বর্গমাইলের পদাতিক : ২৬-২৭

 প্রকাশিত: ২০১৬-১১-০৮ ০১:২৯:১২

রাজা সরকার:

ব র্গ মা ই লে র প দা তি ক
২৬
ভেঙে গেল সুবোধের ঘুম। পাশে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা জাহানারার অবস্থা দেখে সেও অবাক হয়ে গেল। জাহানারার পিঠে হাত দিয়ে সে বলতে গেল—

--কী, হয়েছে কী, এমন করছ কেন?

--কিছু না—

--‘কিছু না’ বলে আবার এমন করছ কেন—কাঁপছো কেন—বাইরে গেছিলে নাকি—বল কী হয়েছে—

কথার আর কোন উত্তর না দিয়ে জাহানারা উপুড় হয়ে মুখ গুজে শুয়েই রইলো বিছানায়। ঘরের আবছা অন্ধকারে সুবোধ কোন ধারণাই করতে পারে না। একসময় জাহানারার কানের কাছে মুখ নিয়ে আবার কিছু বলবে বলে জাহানারাকে জড়িয়ে ধরতে যেতেই জাহানারা ফুঁসে উঠলো। মুখ ঘুরিয়ে বলে উঠলো—আর না, অনেক হইছে,--আইজ তোমার হইছেটা কী—নেশা গিলছ—হু্‌শ নাই, কী করছ না করছ—হায় আল্লাহ্‌—এর নাম ঘর করা--। বলতে বলতে জাহানারা বিছানায় উঠে বসে। জাহানারার মুখ পরিষ্কার দেখা না গেলেও তাকে আবার একবার সুবোধের অচেনা মনে হতে থাকে। কী এমন হয়েছে যে জাহানারা আজ এইভাবে কথা বলছে। শান্ত, ধীর স্থির একটি মেয়ে—কী এমন ঘটলো যে এমন আহতের মত অস্থির হয়ে উঠেছে ? আগের কথার সূত্র ধরে জাহানারা আবার বলতে শুরু করলো—আর একবার অমন হইলে লাইনের উপর লাশ পাইবা কইলাম--। কথা শুনে সুবোধ একদম স্থির। এবার সে মাথা নিচু করে ফেললো। শুনতে লাগলো জাহানারার কথা। তার মুখে এমন ধরণের এত কথা এর আগে কখনো শুনেছে বলে মনে করতে পারছে না। বিস্ময়ে, লজ্জায় মাথা নিচু করে বসে থাকে সে। শুনতে থাকে জাহানারার গলা---অমন কইরবা-তো এইখানে টাইন্না আনছ ক্যান্‌?—ওইখানেই গোর লইতাম—গলায় দড়ি দিতাম। হায় আল্লাহ্‌ , পেটে এক শত্তুর বাসা লইছে। পুড়া কপাল আমার। কই যাই আমি-- আমারে বিষ আইন্যা দ্যাও--।

এই রকম ভারী পরিবেশে তারা দু’জনেই অনভ্যস্ত। কী যে হলো আজ। ঘরে যে আলো নেই তা তাদের মনেও পড়ছে না যেন। কিন্তু ‘পেটে শত্তুরের বাসা’ কথাটা শুনে সুবোধের যেন চৈতন্য ফিরে এলো। বিছানা থেকে নেমে সে দাঁড়িয়ে পড়লো। অন্ধকার ঘরের মেঝেতে কিছুক্ষণ অস্থির পায়ে পায়চারী করলো। একবার বাইরেও গেল। ফিরে এসে ঘরে লণ্ঠনটা জ্বালালো। ঘর লণ্ঠনের মৃদু আলোতে যেন আরো থমথমে হয়ে উঠলো। জাহানারার মুখের দিকে তাকাতে পারছে না সে। তবু এবার জাহানারা পাশে গিয়ে বসে জাহানারার হাত নিজের হাতে নিয়ে বললো—খুব অন্যায় করে ফেলেছি হয়তো—মাফ করে দাও। আর শত্তুর পেটে বাসা লইছে কও-নাই কেন? শত্তুরের কথাটা সুবোধের মুখে শুনে জাহানারা আবার কান্নার ভেঙে পড়লো সুবোধের কোলে। সুবোধ তখনও বলতে থাকলো—তুমি মরলে শত্তুর বাঁচবে? পাগলী ভয় কীসের? কারোর মরার জন্য এই কষ্টের, এই অজ্ঞাতবাসের জীবন-তো বেছে নিই-নি। শুধু বাঁচার জন্যই-তো এই, এত সব করে যাচ্ছি। তুমি যদি এটা না বোঝ, তবে আর কে বুঝবে বলো? হ্যাঁ, শোন কান্নাটা থামাও, দেখি মুখ দেখি—। জাহানারার মুখ তুলে ধরে চোখ মুখ মুছিয়ে দিল সুবোধ। এরপর বললো—শোন, আমরা আর এখানে থাকবো না। সময় বেশি নাই—আমরা আজ ভোর রাতেই চলে যাব। আর এই কথা বলতেই-তো আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এসেছিলাম ! কীসের থেকে কী হয়ে গেল--।

সুবোধের কথা শুনে জাহানারার সব আবেগ যেন থমকে গেল। চোখ রগড়ে ধরা গলায় প্রশ্ন করলো—ক্যান, কী হইছে?

--হয় নাই, থাকলে হইবো। এখানকার কাজটা ভাল না।এই কাজে একটা বিপদ আপদ হইতে পারে।

--অন্য কাজ নেও।

--উপায় নাই, এখানে থেকে এই কাজটা ছাড়াও যাবে না।

--হায় আল্লাহ্‌--একটু খুলেই কও না।

--সে অনেক কথা—ধীরে ধীরে কইবো পরে। এখন গোছ-গাছ করে নাও। আমি একটু ঘুরে আসছি। আর এইটা রাখ সাবধানে।

--কী এইটা?

--টাকা।

দরজা ঠেলে সুবোধ আস্তে আস্তে বের হয়ে গেল। জাহানারা হাতে সুবোধের দেওয়া কাগজে মোড়া প্যাকেটটা নিয়ে স্থির হয়ে বসে রইলো।

অল্প সময়ের মধ্যে ঘটা এই সকল ঘটনার আকস্মিকতায় জাহানারা নিজের কাছে ফিরতে বেশ সময় নিলো। ঘরের দিকে তাকিয়ে মনটাও তার একটু দমে গেল। ছেড়ে যেতে হবে এই ঘর! কাজের বাড়ি কথাও মনে পড়তে লাগলো। কী স্নেহ-ই না করতেন মাসি। কিন্তু ভাবার সময় কই। জাহানারা গোছ-গাছ করতে লেগে গেল।

চা’এর দোকানে বসে সুবোধ চিঠিটা লিখলো। খামটা সে দুপুরেই কিনেছিল। লিখলো—শ্রদ্ধেয় শিবেন মিত্র। স্যার, আপনি আমার অশেষ উপকার করেছিলেন চাকরিটা দিয়ে। এর জন্য আমি আপনার কাছে চির কৃতজ্ঞ। কিন্তু আজ আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি। কারণ আপনাকে না জানিয়ে আমি চাকরিটা ছেড়ে দিচ্ছি এবং বঙ্কু ঠিকাদারের কাছ থেকে পাওয়া ক্যাশ পেমেন্ট দশ হাজার টাকা, আপনার অফিসে জমা না দিয়ে নিজের প্রয়োজনে আমি নিয়ে যাচ্ছি। আমি জানি এই দুটো কাজই যথাক্রমে অন্যায় এবং অপরাধ। কিন্তু নিজেকে এক বিপদের মুখোমুখি দেখে আমি একান্ত নিরুপায় হয়েই এই কাজ করেছি। টাকাটা আমি ঋণ হিসেবেই নিলাম মনে করি। সুযোগ-মত তা পরিশোধ করবো বলে আমি নিজের কাছে দায়বদ্ধ। আমাকে ক্ষমা করবেন। ইতি আপনার অনুগত জয়দেব মণ্ডল।

২৭
চিঠিটা পরদিন ভোরবেলা বালিগঞ্জ স্টেশনের কাছে একটি ডাকবাক্সে ফেলা হলো। স্বাভাবিক নিয়মে পরের দু’দিন বঙ্কু ঠিকাদার আর শিবু মিত্তিরের অফিসের বড়বাবুর মধ্যে কথা-কাটাকাটি হল। বঙ্কু ঠিকাদারের বক্তব্য হলো আমি জয়দেবের হাতে দশ হাজার টাকা গুনে দিয়েছি। সে আপনার অফিসে টাকা জমা না দিলে আমি কী করতে পারি। বড়বাবুর বক্তব্য হলো জয়দেব টাকা পেলে তা নিয়ে অফিসে নিয়ে আসবে এবং জমা করবে। এটাই নিয়ম। বাড়ি নিয়ে যাবে না। বঙ্কু ঠিকাদারের কথা, জয়দেব কোথায়। বড়বাবুর কথা, জয়দেব অফিসে আসছে না। ধরুন ছুটিতে আছে। এই সব কথোপকথনে বঙ্কু ঠিকাদারের মাথা সাধারণ নিয়মে ঠিক থাকার কথা নয়। তার মনে তাই ব্যাপক ক্রোধের জন্ম হয়ে যায়।। সে তখন আর দেরি না করে তার কয়েকজন গুণ্ডাকে কাজে লাগায়। মনে মনে বলে—খানকির ছেলে, আমার উপর বাটপারি ! দাঁড়া, দেখাচ্ছি মজা।

তৃতীয় দিনে যে ঘটনা ঘটলো তার জন্য রেল লাইনের ধারের বস্তি একদম প্রস্তুত ছিল না। সন্ধের দিকে চার পাঁচ জন তাগড়া লোক জয়দেবের ঘর কোন-টা খোঁজ করে। বস্তির-ই কেউ দেখিয়ে থাকবে হয়তো। তারা জয়দেবের ঘরের সামনে এসে ডাকতে লাগলো—জয়দেব, এই জয়দেব, শালা শুয়োরের বাচ্চা, বাইরে আয়। সমস্বরে এই জাতীয় আরো কিছু বিশেষণ প্রয়োগে জয়দেবকে ডাকা হচ্ছে শুনে বস্তির অনেকেই বাইরে বেরিয়ে এলো। যারা বাইরে এলো তাদের কাউকে কাউকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল যে দু’তিন দিন আগে তারা জয়দেব আর তার বউকে দেখেছে। তারপর থেকে আর দেখতে পাচ্ছে না। হয়তো কোথাও বেড়াতে বা কাজে গিয়ে থাকবে। আরো শোনা গেল যে টাকা মেরে দেওয়ার মত খারাপ মানুষ জয়দেবকে দেখে তাদের মনে হয়নি। কিন্তু তাতে আগন্তুক তাগড়া লোকেরা তাদের বিশেষণ প্রয়োগ থামায় নি।

তারা একসময় ঘরের দরজা ফাঁকা করে ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখে। পেছন থেকে তখন একজন বললো—শুনেছি ঘরে মেয়েছেলে আছে বে—থাকলে তুলে নিয়ে চল্‌। কিন্তু ঘরে কিছুই নেই, একটা বড় চৌকি আর একটা খাটিয়া ছাড়া। একজন সঙ্গে সঙ্গে ঘরে টর্চের আলো ফেললো। একজন বললো—শ্‌-শালা ফক্কা ! একজন বললো—পালিয়েছে,চিড়িয়া পালিয়েছে বে--। এরপর আর অপেক্ষা না করে তারা সবাই মূলী বাঁশের দরজা সরিয়ে হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে পড়লো। কেউ ঘরে মেঝেতে দলা করে থুথু ফেললো, কেউ মাটির হাড়ি লাথি মেরে ভেঙে দিল, একজন বললো ধুস্‌ শালা মজাটাই কেচে গেল মাইরি—এসব বঙ্কু ঠিকাদারের ইয়ার্কি নয়তো? আমাদের মালটা দেবে-তো—মানে টাকাটা? একজন বললো—চল চল দেবে না-তো কী—ওর বাপ দেবে---এরকম বলতে বলতে দলটা বস্তি ছেড়ে চলে গেল। বস্তির লোকেরা জয়দেব আর তার বউকে নিয়ে গভীর চিন্তায় পড়ে গেল।

সেদিন বঙ্কু ঠিকাদার অন্যবারের মতোই জয়দেবের হাত দিয়ে তার মালিকের জন্য পেমেন্ট পাঠিয়েছিল। সেদিন জয়দেবের মালিক শিবু মিত্তির পেমেন্টের খবর পেয়ে রাত এগারটা পর্যন্ত অফিসে অপেক্ষা করে জয়দেবকে না পেয়ে বেশ চিন্তিত হয়েই বাড়ি ফিরেছিল। তা ছাড়া পরদিনই জয়দেবের আবার শিলিগুড়ি যাওয়ার কথা। তাই পরদিন সকালে লোক পাঠিয়ে শিবু মিত্তির জেনে যায় জয়দেব ঘরে নেই। ঘর ছেড়ে চলে গেছে।

বঙ্কু ঠিকাদার সহজে ছাড়ার পাত্র নয়। কিন্তু লোক লাগিয়ে সে হতাশ হয়। অবশ্য পুলিশ তাকে আশ্বস্ত করেছে যে মাল তারা ধরে দেবে। তবে একটু মাল খসাতেও হবে। একটা চুরির কেস দায়ের করার অপেক্ষা।

চার দিন পর শিবু মিত্তির চিঠিটা পড়ল। অতঃপর বালিগঞ্জ পোস্ট অফিসের অস্পষ্ট সিল দেখে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। একসময় বঙ্কু ঠিকাদারকে ফোন করে বললো—টাকাটা পেয়েছি। উত্তরে বঙ্কু কিছু বলতে চেয়েছিল। কিন্তু—এ বিষয়ে আর কোন কথা নয়—বলে শিবু মিত্তির ফোন নামিয়ে রেখে দিয়েছিল।
(চলবে)

আপনার মন্তব্য