রামকিঙ্করের সুজাতা

 প্রকাশিত: ২০১৬-১১-১৯ ১৩:০৭:১২

ফরিদ আহমেদ:

রবীন্দ্রনাথ খুব সকালবেলাতে ঘুম থেকে উঠতেন। ঘুম থেকে উঠে শান্তিনিকেতনের আশ্রমের কিছুটা ঘুরে বেড়াবার অভ্যাস ছিলো তাঁর। সেদিনও ওরকমই হাঁটতে বের হয়েছেন তিনি। সাথে আরো কয়েকজন রয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে সঙ্গীত ভবনের কাছে এসেই আচমকা ভাস্কর্যটি চোখে পড়লো তাঁর। এগারো ফুট লম্বা ছিপছিপে এক তরুণীর মূর্তি সেটা। মূর্তি দেখেই থমকে দাঁড়িয়েছেন তিনি। গম্ভীরভাবে জিজ্ঞেস করলেন, “কে করেছে এটা?”

তাঁর গম্ভীর ভাব দেখে ঘাবড়ে গিয়েছে সকলেই। একজন ভয়ে ভয়ে আমতা আমতা করে বললো, “আজ্ঞে, রামকিঙ্কর বাবু করেছেন এটা।”

“ওকে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও।” আরো গম্ভীরভাবে রবীন্দ্রনাথ বললেন। শেষবারের মতো এক ঝলক মূর্তিটাকে দেখে উল্টোপথে হাঁটা ধরলেন তিনি।।

রামকিঙ্কর বেইজ দুরু দুরু বুকে দেখা করতে গেলেন রবীন্দ্রনাথের সাথে।

“নারীমূর্তিটা তুই করেছিস?”

“জী।” শুকনো গলায় রামকিঙ্কর উত্তর দেন।

“সমস্ত আশ্রম এর চেয়েও বড় বড় মূর্তি গড়ে ভরে দিতে পারবি? পারলে ভরে দে।”

যে মূর্তি বা ভাস্কর্য নিয়ে রবীন্দ্রনাথ আর রামকিঙ্করের আলোচনা হচ্ছিল, সেটার নাম ‘সুজাতা’। এর নাম শুরুতে অবশ্য ‘সুজাতা’ ছিলো না। রামকিঙ্কর এর নাম দিয়েছিলেন ‘জয়া’। এই ভাস্কর্যটির মডেল ছিলো জয়া আপ্পাস্বামী। সে শান্তিনিকেতনেই পেইন্টিং নিয়ে পড়তো। রামকিঙ্করেরই ছাত্রী ছিলো জয়া। কী কারণে জয়াকে মডেল করে এই ভাস্কর্য তৈরি করেছিলেন সে প্রসঙ্গে রামকিঙ্কর নিজেই এভাবে বলেছেন,

“যে কো্নো বড় শিল্পকর্মের পেছনেই বড়ো আবেগ, অন্ধ আবেগ আর প্রেম? সেতো থাকবেই। প্রেম ছাড়া ঐসব ছবি, মূর্তি করতে পারতাম? সে তো এসেছেই। বারে বারে। বহুবার। নিঃশব্দ চরণে নয়। ত্রিতাল, ঝাঁপতাল, লয়ের কারুকিরির মতো। ‘বিনোদিনী’ পেইন্টিং বা ‘সুজাতা’, নারীর মুখ, কলের বাঁশীর মতো মূর্তি গড়বো কি করে; আমার জীবনে যতো ইম্পরট্যান্ট প্রেম এসেছে, সবই আমি রেখার আদলে ক্যানভাসে এঁকে রেখেছি বা মূর্তি গড়েছি। সুজাতা মূর্তিটা তৈরি করি জয়া আপ্পাস্বামীকে দেখে। ওরই আদলে। এখানে পেইন্টিং নিয়ে পড়তো। আমারই ছাত্রী। ওর সঙ্গে আমার কোনো প্রেমের সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু ওর ফিগার ছিলো খুব সুন্দর। লম্বা ছিপছিপে। মূর্তি গড়া শেষ হলে নাম দিলাম জয়া।“

রামকিঙ্করের দেওয়া এই ‘জয়া’ নাম টিকে থাকলো না। ভাস্কর্যটিকে স্থাপন করা হলো সঙ্গীত ভবনের পাশে। এখানে আগে থাকতেই রুদ্রাপ্পার তৈরি একটা মাটির বুদ্ধ মূর্তি ছিলো। সেটার সামনেই স্থাপন করা হলো ‘জয়া’-কে। শান্তিনিকেতনের কলাভবনের অধ্যক্ষ তখন নন্দলাল বসু। তিনি দেখতে এলেন ভাস্কর্যটি। ‘জয়া’-র এই এগারো ফুট লম্বা দেহ দেখে তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, “আরে বাবা! এটা কি করেছো হে, লম্বা গাছের মতোন?” বিস্ময়ের অভিনয়টুকু হয়ে গেলে, আনন্দ চিত্তে তিনি বললেন, “তা বেশ করেছো কিন্তু। বুদ্ধ মূর্তির সামনে যখন, তখন মাথায় পরমান্নের পাত্র করে দাও। ‘সুজাতা’ হয়ে যাবে।”

নন্দলাল বসুর পরামর্শে রামকিঙ্কর সত্যি সত্যিই ‘জয়া’-র মাথায় পরমান্নের পাত্র বসিয়ে দিলেন। ‘জয়া’ হয়ে গেলো ‘সুজাতা’। দেখে মনে হবে সত্যি সত্যি সুজাতা পরমান্নের পাত্র নিয়ে এগিয়ে চলেছে বুদ্ধদেবের দিকে। সেই মাটির বুদ্ধমূর্তি এখন আর নেই। অনেক বছর আগে শান্তিনিকেতনেরই এক ছাত্র হাইজাম্প দিতে গিয়ে বুদ্ধ মূর্তিটির মাথা ভেঙে ফেলে। মাটির বুদ্ধ মূর্তির বদলে তখন সেখানে কংক্রিটের বুদ্ধ মূর্তি তৈরি করা হয়।

জয়ার মাথায় পরমান্নের পাত্র দেবার পরামর্শই শুধু দিলেন না নন্দলাল বসু। একই সাথে এটাও বললেন, “এটার চারপাশে লম্বা লম্বা ইউক্যালিপটাস গাছ লাগিয়ে দাও তবে মানাবে।” সত্যি সত্যিই যখন ইউক্যালিপটাস গাছগুলো বড় হলো, এর মাঝে সুজাতা মিশে গেলো তাদেরই একজন হয়ে।

রামকিঙ্কর সুজাতা তৈরি করেছিলেন সিমেন্ট-কংক্রিটে, ব্রোঞ্জে বা স্টোনে নয়। কেন এটা করেছিলেন, এর সরল উত্তর তিনি দিয়েছেন এই বলে যে, টাকার অভাবে। এরকম একটা মূর্তি ব্রোঞ্জে বা স্টোনে করতে গেলে যে খরচ, সেটা তাঁর ছিলো না। তিনি ভাস্কর্য তৈরি করতে চাইলে নন্দলাল বসুও মানা করতেন এই খরচের কথা ভেবে। খরচ বাঁচিয়ে ভাস্কর্য করার জন্য সিমেন্ট-কংক্রিটের পদ্ধতি আবিষ্কার করেন তিনি। ভারতবর্ষে তাঁর আগে অন্য কোনো ভাস্কর এই কৌশলে কাজ করেনি। শুধু ভারতবর্ষ বলে নয়, সিমেন্ট-কংক্রিটের এই কৌশল সেই সময়েই মাত্র এসেছে। পৃথিবীর অন্য কোথাও কোনো শিল্পী হয়তো রামকিঙ্করের সমসাময়িককালে এই পদ্ধতিতে ভাস্কর্য তৈরি করতে পারেন, তবে রামকিঙ্করের কৌশল যে তাঁরই নিজস্ব আবিষ্কার এবং অনন্য, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ, এই শিল্পীর প্রাতিষ্ঠানিক কোনো পড়াশোনা নেই বললেই চলে। একমাত্র নেপাল ছাড়া অন্য কোনো দেশেও কখনো ভ্রমণ করেননি যে সেখান থেকে এগুলো শিখে আসবেন।

আপনার মন্তব্য