মাছেরনগরের পুত্র শোকহীন মাছের বাবা

 প্রকাশিত: ২০১৬-১১-০৩ ২২:৩৮:৩৭

মাসকাওয়াথ আহসান:

মাছের বাবা আগে আয়েস করে সকালে কাঁচা মরিচ ভেঙ্গে পান্তাভাত খেতো। কিন্তু মাছেদের প্রতিনিধি হবার পর এখন কষ্ট করে পাউরুটির টুকরায় মাখন-জেলি মেখে খেতে হয়। টাকানগরীতে নব্য প্রাসাদে বসে সকালের নাস্তাটা খেয়ে কফিতে চুমুক দেবার সময় হঠাত মাছেরনগর থেকে ফোন আসে।

--স্যারমাছ উত্তেজিত মুসলমান মাছেরা হিন্দু মাছেদের বসতিতে হামলা করছে; আপনে দয়া করে একটু আসেন।

--আরে ধুরও; এইদিকে অনেক কাজ; আইতে পারুম না। দেখি মাছেগো চাচারে ফোন করি।

মাছের বাবা মাছের চাচাকে ফোন করে,

--হ্যালো মাছের নগরে কাইজ্জা বাধছে। কিছু একটা করেন।

--দেখি পুলিশ মাছ আর বিজিবি মাছদের ফোন করে দিই। সব ঠিক হয়ে যাবে।

--আপনে তো কথায় কথায় বলেন সব ঠিক হয়ে যাবে; ঠিক তো হয়না।

--আরে সমাজে সংখ্যায় বেশী মাছেরা সংখ্যালঘু মাছেদের একটু খাবেই। সব ঠিক হয়ে যাবে।

মাছের নগরের সহি মাছেদের হবিগঞ্জের এক সাবেক শান্তিমাছের ছেলে খবর দিয়েছে, এক হিন্দু মাছ ইসলাম ধর্মের বিশাল অবমাননা করেছে। একদা শান্তিমাছের ছেলে বর্তমানে সরকারী মাছেদের দলে। সুতরাং তার কথার একটা ওজন আছে। সেও তো এখন শান্তিমাছ। সুতরাং মাছের নগরের সহিমাছেরা আর দেরী করেনি। মুমিন মাছেরা জানেই বিএনপি-জামাতের মাছেদের সংখ্যালঘু মাছ নির্যাতনে সবসময়ই একটা “গো এহেড” দেয়া আছে সেই ১৯৭৫ সাল থেকে। এখন শুধু আওয়ামী মাছের “গো এহেড” হলেই কাজ হয়ে যায়।

সৌভাগ্যের বিষয় আওয়ামী এক সুরুজ মাছ এসে তার মুসলমানুভূতিতে তীব্র আঘাতের ব্যাপারটা স্পষ্ট করে তোলে। এমনকি মাছেরনগরের ইউএনও মাছও গভীর পরিতাপের বিষয়টি ঠারে-ঠুরে বুঝিয়ে দেয়। ফলে এখন মাছের নগরের হিন্দু মাছেদের মন্দির ভাঙ্গতে ও বাড়িঘরে তাণ্ডব চালাতে আর কোন বাধা নেই। লুটপাটও করা গেলো। আর যদি এই হামলায় ভয় পেয়ে হিন্দুমাছেরা বঙ্গোপসাগর থেকে পালিয়ে ভারত সাগরে গিয়ে পড়ে; তাহলে তো কথাই নেই। সর্বদলীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে হিন্দু মাছেদের বাড়ী-জমি দখল করে সুষম ভাগাভাগি করে নেয়া যাবে।

ওসি মাছ সম্ভাব্য হামলার খবরে কয়েকটি পুলিশ মাছকে দর্শক হিসেবে পাঠিয়ে দিয়ে থানায় বন্দী এক ছোটমাছকে দিয়ে গা টেপায়। আনন্দে কুলকুল করে বলে, সহি মুসলমানেরা অগো ভাগটা আগে বুইঝা নেক। পরে গ্রেফতার বাণিজ্যে আমি আমারটা তুইলা নিমুনে।

পুলিশ সুপার একজন ভদ্র হিন্দু মাছ। সুতরাং সে আর ছোটখাটো হিন্দু মাছের জন্য তেমন কষ্টবোধ করে না। বড় মাছ কী আর বোঝে ছোট মাছেদের দুঃখ! জেলা প্রশাসক মাছ একজন সরল মাছ। বড় মাছেদের দুষ্টচক্রে সে ঠাহর করতে পারে না; কোনখানে কোন মাছ কাকে গিলে খায়! সুতরাং যাই ঘটুক সে বলে দেবে, মিটমাট হয়ে গেছে; পরিস্থিতি স্বাভাবিক।

ফলে মাছের নগরের সহি মুসলমান মাছেরা অনায়াসে হিন্দু মাছেদের এলাকায় ঢুকে তাণ্ডব চালায়; লুটপাট করে; স্বর্ণালংকার ছিনিয়ে নেয় শিশুমাছেদের গলায় তলোয়ার ঠেকিয়ে। কিছু ছোটখাটো মুসলমান মাছ প্রতিবেশী ছোটখাটো হিন্দু মাছেদের বাঁচানোর জন্য লড়াই করে। কিন্তু সহি মুসলমানের লুণ্ঠনের অনুভূতির সুনামির সামনে তারা বেশীক্ষণ টিকতে পারে না।

মুমিন মাছেরা মন্দিরে ঢুকে প্রতিমা ভাঙ্গে। একজন সহি মাছ বলে, আহলে হাদিসের মাছ-মাছায়েল বা মূল আদর্শই হচ্ছে মূর্তিভাঙ্গা; সুতরাং জোরসে চালাও শাবল-গাঁইতি।

খবর পেয়ে মাধবকুণ্ডের জামাতের মাছেরা কিছু অনুভূতি মাছেদের লেলিয়ে দেয় মন্দির ভাঙ্গতে।

টি আর পি মাছেরা তখন ডলফিনদের ক্রিকেট টেস্টে বিজয়ের মচ্ছবে ব্যস্ত। ফলে মিডিয়ায় খবরটা আসি আসি বলে তবু আর আসেনা। পরে সামাজিক মিডিয়া সাগরের মাছেরা মাছেরনগরে হিন্দুপল্লীতে হামলার খবর জানাতে থাকে। তখন ঘুম ভেঙ্গে টি আর পি মাছেরা কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণ করে।

বাধ্য হয়ে আওয়ামী লীগের মাছের যে চাচা নিয়মিত ফুল দিয়ে জামাত মাছেদের আওয়ামী মাছে বরণ করে নেয়; সে এগিয়ে আসে একটা বিবৃতি নিয়ে।

--ক্ষয়ক্ষতি মেপে রূপচান্দা ঢেউটিন দেয়া হবে ক্ষতিপূরণ হিসেবে। আস্থা রাখুন।

হামলার দুদিন কেটে গেলেও টাকানগরীর মাছের বাবা-চাচারা একটু গতর নড়িয়ে মাছেরনগর পরিদর্শনে যেতে পারে না। মতস্যসভার বৈঠকে ডলফিনদের টেস্ট ক্রিকেট বিজয় নিয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু নাছেরনগরের হিন্দুমাছেদের এলাকায় সহি মুসলমান মাছেদের হামলার প্রসঙ্গটি আর আসে না।

মাছেদের প্রতিনিধিরা মাছেদের ভোটে নির্বাচিত না হয়ে নির্বাচন কমিশনের ঠোঁটে নির্বাচিত হওয়ায় টাকানগরীর বিলাসী জীবন থেকে তাদের ভারী শরীর আর ওঠেনা। অযথা নিজ নিজ এলাকায় গিয়ে তারা আর হাঁটেনা। ফলে ছোটখাটো মাছেদের বিপদ-আপদে মাছেদের প্রতিনিধিদের কোন রকম সাহায্য জোটেনা।

ওদিকে টেস্ট ক্রিকেটে জেতা এক প্রতিভাবান ডলফিনকে একটি গৃহ উপহারের ঘোষণা আসে বড় করে। আর এদিকে মাছেরনগরের ছোটখাটো হিন্দু মাছেদের জন্য রূপচান্দা ঢেউটিন উপহারের ঘোষণা আসে ছোট করে।

সহি মুসলমানদের দেয়া আগুনে পোড়া গৃহের বারান্দায়-উঠোনে বসে থাকে অসহায় হিন্দু মাছেরা। এ অসহায়ত্ব তাদের সারাজীবনের সঙ্গী। এরকম কতবার কতজন ছোটখাটো মাছ পোড়া বাড়ীর সামনে খোলা আকাশের নীচে বসে রইলো; তবু এসব প্রতিবিধানের কোন ইচ্ছা জাগে না টাকানগরীর বড় মাছেদের। তারা আজকাল ভীষণ ব্যস্ত ডলারনগরী ও পাউন্ডনগরীতে সেকেন্ড হোম নির্মাণে। কারণ উন্মত্ত সহি মুসলমান মাছেদের আর মাছেদের বাবা-চাচা-বেয়াই-তালুইদের অনুভূতির প্রখরতায় বঙ্গোপসাগরে কখন কী হয়! তাই বড় মাছেদের পরিবারগুলো প্রশান্তমহাসাগরে কিংবা অতলান্তিক সাগরে ডিম ফোটানোই ভালো।

মাছেদের আওয়ামী সেলফি ফিশ চাচা মিডিয়ায় বলে, বড়ই পরিতাপের বিষয়। অবশ্য মাছেরনগরের মত ঘটনা এমেরিকাতেও ঘটছে।

অবশেষে টাকানগরী থেকে অনেক কষ্টে গাত্রোত্থান করে মাছেরনগরীতে এসে পৌঁছায় মাছেদের বাবা। সে শোকহীন। সে সাংবাদিক মাছদের বলে, এসবই মিডিয়া মাছেদের সৃষ্টি; কয়ডা মাত্র মন্দির ভাঙ্গছে। বাড়ী-ঘরের ক্ষয়ক্ষতির খবর আপনেরা কই পান!
বানায়ে ছানায়ে কীসব বলে মিডিয়া। আমি বলতেছি, নো-ওয়ান কিল্ড মাছেদের হিন্দু পল্লী। তবে হ্যাঁ যতটুকু যাই হইছে এইখানে আওয়ামী কিছু মাছ টাকা পয়সা খাইছে; তাগো দল থিকা বাইর কইরা দিমু। আপনেরা এখন যান। বিরক্ত করবেন না।

আস্কারা পেয়ে ইউএনও মাছ সাংবাদিক মাছেদের সামনে হুমকি-ধামকি দেয়; কয়েকজনকে পারলে ছাই দিয়ে ধরে।

এইসব সাংবাদিক ঝামেলা মাছেরা ফিরে গেলে মাছেদের শোকহীন বাবা ইউএনও মাছকে জিজ্ঞেস করে, এখন কী করণীয়!

--অনেক কাজ স্যারমাছ। পুনর্বাসনের কাজ। অজ্ঞাত মাছেদের বিরুদ্ধে মামলা হইছে। সেইখান থেকে কিছু ছোট মাছ ধরা।

উপস্থিত হিসাবরক্ষক মাছ খুক খুক করে কেশে বলে, মানে গ্রেফতার বাণিজ্য স্যারমাছ। এই পুরা ব্যাপারডার তিনডা অর্থনৈতিক ধাপ আছে। প্রথমে হিন্দু মাছেদের বাড়ী-ঘর লুটপাটের অর্থনীতি; এরপর রূপচান্দা ঢেউটিনের পুনর্বাসনের অর্থনীতি; এরপর অজ্ঞাত মুসলমান মাছেদের গ্রেফতার বাণিজ্য অর্থনীতি।

আপনার মন্তব্য