বর্গমাইলের পদাতিক : ৩১-৩২

 প্রকাশিত: ২০১৬-১১-১৪ ১১:৪৬:০৭

রাজা সরকার:

ব র্গ মা ই লে র প দা তি ক
৩১
রাত এগারটার আগে সুবোধ ঘরমুখো হয় না। দোকান বন্ধ করতে করতে রাত হয়ে যায়। স্টেশন রোডে এই চা দোকানটা আসলে অর্জুন মালাকার নামে একজনের ছিল। রেলের জায়গায় দোকান। পাকা কিছু করা যাবে না। কল্পনা মাসির মধ্যস্থতায় সে এটা এক হাজার টাকার বিনিময়ে পেয়ে গেছে। বিক্রিবাটা তেমন আহামরি নাহলেও ইতিমধ্যে দোকানটাকে সে ভালবেসে ফেলেছে। কারণ নিজের মনে একা একটা লম্বা সময় কাটানোর সুযোগ রয়েছে সেখানে।খদ্দেররা আসে যায়। অধিকাংশই নানা ধরণের শ্রমজীবী মানুষ। চা বিস্কুট পাউরুটি ডিম ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায় না। যা কাজ করার তা সে নিজেই একমনে করতে থাকে আর এক মনে চলতে থাকে তার নিজের ভাবনা চিন্তার জগত। অতীত ভবিষ্যৎ নিয়ে নিজের মত ভাঙা গড়ার খেলা।

ইদানীং সুবোধ বেশ সুস্থির হয়ে পড়েছে। রাতে ঘরে ফিরে খাওয়া দাওয়ার পর কী সব করে যেন। মোম জ্বালিয়ে একটা ছোট্ট খাতায় কী সব লেখে যেন। কী লেখে সুবোধ? জাহানারা ভেবে পায় না। একদিন প্রশ্ন করতেই সুবোধ হেসে বলে—‘তোমার জীবনী’। ‘ধ্যাত’ বলে জাহানারা বিছানা থেকে নেমে এসে মোমটা নিভিয়ে দিয়ে সুবোধকে নিজের কাছে টেনে নেয়।

সুবোধ লেখে---
তাং-----
চা’পাতা—১০ টাকা
দুধ –৮ টাকা
চিনি—১৪ টাকা
বিস্কুট—২০ টাকা
কয়লা—১৫ টাকা
ডিম—১৫ টাকা
অন্যান্য—২০ টাকা
মোট খরচ—১০২ টাকা।
মোট বিক্রয়—১৮৭টাকা।

অল্প অল্প শীত—বাবা এই সময় খুব সকালে ঘুম থেকে উঠতেন। উঠে আল-পথ ধরে অনেকদূর ধানক্ষেতের মধ্যে দিয়ে কোথায় যেতেন? মনে হতো যেন জোত জমি দেখা শোনা করতে বেরিয়েছেন। আসলে একটা বাড়ি আর সামনের বাগিচাটুকু ছাড়া আমাদের আর কোন জমি ছিল বলে শুনিনি।

মনে হয় জন্মের গন্ধ মাখা নতুন ধানের গন্ধ আর হেমন্তের সূর্যোদয় বাবার খুব প্রিয় ছিল।

এরকম প্রতিদিনের হিসেব। তারপর এক দুই পাতা ব্যাপী এই ধরণের কথা লেখা। আর এভাবেই খাতাটা শেষ প্রায়। কয়েকটা পাতা বাকি। শেষ লেখাটি এরকম—

মোট জমা হয়েছে এক হাজার সত্তর টাকা। পাঁচশ টাকা মূলধনে খারাপ কি?

মা’এর কথা ভাবতে ইচ্ছে করে। মা’এর স্মৃতি বলে-তো কিছু নেই। তবু তাঁর কণ্ঠস্বর কেমন ছিল---।

দেখতে ইচ্ছে করে তাদেরও—যাদের সঙ্গে কত কত দিন---।

কিন্তু কতদিন এভাবে—ফিরতে হবে না?

হ্যাঁ, এবার ফিরবো—সেই পথেই ফিরবো। এ আমার ইচ্ছা।একান্ত আমারই ইচ্ছা। কিন্তু বিপদ? হলে—হউক। তবুও।

কিন্তু লালন, জাহানারা---।

দোকানের বেঞ্চি সারানোর খরচ—২০ টাকা

একটা কেটলি কেনার জন্য—২৫ টাকা

জাহানারার জন্য একটা কম্বল

লালনকে নিয়ে শোয়ার জন্য—১০০ টাকা

খরচ বাড়ছে। দোকানের বিক্রিও একটু বাড়ছে বৈকি। আজ যেমন বিক্রি ৩০০ টাকা ৫০ পয়সা।

জাহানারা মশারি তুলে উঁকি দ্যায়। মগ্ন সুবোধ ঘাড় ঘুরিয়ে একবার দেখে—চোখাচোখি হয়। কিন্তু কথা হয় না। জাহানারা আবার শুয়ে পড়ে। একটা গভীর দম ছাড়ার আবহ টের পায় সুবোধ।

--কেমন আছো জাহানারা?

কী ভাবে বাঁচতে হয় তোমার কাছে শিখতে হবে।

এত প্রাণ শক্তি ছিল তোমার?

বিশ্বাস কর, আমি প্রথম দিন হাসপাতালে তোমার মুখ দেখে রাতভর----।

বেঁচে থাক তোমার এই জন্ম

বেঁচে থাক তোমার আরাধ্য স্বপ্ন—যদি দেখে থাক কখনো—

আচ্ছা তুমি কি স্বপ্ন দেখ?

কোনোদিন বলোনি-তো?

লালন কে তুমি যে এত সাংঘাতিক ভালবাসো—দেখে অনেক সময় মনে হয় তুমি মানুষের মত দেখতে আসলে কোনো বাঘিনী।

তোমাকে আমি অনেক, অনেক ভালবাসি।

এ-রকম আরো প্রাসঙ্গিক অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তায় ভরা দু’টি খাতা। বোঝা যায় এক টানা লেখার মত, গুছিয়ে কিছু লেখার মত ধৈর্য বা একাগ্রতা কোনোটাই সুবোধের ছিল না। শেষদিকে ছিল শুধু জাহানারাকে দেখা। দেখা আর বিস্ময়ের এক যুগপৎ তাড়না।

জাহানারা রাতের দিকে যখন সুবোধের কাছাকাছি হতো, তখন সুবোধের আচরণ তার একদম সঙ্গত মনে হতো না। সুবোধের সাড়া না পেয়ে মাঝে মাঝে সে অভিমানও করতো। আবার ভাবতো—বুঝতে চেষ্টা করতো, কেন এমন হচ্ছে। সুবোধের মনে কীসের কষ্ট ! কিন্তু সত্যি কোনো কারণ সে খুঁজে পেতো না। সুবোধকে দেখা সেই উচ্ছল দুর্দম যুবকটি কোথায়—কোথায় সে দিনে দিনে হারাচ্ছে ! জাহানারা মনমরা উদাস সুবোধের সামনে বসে নিজেই নিজের চোখের জল মুছতো। সুবোধের তা দেখে সেই ভাবান্তর কই। বরং সে নিজেই কাঁদতো মাঝে মাঝে। অদ্ভুত ! জিজ্ঞেস করলেও বলতো না কিছুই। বোঝাই যেত যে সে নিজেকে লুকোতে চাইছে। ফলে সুবোধ তার কাছে অধরাই থেকে গেল। সম্পূর্ণ সুবোধকে কি তাহলে তার আর পাওয়া হলো না ! মনে মনে এই আফসোস আজ সে কোথায় রাখে।

দুপুর নাগাদ অর্জুন মালাকার এলো। দোকান বন্ধ দেখে বাড়িতে খোঁজ নিতে এলো। জাহানারা কল্পনা মাসির কোলে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। লালন ঘুমিয়ে পড়েছে অনেকক্ষণ কান্নাকাটির পর। সুবোধ চলে গেছে। একটা চিরকুট পাওয়া গেছে। জলের গেলাসের তলায় চাপা দেওয়া।

চিরকুটে লেখা।–চিন্তা করো না, মন খারাপ করো না। খোঁজখবর করার দরকার নেই। ফিরে আসব তাড়াতাড়ি। খাতার ভেতর টাকা আছে।

৩২
ময়মনসিংহ-এ বাসটা পৌঁছোতে পৌঁছোতে প্রায় সন্ধে হয়ে গেল। আগের মতই রাস্তার বাতিগুলো যেন জ্বলেও জ্বলে না। বাস থেকে নেমে একটা রিকশা নিয়ে সুবোধ পৌঁছে যায় রামবাবু রোডে। আশৈশবের চেনা শহর তার। চোখ বেঁধে ছেড়ে দিলেও যেন এই শহরে সে ঠিক জায়গায় পৌঁছে যেতে পারে। মনে হলো সে যেন কোথাও যায় নি। এখানেই ছিল। এখন সে একটি বাড়িতে যাচ্ছে মাত্র।

দেখতে দেখতে সুবোধ নির্দিষ্ট উকিল বাড়িটির সামনে এসে রিকশা থামালো। এটাই তার গন্তব্য। এবং একমাত্র।

বাইরের ঘরের দরজায় আস্তে করে টোকা দিতেই শোনা গেল চেনা গলা—‘ও মালা, দ্যাখ্‌তো কেডা’।

তার মানে রব্বানি সাহেব আছেন। সুবোধের ‘সাহেবকা’। উকিল সাহেব।

খবরের কাগজ পড়ছিলেন। নির্দিষ্ট ইজি চেয়ারে বসা। সেই একভাবে মুখ ঢেকে কাগজ পড়ার ভঙ্গী। পা’এ হাতের স্পর্শ পেয়েই মুখ থেকে কাগজ সরিয়ে অবাক।

--তুমি?

--জী হ্যাঁ, আমি—ক্যামন আছেন আপনি?

--ভিতরের ঘরে চল।

ভেতরের ঘরে যেতে যেতেই রব্বানী সাহেব যেন ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। কথা বলার আগেই খাটের উপর ধপ করে বসে পড়লেন। তারপর বললেন—বসো।

মুখোমুখি সুবোধ একটা মোড়ায় বসে সামনের দেয়ালের দিকে তাকালো। সেই ছবিটা—যামিনী রায়ের—নারী ও মাতৃত্ব।

আসলে রব্বানী সাহেবের বাড়িতে যেমন ‘আদাব’ ‘প্রণাম’ দুটোই চলতো, তেমনি নারী ও মাতৃত্ব সম্পর্কিত ধারণাগুলোও ছিলো খুব এগিয়ে থাকা। ফলে ছোট বেলা থেকেই এ বাড়িতে সুবোধ ছিল সবচে স্বচ্ছন্দ।

এক সময় এই ছবি নিয়ে কুসুমের সঙ্গে সুবোধের খুব হৈ চৈ হতো। ছবির নারীটির সঙ্গে কুসুমের তুলনা টেনে তার পেছনে লাগার দুষ্টুমিতে সুবোধ যেমন বলতো—আচ্ছা কুসুম, আজ থেকে ধর যদি এই ছবিটির মধ্যে তোমাকে দেখি---।

--দেখো না, বারণ করবে কে?

--আরে অতটা রূঢ় হচ্ছো কেন?

--আমার মাথা-তো তোমার মত খারাপ হয়নি—

--না, মানে তুমি-তো আর বছর দশেকের মধ্যেই এই রকম একটা আকার নিতে পারো আর কোলে যদি একটি শিশু—

কথা আর শেষ হয় না। কুসুম বুঝে যায় ইঙ্গিতটা। যেহেতু সে ছোট বেলা থেকেই একটু ভারী স্বাস্থ্যের। আর এখান থেকেই কুসুম, হাতের কাছে যা পাওয়া যায়, যেমন কলম, পেন্সিল, বই খাতা, হাত পাখা---ইত্যাদি ঘর জুড়ে ওড়াতে শুরু করবে সুবোধের দিকে তাক করে। সুবোধ হয়তো কোনোমতে একটু কাছাকাছি এসে কুসুমের হাত দুটো চেপে ধরে ফেলেছে—আর তখন শুরু হবে মুখে মুখে। আর একসময় সুবোধ হয়তো বলে ফেলবে মোক্ষম কথাটা।

--কেন এই মহান চিত্রকাব্যটি কি তোমার আবেগ হতে পারে না?

--ধ্যাত, ছাইপাঁশ—সেই এক কথা---

একসময় কুসুমের মা, সুবোধের চাচী আম্মা, হৈ চৈ শুনে দুজনের মাঝে এসে দাঁড়াবেন। যুদ্ধ শেষ হবে সে দিনের মত। চাপা পড়বে প্রসঙ্গ।

রাত প্রায় এগারটা নাগাদ চাচী আম্মা খেতে ডাকলেন। এতক্ষণ রব্বানী সাহেবের সঙ্গে যতটা কথা হয়েছে প্রায় ততটাই নীরবতাও পালন হয়েছে। সুবোধ প্রায় কিছু খেলো না। বহুদিনের চেনা ঘর,চেনা হাতের রান্না, চেনা উদ্বেগ ভরা চাচী আম্মার গলা—সুবোধ তবু নিঃশব্দ। খেতে বসার কিছু আগেই সে তার পিতৃ বিয়োগের কথা জেনেছে।

---বহুদূরের এক কণ্ঠস্বর যেন কানে এখনও আসছে—সুবো, সূর্যোদয়ের আগে ঘুম থেকে ওঠো। সময়ের সঙ্গে চলার চেষ্টা করো। পিছিয়ে পড়ো না।

দৃশ্যটা এমন—বাবার পেছন পেছন বালক সুবোধ হাঁটছে। সদ্য বীজ ছড়ানো জমি দু’পাশে। মাঝের একটা মেঠো পথ ধরে দুজনে হেঁটে চলেছে যে দিকে, সে দিকে শুরু হয়েছে সূর্যোদয়। মাঝে মাঝে বাবার গলায় এমন সব কথা শুনতে শুনতে সুবোধ হেঁটে চলেছে। বাবার কথার সারার্থ বোঝার মত বয়স তার তখনও না হলেও বাবার আন্তরিক কণ্ঠস্বর তার ভেতরে এখনও যেন বেজে চলেছে।

হঠাৎ চাচী আম্মার কথায় কিছুটা চমকে উঠলো সুবোধ।

--খাইতাছনা যে বাবা কিছুই—তোমার শরীলডা ঠিক আছে-তো?

--হ্যাঁ, হ্যাঁ আম্মা ঠিক আছে। ও কিছু না।

একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস গোপন করতে করতে চাচী আম্মা যেন অনেকটা স্বগতোক্তির মত বলে চলেছেন—তোমরার মাথাত যে কখন কী হয়,কেডা জানে—হঠাৎ কইরা কই চইলা গেলা—বাপ মায়ের মনের কথাডা একটু ভাবন লাগে। আর চেহারাখান-ই বা কী বানাইয়া আনলা—রাস্তায় দেখলে তোমারে চিনব কেডা---।

কথার মধ্যেই সুবোধ নিঃশব্দে উঠে পড়লো। মাথা নিচু করা ছোট বেলার সেই অপরাধী ভঙ্গী। মুখ ধুয়ে সে কথামত আবার সাহেবকার ঘরে গিয়ে বসলো।
[চলবে]

আপনার মন্তব্য