বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, সপ্তম পর্ব : ২

 প্রকাশিত: ২০১৬-১১-০৫ ০২:৩০:৫৪

 আপডেট: ২০১৬-১১-০৫ ০৩:০৪:৩৫

কাজী মাহবুব হাসান:

বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, সপ্তম পর্ব (কারেনিনের হাসি)

জেনেসিসের* একেবারে শুরুতেই আমাদের বলা হয়েছে, ঈশ্বর মানুষ সৃষ্টি করেছেন মাছ,পাখি আর সব প্রাণিদের উপর তাকে নিয়ন্ত্রণ দেবার জন্য। অবশ্যই, জেনেসিস মানুষেরই লেখা, কোনো ঘোড়ার নয়। আর এমন কোনো নিশ্চয়তাও নেই যে, ঈশ্বর আসলেই মানুষকে অন্য সব প্রাণিদের উপর কর্তৃত্ব করার অধিকার দিয়েছিলেন। যা ঘটার সম্ভাবনা অনেক বেশী সেটি হচ্ছে, মানুষই ঈশ্বরকে আবিষ্কার করেছে, গরু আর ঘোড়াদের উপর শুধুমাত্র নিজের জন্য দখল করে নেয়া কর্তৃত্বটিকে একটি পবিত্র অধিকার হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ।হ্যাঁ, একটি হরিণ বা গরুকে হত্যা করার অধিকার হচ্ছে একমাত্র বিষয় যা নিয়ে সমগ্র মানবজাতি ঐক্যমত্যে পৌছাতে পারে, এমনকি সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সময়েও।

এই অধিকারটি কোনো প্রশ্ন ছাড়াই আমরা মেনে নেই, আর তার কারণ হচ্ছে আমরা কর্তৃত্বের প্রাধান্য পরম্পরায় সবচেয়ে উপরে অবস্থান করছি। কিন্তু তৃতীয় একটি পক্ষকে সেই খেলায় প্রবেশ করার অনুমতি দেয়া হোক – যেমন, অন্য গ্রহ থেকে আসা কোনো অতিথি। এমন কেউ যাকে ঈশ্বর বলেছেন, অন্য সব নক্ষত্রের প্রাণিদের উপর তোমাকে কর্তৃত্ব দেয়া হলো – এবং সাথে সাথেই কোনো প্রশ্ন ছাড়াই জেনেসিসকে মেনে নেয়া সমস্যাজনক হয়ে যাবে। হয়তো একটি মানুষ যাকে কোনো মঙ্গলগ্রহবাসী তার গাড়িতে বেধে নিয়ে যাবে অথবা মিল্কি ওয়ের কোনো অধিবাসী তাকে লোহায় শিকে গেঁথে পুড়িয়ে খাবে, সে হয়তো তার ডিনার প্লেটের সেই বাছুরের মাংসের কাটলেটটার কথা স্মরণ করতে পারবে এবং ( দেরীতে যদিও) গরুর কাছে সে ক্ষমাপ্রার্থী হবে।

বাছুরদের নিয়ে হাটতে আর তাদেরকে তার সামনে ঠিক মত চালাতে তেরেজাকে সারাক্ষণই বাধ্য হতে হতো কিছু শক্তি প্রয়োগ করার জন্য, কারণ বাছুররা খুব অস্থির, সুযোগ পেলেই তারা দৌড়ে হারিয়ে যেতে চায় খোলা মাঠে। তার সঙ্গী ছিল কারেনিন। গত দুই বছর ধরে কারেনিন তার সাথে চারণ ক্ষেত্রে যাচ্ছিল। সেও পছন্দ করতো বাছুরগুলোর সাথে কঠোর আচরণ করতে, তাদের গর্জন করে ভয় দেখাতে, তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে ( তার ঈশ্বর তাকে কর্তৃত্ব দিয়েছে গরুদের উপর এবং সে খুবই গর্বিত সেই দায়িত্ব পেয়ে)। তবে, আজ, তার বেশ কষ্ট হচ্ছিল তার সেই কাজ করার জন্য, তিন পায়ের উপর খুড়িয়ে হাটতে হয় তাকে, চতুর্থটাতে সেই ক্ষতটা, আর ক্ষতটা এখনও ভালো হয়নি, তেরেজা বার বার ঝুঁকে পড়ে তার পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়। অস্ত্রোপচারের দুই সপ্তাহ পর, বিষয়টি স্পষ্ট হয় ক্যান্সারটি ছড়িয়ে পড়া অব্যাহত রেখেছে, আর কারেনিনের শরীরে আরো বেশী খারাপ হতে থাকবে।

যাবার পথে এক প্রতিবেশীর সাথে দেখা হয় তাদের, রাবার বুট পরে যে দ্রুত হেতে গরুর ছাউনির দিকে যাচ্ছিল। মহিলাটি যথেষ্ট পরিমাণ সময় দাঁড়িয়েছিল জিজ্ঞাসা করতে, ‘কুকুরটার সমস্যা কি হয়েছে? মনে হচ্ছে যেন সে খোঁড়াচ্ছে’।‘তার ক্যান্সার আছে’ তেরেজা বলে,‘কোনো আশা নেই’। গলায় আটকে থাকা দুঃখটা তাকে আর কিছু বলতে দেয়না। মহিলাটি তেরেজার চোখে অশ্রু লক্ষ্য করে, প্রায় তার তার মেজাজ হারিয়ে ফেলে। ‘কি আজব কথা, আমাকে বলো না তুমি তোমার মাথা চাপড়িয়ে কাঁদবে একটা কুকুরের জন্য’! অবশ্যই মহিলাটি খুব হিংস্র প্রকৃতির নয় বা খারাপ অর্থেও সে কথাটা বলেনি, সেই দয়ালু মহিলাটি শুধুমাত্র চেয়েছিল তেরেজাকে সান্ত্বনা দিতে। তেরেজা সেটি বুঝতে পেরেছিল, আর সে গ্রামে যথেষ্ট পরিমাণ সময় কাটিয়েছে অনুধাবন করার জন্য যে স্থানীয় অধিবাসীরা যদি প্রতিটি খরগোশকে ভালোবাসতো, ঠিক সে যেভাবে কারেনিনকে ভালোবাসে, তাহলে তারা তাদের একটিকেও হত্যা করতে পারতো না, আর তারা ও তাদের সব প্রাণিগুলোও শীঘ্রই না খেয়ে মারা যেত । কিন্তু তারপরও মহিলাটির কথাগুলো শুনে তার মনে হয়েছিল, বন্ধুত্বপূর্ণতার চেয়ে কিছুটা কম। কোনো প্রতিবাদ ছাড়াই সে উত্তর দেয়, ‘আমি বুঝতে পেরেছি’। কিন্তু খুব দ্রুত সে মাথা ঘুরিয়ে তার পথে চলে যায়। যে ভালোবাসা সে তার কুকুরের জন্য বহন করছে সেটি তাকে বিচ্ছিন্ন আর নিঃসঙ্গ করে দেয় । দুঃখী হাসি নিয়েই সে নিজেকে বলে, কোনো গোপন প্রেম লুকিয়ে রাখার জন্য যা দরকার হয় তার চেয়ে বেশী কষ্ট তাকে করতে হয় এই ভালোবাসাটা লুকিয়ে রাখার জন্য। মানুষ খুবই বিরক্ত হয় কেউ তার কুকুরকে ভালোবাসতে পারে এমন ভাবনায়। কিন্তু যদি কোনো প্রতিবেশী আবিষ্কার করতো যে তেরেজা টমাসের প্রতি বিশ্বস্ত না, হয়তো তেরেজার পিঠে ইঙ্গিতবাহী মৃদু চাপড় দিতো তারা গোপন সৌহার্দতার চিহ্ন হিসাবে।

যাই হোক না কেন, তেরেজা তার পথ ধরে এগিয়ে যায়, বাছুরগুলোর পরস্পরের গায়ে গা ঘেঁষে হাটা দেখতে দেখতে, সে ভাবছিল কত চমৎকার প্রাণি তারা । শান্ত, ছলনাহীন আর কখনো শিশুর মত আনন্দে উচ্ছল, তারা দেখতে স্থূল পঞ্চাশ বছর বয়সী মানুষদের মত, যারা ভান করছে তাদের বয়স চৌদ্দ। গরুদের খেলা করতে দেখার মত মর্মস্পর্শী দৃশ্য খুব কম আছে। তেরেজা খুব উপভোগ করতো তাদের মজার খেলাগুলো দেখতে, আর সে না ভেবে পারতো না (যে ধারণাটি গ্রামে তার এই দুই বছরে প্রায়ই মনে হয়েছে) যে, মানুষ তাদের পরজীবী ঠিক ততটাই, যতটা ফিতাকৃমিরা মানুষের পরজীবী। জোকের মত আমরা তাদের দুধ শুষে নেই, মানুষ হচ্ছে গরুর পরজীবী, এভাবেই সম্ভবত মানুষ নয় এমন কেউ তার প্রাণীবিজ্ঞানের বইকে মানুষকে সংজ্ঞায়িত করতো।

বেশ, সংজ্ঞাকে একটি কৌতুক মনে করে অবজ্ঞাসূচক হাসি দিয়ে আমরা হয়তো বাতিল করে দিতে পারি। কিন্তু, তেরেজা যেহেতু বিষয়টি গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করে নিয়েছে, তার অবস্থানটি বেশ ঝুঁকিপূর্ণ: তার ধারণাগুলো খুবই বিপজ্জনক ও সেটি তাকে বাকী মানবজাতি থেকে পৃথক করে রেখেছে। এমনকি যদিও জেনেসিস বলেছে যে, ঈশ্বর মানুষকে সব প্রাণিদের উপর কর্তৃত্ব দিয়েছেন, আমরা সেটি এমন ভাবে ভেবে নিতে পারি যে, এর মানে হচ্ছে তিনি শুধুমাত্র তাদের রক্ষণাবেক্ষণ করার দায়িত্ব দিয়েছেন মানুষদের। মানুষ এই গ্রহের মালিক নয়, শুধুমাত্র এর প্রশাসক। আর সেকারণেই একসময় তাকে দায় নিতে হবে তার প্রশাসনের জন্য। দার্শনিক দেকার্ত একটি নির্ধারণী পদক্ষেপ নিয়েছিল অগ্রসর হবার জন্য: প্রকৃতির মনিব আর প্রশাসক হিসাবে ঈশ্বর মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। আর নিশ্চয়ই গভীর একটি যোগাযোগ আছে সেই পদক্ষেপটি আর সেই বাস্তবতাটির মধ্যে, তিনি প্রাণিদের আত্মা দিতে সরাসরি অস্বীকার করেছিলেন। দেকার্ত বলেছিলেন, মানুষ মনিব ও প্রশাসক, আর অন্যদিকে জন্তুরা হচ্ছে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের মত, জীবন্ত কোনো যন্ত্র, একটি ‘ম্যাকাইনা অ্যানিমাটা’। যখন কোনো প্রাণি যন্ত্রণায় বিলাপ করে, সেটি আসলে বিলাপ না, শুধুমাত্র খারাপভাবে কাজ করা কোনো যন্ত্রের খসখসে আওয়াজ। যখন কোনো ঘোড়া গাড়ির চাকা আওয়াজ করে, তখন ওয়াগনের কোনো কষ্ট হচ্ছে না, এর জন্য দরকার শুধুমাত্র খানিকটা তেল দিয়ে পরিচর্যা করা। এভাবেই, কুকুরের জন্য শোক প্রকাশ করার কোনো কারণ নেই আমাদের, যখন ল্যাবরেটরিতে তাকে আমরা জীবন্ত ব্যবচ্ছেদ করি।

বাছুরগুলোকে মাঠে ছেড়ে দিয়ে, তেরেজা গাছের একটা গুড়ির উপর কারেনিনকে তার পাশে নিয়ে বসে; কারেনিন মাথা তার কোলে। দশ কিংবা আরো অনেক বছর আগে একটি খবর পড়ার কথা মনে পড়ে তেরেজার, খবরটি ছিল কিভাবে কোনো একটি রুশ শহরে একবার সব কুকুরদের সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে মেরে ফেলা হয়েছিল। সেই অশুভ আর স্পষ্টতই গুরুত্বপূর্ণ নয় ছোট নিবন্ধটি প্রথমবারের মত তাকে উপলব্ধি করাতে পেরেছিল তার দেশের এই আকারে অতি বড় প্রতিবেশী দেশটির নির্ভেজাল নিষ্ঠুরতাটিকে।

সেই সংক্ষিপ্ত নিবন্ধটি ছিল আসন্ন বহু কিছুর আগাম হুশিয়ারি। রুশ আগ্রাসনের প্রথম বছর তখনও সন্ত্রাসের রাজত্ব হিসাবে শনাক্ত করা হয়নি। কারণ বাস্তবিকভাবে পুরো দেশের কেউই একমত ছিলনা আগ্রাসী শাসকের সাথে, রুশদের বেশ কষ্ট করে শিকার করে খুঁজে বের করতে হয়েছে অল্প কিছু ব্যতিক্রমকে, যাদেরকে তারা ক্ষমতায় বসিয়েছিল। কিন্তু তারা কাদের খুঁজেছিল? কমিউনিজম প্রতি সব বিশ্বাস আর রাশিয়ার প্রতি ভালোবাসা ছিল তখন মৃত। সুতরাং তারা সেই মানুষগুলোকে খুঁজে বের করেছিল যারা কোনো না কোনো কারণে বদলা নিতে চায়, যাদের মগজে ছিল প্রতিশোধ নেবার স্পৃহা। তারপর এই সব মানুষগুলোর আগ্রাসী মনোভাবকে তারা আরো সংহত, বিকাশ সাধন ও প্রতিপালন করেছে, আর অনুশীলন করার জন্য তাদের ক্ষণস্থায়ী একটি বিকল্প দিয়েছিল তারা।

যে বিকল্পের কথা তারা ভেবেছিল, তা হলো প্রাণিরা।

একসাথে সব পত্রিকাগুলো চক্রাকারের প্রকাশ করতে শুরু করে কিছু প্রবন্ধ আর সংগঠিত সম্পাদকের প্রতি চিঠির আন্দোলন, যা দাবী করে, যেমন, শহরের সীমানায় সব কবুতরদের বিলুপ্ত করতে হবে। এবং সব কবুতরদের হত্যা করা হতো। কিন্তু সবচেয়ে বড় আন্দোলনটি ছিল কুকুরদের প্রতি। মানুষ তখনও আশাহত তাদের পেশাগত জীবনের ভয়াবহ বিপর্যয়ে , কিন্তু রেডিও, টেলিভিশন আর পত্রিকাগুলো অবিরামভাবে কুকুরদের প্রতি তাদের বিদ্বেষ ছড়িয়ে যাচ্ছে: কিভাবে তারা আমাদের পার্ক আর রাস্তা নোংরা করে, আমাদের শিশুদের স্বাস্থ্যের জন্য যা ক্ষতিকর, কোনো উপযোগী কাজ তারা করছে না, কিন্তু তারপরও তাদের অবশ্যই খাওয়াতে হবে। তারা যেভাবে মানুষকে উন্মত্ত করে তুলেছিল যে, তেরেজা ভয় পেয়েছিল, উন্মত্ত জনতা না আবার কারেনিনের কোনো ক্ষতি না করে বসে। মাত্র এক বছর পরেই পুঞ্জীভূত বিদ্বেষ ( যা এতদিন অনুশীলনের কারণে প্রকাশিত হচ্ছিল প্রাণিদের প্রতি) তার সত্যিকারের লক্ষ্যটি খুঁজে পায় – জনগণ। তাদের কাজ থেকে মানুষদের বের করে দেয়া শুরু হয়, তাদের গ্রেফতার করা হয়, বিচার করা হয়। অবশেষে প্রাণিরা শান্তিতে শ্বাস নিতে পারে।

তেরেজা কারেনিনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে, যে তার কোলে শান্ত হয়ে শুয়ে আছে, যখন তার মনে এমন কিছু ভাবনা সক্রিয় হয়ে ওঠে: অন্য মানুষের সাথে ভালো আচরণ করার কোনো সুনির্দিষ্ট উপযোগিতা নেই, গ্রামবাসীদের সাথে তাকে ভদ্রভাবে আচরণ করতে হয়, কারণ এছাড়া সেখানে সে বাস করতে পারবে না। এমনকি টমাসের সাথেও, সে ভালোবাসার সাথে আচরণ করতে বাধ্য কারণ তাকে তার দরকার। আমরা কখনোই নিশ্চিতভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পারবো না আমাদের সম্পর্কগুলোর কোন অংশটি আসলেই আমাদের আবেগগুলোরই পরিণতি – ভালোবাসা, বিতৃষ্ণা, দয়া অথবা বিদ্বেষ – আর কোন অংশটাই বা পূর্বনির্ধারিত হয় সদস্যের মধ্যে অবিরত ক্ষমতার খেলায়।

মানুষের সত্যিকারের ভালোত্ব, এর সব বিশুদ্ধতা আর স্বাধীনতাসহ, শুধুমাত্র তখনই উন্মুক্ত হতে পারে যখন সেই আচরণের গ্রহীতার কোনো ক্ষমতা থাকে না। মানবজাতির সবচেয়ে সত্যিকারের নৈতিকতার পরীক্ষা, এর মৌলিক পরীক্ষা ( যা আমাদের দৃষ্টির আড়ালে গভীরে লুকিয়ে থাকে) মূলত নির্ভর করে যারা এর দয়ার উপর নির্ভরশীল তাদের প্রতি আচরণের উপর: প্রাণিরা। আর এই ক্ষেত্রে মানবজাতিকে সহ্য করতে হয়েছে মৌলিক অধঃপতন, এই অধঃপতন এত মৌলিক যে বাকী সব কিছু এর থেকেই জন্ম নেয়।

বাছুরদের মধ্যে একটি তেরেজার সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছিল। তার বড় বাদামী চোখ দিয়ে সে দাড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে, তেরেজা তাকে ডাকতো মারকেতা বলে। সব বাছুরদের নাম দিতে পারলে সে খুশী হতো। কিন্তু সে সেটা পারবে না। কারণ তারা সংখ্যায় অনেক বেশী। খুব বেশী দিন আগে না, চল্লিশ বছর বা তারও আগে, গ্রামের সব গরুদেরই নাম ছিল ( আর যদি নাম থাকাটা আত্মা থাকার কোনো চিহ্ন গয়ে থাকে, আমি বলতে পারি দেকার্ত এর বক্তব্য সত্ত্বেও তাদের আত্মা ছিল), কিন্তু তারপর গ্রামগুলো রূপান্তরিত হয়েছে বড় সমবায় কারখানায়, আর গুরুরা তাদের তাদের সারা জীবন কাটাতে শুরু করে ছাউনিতে তাদের প্রত্যেকের জন্য নির্দিষ্ট মাত্র পাঁচ বর্গফুটের মতো নির্দিষ্ট জায়গায়। সেই সময় থেকেই তাদের কোনো নাম নেই তারা শুধুমাত্র জীবন্ত যন্ত্র। পৃথিবী দেকার্তকে সঠিক প্রমাণ করেছে।

চোখের সামনে বারবার তেরেজা ছবিটি ভেসে উঠছে, আমি তাকে গাছের গুড়িতে বসে কারেনিনের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে আর মানব জাতির অধঃপতন নিয়ে ভাবতে দেখি। আরেকটি দৃশ্যও মনে আসে। তুরিনে তার হোটেল ছেড়ে নিচাহ বের হয়েছেন, একটি গাড়িতে বাধা ঘোড়া, যার চালক তাকে চাবুক দিয়ে মারছিল, নিচাহ ঘোড়াটির কাছে গিয়ে চালকের চোখের সামনে ঘোড়াটির গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করেছেন।

এটি ঘটেছিল ১৮৮৯ সালে, যখন নিচাহ নিজেও মানুষের পৃথিবী থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন, অন্যার্থে এটাই সেই সময় যখন তার মানসিক অসুস্থতা কেবল বের হয়ে এসেছে। কিন্তু সেই কারণেই আমি অনুভব করি তার আচরণে অনেক ব্যাপক গুরুত্ব আছে: নিচাহ দেকার্ত এর জন্য ঘোড়ার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে চেষ্টা করেছিলেন। তার উন্মাদনার ( সেটি হচ্ছে মানবজাতির সাথে তার চূড়ান্ত বিচ্ছেদ) সূচনা হয়েছিল সেই মূহুর্তে যখন তিনি ঘোড়ার গলা জড়িয়ে কেঁদেছিলেন।

আর আমি ঠিক সেই নিচাহকে ভালোবাসি, যেমন করে আমি তেরেজাকে ভালোবাসি, যার কোলে মাথা রেখে মরণাপন্ন অসুখে আক্রান্ত একটি কুকুর বিশ্রাম নিচ্ছে। আমি তাদেরকে পরস্পরের পাশাপাশি দেখতে পাই: দুজনেই সেই পথ থেকে সরে দাঁড়িয়েছে, যে পথ দিয়ে প্রকৃতির মনিব আর প্রশাসক, সামনে এগিয়ে চলছে।

* জেনেসিস: বুক অব জেনেসিস, হিব্রু বাইবেল ও খ্রিস্টীয় ওল্ড টেস্টামেন্টের প্রথম বই।
(চলবে)

আপনার মন্তব্য