বর্গমাইলের পদাতিক : ২৮-২৯

 প্রকাশিত: ২০১৬-১১-১০ ০৩:৫৫:৩৩

রাজা সরকার:

ব র্গ মা ই লে র প দা তি ক
২৮
পারুলরা সেদিন বড়বাবুর সঙ্গে দেখা করে আসার পর পরদিন বড়বাবুর কথামত তারা কোর্টেও যায়। কিন্তু কোর্ট তাদের কাছে অচেনা জগত। একদিকে কাজের বাড়ির তাড়া আর অন্যদিকে কোর্টের এই গোলক ধাঁধাঁর মত পরিস্থিতিতে তারা কিছুক্ষণ উদ্দেশ্যহীন ঘোরাঘুরি করে যে যার মত কাজে চলে যায়। ইচ্ছে, পরে আরেকদিন থানার বড়বাবুর সঙ্গে দেখা করবে। কিন্তু এদিকে ঐদিনই উর্মিলার জামিন হয়ে যায়। পারুলরা জানতে পারে না। পান দোকানদার সুবল গিয়ে সব ব্যবস্থাদি করে। প্রথম থেকে আড়ালে থেকেই সুবল এই কাজটা সফল ভাবে করে। যদিও এই ব্যাপারে তাকে সাহায্য করেছেন স্বয়ং কল্যাণ সেন। শর্ত, সব কিছু গোপন রাখতে হবে। সুবল তাই রেখেছে।

ছাড়া পেয়ে ঊর্মিলার বস্তিতে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। তাকে দেখে সবাই উৎসুক কথা বলার জন্য—কিন্তু কেউ আগ বাড়িয়ে কিছু জিজ্ঞেস করছে না। পারুলকে দেখেও ঊর্মিলা কিছু না বলে ঘরে ঢুকে পড়ে। বাচ্চাগুলোকে ঘরের মধ্যে পেয়ে ওদের বুকে জড়িয়ে ঊর্মিলা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। কিছুক্ষণ কান্নাকাটি শোনার পর পারুল নিজের ঘরের লণ্ঠন জ্বালিয়ে নিয়ে ঊর্মিলার ঘরে গেল। গিয়ে তাদের ঘরের লণ্ঠন খুঁজে পেতে ওঠা মুছে টুছে জ্বালিয়ে দিল। এবার আসার সময় বললো—ঊর্মিলাদি এখন আর কাইন্দো না—এইবার ওঠো, উঠে স্নান টান করে পোলাপান নিয়ে আমার ঘরে এসে চারটে খেয়ে নেও। আমি যাই ভাত বসাইগে। পারুল তার কথা বলে চলে যাওয়ার পর ঊর্মিলা আরো কিছুক্ষণ বসে থেকে উঠলো। বড় ছেলের কাছ থেকে শুনলো তাদের এই ক’দিনের জীবন যাপন। শুনে যেন ঊর্মিলার মনটা একটু হাল্কা হয়ে গেল।

রাতে খাওয়া দাওয়ার পর অনেকেই এলো ঊর্মিলার সঙ্গে দেখা করতে বা কথা বলতে। সবার সঙ্গেই ঊর্মিলা কথা বললো, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো তার মত করে। পারুল এলো সবার শেষে। ঘরের সব কাজ শেষ করে। একপ্রস্ত কান্নাকাটি সমেত তারা অনেকটা সময় কথা বললো। পারুল উঠে যাওয়ার সময় ঊর্মিলা বললো—বাইচ্চা থাক্‌রে বইন, বাইচ্চা থাক, আগের জম্মে তুই আমার মায়ের পেটের বইন-ই আছিলি,---এই বলে পারুলকে জড়িয়ে ধরে ঊর্মিলা চোখের ফেললো। পারুলেরও চোখের পাতা ভারি হয়ে আসছিলো।

রাত হয়েছে। বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়েছে। শুতে যাবার আগে পারুলের প্রতি কৃতজ্ঞতায় যেমন তার মনটা আর্দ্র হয়ে উঠেছিলো, তেমনি বালিশে মাথা দিয়ে শুতে গিয়ে সুবোধের কথা মনে পড়াতে মনটা ততখানি শুষ্ক হয়ে গেল। ঘুম আসতে তাই অনেক দেরি হলো ঊর্মিলার।

পরদিন ঘুম থেকে উঠে শুনলো যে কমল বেপাত্তা। ঊর্মিলার গ্রেফতারের মূলে কে—এটা জানাজানি হয়ে যাওয়াতে কমল বস্তিতে অঘোষিত বয়কটের মুখে পড়েছিলো। তারপর হঠাৎ একদিন দেখা গেল তার ঘরে একটা টিপ তালা ঝুলছে। প্রথম প্রথম নানা ধরণের লোকজন এসে তার খোঁজ করতো। নানা বিড়ম্বনা আর মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও বেশিরভাগ জবাবদিহি ঊর্মিলাকেই করতে হতো, যেহেতু তাদের পাশাপাশি ঘর।

ইতিমধ্যে কিছু ধার-দেনা করে ঊর্মিলা তার দোকানটা আবার বসিয়েছে। দিনে রাতে হাড়ভাঙা পরিশ্রম—মুখ বুঝে কাজ করতে করতে ঊর্মিলা মনের দিক দিয়ে অনেকটাই কঠিন হয়ে উঠেছে। হঠাৎ যেন তার বয়সটা বেড়ে গেছে।

সুবোধের কথা মনে পড়লে বা কেউ জিজ্ঞেস করলে কেমন অসহ্য বোধ করে আজকাল। এ নিয়ে একদিন সমীরের সঙ্গে অনেক কথা কাটাকাটি হয়ে যায়।

--আরে ঊর্মিলা যে, দোকান আবার কবে চালু করলে?

--এই ত ক’দিন হলো—

--তুমি-তো খুব বিখ্যাত হয়ে গেছ দেখছি—কাগজে কাগজে খবর---

--হঃ, শুনছি সবই---

--আসল কালপ্রিটকে না ধরে পুলিশ যা ক’রে আর কি—তোমাকে তুলে নিয়ে গিয়ে বীরত্ব দেখাল---

--হঃ, বীরত্ব কেউ কম দেখায় নাই।

--কেমন?

--আপনারা, আপনাদের মত ভদ্দর লোকেরা—

--আমরা—মানে?

--পুলিশের কথা আপনাদের মুখে মানায় না।সবই শুনছি—সব ভদ্দর লোকের এক রা। গরীব লোকের বদনাম দিতে সবাই এক পায় খারা—যাক্‌, ছাড়ান দ্যান ঐ সব কথা—কী নেবেন কন দেখি---

--কিন্তু তুমি যেভাবে বলছো, আসলে মনে হচ্ছে কিছু ভুল করছ তুমি—

--যাক্‌ যাক্‌ এখন সরেন তো, দোকানের সামনাটা ছাড়েন এখন—

ভিড়ের মধ্যে এই সব কথা-বার্তা হয়তো কেউ খেয়াল করে থাকবে। তবে কল্যাণ সেন করেছেন বিলক্ষণ। সঙ্গে একটু মুচকি হাসলেন নিজে থেকেই। যেতে যেতে দেখে নিলেন সুবোধ নেই। আশে পাশে তেমন কোন সোর্সেরও দেখা নেই। তবে ঊর্মিলা থাকলেই-তো সুবোধের একদিন আসার সম্ভাবনা। না থাকলে আর সম্ভাবনা কোথায়?

দীর্ঘ সাত মাস পর কমল ফিরেছে। পুলিশের কাছে খবর সে বাংলাদেশ ঘুরে এসেছে।মাদক চালানের একটা গোটা দল এবার জালে পড়বে।অদৃশ্য প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে।

ঊর্মিলার সঙ্গে মুখোমুখি হলেও কমল কথা বলে না। তবে আজকাল সুযোগ বুঝে ঊর্মিলার বাচ্চাগুলোকে সে একটু আধটু আদর করে দেয়।

তবে ফিরে আসার পর দেখা যায় কমলের চেহারাটা ফিরেছে। এখানে এখন মদ মাংসের গন্ধ রাত বিরেতে ঊর্মিলা টের পায়। টের পায় গভীর রাত পর্যন্ত কমলের ঘরে লোকের আনাগোনা। মনে হয় কমলের এখন রোজগার ভাল।

কমলের প্রতি ঊর্মিলার রাগ নেই। কেন নেই এটা ঊর্মিলা বুঝতে পারে না। ধীরে ধীরে এক ধরণের উদাসীনতা যে তাকে আচ্ছন্ন করে চলেছে তা তার বোধের বাইরে। সাত মাস পর ঊর্মিলার ফিরে আসাটা ঊর্মিলা ইচ্ছে করলে ভেস্তে দিতে পারতো। বস্তিতে ঊর্মিলার সেই প্রভাব ও সমর্থন আছে। কিন্তু কেন জানি, দু’একজন পড়শির উৎসাহ সত্ত্বেও সে ঐ পথে পা বাড়ালো না।

রাগ সে সুবোধ বা জাহানারার উপরও করতে পারে না। কারণ গোটা ঘটনাটা তাকে এতটাই আহত করেছে যে সে এ নিয়ে আর ভাবতে চায় না। পারত পক্ষে কারোর সঙ্গে এ বিষয়ে কথাও বলতে চায় না। চোখের জল বা স্তব্ধতা তার ভেতর আপনা আপনিই জন্মায় বা শুকিয়ে যায়। সে মনে করে এর সঙ্গে যেন তার কোন সম্পর্ক নেই।

তবু, তারপরও এক জেদ, এক ব্যাখ্যাতীত জেদ তাকে বেঁচে থাকার জন্য তৈরি করে নিতে হয়েছে। রাতে ঘরে এসে ঘুমিয়ে না পড়া পর্যন্ত সেই জেদ তার সারা শরীর জুড়ে তীব্র বেগে চলাচল করে।

আজকাল তার ঘুমটা যেন একটু বেশিই পায়। অসহনীয় এক ক্লান্তির বোঝা, যা তার সারা দিনের সঞ্চয়, তাকে নিয়ে বেশিক্ষণ চোখ খোলা রাখা যায় না। ক্রমশঃ শরীর যেন আর তার চেনা শরীরটি থাকে না। পাশে শোওয়া বাচ্চাগুলো উপর ছড়ানো থাকে তার ডানা—একসময় সেই দিকে তার ভাবনাগুলো ক্রমে ঢলে পড়ে। তার ঘুম এসে যায়। ঘুমের ভেতর কখনো সুবোধ আসে না। আসে না এমনকি ছিঁচ কাঁদুনে ঐ শিবানীটাও।

২৯
পুলিশ আর দেরি করেনি। ফিরে আসার দিন দশেকের মাথায় কমলকে তারা তুলে নিলো। সঙ্গে আরও সাতজন দাগি। সব একসঙ্গেই কমলের ঘরে জমা হয়েছিল রাতে। পুলিশ ঢুকেছিল ঊর্মিলার ঘরেও। বাচ্চাগুলো হাউমাউ করে কেঁদে ওঠাতে পুলিশের জোর ধমক আছড়ে পড়েছিল ঘর জুড়ে। তার মধ্যে শুনতে হয়েছিল—তোর ভাতার কইরে? কোথায় পাঠিয়েছিস? সময় আছে এখনও বল, নয়তো মাগী জানিস-তো পুলিশের চোখ---

--কইছি-তো জানি না—কতবার কমু?

--জানিস না! আচ্ছা, ঠিক আছে—আর একদিন দেখবো কেমন জানিস--। বলতে বলতে পুলিশ অফিসারটা বেরিয়ে যেতেই গন্ধটা পেল। চেনা গন্ধ। মদ।

শেষ রাতের দিকে ঘণ্টা দু’এক ধরে গোটা বস্তি জুড়ে চললো তল্লাসি। তল্লাসি-তো নয়, এক কথায় তাণ্ডব। সব নীরব, টু শব্দ করার উপায় নেই। পুলিশ অপরাধী মিলিয়ে প্রায় চল্লিশ জনের দলটা কাক ডাকার আগেই বস্তি ছাড়লো। মিলিয়ে গেল ভ্যানের আর জিপের শব্দ।

ঊর্মিলা আবার শুয়ে পড়লো। একসময় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লো। বেলা পর্যন্ত ঘুমনোর অভ্যেস ঊর্মিলার কোন কালে নেই। কিন্তু আজ সকাল আটটা বেজে গেলেও ঊর্মিলার হুঁশ নেই। এদিকে বাচ্চাগুলো উঠে পড়েছে। উঠে নিজেদের মধ্যে তারা খেলাধুলা, ধাক্কাধাক্কি, ঝগড়াজাটি করে চলেছে। কেউ কেউ মাকে মাঝে মাঝে নালিশও করছে। কিন্তু মা’এর তাতে ঘুম ভাঙছে না।

একবার পারুল এলো ঊর্মিলার খোঁজ নিতে। এসে ঘরের বিশৃঙ্খলা দেখে ঊর্মিলাকে প্রায় ঠেলে তুললো সে। ঊর্মিলাও জেগে উঠে বসে ঘরের অবস্থা দেখে অবাক।

পারুল গতরাতের কিছু খবরাখবর দিল ঊর্মিলাকে দিল। তাদের বস্তিটা যে দিন দিন অপরাধীদের আস্তানা হয়ে উঠছে তাও জানালো। ঊর্মিলা মনে মনে ভাবে কবে এটা অপরাধীদের ছিল না---? পারুল এই বস্তিতে খুব বেশিদিন হয়নি এসেছে। মেয়েটি ভাল। ও চায়, গরীব মানুষের বস্তি হলেও অপরাধীরা যেন এখানে আশ্রয় না পায়। কিন্তু এই সব কাজ করা যে কত কঠিন ঊর্মিলা জানে।

অনেকদিন পর পারুল আসাতে তার দৈনন্দিন রুটিনে আজ ছেদ পড়লো। শরীরও ভাল না। একসময় ঊর্মিলা পারুলকে বলল-ও, –নারে আর পারতাছিনা। ভালই-তো ছিলাম রে—ঐ ছোঁড়াটা আওনের আগে। কী বুদ্ধিতে যে করতে গেলাম দোকান—মানুষের চোখ, চোখ ত না, যেন লোহার শলা—তেলে ভাজা থুইয়া আমারেই খাইতে চায়—হায় ভগবান---। তাও যদ্দিন সুবোধটা ছিল—একটা বল ভরসা ছিল। এখন কার ভরসায় কী করি--। ভাবতাছি কাইল থেকে আবার সবজির লাইন ধরুম। দোকান আর করুম না।
পারুলও সায় দিল।–হ্যাঁ তাই কর দিদি, একা মেয়েমানুষ তুমি---।

শেষ দিনের তেলেভাজা বিক্রির টাকাটা কোমরে বেঁধে আবার হলদিবাড়ির ট্রেনে চড়ে বসলো ঊর্মিলা। এবার এই সাত সকালে সঙ্গে নিয়ে এসেছে বড় ছেলেটাকে। বছর দশেকের ছেলে। বাকিগুলো ঘরেই থাকলো। পারুলকে বলে এসেছে দুপুরে একবার দেখে যাওয়ার জন্য।

ট্রেনের হকারের কাছ থেকে চা আর পাউরুটি নিয়ে খেতে খেতে চলেছে মা আর ছেলে। পুরনো মুখ আর একটাও দেখা যাচ্ছে না। সব কি কাজ ছেড়ে দিয়েছে?—ভাবতে ভাবতেই ভিড়ের মধ্যে চোখে পড়ে গেল পবনের মা। এক কোণে গুটিসুটি মেরে বসে আছে বুড়ি। এই বয়সেও চালিয়ে যাচ্ছে। ঊর্মিলাকে দেখে ঠেলেঠুলে কাছে এলো।

--কী গা, এতকাল পর আবার চল্‌লা কই—

--আর সব কই মাসি?

--সব আর কই—কেউ কেউ খইস্যা গেছে—কেউ কেউ আছে এদিক ওদিক—বেশির ভাক্‌ রেল-বাজারে দুকান নিছে—

--তা, তুমার খবর কও মাইয়া—শুনছিলাম তুম্যো নাকি কিয়ের দুকান দিছ?

--হ্যাঁ গো মাসি, দিছিলাম ঠিকই—কিন্তু কপাল, কপাল যাইব কই—টিকাইতে পারলাম না—তাই আবার পুরানা পথই ধরলাম---।
[চলবে]

আপনার মন্তব্য