থানীয় বন্দোবস্তে এক কি দু’দিনের মধ্যেই ছাড়া পেয়ে যায়। স্থানীয় বন্দোবস্ত মানে ঘুষের কথা, মুখ ফুটে কেউ যেমন বলে না, তেমনি পুলিশের বিরুদ্ধেও কারোর বিশেষ রা নেই। কিন্তু ঊর্মিলার ক্ষেত্রে ঘটনা একটু অন্য রকম হয়ে গেলো।

বস্তির সবাই মনে করে ঊর্মিলা নির্দোষ,স্বামী পরিত্যক্তা, নিরুপায় একজন মহিলা। সে অসৎ নয়। সে অপরাধীও নয়। কার বউ নিয়ে কে পালাবে তার দায় ঊর্মিলার ঘাড়ে কেন আসবে? তার দায় চাপিয়ে তাকে হেনস্থা করাটা ঘোরতর অন্যায়। বিশেষত বস্তির মহিলারা এই ব্যাপারে মুক্ত-কণ্ঠ। তার মধ্যে পারুল, যে ঊর্মিলার অসহায় সন্তানদের সেদিন থেকে আগলে রেখেছে, সে একজন প্রথম সারির প্রতিবাদী। তারা এরমধ্যে একদিন থানায় গিয়ে ঊর্মিলার সঙ্গে দেখা করে এসেছে। তাকে দু’ একটা কাপড় চোপড় দিয়ে এসেছে। চেয়েছিল কিছু খাবার কিনে দিতে, কিন্তু পুলিশ বারণ করেছে। বলেছে নিয়ম নেই। খাবার এখান থেকেই দেয়া হয়।

কথা বলে এসেছে বড় বাবুর সঙ্গে। বড়বাবু বলেছে—আমার কিছু করার নেই রে, বুঝিসই-তো উপরের ব্যাপার স্যাপার। পারুলরা জানে—এগুলা সব মিছা কথা—বড়বাবুর লব্জ কথা। কিন্তু তবু পারুলরা বড়বাবুকেই মিনতি করে বলেছে—ছ্যার, জানেনই-তো আমরা গরীব মানুষ—বাবুদের বাড়িতে ঝি-গিরি করে খাই—এখন ঊর্মিলার ছানাপোনাদেরও তো রাখতে হচ্ছে, খাওয়াতে হচ্ছে—আমরার আর কী করার আছে—আপনি দয়া করেন ছ্যার। বড়বাবু বললেন—ঠিক আছে দয়া করব, কিন্তু তার আগে সুবোধ নামের ছেলেটিকে ধরে নিয়ে আয়। না পারিস-তো বল কোথায় আছে ঐ মেয়েটাকে নিয়ে--। বড়বাবুর কথা শুনে পারুলরা সবাই প্রায় সমস্বরে বলে উঠল—তারে আমরা কই পাব ছ্যার—আমরার উপর এই দায় দিয়েন না ছ্যার--।

বড়বাবু মিটি মিটি হেসে এবার বললেন—আচ্ছা, ঠিক আছে, তাহলে বল অন্যের বউ নিয়ে পালানো কাজটা খুব খারাপ না, না? পারুল একটু সাহস পেয়ে আবার বলতে শুরু করল—খারাপ হইব না ক্যান ছ্যার, খারাপ কাজই-তো—কিন্তু, মাফ করবেন ছ্যার, কার বউ এর কথা কইলেন বুঝলাম না। বড়বাবু খুব ঠাণ্ডা গলায় বললেন—কেন কমলের বউ, চিনিস-না মনে হচ্ছে। মাফ করবেন ছ্যার, চিনব না ক্যান, তয় ঐ মাইয়া কমলের বউ কিনা আমরা কিন্তু জানি না। বড়বাবু এই কথা শুনে চোখ বড় করে তাকালেন, বললেন—কস কি রে! বউ না-তো কী?এক ঘরেই-তো থাকতো শুনেছি। পারুলের দলের সবাই মুখে কাপড় দিয়ে খুক খুক করে হাসলো। তারমধ্যেই পারুল বলল—ছ্যার ছুটু মুখে বড় কথা হইয়া যাইব—অপরাধ নিয়েন না—কমলের এরকম বউ আগেও ছিল—কী জানি কী হয়—পরে আর থাকে না—এরেও এভাবেই নিয়া আসে—শুনছি-ত মাইয়া বাংলাদেশের—আমরা গরীব মানুষ এত-শত খোঁজও করিনা, জানিও না ছ্যার।

পারুলদের চার পাঁচ জনের দলটি বড়বাবুর ঘরে মাটিতে বসে আছে। বড়বাবু একমনে কাজ করে যাচ্ছেন। মাঝে মাঝে ওদের কথায় মিটি মিটি হাসছেন আর ফোঁড়ন কাটছেন। এবার বললেন—হ্যারে, ঐ দিন তোরা নাকি পুলিশদের গালি দিছস--। পারুল চমকে গিয়ে বলে—ছ্যার, মিছা কথা কমু না। গরীব মুখ্যু মানুষ আমরা—ঐ দিন কী বলছি না বলছি, মাথার ঠিক ছিল না— আপনার পা’য় ধরি ছ্যার—হের সোয়ামী থাকতেও নাই, আর বাচ্চাগুলানের কান্দনে আমরার মাথার ঠিক ছিল না—ভুল কইরা ফালাইছি—মাফ কইরা দ্যান ছ্যার—ঊর্মিলারে ছাইরা দ্যান—

বড়বাবু ফাইল গুছিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন—যা এখন, কালকে কোর্টে আসিস—দেখি কী করা যায়। একজন কনস্টেবলকে ডেকে বললেন—এই প্রহ্লাদ, এদের জলধরের দোকান থেকে চা বিস্কুট দিতে বলতো। তোরা এখন ওঠ।

পারুলরা বড়বাবুর ব্যবহারে অবাক। তারা চটপট উঠে পড়লো। থানা চৌহদ্দির এক কোণে জলধরের দোকানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চা বিস্কুট খেলো। চলে যাওয়ার আগে কনস্টেবলকে একবার অনুরোধ করে ঊর্মিলার সঙ্গে দেখা করেও গেল।

২১
এক সময়ে শোনা যেত নদী-তীরগুলোই ছিল মানুষের আবাস স্থল হিসেবে প্রথম পছন্দের।জীবন, জীবনের সম্পদ তৈরি করার জন্য নদী-তীর থেকেই মানুষের যাত্রা শুরু হতো। কিন্তু আজ বুঝি এই চিত্রটা বদলে গেছে। নদীর জায়গা নিয়েছে রেল লাইন। সেই মানুষের জায়গা নিয়েছে এক নতুন প্রান্তিক মানুষ। রেল লাইনের ধারে ধারেই আজ গড়ে উঠেছে সেই প্রান্তিক মানুষের জীবন। নির্মিয়মান এই জীবনে টিকে থাকার জন্য দরকার শুধু শরীর। অথচ শরীর এক ভঙ্গুর জিনিস। ভাঙা, খোঁড়া, মালিন্য তার আবহমানের সঙ্গী। তবু শরীরময়তা দিয়েই শরীরের ঘাটতি পুষিয়ে দিতে হয় এখানে। এখানে অন্য কিছু কাজে আসে না। সুবোধ ক্রমশঃ চিনে ফেলছে এই শরীরের জাত।

শহরতলী বুঝি এটাকেই বলে ! না, শহরের তলা ! জাহানারার কাছে কথাটাও নতুন, জায়গাটাও নতুন। ঘরের দরজা খুললেই পাশাপাশি অনেক ক’টা রেল লাইন। অনবরত রেলগাড়ি যাচ্ছে আর আসছে। লোকে গিজগিজ করা কামরা। এত মানুষ কোথায় যায় ! কিন্তু এ-সবই নতুন আর ভয়াবহ তার কাছে। অবাক হওয়ার চেয়ে সে ভয়ই বেশি পায়। একটানা অনেকদিন নতুন আর ভয়াবহতার চাপে জাহানারা এখন আর কোনো কিছুকেই সহজে মেনে নিতে চায় না। সুবোধ লক্ষ্য করে যে পৃথিবীর সব ভয় যেন জাহানারার দিকে তাকিয়ে আছে। অন্তত তার চোখ দেখে সুবোধের তাই মনে হয়।

বর্ডার পেরিয়ে এপারে ঢোকার পর সুবোধ একবার তার টাকার হিসেব করেছিল। তারপর আর করে নি। ঊর্মিলার ওখানে কিছু খরচ করার পর যা ছিল তা একটা খামের মধ্যেই এতদিন ছিল। এবার খরচ করতে করতে একদিন ভাবলো যে গুনে দেখে টাকাটা। মাসিক পঞ্চাশ টাকা ভাড়ায় ঘরটা নেয়ার পর আজই তারা দু’জনে মিলে সামান্য কিছু বিছানাপত্র, থালা বাসন, একটা কেরোসিন স্টোভ ও আরো কয়েকটা টুকিটাকি জিনিস কেনার জন্য যাবে বলে স্থির করেছিলো। কিন্তু জাহানারার পক্ষে বাজারে যাওয়া অসম্ভব মনে হলো। তার পরনে সেই থেকে একখানি-ই কাপড়, যার অবস্থা এখন খুব খারাপ। ঘাম-চিটে ব্লাউজও তার আর গা’এ নেই। ঘরের কোণে ফেলে রাখা হয়েছে। কাপড়টাই কোনোমতে গা’এ জড়ানো। অগত্যা সুবোধ একাই গেল। বালিগঞ্জ স্টেশনের ওপাশ থেকে সে কেনা কাটা করলো। তার মধ্যে জাহানারার জন্য দুটো অল্প দামের শাড়ি,দুটো ব্লাউজ ও সায়া কিনলো। জীবনে প্রথম মেয়েদের পরিধেয় বস্ত্রাদি কিনতে কিনতে সুবোধের এক অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিলো। অনর্থক মনে একটা খুশির ভাবও তৈরি হলো কেন কে জানে। ঘরে ফিরে সমস্ত জিনিস নামাতে নামাতে জাহানারাকে বললো—এখুনি শাড়িটা পালটে নতুন শাড়িটা পরে ফেল। একসাথে এতগুলো জিনিস দেখে জাহানারা বাকরুদ্ধ। সুবোধ জাহানারার প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য না করে টাকা গুনতে বসে গেল। গুনে দেখলো আর মাত্র একশ চল্লিশ টাকা পড়ে আছে। আরো কিছু কেনা দরকার। মানুষ-তো দু’জন। কিন্তু বসবাস করতে গেলে আরো কতকিছু লাগে। টাকা গুনে পকেটে ঢুকিয়ে সে বাইরে গিয়ে বিড়ি ধরালো।

জীবন বুঝি এভাবেই শুরু হয়! সুবোধ ক্রমশঃ বুঝতে পারছে এটা ভাবনাতেই সম্ভব। বাস্তবে একদম না। জীবন শুরু করার জন্য আজকের পর আগামীকাল বাঁচতে হয়।তার বা তাদের বাঁচার জন্য কী আছে? কিছু না। তবে প্রয়োজনে বাঁচার জন্য ভিক্ষা দিয়ে শুরু করা যায়। কিন্তু সেটা কি সম্ভব? না, সম্ভব না। তাই এই মুখচোরা ছেলেটিকে বদলাতে হবে। মানুষের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করতে হবে। আর কিছু না, একটা কাজ যে করেই হোক যোগাড় করতে হবে।

বস্তি থেকে চলে আসার পর আজই প্রথম তাদের এক ঘরে, এক সঙ্গে থাকা। জাহানারার পক্ষে এটাও একটা ঘটনা, যা তাকে মেনে নিতে হচ্ছে। সুবোধকে সে কতটুকু জানে, কতটুকু বিশ্বাস করে—এটা আবার নতুন করে সে ভাবতে চাইছে। ভাবতে চাইছে তার ছোট্ট একটা জীবন কীভাবে ভাসছে—ভাসার মধ্যে স্বস্তি কোথায়, আনন্দ কোথায়—এত শুধু ভয় আর ভয়। নিশ্চিহ্ন হওয়ার ভয়।

তবু আজ একটা ঘর পাওয়ার অনুভূতি জাহানারার সর্বাঙ্গে। সুবোধ ‘একটু আসছি’ বলে আবার বের হয়ে গেলো। এই সুযোগে সে একটু আগে স্নান সেরে এসেছে। আঃ ক’দিন পরে স্নান! শরীর জুড়িয়ে গেছে যেন। খুব লজ্জা লাগছিল নতুন কাপড় পরতে। পরতে-ত হবেই, কারণ পরনের কাপড়-তো আর গা’এ রাখা যাচ্ছিল না। কী লজ্জার কথা! এই সুযোগে সে যত্ন করে সেটা ধুয়েও নিয়েছে। জিনিস পত্র একটু গোছ-গাছ করে সে তাড়াতাড়ি বিছানাও বিছিয়ে নিল চৌকির উপর। ভাড়ার ঘরে এই একটি মাত্র জিনিসই ছিল। পরনে নতুন কাপড়, চৌকির উপর নতুন বিছানা, তার ভেতর এক অদ্ভুত অবিশ্বাস তৈরি করতে শুরু করলো। অতিক্রমের এই ধাপ সে যেন গ্রহণ করতে পারছে না। খুব অসহায় লাগছে তার। সুবোধ ঘরে নাই বলে অনেকক্ষণ সে মাথায় কাপড় রাখেনি। সঙ্গে আনা পুরনো শুকনো কাপড়ের টুকরো দিয়ে ভেজা চুল ভাল করে জড়ানো। কিন্তু চোখে তার জল। কিছু সময় সুবোধের না-থাকাটা যেমন তার স্বস্তি তৈরি করেছিল, তেমনি এখন সুবোধের না-আসাটাও তার অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠছে। এই সব ভাবতে ভাবতে সে বিছানার একপাশে এক সময় নিজের অজান্তেই একটু কাত হলো।

কাজের সন্ধানের কথাটা সুবোধের মাথাতেই ছিল। একটু আগে সে যে দোকান থেকে বেশ কিছু জিনিস কিনেছে তার মালিককেই দাম দেয়ার সময় অনুরোধ করেছিল যে কাজ কর্মের কোন খোঁজ আছে কিনা—যে কোন ধরণের কাজ। দর-দাম করার সুত্রে তার পছন্দ হওয়াতেই সে জিজ্ঞেস করতে ভরসা পেয়েছিল। দোকান মালিক তখন তাকে কিছু সময় পরে যেতে বলে। আপাতত সেখানে গিয়ে তাদের মধ্যে সেই কথা-বার্তা হলো। এদিকে দেরি হচ্ছে দেখে সুবোধ নিজেই ভাবছিলো জাহানারা ভয় পেতে পারে। তাই সে কথা-বার্তা সেরে সস্তার এক হোটেল থেকে তাদের দু’জনের জন্য রাতের খাবার নিয়ে ফিরে এল।

হন্তদন্ত হয়ে সুবোধ ফিরলো প্রায় এক ঘণ্টা পর। সন্ধে উতরে গেছে। দোর ভেজানো। ভেতরে অন্ধকার। বাইরের দিকে রাস্তার আলো রয়েছে ভাল। সুবোধ ঘরে ঢুকে আবছা অন্ধকারে দেখে জাহানারা শুয়ে আছে। পকেট হাতড়ে দেশলাই বের করে সে প্রথমে আজই কিনে আনা মোমবাতি খুঁজে নিয়ে আলো জ্বালালো। এবার স্পষ্ট দেখতে পেল জাহানারা শুয়ে আছে। পরনে নতুন কাপড়। বোঝা গেল গভীর ঘুমে। ডাকবে কি ডাকবে না ভাবতে ভাবতে সে ডেকেই বসলো—এই-যে ওঠ, খাবে না—কী হলো, ওঠ--। কিন্তু জাহানারার কোন সাড়া নেই। নিঃসাড়ে ঘুমোচ্ছে। সামান্য’হা’ হয়ে আছে মুখ। চুপসানো। গালের হনু দুটো বেশ উঁচু হয়ে আছে। মাথার চুল খোলা। কেমন যেন অচেনা লাগছে। জাহানারাই-তো, নাকি অন্য কেউ!

আসলে জাহানারার মুখ কি সে ঠিক মতো দেখেছে কখনো? একজন মানুষকে সনাক্ত করতে গেলে যা যা দেখা দরকার তার কিছুই-তো সে দেখেনি। সেই থেকে আজ অবধি সে জাহানারার সম্পূর্ণ মুখ কখনো দেখেছে বলে মনে করতে পারছে না। আচ্ছাদনের বাইরে থেকে একটা ছোটখাটো কাঠামো দেখা আর ফ্যাসফ্যাসে একটা গলার স্বর শোনা ছাড়া তার আর কোন স্মৃতি নেই। সুবোধ খুব বিপন্ন বোধ করতে লাগলো।

কতক্ষণ এভাবে সময় কাটছিল খেয়াল নেই। হঠাৎ একটা কঁকিয়ে ওঠা আওয়াজ—ভাবলো, জাহানারা জেগেছে। তড়ি ঘড়ি নিভিয়ে দেয়া মোমবাতিটা জ্বালাতে গিয়ে চমকে উঠলো। শুনতে পেল জাহানারা কান্না-চাপা গলায় বলছে—কেডা, ঘরের মইধ্যে কেডা। ‘আমি আমি’ বলে সুবোধ যতই মোমবাতিটা নিয়ে কাছে এগোয়, জাহানারা ততই প্রায় নগ্ন ঊর্ধ্বাঙ্গে একটা বালিশ চাপা দিয়ে—‘না না না’করতে লাগলো। সুবোধ আর সাহস পেল না আলোটা নিয়ে এগোতে। সেটা সামনে নিয়েই মাথা নিচু করে মেঝেতে বসে পড়লো সে। সে এতটাই বিচলিত হয়ে পড়লো যে, টের পেল তার দু’চোখ থেকে জল গড়াচ্ছে। জাহানারার দিকে সরাসরি আর না তাকিয়ে আড়চোখে একসময় দেখলো যে জাহানারা আবার শুয়ে পড়েছে। এবার সুবোধ আর বাতিটা নেভালো না। চুপচাপ বসে রইলো।

সেদিন জাহানারার দুঃস্বপ্নও একসময় শেষ হয়েছিল। এক সময় সুবোধ তাকে রুটি সব্‌জি আর জল খাওয়াতে পেরেছিল। আর ভয় পায় নি। অনেকক্ষণ নীরব থাকার পর জাহানারা নিজের মনেই একবার হেসেছিল—কেন কে জানে! সুবোধ ততক্ষণে আরো ভাল করে জাহানারাকে দেখলো—দেখলো যে ঘরে এক পূর্ণাঙ্গ নারী। একটানা আতংক আর উৎকণ্ঠার সঙ্গী তার। উভয়ের বাঁচার জন্যই বাধ্যত যাকে ‘স্ত্রী’র পরিচয় দিতে হয়েছে। নাম দিতে হয়েছে—নমিতা মন্ডল। স্বামী, জয়দেব মণ্ডল। সাকিন—জলপাইগুড়ির এক গ্রাম, মাধবপুর। সবই শুনেছে জাহানারা। যা বোঝার বুঝেও নিয়েছে। রাতে সুবোধ বিছানায় শোয়ার পর সে পাশে বসে থেকেছে অনেকক্ষণ। ঘুমন্ত সুবোধকে আবছা অন্ধকারে যতক্ষণ দেখা যায় চেয়ে চেয়ে দেখে গেল সে। একসময় পাশে শুয়ে সেও ঘুমিয়ে পড়লো।
[চলবে]

আপনার মন্তব্য